#টিট_ফর_ট্যাট
#Alisha_Anjum
#বোনাস_পাঠ
আমার কড়া কন্ঠে সকলে অপরিসীম বিস্ময় নিয়ে তাকালো আমার দিকে। চোখে জল আর হাতে দা দিয়ে হনহন৷ করে চলে গেলাম আমার নীরবের কাছে। সোজা একহাতে তার মাথাটা বুকে চেপে নিলাম। তিনটে পুলিশ অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। আমি তাদের হুংকার দিয়ে বললাম
— সরুন। একদম ধরবেন না আমার স্বামীকে। আমার স্বামী বেঁচে আছে।
— নীলিমা নীরবকে শেষ কালে তো একটু শান্তি দেবে।
জেরিনের বাণী। শরীর আমার জ্বলে উঠলো। নীরবকে ছেড়ে তেড়ে দা নিয়ে চলে গেলাম তার কাছে। এতোটা নিষ্ঠুর নিকৃষ্ট মনে হয় অতীতে কেউ ছিল না। সব শয়তানকে হার মানায় এই মেয়ে। হাত উঁচু করে দা তুললাম তার বুক বরাবর। মেরেই ফেলবো আজ আমি। আমার নীরবকে কত কষ্ট দেয়েছে। না জানি বাইক থেকে পরে যেতে কত কষ্ট হয়েছে তার। যেই না তীব্র ঘৃণা নিয়ে মারতে যাবো ওমনি কিছু মহিলা এসে আমায় আটকালো। আমি উন্মাদের মতো ছোটাছুটি করতে লাগলাম। ওর সাথে আমার অনেক হিসেব বাকি। কেন ও আমার ভালোবাসার মানুষকে মারার দুঃসাহস করলো। ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ নজর গেলো নীরবের দিকে। ওরা আমার নীরবকে ছুয়েছে। ছুটে গেলাম আবার সেখানে। প্রচন্ড ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম পুলিশ গুলোকে। পূর্বের চেয়েও দ্বিগুণ জেদ নিয়ে বললাম
— শুনতে পান না আপনারা? আমি কি বললাম যে আসবে তাকেই মেরে ফেলবো। এই যে দা দিয়ে কেটে ফেলবো গলা।
কথাগুলো বলতে গিয়ে আমার বুকে তীব্র ব্যাথা অনুভব করলাম। থমকে আসছে নিশ্বাস। আমার অবস্থাও অধপতনে। হুঁশ হলো নীরবকে তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিতে হবে। সামনে নজর দিলাম। কেনো মহিলা পুলিশ নেই বলেই আমার সাথে জবরদস্তি হচ্ছে না। জলদি করতে হবে আমার। শক্ত করে চেপে ধরলাম হাতের অস্ত্র। চাচা শশুর ছিল বারান্দায়। চেয়ারে বসে সে নীরবে অশ্রু সমর্পন করছে। আমি এগিয়ে গেলাম। সকলেই ভিতু আমার রূপ দেখে। আশপাশ থেকে কলরব শুনতে পেলাম, ” হায় হায় মেয়ে তো খুব চোখা। এতো সাহস!” আমি তোয়াক্কা করলাম না। বুকে অনবরত ঢোল পিটে যাচ্ছে কেউ। চিন চিন ব্যাথায় কাতর আমার ছোট্ট হৃদপিণ্ড।
— গাড়ির চাবি দিন। আমি ঢাকা নেবো আমার স্বামীকে।
অপলক কঠিন চোখে তাকিয়ে বললাম। সুধার বাবা অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে। আমি সামনে হাত বাড়িয়ে দিয়ে আছি। একটু পর তার কোনো সাড়াশব্দ না দেখে আবারও যখন চাবি চাওয়ার জন্য মুখ খুলবো ঠিক তখনই সুধার কন্ঠ কানে এলো
— ভাবি। এই যে চাবি। চলুন ভাইয়াকে গাড়িতে উঠাতে হবে।
আমি সুধার দিকে তাকিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলাম। এই মেয়েটার ঋণ আমি কিভাবে নিঃশেষ করবো? তখনও সবাই আমার ভগ্ন হৃদয়ের আর্তনাদ আর চোখের জলের প্রহর উপভোগ করছে। সুধা গাড়ি ঘুরাতে গেলো। আমি নির্লিপ্ত, জলযুক্ত চোখে এগিয়ে এলাম নীরবের কাছে। কপালে দ্বিতীয় বারের মতো ছোট একটা চুমু দিয়ে বললাম
— কিচ্ছু হবে না আপনার। আমি নিয়ে যাচ্ছি ডাক্তারের কাছে। এতো সহজ নাকি নীলিমার হাত থেকে ছাড়া পাওয়া? আরো কোটিবার শুনবো আমি, “দেনমোহর দিয়ে জীবন ত্যানা ত্যানা করার জিনিস কিনে আনছি রে ভাই”
কথাটা বলেই কান্নারত দশায় খিলখিল করে হেসে দিলাম। ভীষণ ভালোবাসি তাকে। আমার নীরব নিস্তব্ধ হতেই পারে না এতো তাড়াতাড়ি!
.
কখনো শুনশান নীরবতায় ছেয়ে থাকা রাস্তা কখনো গাড়ির হর্নে তোলপাড় করা সড়ক। গাড়ি চলছে। সুধা দক্ষতার সাথে গতি বাড়িয়ে চালাচ্ছে। এখান থেকে ঢাকা যাওয়া সম্ভব হলেও নীরবের জন্য ঝুকিপূর্ণ। তাই যাওয়া হচ্ছে চট্টগ্রামেরই শহরের হসপিটালে। যেতে দু’ঘন্টার মতে নাকি লাগবেই। আমি নীরবকে জরিয়ে ধরে আছি। তার বুকে মাথা রেখে আমি তার হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি শুনছি। যেন এটা বন্ধ হলেই আমার নিশ্বাস আটকে যাবে। চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। শুধু শুকোয়নি হৃদয়ের রক্তাক্ত অবর্ণনীয় ক্ষত। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে প্রচুর। আমার এমন মরণ দশায় হঠাৎ সামনে বসে থাকা হৃদ বলে উঠলো
— নীলিমা? এসে গেছি আমরা।
আমি হৃদের কথায় নীরবের বুক থেকে মাথা তুললাম। চুলে ভেজা কিছু অনুভব হলো। নিশ্চয়ই রক্ত লেগেছে। সাদা ওড়নাটা দিয়ে বেঁধে দিয়েছি তার মাথা। লালে রঙিন এখন। আলতো করে স্পর্শ করলাম। সুধা গাড়ির দরজা খুলে দিলো। হৃদ ডেকে আনলো হসপিটালের সেবক সেবিকাদের। ধবধবে আলোয় নীরবের চুপসানো মুখটা নজরে ধরা দিলো। নতুন করে বুকটা হু হু করে উঠলো। ওরা আমার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলো নীরবকে। নিয়ে যাচ্ছে। আমি হন্তদন্ত হয়ে নামলাম গাড়ি থেকে। তাকিয়ে রইলাম পলকহীন। একবিন্দু সাহস পাচ্ছি না নড়তে। সমস্ত শক্তি যেন শেষ। হাশফাশ লাগছে। এটা আমার শ্বাসকষ্টের অগ্রিম বার্তা। সুধা হৃদের পিছু পিছু যাচ্ছিল যেখানে নীরবকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি খপ করে টেনে ধরলাম সুধাকে। আমি নিশ্চয়ই এখন সেন্স হারিয়ে ফেলবো। খুব কষ্টে বললাম
— ভাবি আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। একটু ভেতরে নিয়ে চলুন।
কথাটা বলতে বলতেই আমি গা এলিয়ে দিলাম। হয়তো সুধা আময় জাপ্টে ধরলো। চোখ বুঁজে এলো আমার। তবুও মনে একটু শান্তি। আমি আমার নীরবকে অন্তত পুলিশদের হাতের নিচ থেকে নিয়ে এসেছি। কশাইখানা থেকে। ভাবতেই পায়ের মাটি যেন কেঁপে উঠে।
.
— আমার রক্তর সাথে ভাইয়ার রক্ত ম্যাচ করে। আমি দেবো রক্ত। তুমি চিন্তা কোরো না। আর শোন, আমাদের বিয়ের কোনো অনুষ্ঠানের প্রয়োজন নেই। যা জমিয়েছো সব নিয়ে আসো। তাড়াতাড়ি। ভাইয়ার চিকিৎসাটা বেশি জরুরি।
এমন কথোপকথন আমার শিয়রে চলছে। নিভু নিভু চোখ টেনে খুললাম। মাথা উচিত চাইতেই হঠাৎ টান পরলো হাতে। অজান্তেই মুখে আহ ধ্বনি ফুটলো। আমার মৃদু চিৎকারে সুধা আর হৃদ চলে এলো আমার সম্মুখে। সুধা বলল
— আপনকে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। নড়বেন না।
আমি একনজর দেখলাম হাত। পর মুহূর্তেই আকুল হয়ে সুধার কাছে জানতে চাইলাম
— সে কেমন আছে? তার জ্ঞান ফিরেছে?
আমার কথায় সুধা মলিন হাসলো। হঠাৎ আমার হাতের উপর একহাত রেখে বলল
— ভাবি আপনি সত্যিই অনন্য। উপর ওয়ালার উপর আপনার ভরসা দেখে আমি অবাক। ভাইয়া জীবিত। ট্রিটমেন্ট করতে হবে। সুস্থতার বিষয়ে কিছু বলা যাবে না। তবে আপনি দেখবেন ঠিক সুস্থ হয়ে যাবে ভাইয়া।
আমার চোখের কার্ণিশে জল নেমে এলো। গড়িয়ে কানের পিঠে চলে গেলো। আমি নাক টেনে রুদ্ধ কন্ঠে বললাম
— রক্ত লাগবে তার?
— হুম। আমি দেবো।
— কত টাকা লাগবে?
আমার প্রশ্নে সুধা চুপসে গেলো। পরমুহূর্তেই আবার মুখে সজীবতা আনার প্রয়াস চালিয়ে বলল
— সমস্যা নেই। সব হয়ে যাবে। বেশি টাকা লাগবে না।
— টাকা ছাড়া ওরা যত্ন করবে না ওর। আপনি হৃদকে ডাকুন। আমি… আমার এই গলার চেনটা বিক্রি করতে বলুন। তাড়াতাড়ি । টাকা আনতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। দশটা ঘুমের ওষুধ খাইয়েছে। নিশ্চয়ই ওর অবস্থা ক্রিটিকাল।
কথাটা বলতে বলতে গলার চেন খুলে ফেললাম এক হাতে৷ বাবা বানিয়ে দিয়েছিল। এসএসসিতে জেলা ফার্স্ট হয়েছিলাম তাই।
চলবে………
( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। আপনারা কিভাবে ভাবলেন নীরবকে মারবো। আমি নিজ হাতে চরিত্র গড়েছি না? তার উপর নিজের করে বর্ণনা করি। এতো সাহস নেই যে লিখবো, ” আমার স্বামী মারা…। সাহস হয় না। বুক কেঁপে উঠে। তবে একটা জিনিস বুঝলাম। নীরবকে আপনারা খুব পছন্দ করেন 😳)