#টিট_ফর_ট্যাট
#Alisha_Anjum
#পর্ব_২০
সদ্য ভেজা চুলে চিরুনি চালাচ্ছি। সময় সকাল দশটা হবে। গরমের তাগিদে দিনে অন্তত তিনবার গোসল হয়েই যায় আমার। তারউপর নীরবের প্রত্যেকটা কাজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে করতে হয়। কিন্তু ঐ একটা জ্বালা। আজ পাঁচ দিন হবে হসপিটাল থেকে তাকে বাসায় স্থানান্তর করা হয়েছে। সে একটা মশা থেকে শুরু করে বিড়াট প্রাণীর সাথে কথা বলতে পারে। শুধু আমার সাথেই কথা বলবে না। এতো রাগও মানুষের হয়? বুঝি তো আমি! হয়তো হৃদ আর আমার সম্পর্কের কথা তার কাছে ব্যাক্ত করিনি বলে তার এ কান্ড। কিন্তু এমন করা কি তার ঠিক হচ্ছে? বউ ছাড়া কারো চলে?
— আম্মু, আমার ফোনটা দিয়ে যাও।
নীরবের কন্ঠে মাথা থেকে চিরুনি নামিয়ে হুমড়ি খেয়ে পরলাম আমি। মানে কি? তার ফোন আমার হাতের কাছে, ড্রেসিং টেবিলের উপর আর সে অন্যরুমে থাকা আম্মুকে ডাকছে? এজন্যই বলি স্ক্রু ঢিলা ডাক্তার। রাগ হলো ভীষণ! সেই আমার থেকেই তো ফোন নিবে ভাই এতো ম্যা ম্যা করার কি আছে? সোজাসাপটা আমায় বলো। এমন ঢং আর আমার সহ্য হচ্ছে না। গটগট করে এগিয়ে গেলাম বিছানার কাছে। কোমরে দু’হাত রেখে মুখে ফুটিয়ে তুললাম জল্লাদী রূপ। বিরক্ত আর রাগ নিয়ে বললাম
— এই একদম ম্যা ম্যা করবেন না। আপনার সামনে যে তাজা, সতেজ, কর্মঠ একটা বউ দাড়িয়ে আছে চোখে পরে না? আবার মাকে ডাকতে হবে?
আমার কথায় নীরব ক্ষণকাল মৌন হয়ে স্থির নয়নে দেখলো আমায়। শুকিয়ে গেছে অনেক। কপালের ক্ষতর উপর সাদা ব্যান্ডেজ। কিন্তু জনগণ, তেজ তার শুকোয়নি। বরং অসুস্থ হয়ে ঝট করে যেন কয়েক ধাপ বেড়ে গেছে। সাংঘাতিক তেজ ছিটকে ফেলে বোবা হয়ে। এই যে এখন তাকে বলছি। সে আলগোছে বিছানা থেকে উঠবে। ওঠার সময় গায়ের চাদরটা ঝাড়ি দিয়ে আমার মাথায় ফেলবে। নয়তো বেলকনিতে গিয়ে সিগারেট ধরাবে। আমি জ্ঞান দিতে গেলেই মোর গালটা ধরে মুখখানি হা করিয়ে ধুয়ো ছাড়বে আমার মুখে। কাশতে কশতে জীবন বেদনার হয়ে যায়। সে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। বেশ কিছুক্ষণ পার হওয়ার পর বলবে
— রুমে পানি আছে।
এইটুকুই তার বাক্য। সম্বোধন করে না আমায়।
আজ আর ঝাড়ি দিয়ে কাথা আমার গায়ে ফেলল না। বিছানা ছেড়ে সোজা চলে গেলো ফোন নিতে। পুনরায় বিছানার কাছে এসে শার্টের পকেট থেকে সিগারেট বের করলো। কুটিল চোখে চেয়ে চেয়ে দেখছি। কতশতবার যে ভেবেছি তামাকগুলো জানালা দিয়ে আত্মহত্যা করাবো কিন্তু সুযোগ পাই না। ইদানীং তার চাহনি দেখলে বোকা হয়ে যাই। আগে থেকেই তো হা হয়ে যেতাম এখন তার সাথে সার্ভিস হিসেবে জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পায়। তবে আজ একটা কিছু করা বাঞ্ছনীয়। নীরব সিগারেট হাতে নিয়েছে। লাইটারটা ছোঁয়ার আগেই আমি আচমকা ছো মেরে হাতে তুলে নিলাম। নীরব যেন অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো। ধীরে ধীরে ফুটে উঠলো তার চোখে রাগ। আমি সুযোগ বুঝে সিগারেটাও হাত থেকে খপ করে নিয়ে নিলাম। রয়ে সয়ে বললাম
— সিগারেট খাওয়া হারাম। আপনি না নামাজ পরেন, রোজা রাখে। রবের প্রতি আপনার যথেষ্ট ভালোবাসা আছে। এসব আপনার সাথে যায় না।
— তো?
নীরব বাক ফুটালো। আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত। আমি মনে থোকা থোকা আনন্দ নিয়ে পুনরায় বললাম
— এগুলো খাওয়া ভালো না। আপনার শরীরও ভালো নেই।
— খাওয়া শিখেছিলাম এক প্রস্টিটিউটের জন্য। ছেড়েছিলামও। আবার খেতে হয় আরেক…… ।
নীরব অসম্পূর্ণ কথা রেখে চলে গেলো বেলকণিতে। কিন্তু আমার কান থেকে যে তার ইঙ্গিত সরলো না। চোখ আমার ছলছল করে উঠলো। আমিও জেরিনের মতো? নীরব এ কথা কিভাবে বলতে পারলো? আমার সাথে সাতদিন হলো কথা বলে না মেনেছি। আমি উষ্কে উষ্কে গিয়ে তার সমস্ত কাজ করে দিয়েছি। সেবা যত্ন করেছি আর এসবের বিনিময়ে যদি আমি প্রস্টিটিউট উপাধি পাই তাহলে দরকার নেই আমার কারো ভালোবাসা। প্রয়োজন নেই স্বামীর। এতোটাও খারাপ সময় আসেনি যে সুলভ মূল্য নীলিমা গ্রহণ করবে। মেয়েরা স্বামী ছাড়াও চলতে জানে। ভীষণ আক্রোশে হাতের লাইটার সিগারেট ছুড়ে মারলাম বেলকণির দিকে। আমি চলে যাবো। আলমারি থেকে বোরখা হিজাব বের করে পরে নিলাম। চোখে জল নেমে এসেছে। মনে উঠেছে অত্যন্ত জেদ। নিজ আত্নসম্মান সত্যিই বিলিয়ে দিতে নেই। স্বামী বলে ভেবেছিলাম আমার আবার কিসের আত্মসম্মান? যে আমার প্রত্যেকটা লোমকূপ চেনে তার কাছে আবার আত্মসম্মান, ইগো মানায় নাকি। কিন্তু ভুল। আত্মসম্মান না থাকলে স্বামী কেন পরম আপন মা বাবার কাছেও মূল্যহীন হতে হবে। আজ শুধুমাত্র হৃদের কথা তার থেকে গোপন করেছি বলে সে আমায় এভাবে খোঁচা মেরে কথা বলে। আর যদি বলতাম? তাহলে যে সে আমার সাথে খুব ভালো ব্যাবহার করতো তার কি দলিল আছে? সংসার জীবনে অহরহ বার এ নিয়ে ঝগড়া হতো। কিছু হলেই বলতো, ‘ তুমি কতো ভালো জানা আছে। ভাসুরের সাথে প্রেম করে ছ্যাকা খেয়ে আমাকে হাতিয়ার করেছো’। এসব ভালোবাসা জানা আছে আমার। সব দু-দিনের জন্য। বাস্তবতা বড় অদ্ভুত। মানুষ সময়ে সুযোগ খুঁজে নিজেকেই নির্দোষ প্রমাণ করতে ব্যাস্ত হয়। আজ বিয়ের বিশ পঁচিশ দিনের মাথাতেই আমার দোষ আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে কিঞ্চিৎ ভুল করছে না। অবজ্ঞায় বলতেই হয় ভবিষ্যতে কি করবে! ভাবনা আর অভিমান মাথায় নিয়ে হ্যান্ড ব্যাগ হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলাম দরজার কাছে। চোখ ঝাপসা। পরের মেয়ে বলে এভাবে কথা শোনানো উচিত নয়। হাঁটছি ঢুলতে ঢুলতে। দরজার কাছে গিয়ে টান দিলাম খুলবো বলে। কিন্তু অবাক কান্ড? দরজা খুলছে না? আমার ভাবনা, অভিমান দৌড়ে পালালো। আজব! বাইরে থেকে কি লাগানো? আনমনায় ভাবতে ভাবতে হঠাৎ চোখ গেলো উপরে। টুপ করে যেন পরে গেলাম হতাশার সাগরে। দরজার উপরে আটকানো। কিন্তু আমি তো নাগাল পাবো না? নিশ্চয়ই এটা তার কান্ড। রাগ হলো ভীষণ। এখন কি গরু মেরে জুতা দান কারার বুদ্ধি এঁটেছে? আমি দুমদুম শব্দ তুলে দরজা ধাক্কাতে লাগলাম। ঠাস ঠাস করে হাত দিয়ে আঘাত করতে লাগলাম দরজায়। যদিও ব্যাথা দরজা নয় আমিই পাচ্ছি। সে নিশ্চই ওয়াশরুমে গেছে। বেরিয়ে আসার এক পরোক্ষ ইঙ্গিত আমার। আবারও তুমুল বেগে দরজায় আঘাত করা শুরু করলাম। আমার গরু মারছে না? জুতা তো আমি নেবোই না। আমার দরজা ধাক্কাধাক্কির মুখ্যক সময়ে হঠাৎ পেছন থেকে নীরবের কন্ঠ ভেসে এলো
— দরজা ভাঙলে কিন্তু কোনো দরজা লাগানো হবে না। রাতে যেন আবার ভয়ে চিল্লাচিল্লি করা হয় না।
আমি থেমে গেলাম। তবুও মুখ ফিরিয়ে চাইলাম না তার দিকে। আলতো নয়নে দরজা পরখ করতে করতে তেজ নিয়ে বললাম
— থাকবোই না এখানে। ভয় তো দূরের কথা।
নীরবের পক্ষ হতে সম্বোধনহীন জবাব এলো
— দরজার ওপারে এক পাও যদি ফেলা হয় পা ভেঙে দেবো।
— দরজা খোলা হোক। আমি চলে যাবো। আমাকে কেন জেরিনের সাথে তুলনা হবে হবে।
— রাগ অভিমান প্রত্যেকেরই থাকে। আমাকে কেন ভাইয়ার কথা বলা হয়নি? আমার কোন কথাটা আমি লুকিয়েছি? সব বলছি। তাও বিশ্বাস পেলো না। রাগ হওয়া কি স্বাভাবিক নয়? সেদিন সব খোলাখুলি বললে কি জেরিনের মুখে আমায় সব শুনতে হয়? আজ আমি না হয়ে আমার বউও তো গ্লাসের পানিটুকু খেতে পারতো। তখন কি হতো?
নীরবের কথায় আমি ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে চাইলাম। তার চোখের দৃষ্টি আমাতেই আবদ্ধ। আমি নয়নে ফুটিয়ে তুললাম অবুঝ ভাব। গ্লাসের পানিতে ঘুমের ওষুধ কিভাবে? নীরব মুখ ফিরিয়ে নিলো আমার থেকে। একটু থেকে বলল
— টেবিলের উপর গ্লাসে পানি ছিলো। ঘুম থেকে উঠে আমি পানিটুকু খাই। ওর মধ্যেই ওষুধ ছিলো। জেরিন স্পেসিফিক আমার ক্ষতি করার জন্য পানিতে ওষুধ মেশায়নি। আমি সিউর ওর লক্ষ ছিল আমাদের দুজনের একজন তো খাবে পানিটা। যে কারো ক্ষতি হলেই হবে। ভাগ্যিস আমিই পানি খেয়েছিলাম।
কথাগুলো বলে বড়সড় এক নিশ্বাস নিলো নীরব। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি। গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো আমার। নীরব ঘুরে দাড়ালো আমার দিকে। চোখে বিতৃষ্ণা নিয়ে বলল
— সবকিছু আমায় আগে বলে দিতে এতো কিছু হতোই না। কিন্তু মেয়েদের যে স্বভাব বেশি বোঝা। ভালো করতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনে। পৃথিবীতে তদন্ত করলে মনে হয় সবগুলো বিপদের পেছনে নারীর হাত পাওয়া যাবে। এরাই বিপদের সূত্রপাত ঘটায়।
কথাটা বলে নীরব এগিয়ে গেলো আলমারির নিকট। মুখটা কুঁচকে ফেলেছে। আমার হুট করে মনে হলো সে আমায় চরম অপমান করলো। আমিও বলে উঠলাম
— ঘুরিয়ে ফিরিয়ে না বলে এটা বললেই তো হয়, পৃথিবীর সব বিপদের সূত্রপাত নীলিমা করেছে। সুযোগ বুঝে খোঁচা মারতে ভোলে না! হু!
— আমি অযথা কাউকে দোষী সাব্যস্ত করি না।
— ভালো। এখন দরজা খোলা হোক। আমি চলে যাবো।
গাঢ় অভিমান ঝরে পরলো আমার কন্ঠ হতে। সে আলমারি থেকে একটা শার্ট বের করে হাতে নিলো। সময় নিয়ে আচমকা পরখ করলো আমায়। অতঃপর হুট করে আমার নিশ্বাস আটকে দেওয়ার মতে কথা বলে উঠলো। আমি৷ রীতিমতো হা হয়ে গেলাম তার কথায়। সে অতি যত্নে ভাবলেশহীনভাবে গায়ে শার্ট জড়াতে জড়াতে বলল
— সেকেন্ডে সেকেন্ডে বমি করার রিজনটা কিন্তু আমি বুঝি।
চলবে….
( কনসিভ করার বিশ পঁচিশ দিন পর বমি করে কিনা জানি না। শুধুমাত্র গল্প তাড়াতাড়ি শেষ করার তাগিদে দিলাম)