ডাহুক_নদীর_তীরে ( পর্ব-২৪) #হালিমা রহমান

#ডাহুক_নদীর_তীরে ( পর্ব-২৪)
#হালিমা রহমান

তথার ঘুম ভাঙলো খুব ভোরে।প্রকৃতি কার্তিকে সেজেছে।তাই শেষরাতে বেশ ভালোই ঠান্ডা লাগে।মাথার কাছের জানলাটা খোলা।হু হু করে ঠান্ডা বাতাস আসছে ঘরে।কাঁথা গায়ে না দেওয়ায় তথার শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যায়।মৃদু ঠান্ডায় ঘুম পালায় দু-চোখ থেকে।তথা উঠে বসে।শরীরে সুতির ওড়না জড়ায়।খাটের অন্যপাশ খালি দেখে তথা অবাক হয়।এতো সকালে কোথায় গেল সোনালী? এতো তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙলো আজ!
অলস পায়ে খাট থেকে নেমে জানলার কাছে যায় তথা।প্রাণভরে শ্বাস নেয়।কতদিন মুক্ত বাতাস নেওয়া হয় না।এতো সকালে সচরাচর ঘুম ভাঙে না তার। বাইরে এখনো আবছা অন্ধকার।হালকা কুয়াশা চোখে পড়ে ।শহরে কার্তিকের কুয়াশা খুব একটা পাত্তা পায় না।তাই তাদেরকে দেখাও যায় না।তবে, প্রত্যন্ত গ্রামে এদের উপস্থিতি চোখে পড়ে মাসের শুরু থেকেই। বাড়ির পিছনের বিশাল গাছগুলোর মাথায় অশরীরীর মতো ভর করেছে কার্তিকের কুয়াশা।
জানলায় মোটা পর্দা টেনে দেয়।এখন আর ঘুম আসবে না।হাত-মুখ ধুয়ে সোনালীকে খুঁজতে বেরোনোর উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই পায়ের নিচে কাগজের অস্তিত্ব পায় তথা।হাঁটু ভেঙে কাগজ তুলতেই চোখে পড়ে গুটিগুটি কতগুলো অক্ষর।এক নিঃশ্বাসে পুরোটা পড়ে ফেলে।

তথা আপু,

খুব জরুরি কাজে ঢাকা যেতে হচ্ছে।ফিরব কিনা জানি না।সবাই ঘুমিয়ে আছে, তাই কাউকে বলতে পারলাম না।তুমি একটু কষ্ট করে সবাইকে জানিয়ে দিও, প্লিজ।কাজের মাঝ থেকে চলে আসার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।তোমাদের সবাইকে খুব মিস করব।ভালো থেকো,আল্লাহ হাফেজ।

ইতি

সোনালী।

খুব অবাক হয় তথা।আরো কয়েকবার লাইনগুলো পড়ে।কখন গেল সোনালী? তথার স্পষ্ট মনে কালরাতে সে যখন ইউসুফের ঘর থেকে ফিরে এসেছিল,তখন সোনালী ছিল না ঘরে।তথা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিল সোনালীর জন্য।কিন্তু যখন দেখলো সোনালী ফিরছে না, তখন দরজায় ছিটকিনি না দিয়ে চাপিয়ে রেখেছিল।এরপরের কথা আর বলতে পারে না তথা।কারণ, সোনালীর জন্য আর অপেক্ষা না করে ঘুমিয়ে গিয়েছিল সে।তথা উঠে দাঁড়ায়।কতগুলো প্রশ্ন তার মাথায় আসে।সোনালী কি পরে রুমে এসেছিল? নাকি তথা যখন ইউসুফের ঘরে ছিল তখনই বেরিয়ে গেছে? কিন্তু তখন বেরোলে চিঠি লেখবে কেন? তথা তো তখন জেগেই ছিল।তথা আলমারির কাছে যায়।আলমারির পাল্লা খুলতেই শুধু তার জামা-কাপড় চোখে পড়ে।সোনালীর ব্যাগটা নেই এখানে।ওর জামাগুলো সব ব্যাগে ভরা ছিল।তথা আলমারির পাল্লা আটকে দেয়।মনটা খচখচ করছে তার।এইটুকু একটা মেয়ে।এতোদূরে একা একা যেতে পারবে? এখান থেকে বাস স্টেশন অনেক দূরে।কতরাতে ঘর থেকে বেরিয়েছে কে জানে! তাছাড়া এতোরাতে বাস পেয়েছে ও? ঢাকা অবধি পৌঁছাতে পারবে তো? সোনালীর জন্য খুব চিন্তা হয় তথার।ফোনটা নেই।ফোন থাকলেও ভালো হতো।সোনালীর সাথে যোগাযোগ করতে পারতো।যোগাযোগের কথা মাথায় আসতেই আরেকটা বিষয় মাথায় খেলে যায় তথার।সোনালীরও তো ফোন নেই।তাহলে? ঢাকায় কি এমন জরুরি কাজ পড়লো? তাছাড়া জরুরি খবর সোনালী অবধি আসবে কিভাবে? ফোন ছাড়া ও যোগাযোগ করল কিভাবে?
তথার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়।সোনালীর হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারছে না যেন।কিন্তু এই চিঠি?এটাও তো সোনালীই লিখে গেছে।তার মানে যেভাবেই হোক রাতের বেলা সোনালী পঞ্চগড় ছেড়েছে।এতো সকালে কি ঢাকা পৌঁছাতে পেরেছে?আখতার হোসেনের কাছে সোনালীর ডিটেইলস আছে।সেখানে নিশ্চয়ই সোনালীর অভিভাবকের ফোন নম্বর আছে।ওখান থেকে নম্বর নিয়ে ইউসুফের ফোন দিয়ে ওদেরকে কল করলে কেমন হয়? সোনালী যদি পৌঁছে যায় তবে ওর সাথে কথা বলতে পারবে।আর না পৌঁছালেও জানতে পারবে।চিন্তা তো কমবে।নাহয় সোনালীর জন্য খুব চিন্তা হবে তথার।তথা বেরিয়ে পড়ে।সে এখন ইউসুফের কাছে যাবে।আখতার হোসেনের সাথে ইউসুফের ভালো সম্পর্ক চোখে পড়েছে তথার।সে নিশ্চয়ই ডিরেক্টরের কাছ থেকে সোনালীর ডিটেইলস নিয়ে দিতে পারবে।পাশের ঘরটাই তো ইউসুফের।ইউসুফ নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে আছে।এতো সকালে ঘুম থেকে উঠে তথার কথা মতো কাজ করবে কিনা কে জানে! তবে আখতার হোসেনের কাছ থেকে ডিটেইলস না নিয়ে দিলে খবর আছে ইউসুফের।প্রেমিকার জন্য এতূটুকু করতে না পারলে সে আবার কেমন প্রেমিক?

ইউসুফ ঘুমিয়ে ছিল।বুক অবধি কাঁথা টেনে দিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল।শব্দহীন পায়ে ইউসুফের খাটের কাছে যেয়ে দাঁড়ায় তথা।মাথা ঝুকিয়ে আলতো স্বরে ইউসুফকে ডাকে।

_” ইউসুফ, ইউসুফ। ”

কোনো হোলদোল দেখা যায় না ইউসুফের মাঝে।সে ঘুমে ব্যস্ত।আরো কয়েকবার ডাক দেয় তথা।কিন্তু না,ইউসুফের ওঠার কোনো নাম-গন্ধ নেই।তথা বিরক্ত হয়।ডানহাতে ইউসুফের সুন্দর চুলগুলো টেনে দেয়।চুলে হাত দিয়েই বুঝতে পারে ইউসুফের চুলগুলো ভেজা। তার মানে ইউসুফ সকালের দিকেই গোসল করে ঘুমিয়েছে।কি আশ্চর্য! এতো সকালে গোসল কেন করলো?

_” এই ইউসুফ,ইউসুফ, উঠুন না।ইউসুফ, ইউসুফ।”

এতোক্ষণে নড়ে উঠে ইউসুফ।বিরক্ত হয়ে চোখ খুলতেই চোখে পড়ে তথার সদ্য ঘুম ভাঙা সুন্দর মুখ।ঘুম থেকে উঠেই আরেক দফা মুগ্ধ হয় ইউসুফ।মেয়েটার সবকিছুতেই মুগ্ধতা জড়ানো।তার চলনে,বলনে,বেশ-ভূষায়,সুগন্ধে—সব কিছুতে।সুন্দর মুখে একটি সুন্দর হাসির রেখা ফুটিয়ে তোলে উঠে বসে ইউসুফ।বিরবির করে বলেঃ” আমার বাসি কামিনী ফুল।”

_” কতক্ষণ ধরে ডাকছি,ওঠার নাম নেই।এতো ডাকা লাগে কেন?”—খুব বিরক্ত শোনায় তথার স্বর।

ইউসুফ হাই তুলে। তথার দিকে চেয়ে বলেঃ” আপনি ডেকেছেন কেন? আগেই চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিতেন।আমি আরো আগেই উঠতাম।”

_” আমি চুলে হাত বুলাইনি,বিরক্ত হয়ে টেনে দিয়েছি।বাজে কথা বাদ দিন।আমাকে একটু হেল্প কর‍তে হবে।”

_” আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন।আর কীসের হেল্প?”

__” ডিরেক্টরের কাছ থেকে সোনালীর ডিটেইলস নিয়ে দিন না প্লিজ।”

ইউসুফ কপাল কুঁচকায়।গা থেকে কাঁথা নামিয়ে বলেঃ” কেন?”

_” সোনালী ঢাকা চলে গেছে।ওর সাথে একটু কথা বলব।ওর ফোন তো নেই,তাই ওর বাড়িতেই কথা বলব।ওর খোঁজ-খবর নেব একটু।”

_” আপনাদের শুটিং কি শেষ?”

_” উঁহু। ”

_” কাজের মাঝ থেকে গেল! কান্ড জ্ঞানহীন কেন এরকম? টাকা নেওয়ার সময় তো ঠিকই নিতে পেরেছে। এখন কাজের বেলায় ফাকি দিলে চলবে?ও কি কাউকে জানিয়ে গেছে? মানে এরকম কাজের মাঝ থেকে চলের যাওয়ার তো কোনো রুলস নেই।”

ভয়াবহ বিরক্ত হয় তথা।কীসের জন্য ডাকলো আর এ কি বলছে।ইউসুফের দিকে চিঠিটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেঃ” এই যে এটা পড়ে দেখুন।ও জরুরি কাজে গেছে,শখে যায়নি।তাছাড়া,যেই ঘোড়ার কাজ হয় এখানে।এখানে থাকার চাইতে না থাকা ভালো।আমিই তো বলেছি এমন ভুংভাং কাজ দেখলে এখানে আর থাকবই না।বাড়ি চলে যাব।”

চিঠিটা বারকয়েক পড়ে ইউসুফ।তারপর তথার দিকে চেয়ে বলেঃ” মেয়েটা তো বললোই ওর কাজ আছে তাই চলে গেছে।ওর খোঁজ নেওয়ার জন্য আপনি এতো উতলা হচ্ছেন কেন?”

_” আমার কেমন যেন লাগছে।ওর কাছে ফোন নেই যে জরুরি খবর আসবে।কি এমন কাজ পড়লো যে এতো রাতেই পঞ্চগড় ছাড়তে হলো? তাছাড়া ও তো একটুখানি মেয়ে,যেতে পারলো কি না।”

_” এতো চিন্তায় আপনার কি কাজ? ”

_” আশ্চর্য! আমার রুমমেটের খবর আমি না নিলে কে নেবে? আর আপনিই এতো খবরদারি করছেন কেন? আমি কোনো পাপ করছি? আমি আপনার উপর খবরদারি করেছি? এই যে আপনি এতো সকালে গোসল করেছেন, আমি কি এসব নিয়ে প্রশ্ন করেছি? আপনি দরজা খোলা রেখে ঘুমিয়েছেন,আমি এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেছি? করিনি তো। তাহলে আপনি কেন এতো প্রশ্ন করছেন? সামান্য ডিটেইলস জোগাড় করতে বলেছি,খুন করতে বলিনি।তাতেই এতো প্রশ্ন আপনার।কেমন প্রেমিক আপনি?”— এক নাগাড়ে এতোগুলো কথা বলে হাঁপিয়ে উঠে তথা।কথার শেষে ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে।

ইউসুফ মুচকি হেসে বলেঃ” বলেননি কিন্তু বলতে বলতে আবার সবই বলে ফেলেছেন।গরম লাগছিলো বলে সকালে গোসল করেছি আর দরজা আঁটকানোর কথা মনেই ছিল না।আর আপনিও একটা পাগল কামিনী ফুল।কয়টা বাজে দেখেছেন?মাত্র সাড়ে পাঁচটা।ডিরেক্টর এতো সকালে ঘুম থেকে উঠেছে? ঘুম থেকে তুলে তো আর আরেক মেয়ের খবর নিতে পারি না।আরেকটু সকাল হোক,ডিরেক্টর ঘুম থেকে উঠুক।”

ইউসুফের হাত থেকে খপ করে চিঠিটা নিয়ে নেয় তথা।সকাল সকাল একদম বিরক্ত করে ফেললো খাটাশ লোকটা।তথা বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে আঙুল তুলে বলেঃ” তাহলে ডিরেক্টরের ঘুম ভাঙার অপেক্ষা করুন আপনি।আমি আসছি।কিন্তু সোনালীর বাড়ির নম্বর যদি আমাকে না নিয়ে দিয়েছেন,তবে খবর আছে আপনার।কথাই বলব না আর। মনে থাকে যেন।”

ধুপধাপ পা ফেলে বেড়িয়ে যায় তথা।যাওয়ার সময় ঠাস করে দরজা আঁটকে দেয়।ইউসুফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।মেয়েটা বোকা।শিয়ালের কাছে মুরগীর খবর নিতে এসেছে।ইউসুফ আস্তে আস্তে নিচে নেমে দাঁড়ায়।হাত-পায়ের পোড়া জায়গাগুলো থেতলে গেছে একদম।হাঁটুটাও ব্যাথা।মেয়ের শরীর তো নয় যেন আস্ত লোহা।মেয়েমানুষ এতো শক্ত-পোক্ত হবে কেন? এরা মোমের মতো নরম হবে। ছুঁয়ে দিলে গলে যাবে।সোনালী মেয়ে? বাবারে বাবা! এক মেয়েকে সামলাতে জানটা বেরিয়ে গেছে ইউসুফের।ইউসুফ ফোনে চোখ বুলায়।আরেকটু সকাল হলেই দুজন বডিগার্ড আসবে।দরজায় পাহারা বসাতে হবে।কেউ যাতে বেরোতে না পারে বাড়ি থেকে।ভাগ্যিস সেই নদীর পাড়ে সোনালীর মারকুটে ভাব দেখে ইউসুফের সন্দেহ হয়েছিল।তারপরে ভালোভাবে খোঁজ-খবর নিতেই তো থলের বিড়াল বেরিয়ে এলো।নাহয় ইউসুফ জানতেই পারতো না, সোনালী এস.বি অফিসার।তাছাড়া,কাল রাতে সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় যদি মামুনের ঘর থেকে সোনালীকে বেরিয়ে যেতে না দেখতো,সোনালীকে অনুসরণ না করতো,তবে সোনালী কি করতো আল্লাহ মালুম।কাল খুব বাঁচা বেঁচে গেছে ইউসুফ। এখানে আসার আগেই বডিগার্ড নিয়ে আসা উচিত ছিল।কোনোরকম নিরাপত্তা ছাড়া এখানে এসে একটুও ভালো হয়নি।খুব ভুল হয়ে গেছে।ভুলের মাশুল কীভাবে দিতে হয় আল্লাহ মালুম।সোনালী নিশ্চয়ই একা আসেনি। আরো কয়জন এসেছে কে জানে।গোয়েন্দা বিভাগ থেকে খবর এসেছে অনেকগুলো অফিসার এসেছে এখানে।কিন্তু খোলামেলা কারো নাম জানতে পারেনি ইউসুফ।ওর বিরুদ্ধে এবার এতো উঠেপড়ে লেগেছে কেন সবাই? তথাকে নিয়ে খুব বেশিদিন থাকা যাবে না এখানে। মেয়েগুলোর একটা গতি করেই পাকিস্তানে পাড়ি জমাতে হবে।ততোদিন ভালোয় ভালোয় দিন কাটলেই হয়।ইউসুফ খুড়িয়ে খুড়িয়ে জানলার কাছে যায়।ওই যে বয়স্ক অর্জুন গাছটা দেখা যাচ্ছে।গাছের সামনে জীর্ন-শীর্ণ বহু পুরোনো ঘরের একাংশও দেখা যাচ্ছে।ইউসুফ ঘাড় উচিয়ে আরো দূরে নজর দেয়।অদ্ভূত দুটো সবুজ মনি দিয়ে একটা কবর খোঁজে।অপক্ক হাতে করা কাঁচা একটা কবর,যার মাঝে শুয়ে আছে ভীষণ সাহসী একটা মেয়ে।তবে মানুষের শেষ ঠিকানা চোখে পড়ে না ইউসুফের।সে ঘাড় নামিয়ে ফেলে।ঠোঁটের কোনে অহংকারের হাসি ফুটে ওঠে। আহমেদ ইউসুফের পতন এতো সহজ নয়।

***

খাটের উপর মামুনের অর্ধেক শরীর।ঠিক কোমড়ের নিচের অংশটুকু খাটের নিচের দিকে ঝুলে আছে।মামুনের ঘরে দুটো জানলা।দুটো জানলাই বন্ধ।তাই সকালের আলো এখনো ঘরে আসেনি।ঘরের লাইটটা জ্বলছে এখনো।মামুন চোখ খোলে ধীরে ধীরে।মস্তিষ্ক কাজ করতে শুরু করেছে।চোখ খুলে ঘাড় নাড়ানোর চেষ্টা করে মামুন।শুধু ঘাড় নয় হাত-পা-কোমড় সব নাড়ানোর চেষ্টা করে।কিন্তু হচ্ছে না।সব যেন একে অন্যের সাথে আঁটকে গেছে।মামুন বহু কষ্টে ঘাড় ঘুরিয়ে ডানপাশে তাকায়। বাদামী রঙের জ্যাকেটটা দেখা যাচ্ছে খাটের একপাশে।মুহূর্তেই মনে পড়ে যায় কাল রাতের ঘটনা।সোনালী এসেছিল,তারপর জ্যাকেট চাইলো,মামুন জ্যাকেটের হাতা শুকলো, তারপর….।ডানহাতের আঙুল তুলে কপাল চেপে ধরে মামুন।জ্যাকেটের হাতায় কিছু ছিল।খুব সম্ভবত ক্লোরোফর্ম ছিল। বোকার মতো সোনালীর কথা শুনে জ্যাকেটের গন্ধ নেওয়া উচিত হয়নি।মামুন উঠার চেষ্টা করে।শুয়ে থাকলে চলবে না এখন।প্রথমে ঘাড় তোলে,তারপর মাথা,তারপর কোমড়ের উপরের অংশ,তারপর পা দুটো।অসাড় শরীরটাকে সচল করতে টানা দশ মিনিট সময় লাগে মামুনের। মেয়েটা ভীষণ চালাক।বুদ্ধি করে পঙ্গু করে দিয়েছে একদম।মামুন ধীরে ধীরে উঠে বসে।হাত-পা ঝাড়া দেয়।গলা শুকিয়ে কাঠ।শরীরের জোড়ায় জোড়ায় ব্যাথা হচ্ছে।সোনালীর উপর খুব রাগ জমে মামুনের।আজকে সামনে পেলে ঠাটিয়ে দুটো চড় মারবে।এরপর যা থাকে কপালে।রাতদুপুরে অজ্ঞান করে কি লাভ হলো মেয়েটার? মামুন টেবিলের উপর থেকে পানির বোতল নেয়।ঢকঢক করে শেষ করে বোতলে অর্ধেক পানি।ঘড়ির দিক্ব নজর বুলায় একবার। সারে নয়টা বাজে।ধীরগতিতে দরজার কাছে যায় মামুন।ছিটকিনি দেওয়া নেই।অলস হাতে দরজা খোলার আগেই হাত গুটিয়ে নেয় মামুন।বাইরে থেকে দুটো গলার স্বর শোনা যাচ্ছে।ফিসফিস করে কথা বলছে তারা।দুটো পরিচিত কন্ঠস্বর।মামুনের কপাল কুঁচকে যায়। কি এতো ফিসফিস করছে এরা? সে কান পেতে রাখে দরজায়।কাঠের দরজার সাথে একটা কান একদম চেপে ধরে।হ্যাঁ, ওই তো শোনা যাচ্ছে এখন।খুব গোপন কথাগুলো স্পষ্ট কানে আসছে মামুনের।মামুন মনোযোগ দেয়।মন-প্রাণ-মস্তিষ্ক সব সচল হয়ে উঠে মুহূর্তেই।

শাফিন তথার উপর বিরক্ত হয়।ফিসফিস করে বলেঃ” এটা সোনালীর হাতের লেখা নয় তথা।”

_” আপনি বললেই হলো? এটা সোনালীর হাতের লেখা না হলে কার লেখা হবে? আমি নিজে আমার ঘরে পেয়েছি এটা।”

_” সোনালীর হাতের লেখা আমি খুব ভালো করে চিনি।”

তথা কপাল কুঁচকায়।গলায় সন্দেহ নিয়ে প্রশ্ন করেঃ” আপনি কি করে চিনেন? আপনারা কি পূর্ব পরিচিত? এখানে আসলে কি হচ্ছে বলুন তো?”

শাফিন ফাঁকা ঢোক গিলে।তথাকে খুলে বলবে সব? সোনালীর ব্যাপারে,বাকি সবার ব্যাপারে? না,এখনও বোধহয় সময় হয়নি।তথার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে নেয় শাফিন।ভাঁজ করে পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বলেঃ” আপনি যতটুকু জানেন,তাই নিয়ে খুশি থাকুন।সবটা জানানোর সময় হলে আমি নিজেই জানাব আপনাকে।”

তথাকে অতিক্রম করে সামনে যেতে চাইলে বাধা দেয় তথা।নিচু স্বরে বলেঃ” আমার আর ভাল লাগছে না শাফিন।সত্যি আর ভাল লাগছে না।একটা বাজে লোকের সাথে অভিনয় করতে করতে ক্লান্ত আমি।যতবার তার সামনে যাই ততোবার দুঃখে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে।যতবার তার যত্ন নিতে হয়, ভালোভাবে তার সাথে কথা বলতে হয়, ততোবার নিজের উপর ঘৃণা হয়।এর শেষ কোথায় শাফিন? আপনি না এস.বি অফিসার? স্টেপ কবে নেবেন আপনি?”

এই প্রথম তথার জন্য খুব খারাপ লাগে শাফিনের।মেনে নেয় অভিনয় করতেও কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার।শাফিন কথা সাজিয়ে নেয়।নরম গলায় বলেঃ” আরেকটু কষ্ট করুন তথা।আর একটু প্লিজ।আমি সবটা গুছিয়ে নেব খুব দ্রুত।”

সামনে পা বাড়িয়েও আবার থেমে যায় শাফিন।পিছু ফিরে বলেঃ” আপনাকে একটা কথা বলতে ভুলেই গেছিলাম তথা।ইরফান এসেছে আপনার খোঁজ নিতে।কালকে এসেছে। এখনো আছে বোধহয় এখানেই।আমার সাথে আর যোগাযোগ হয়নি।”

আর দাঁড়ায় না শাফিন।দ্রুত গতিতে সামনে চলে যায়।পিছনে ফেলে যায় হতভম্ব তথাকে।তার কান জুড়ে ঝুমঝুমিয়ে বাজে কেবল দুটো শব্দ।ইরফান এসেছে।হ্যাঁ, এসেছে।সেই টলটলে চোখের প্রেমিক পুরুষ এতোটা পথ পাড়ি দিয়েছে।কারণ?কারণ তথা।একমাত্র তথার জন্যই এসেছে সে।গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহের শেষে কালবৈশাখীর উত্তাল হাওয়া যেমন প্রকৃতিকে ছুঁয়ে দেয়,ঠিক তেমনি এক পশলা ঠান্ডা হাওয়া তথার সর্বস্ব ছুঁয়ে দেয়।তথার মন-প্রাণ বসন্ত বাতাসে নেচে উঠে।তথা কান পেতে সুখ কাব্য শোনে।আশেপাশে যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দুটো শব্দ। মন শান্ত করা জাদুকরী দুটো শব্দ।ইরফান এসেছে,ইরফান এসেছে,ইরফান এসেছে।।।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here