তনুশ্রী♥পর্ব_২ ও ৩

তনুশ্রী♥পর্ব_২ ও ৩
#লেখক:হৃদয় আহমেদ

আজিদ লতিফাকে মেরে আধমরা করে ঘর থেকে রেগে বেড়িয়ে গেলেন। সেই লাঠির ভাঙা অংশ পড়ে আছে লতিফার পাশেই। ব্যাথায় গোঙ্গাচ্ছে লতিফা। ওঠার সামর্থ নেই তার। ব্যথায় অবস তার পুরো শরীর!

______________

– তনু যে? তা এখানে এত রাতে?

বড়মামীর মুখের দিকে চেয়ে রয় তনু। তিনি কথা না বাড়িয়ে ভতরে নিয়ে আসেন তনুকে। লতিফার বাবা একজন বিত্তবান শ্রেণির লোক ছিলেন। দালানের বাড়ি দিয়েছিলেন আর শিক্ষত ছিলো পরিবারের ছিলো সবাই। তাই এতটা শুদ্ধ কথা বলতে পারেন তনুর মামী। বাড়ির কাজের লোকটা লোক আয়রা ছাড়া সবাই শুদ্ধ বাংলায় বলতে পারে। তনুকে চেয়ার পেতে বসতে দেন তনুর বড়মামী। তার ছোটমামা এখনো অবিবাহিত। বয়সও বেশি নয়।

এক গ্লাস পানি তনুর সামনে আসতেই সে ডকডক করে সবটা খেয়ে নেয়। তনুর বড়মামা বাড়িতে থাকেন না। কাজের সূত্রে বাইরেই থাকতে হয় তাকে। লতিফার ছোট ভাইয়ের নাম ইশয়াখ, তনুর ছোটমামা।

তনুর পাশে বসেন তার বড়মামী ইশা আম্বানি।’ আম্বানি’ এ বাড়ির পদবি। এমনকি বাড়ির নামও আম্বানি ভিলা। তনুর মামী তনুকে আদর সুলভ জিজ্ঞেস করলেন,

– এত রাতে আসতে গেলে কেন তুমি? যদি কোন বিপদ হতো তখন?

– আম্মায় পাঠাইছে।

– এত রাতে?

– না হইছে কি..।বলে থামে তনু। ইশা আবারো জিজ্ঞেস করে,

– বলো। কিছু হয়েছে? নাকি এবারে তোমাকে মারতে চাইছেন তোমার আব্বা?

– আব্বায় আমার বিয়া ঠিক করসে। আমার থেইকা পনেরো বছরের বড় একজনের সাথে। আম্মায় চায় নাই এ বিয়া হোক। তাই এইহানে আমারে পাঠানো।

– তোমার বাপ এমন কেনো? আগের ফুটফুটে মেয়েটাকে কি ভাবেই না মারছে। পুলিশ যে কেনো ছারলো..? আর তোমার এই বয়সে বিয়া ঠিক করেছে? ঠিক করেছো এখানে এসে। পালিয়ে পাঠাইছে না?

– হু।

– আসো খেয়ে নাও। আমি তোমার শোয়ার ব্যাবস্হা করছি।

তখনি সেখানে ইশয়াখের আগমন। প্রথম এসেই তার চোখ পড়ে তনুর ওপর। এর আগে যখন এসেছে তখন বয়স আট থেকে নয়। আর এখন তার দেহ সাদা ধবধবে। উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো মুখ। কালো কেশ। ইশয়াখ নিজের লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে তাকায় তনুর দিকে। কথা শুরু করতে বলে,

– কেমন আছো তনু? অনেকদিন পর আসলা।

উত্তরে মৃদু হেঁসে মাথা নাড়ায় তনু। ইশয়াখ চলে যায় এখনকার মতন।
মাথার উপরে টিন থাকলেও দেয়ালের বাড়িটায় কমতি নাই রুমের। কিন্তু ইশা তাকে নিজের কাছে রাখতে চান। তিনি তো একাই থাকেন তনুকে রাখলে তার একটু ভালো লাগবে। সবাই মিলে খাওয়ার ঘরে চলে যায়। তিনজনেই খেতে বসে। খাওয়ার মাঝে ইশয়াখ তনুকে জিজ্ঞেস করে,

– কোন ক্লাসে পড় তনু?

– পড়ি না।

– কেন?

– আব্বায় দেয় না।

– ও।

খাওয়ার মাঝে কথা বলা পছন্দ করেননা ইশা। তাই এর বেশি আর কথা হয়না সেখানে।

খাওয়া শেষ! সবাই সবার ঘরে। ইশা তনুকে জাপটে ধরে শুয়ে আছে। তনু উত্তরে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। তার মাকে মনে পড়ছে। মায়ের সাথে কাটানো সময়গুলো মনে পড়ছে। যে মাকে ছাড়া তনু একটা মিনিট ভালো থাকেনা সে মাকে ছাড়া কিভাবে ঘুম আসবে?
‘আব্বায় ক্যান এমন করলো? কি করছিলাম আমি যে এত তাড়া বিয়া দিয়ার? আমার মেলা(অনেক) টাকা থাকলে আমি আব্বার মুখে ছুড়ে মারতাম। আল্লাহই জানে আম্মা কেমন আছে! আব্বা কি বেশি মারবো আম্মারে?’
এসব ভাবতে ভাবতে কেঁদে ওঠে তনু। তার তৃষ্ণা জেগেছে। মাকে একপলক দেখার তৃষ্ণা!

_____________

মোড়ল বাড়ি! বিরাট কয়েক বিঘা একাই ঘেরাও করে স্থাপিত ১৯০১ সালে। কারুকাজে বিচিত্র দৃশ্যের যেন এক রাজপ্রসাদ গড়ে তুলেছেন মইনুল মোড়লের পূর্বপুরুষ। দোতলার এক বিরাট বাড়ি। কেউ ভেতরে ডুকলে ভরকি খাবে নিশ্চিত। তেমনি গোলকধাঁধায় পড়েছে আজিদ ইশকুল। মেয়েকে কোথাও পাঠিয়েছে কথাটা শুনেই তিনি বেধোরে পিটিয়েছেন বউকে। তারপর মোড়ল বাড়ি বলে ছুট লাগিয়েছেন। রাতের ঘন অন্ধকার তিনি তোয়াক্কা করেননি। শেয়ালের হাঁক,ঝিঝি পোকার ডাকে তৈরি ভুতুড়ে পরিবেশ তার কাছে তখন নগন্য। দরকার টাকার! সোনার হরিণ পালিয়েছে তার। মেয়েকে দেয়ার বদলে তিনি পাবেন কয়েক হাজার টাকা। যেন বিক্রি করছেন তনুকে মোড়ল বাড়ির কাছে!

– কে ওখানে?

আজিদ কন্ঠস্বর লক্ষ্য করে তাকায়। মইনুল সূর্যমুখী গাছগুলোর ওপরপানে দাড়িয়ে। আজিদ ছুটে যায় সেখানে। আজিদের ঘাম ছুটছে একপ্রকার। মইনুল ভ্রু কুঁচকে বলে,

– এত রাতে আপনি এখানে? কি মতলব? বলেছিলাম তো বিয়েটা হলেই টাকাটা পেয়ে যাবেন!

আজিদ চোরের মতো এদিক ওদিক দেখে।

– হেই মাইয়া থাকপো তারফরে তো বিয়া! মাইয়া ভাগছে। নিজ বউই আমার সয়তান!

– তারমানে?

– তনুরে কোনহানে লুকায়া রাখছে লতু।

– তর বউয়ের বেশিই দেমাগ দেখছি।

– তাইলে কন? পিঠির(পিঠের) চামড়া ছিড়া ফালাইছি তবুও একটা কথা কয় নাই। আত্মীয়তো হাজার হাজার। কোনহানে রাখছে ক্যামনে খুজমু?

মইনুলের কপালে চিন্তার ছাপ পড়ে। কি করবে এখন? শরীরে এক অংশ কাটলেও যেন এক্কেবারে খারাপ দেখা না যায় তাই ফুটফুটে তনুকে বাছাই করা। গ্রামে ওর থেকে বেশি ভালো আর নাই বললেই চলে। এবারে কি করবে? আর তূরও ওকেই চায়!
উনি ভাবতে ভাবতেই বলেন,

– তুমি এখন এখান থেকে যাও। আমি দেখছি!

মইনুল নিজের লুঙ্গির এক কোন হাতে নিয়ে অন্দরমহলের দিকে পা বাড়ালেন। চিন্তিত আজিদ ঠায় দাড়িয়ে রয়। মইনুল লক্ষ্য করে বললেন,

– যান মিয়া! আমি দেখছি। কালকের মধ্যই ঘরের হবু বউরে পাওয়া যাইবো। আপনি যান এখান থেকে।

আজিদ অন্ধকারে বেড়িয়ে যায় বাড়ি থেকে। রেখে যায় নিজের চিন্তার ভার!
মজিদ অন্দরমহলে গিয়েই তূরের ঘরেরদিকে পা বাড়ায়। বেঘোরে ঘুমোচ্ছে তূর। মইনুল তাকে ডাকেন। হকচকিয়ে ওঠে তূর। ঘুমো ঘুমো চোখে বলে,

– এখন কোন অপরেশন আছে নাকি? আমি যাইতে পারবো না।

– তনু পলাইছে!

স্পষ্ট কথা দুই বাক্য বলে উঠলেন মইনুল। মুহূর্তে ঘুম উধাও হয়ে যায় তূরের। চমকালো স্বরে বলে,

– কবে?কখন?কিভাবে?

– তনুর মা ওকে লুকাইছে। ওর আব্বা যা বললো তাতে খুব পিটিয়েছে মহিলাকে। তবুও টু শব্দ করে নাই। মন দিয়া শোন তূর, ছবি সমেত মাল চাইছে! তনুরে লাগবেই।

এক ঝাপে বিছানা থেকে ওঠে তূর। চোখে ঘুমের ছায়া নেই। যেন সপ্ন দেখছিলো তনুকে নিয়ে আর উঠতেই সে নেই! তূর ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,

– লোক পাঠান আব্বা। ওই মেয়ে চাইই চাই!

তূর আর মইনুল বেড়িয়ে যায় অন্দরমহল থেকে। লোক জড় করে। কম করে হলেও আশি জন বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী! আর পয়ত্রিশ জন রোগা পাতলা। সকলকে এক কথায় বুঝিয়ে দেয়া হয় সবটা! ছড়িয়ে যায় তারা পুরো গ্রামে!

______________
ভোরের আলো ফুটেছে! চিকচিকে সোনালি রোদ ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর বুকে। নতুন দিন আর নতুন আলোর খোজে অনেকে ব্যাস্ত। কেউ ওপারের জন্য মোনাজাতে কাঁদছে তো কেউ মরা ঘুম ঘুমোচ্ছে। বাকি নেই তনুও! কাল রাতের ধকলে তনুও এখনো ঘুমের জগতে। রাত পুহিয়ে সকাল হয়েছে তা তনুর মস্তিষ্ট ঠাউর করতে পারেনি। ইশা কোরআন তেলোয়াত করছেন। সবেমাত্র ফজরের নামজ আদায় করে তিনি বসেছেন। পড়ার আওয়াজ কানে আসতেই তনু চোখ মেলে তাকায়। বিছানায় উবু হয়ে বসে। রাতে তার ঠিক ঘুম হয়নি। কেউ এসেছিলো ঘরে। ইশা আম্বানির ছাড়াও আরও কারো নিশ্বাস টের পেয়েছিলো তনু।তাই প্রায় পুরো রাতই জেগে ছিলো সে! কিন্তু কে ছিলো তা অজানা। বুঝতে পারেনি তনু!
বিছানার থেকে উঁচু চৌকির মতো একটা জায়গায় কুরআন তেলাওয়াত করছেন ইশা। তনু শুনছে মুগ্ধ হয়ে। তার মাও এরকম সকাল সকাল তেলাওয়াত করে আর তনু বিমোহিত হয়ে শোনে।
ইশার পড়া শেষে তিনি লক্ষ করেন তনু উঠেছে। তিনি কুরআনুল কারিমে চুমো দিয়ে ওপরের তাকে রেখে নেমে আসেন চৌকি থেকে।

– নামাজ কালাম পড়ো তনু?

তনু মুচকি হেঁসে বলে,

– ফড়ি তো।

– আজ যোহর থেকে পড়ো! শরীর ঠিক করে কেমন? যাও গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আসো। নাস্তা দিচ্ছি। যাই ইশয়াখকে ডাকি নইলে ও আর উঠবে না।

ইশয়াখের কথা মনে পড়তেই তনু কেন জানি মনে হয় রাতের ওই অজ্ঞাত লোকটা ইশয়াখ ছিলো। পরমুহূর্তেই ভাবে নিজের মামাকে নিয়ে এসব মনে করা ঠিক নয়।
তনু বিছানা ছাড়ে। দু বিঘায় বানানো অট্টালিকা বাড়িতে একজন পুরুষ কাজের লোক আর একজন মহিলা। তনু কলপাড়ে যেতেই তাবিজ চাচাকে দেখতে পায়। উনি ফুল গাছে পানি দিচ্ছিলেন। তনু তাবিজ চাচাকে ডেকে বললেন,

– শুক্রভাত চাচা। কেমন আছেন আফনে চাচা?

তাবিজ তনুর দিকে অবাক চোখে তাকায়। সেই কত ছোট একটা মেয়ে এসেছিলো আর সে এত বড় হইসে? তিনি উঠে তনুর দিকে এগিয়ে আসেন। এ বাড়িতে থাকতে থাকতে তিনি শুদ্ধ কথা বলতে পারেন।

– কেমন আছো তনু?

– আফনি চিনছেন আমারে?

– না চেনার কি আছে? সেই কত্ত ছোট থাকতে তোমায় দেখছিলাম। এখন কোন ক্লাসে তুমি তনু?

– আমি ফড়ি না তো চাচা।

– কেন? পড়োনা কেন?

– ১৯৭৫ সাল! তিথি আপু আর আমি একলগে স্কুলে যাইতাম। আমি তহন কিলাস (ক্লাস) ফোরে পরি। আপা কিলাশ(ক্লাস) সেবেনে ফড়তো। লুকায়া লুকায়া শাহাজালাল ভাইয়ের সাথে প্রেম করতো আফায়। কথাডা শুধু আমি আর আম্মায় জানতো। আম্মায় কিছুই কয় নাই এই নিয়ে। কারন শাহজালাল ভাই ছিলেন খুব ভালা মানুষ! খুবই ভালা মানুষ! আম্মাও পছন্দ করতো শাহাজালাল ভাইরে। কিন্তু একদিন আব্বা দেইখা ফালায় বোন আর শাহাজালাল ভাইরে। বাড়ি আইসা আম্মারে আর আপুরে খুব পিটায় আব্বা। আপুরে ঘরে নিয়ে দুইডা লাঠি ভাঙে! আম্মা আটকাতে পারে নাই। সেই আঘাতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন আপু। আর তারপর আমারো স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন আব্বা।

তনুর চোখ চিকচিক করে ওঠে। বুকের তার কষ্ট হচ্ছে। তাবিজ চাচা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।

– নিজের মেয়েকে এক্কেরে মেয়ে ফেললো? কি নিষ্ঠুর! শাস্তি পায় নাই?

– পাইসে। তবে তা কয়দিনের মাত্র। তারপর ছেড়ে দেয় পুলিশ!

তনু ‘আসি চাচা’ বলে চলে যায় কলপাড়ে। মুখে পানির ছিটে দিয়ে ছাই দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করে। কুলি করে চলে আসে ঘরে। ইশয়াখ নিজ ঘরে। ইশা রান্না করছিলেন। তনু রান্নাঘরে গেলো। ইশা তনুর উপস্থিতি টের পেয়ে বললেন,

– এখানে আসতে গেলি কেন?যা। রান্না হয়ে গেছে। টেবিলে যা আমি খাবার নিয়ে আসছি।

তনু উল্টোদিক ফিরে যেতে নিলেই ইশা বলে ওঠেন,

– ইশয়াখকে একটা ডাক দিবি তনু? আমি কাজ করতেছি আর না ডাকলে ও আসবে না।

– জ্বি মামী। আমি ডাকতাছি।

বাধ্য মেয়ের মতো তনু চলে যায় ইশয়াখের রুমের দিকে। ইশার ঘরের তিন ঘর পেরিয়ে ইশয়াখের রুম। তনু আস্তে করে দারে টোকা দেয়। সারা নেই! তার কি ভেতরে যাওয়া উচিত? যদি ঘমিয়ে পড়ে? তনু নিজের ওড়না ঠিক করে ঘরে ডোকে। দার পেরিয়ে এক পা যেতেই কেউ হেচকা টানে রুমে ডুকিয়ে নেয় তনুকে। খুলে ফেলে তেরো বছর বয়সি তনুর গা থেকে ওড়না!

_______________বর্তমান____________

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো তূর। বললো,

– তারপর? ইশয়াখ তোমায় ধর্ষন করলো?

তনু হু হু করে কেঁদে ওঠে। বাসরাতের ফুলে বিছানো বিছানার চাদর খামচে ধরে বলতে লাগলো,

– তারপর….

#চলবে….

অনেকে মানছে না এটা থ্রিলার! আমি তাদের বোঝাতে চাইনা। শুধু বলবো গল্পের মাত্র দুটো পথ অতিক্রম হয়েছে। এতটা ব্যাস্ত হবেন না। আর সবাই রেসপন্স করবেন যাতে গল্প সবার কাছে যায়। হ্যাপি রিডিং🥰

#তনুশ্রী♥
#লেখক:হৃদয় আহমেদ
#পর্ব_৩

ইশয়াখ নিজের ঘৃন্য হাত দিয়ে জাপটে ধরলো তনুকে। তনু গলা ফাটা চিৎকার দিয়ে ডাকতে লাগলো,
– কেউ আছেন? মামী! মামী বাচাও আমারে। মামীগো!’
তিনঘর তিনফুট পেরিয়ে তার স্বর পৌছালোনা ইশার কাছে। ইশয়াখ তনুর জমার কোনা টেনে খোলার চেষ্টা করে। তনু তখনি নিজের মৃত্যু কামনায় লুটিয়ে পড়ে। তনু মনে মনে আল্লাকে স্বরণ করে নেয়। নিজে ছুটতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। তার লক্ষ এই জানো*র হাত থেকে তাকে বাচতেই হবে! হঠাৎ হাত আলগা করে ছেড়ে দেয় তনুকে ইশয়াখ। চোখের পলকে তনু মাটিতে পড়ে থাকা বোতল কুড়িয়ে নেয়। তনু যদ্দুর জানে এটা মদের বোতল। ইশয়াখ মদ খেয়েছে কিছুক্ষণ আগে। তনু মাটিতে এক ঝটকায় বোতলের নিচের অংশ ভেঙে ফেলে। ইশয়াখ তেড়ে যায় তনুর দিকে। শুরু হয় হস্তাহস্তি। ইশয়াখ হাতের বোতল নেয়ার জন্য তনুর পাতলা কালো চুলগুলো একহাতে মুঠো করে নেয়।
– সয়তান মেয়ে,ইশয়াখের জন্য পুরো মহল্লার মেয়ে পাগল আর তুই?
মুষ্টিবন্ধ হাতে চুল ছিড়ে আসে। তনু আবারো চিৎকার দিয়ে ওঠে,
– ইশা মামী বাচাও আমারে। মামী কই তুমি। বাঁচাও আমারে!
তনুর স্বর কি কেউ শুনছে? কেউকি নাই তাকে বাঁচাতে? বোতল পড়ে গিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। কাঁচ ছিটিয়ে রয়েছে পুরো মেঝেতে! তনু ঘরের কোনে গিয়ে দাড়ায়। মুখে আঁচড় কেটেছে ইশয়াখ। গলগল করে লাল রক্ত চুইয়ে পড়ছে ধবধবে সাদা গাল বেয়ে। চারদিকে একবার ভালো করে চোখ বোলায় তনু। ঘরে আরেকটা দরজা! এটা কিসের দরজা? বাইরে যাওয়ার নাকি? যদি না হয় তাহলে তাকে আজ নরপশুর হাতে হতে হবে ধর্ষিতা! ইশয়াখ সয়তানি হেঁসে এগোয় তনুর দিকে।
– তুমিতো পালাচ্ছো কেন? কাছে আসো!
তনু ঘেষে দাড়ায় দেয়ালে। আরও কয়েকটা ডাক দেয় ইশাকে তনু। ইশা শুনেনা! তনুর চোখ বেয়ে ঝড়ছে পানি,নোনা পানি! নিজের সতিত্ব নষ্ট হওয়া থেকে সে কিভাবে বাঁচবে? ইশয়াখ ঘেমে নেয়ে গেছে। এই প্রথম কোন মেয়ে তাকে এতটা ধস্তাধস্তি করালো। পাতানো মোড়া টেনে বসে ইশয়াখ। পকেট থেকে দিয়াশলাই আর বিড়ি বের করে।
– আমারে যাইতে দেন মামা। আমারে ছাইড়া দেন। কসম লাগে,আমি আর জিবনেও আমু না আপনাগো বাড়িত! মামাগো ছাইড়া দেন। মামা!
করুন কন্ঠে বলে ওঠে তনু। বুক ছারখার হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে নিজেই ধিক্কার জানাচ্ছে! যে মা তাকে বাড়ির বাইরে বের হতে দিতে ভয় পেত, বুকের ওড়নার এতটুকু নড়চড় হতে দিতো না, আজ সে ওড়না মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে! বিড়ি ফুকোতে ফুকোতে বলে ইশয়াখ,
– শোন,অত সহজে কোন মাইয়া আজ পর্যন্ত ছাড় পায় নাই। তোরে যহন পছন্দ করছি তুই আমার বুঝছোত?’
তনু আবারো আশেপাশে দেখে। দরজাটা খোলা! বাইরের আলো আসছে। ওটা কি আরেকটা বের হওয়ার দরজা? ভাবতে দেড়ি নাই তনু কাঁচের উপর দিয়ে দৌড়ে যায় দরজার কাছে। পায়ে ফুটে যায় ধারালো কাচ! পুতুলের মতো পা গুলো তৎক্ষনাৎ লালে রঙিন হয়ে ওঠে। তবুও হাল ছাড়ে না তনু। ক্ষত পা নিয়েই বেড়িয়ে যায় দরজা দিয়ে। আকস্মিকতায় হকচকিয়ে ওঠে ইশয়াখ। মোড়া ছেড়ে ছুটে যায় দরজার কাছে। তনু প্রানপনে দৌড়াতে থাকে।

দরজার বাইরে মেঠো পথ! যত দূর দেখা যায় শুধু মাঠ আর মাঠ! কিছুদিন আগেই এখানে ধান চাষ করা হয়েছিলো। যা কৃষকরা ঘরে তুলেছে। তনু এ পথ বেয়ে দৌড়াতে থাকে। পেছনে ইশয়াখ! প্রতিটা পায়ের ছাপ স্পষ্ট মাটিতে তনুর। কারন ঝড়ছে তরতাজা রক্ত! তাতে তোয়াক্কা নেই তনুর। নিজের সর্বশ দিয়ে দৌড়াতে থাকে। ইশয়াখ আগে থেকেই ঘামে জর্জরিত। সে প্রায় হাপিয়ে উঠেছে। একটা মেয়ে হয়ে এত জোড়ে কিভাবে দৌড়াতে পারে? তার বিশ্রী ভাবে কাটা পা নিয়ে?

মেঠো পথ মাঝের দিকে। শরীর ঘেমে নেয়ে গেছে তনুর। জঘন্য গন্ধ আসছে। তনু থামে। পেছনে একবার লক্ষ করে দেখে ইশয়াখ নেই। কোথায় গেলো? চলে গেছে বোধহয়। মাটিতে ধপাশ করে বসে পড়ে তনু। ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেছে পা। শুকনো খড়খড়ে মাটিতে দৌড়ানোর ফল! তনু ব্যাথায় কাতর হয়ে পড়ছে। পানির তৃষ্ণা পেয়েছে ওর। দরকার একফোটা ঠান্ডা পানি!

বিশাল মোড়লপাড়া চিরুনি তল্লাশি দিয়েও তনুকে খুজে পাওয়া যায়নি। মোড়লপাড়া অন্যান্য পাড়াগুলোর থেকে কম করে হলেও চারগুণ বড়! সবাইকে ভাগ ভাগ করে পাঠানো হয়েছিলো খুজতে। কাল রাত থেকে চোখে ঘুম নেই তূর আর মইনুল মোড়লের। সবার সাথে সারা রাত তারাও খুজেছে। এখন তারা মাঠে। কিছুক্ষণ আগেই গোয়ালালাদাপূরে ততন্ত চালিয়েছে। আজিদ না থাকায় লতিফার বাপের বাড়ি যেতে পারেনি তারা।
– মাইরা এক রাতে গেলো কই?’
মইনুল বলে উঠলেন কথাটা। তূর চেয়াল খিচে নিলো। ওই তনুর জন্য সারারাত ঘুম হয় নাই। মাথা ঝিমঝিম করছে। তূর কটাক্ষ স্বরে বললো,
– একবার পাইয়া বিয়া করি খালি! মা*র থোতা মুখ ভোতা করে ছাড়বো।’
– কিন্তু পাবা কই? মোড়লপাড়ায় নাই! এখানে নাই। তাইলে গেলো কই?’
পাশে তাদের আরও কয়েকজন। গোয়ালাদাপূর থেকে মাঠ হয়ে ফিরছে সবাই। সবার মাঝ থেকে ঘেঁটু বললো,
– মোড়লমসাই, ওইযে আজিদের বউ লতিফা আবার মেয়েরে মাইরা ফালাইনাই তো? দেহেন বিয়া হইতে দিবো না কইয়া ঘাটে ফালাই দিসে।’
– ঠিক বলেছিস! মহিলা সুবিধার না। এত মাড়ছে তবুও কিছু বলেনি। আমিও তো কিছু বলতে পারবো না। এ গ্রামের সন্মান হাড়াইলে ব্যাবসা করা কঠিন হয়ে পড়বে।’
তূরের রাগের মাত্রা বাড়লো। একটা মেয়েকে খুজে পাচ্ছে না? অথচ এটা তার বা হাতের খেল! রাগে মাথার রগ দপদপ করছে তূরের। কথা বলতে গেলে গলার রগ ভেসে উঠছে,
– আমাদের আরেকজন কে খোঁজা উচিত!’
কথাটা বলেই দাড়ায় তূর। দূর থেকে দেখতে পায় মাঠের মাঝে ওড়না হীন কোন নারী বসে আছে। তার চোখ পায়ের তালুতে। ফরসা গায়ের রঙ দূর থেলে যেন হিরের মতো জ্বলছে!

তূরের দাড়ানো দেখে মইনুল বিরক্তি নিয়ে বলেন,
– এখানে দাড়াচ্ছিস কেন?
– সামনে দেখো!
মইনুল দেখেন সেদিকে।বুঝতে পেরে তূরকে বলেন,
– কে ও?
– মনে তো হয় তনুই! কিন্তু রক্ত কেন? কোন ছেলে আবার…
– ওটা আজিদই বলবে। এখানে দাড়ালে হবে না? চল ওকে ধরবো!’
– বোকার মতো কথা বলোনা আব্বা। আমি এখন গেলে ও আমাকে দেখে ফেলবে। আর বিয়ের পর ওর বিশ্বাস অর্জন করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। নইলে ক্লিনিকে নিয়ে যেতে সমস্যা হবে। তুমি যাও। আমি এদের সাথে মুখ ডেকে যাচ্ছি!’

মইনুল ঠোঁট বাকিয়ে ইসারা করে,
– তবে তাই হোক!’
তূর মুখে রুমাল বেঁধে নেয়। সবার সাথে মিশে যায়। মইনুল ধির পায়ে গিয়ে তনুকে ঘেরাও করে। চারপাশে এত মানুষ দেখে তনুর কলিজার পানি শেষ! তৃষ্ণা চারগুল বেড়েছে! ঘুরে তাকাতেই গ্রামের মোড়লকে দেখতে পায় তনু। তিনি একহাতে ধরে ওঠান তনুকে। বোকার মতন তনু ছোটবার চেষ্টা করে। তার সকল চেষ্টা ব্যর্থ!নিয়ে যাওয়া হয় তাকে মোড়লপাড়া!

____________
– মাইয়া কোনহানে রাখছোত ক লতু! এক কথা হাজার বার ভালো লাগে না।’
বিছানায় গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছেন লতিফা। মেয়েকে নিয়ে তার মন সকাল থেকে খচখচ করছে। খালি মনে হচ্ছে কিছু হয়েছে তনুর! তিনি নিজের চিন্তাকে পাত্তা দিয়ে এক চোখে চৌকির দিকে তাকিয়ে। আজিদ কি বলছে তার কানে আসছে না!

– আজিদ আছো বাড়িতে?
মোড়ল মসাইয়ের কন্ঠ কানে আসতেই বিছানা ছাড়েন লতিফা। আজিদ দৌড়ে বাইরে যায়। শক্তহাতে মেয়েকে ধরে মইনুলের দলবল সহ তূর দাড়িয়ে! আজিদ তনুকে দেখেই ছুটে যায় মাড়তে। ঘেঁটু আগলে দাড়ায়।
– কি করতাছেন? মারবেন না!
– ক্যান মারুম না? ওর সাহস হয় ক্যামনে?
– আহ্! আগে বলুনতো মেয়েকে কোন ছেলে আবার.. ‘
মইনুলের কথায় আজিদ তেড়ে মেয়ের কাছে যান। আগমন ঘটে লতিফারও। তিনি দূর থেকে মেয়ের মুখে রক্ত দেখে ছুটে আসেন। আজিদ ধরার আগেই লতিফা বুকে জড়িয়ে নেয় তনুকে। তনু পাড় ভাঙা নদীর মতো হু হু করে কেঁদে ওঠে। লতিফার স্বরে চিন্তা,
– কি হইসে মা? তোর গায়ে রক্ত ক্যা? পায়ে কি বাধাইছোস? কেউ তোরে কিছু বলছে?’
তনু অস্পষ্ট স্বরে বললো,
– না মা!
মইনুল হৈ হৈ করে উঠলেন,
– তাইলে তো হইছেই। মেয়েরে রেডি রাইখেন। কালই নিতে আসবো। ছেড়ির ডানা গজাইছে।’
লতিফা কিছু বলতে পারলেন না। এবারে কিছুবললে হয়তো তনুকে মেরে ফেলবে আজিদ! মইনুল সহ সকলে চলে যায়। লতিফা মেয়েকে ঘরে নিয়ে আসেন। পালঙ্কে বসিয়ে বলেন,
– তোরে পাইলো কই? আর তোরে কি মারছে ওরা? কথা কচ না কিল্লাই? কিছু করছে?’
তনুর কান্নার বেগ বাড়ে। সব বলে দেয় তনু লতিফাকে। লতিফা সবটা শুনে বিছানার চাঁদর খামচে ধরে দৃঢ প্রতিজ্ঞা করেন। যা খুবই শক্ত! খুউব!

মাঝে কেটে গেছে একদিন। আজ বাড়ি আর খালি নেই। চারপাশে প্রতিবেশী আর আত্মীয় দের ভির। মোড়লমশাই সবাইকে গণহারে নিমন্ত্রণ করেছেন। টাকাকড়ি সব উনিই দিবেন। এসেছে ইশাও। আসেনি ইশয়াখ! চোরের মন পুলিশ পুলিশ তাই আসেনি। ইশা অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে কেন চলে আসলো, উত্তরে তনু চুপ থেকেছে। লতিফা কিছু বলেনি। তনুর গায়ে হলুদের আয়োজন চলছে তোরজোর। চারিদিকে হলুদ গাধার সমাহার। চলছে বিরাট ভাবে আয়োজন। লতিফা কাজ করছেন, তবে মনমরা হয়ে। কাজে মন নেই তার।

তনুকে সাজানো হচ্ছে হলুদ রঙা সাড়িতে। গোলাপ গাধায় সুন্দর মালা তৈরি করেছেন মেয়ে বউরা। তা দিয়ে অপরুপ ভাবে সাজানো হয়েছে তনুকে। কিশোরী তনুকে লাগছে চমৎকার! অনেক ছেলেও মাঝেসাঝে উঁকি দিচ্ছে! আজিদের আগ্রহ সবথেকে বেশি। কিছুক্ষণ আগেই তিনি ঘরে গিয়ে তাড়া দিয়ে আসলেন! তনুকে বাইরে আনা হয়। লতিফা না চাইতেও মেয়ের গায়ে হলুদ ছোঁয়ালেন। এরপর ভির জমালো বাকিরা। সবাই তনুকে হলুদ মাখাতে মাখাতে হলুদপড়ি করে তুললো তনুকে! করতে লাগলো নানা রকমের খুনসুটি!

বিয়েল গড়িয়েছে! সূর্য অস্তে যাওয়ার সময় প্রায় হয়ে এসেছে। বাড়ি সাজানো চান্দোয়া দিয়ে। রঙ বেরঙের কাপরে সাজানো হয়েছে তনুদের ছোট্ট বাড়ি। বাড়ির পাশের আট-দশ বছরের মেয়েরাও শাড়ি পড়েছে। ছোটরা পুরো বাড়িতে জুরেছে কোলাহল। তনুকে লাল বেনারসি দিয়ে সাজাচ্ছে। ভরি ভরি গহনা পাঠিয়েছে মইনুল মোড়ল! সোনায় মুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে তনুকে।
– বর আইছেএএএ! চাচীইইইই! কই গেলা?
আজিদ এগিয়ে যায়। দূরত্ব কম বলে হেটে আসছেন মোড়ল বাড়ির সবাই। মেয়ে বৌ রা সকলে বোরখা পড়ে এসেছে।

_________________
ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে তূর! চোখ লাল হয়ে উঠেছে। ইশয়াখের করা যঘন্যতার কথা মনে আসলেই হাত নিশপিশ করছে ওকে খুন করতে। কিন্তু আজ তো নিজের বাসর রাত। তাই আর হাত নোংরা করতে চায় না তূর। তনু চকিতে তাকিয়ে রয়েছে। তূর বললো,
– ইচ্ছে করছে ওই ইশয়াখকে শেষ করে দিতে।
তনু নির্বিকার স্বরে বললো,
– হ্যাতে তো মইরাই গেছে।
চমকে ওঠে তূর! চোখ বড় বড় করে তাকায় তনুর দিকে। গলা খাঁকড়ি দিয়ে বলে,
– কে মাড়লো?
– জানিনা। কালকে রাত্রে খবর আইছে তিনি ইন্তেকাল করছেন। কেউ রাম দা দিয়ে কুপাইছে!
– ভয়ঙ্কর! এত লম্বা কাহিনি তোমার বিয়ের?
উত্তরে তনু চপ থাকে। ইশয়াখকের খুনি তনু বারবার মনে করছে লতিফাকে। কাল রাতে ইশয়াখের খুনের খবর যখন আসে তখন লতিফা বাড়িতে ছিলেন না। খবর আসার পর ঘাম শরীরে বাড়িতে প্রস্থান করেন উনি। সাথে ব্যাগ আর ব্যাগে ছিলো রক্তমাখা রামদা!
– কি ভাবছো?
– ভাবি না তো?
– হুম তুমি ঘুমাও। আমি একটু আসছি।
তূর ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। তনুর কিছুতেই শুতে ইচ্ছে করছে না। বারবার তার লতিফার কথাগুলো মনে পড়ছে। কেন তাকে আসার আগে এসব বললেন লতিফা? আর ‘শক্ত হাতে রক্ত’ মানেই বা কি?

#চলবে……

কাল থেকে রওনা হবো নতুন মোড়ে। হ্যাপি রিডিং😍

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here