#তিতির_পাখির_বাসা
(পর্ব-১০)
#জয়া_চক্রবর্তী
‘বাবিনরা কি আর ফোন করেছিলো দিদি?’প্রশ্নটা করেই উদ্বিগ্ন মুখে মাঝপথেই মশলা বাটা স্থগিত রেখে দিলো তৃণা মানে বাবিনের কাকিয়া।
‘নারে,সেই কালকা পৌঁছেই যা একবার ফোন করে জানিয়েছিলো,ওমা মশলা বাটাটা বন্ধ করলি কেন?’বলে গ্যাসটা নিভু আঁচে করে দিলো অনুশ্রী।
তৃনা হাত চালিয়ে মিহি করে পোস্তটা বেটে এগিয়ে দিলো জায়ের দিকে।
অনুশ্রী বাটিটা নিয়ে পোস্তটা কড়াইতে দিয়ে দু-একবার নাড়িয়ে এক কাপ দুধ আর ঘি দিয়ে ফুটিয়ে লাউশুক্তোটা নামিয়ে নিলো।
তারপর টাওয়াতে মেথি-তেজপাতা-রাধুনি ভেজে বেটে দেওয়ার জন্য এগিয়ে দিলো তৃনার দিকে।
তৃনা ভাজা মশলা বাটতে বাটতে বললো,’দেখলে তো দিদি,তিতির কেমন বাবিনের কাছে ডিভোর্স চাইলো?’
উত্তর না পেয়ে নিজেই বলতে থাকলো,’আজকালকার মেয়েদের সুখে থাকতে ভুতে কিলোয়’।
তৃনার কথা শুনে অনুশ্রী নিজেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়।প্রথম প্রথম অনুশ্রীর নিজেরও কি মন বসেছিলো সংসারে?
তখন তো আর ডিভোর্সের চল ছিলোনা।
অবশ্য থাকলেই বা কি হতো!তিনি তো আর বেশিদূর পড়াশোনা করেননি যে ডিভোর্স নিয়ে চাকরি করতেন।তার ওপর বাপের বাড়িতে অতো গুলো ভাই বোন।
দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো অনুশ্রীর।
কোন ছোট বয়েসে বিয়ে,সেই থেকেই সংসার টেনে চলেছেন।তার ওপর শ্বাশুড়ীর বাক্যবাণ তো লেগেই ছিলো।ননদ, জায়েরাও কিছু কম যেতো না।
সেই এক শব্দ আবহমান কাল ধরে চলে এসেছে অ্যাডজাস্ট,অ্যাডজাস্ট আর অ্যাডজাস্ট।
কথায় আছে ‘সংসার সুখের হয় রমনীর গুনে’..অনুশ্রী বুঝেই পায়না,দুজন মানুষ বিয়ে করে সংসার বাঁধে অথচ সংসারকে সুখের করার যত গুন সব শুধু মেয়েদেরই কেন থাকতে হবে?
শ্বাশুড়ী গত হওয়ার পর সবাই যে যার মতোই ভিন্ন।শুধু তৃনারাই তাদের সাথে থেকে গেছে।তৃনার দুই মেয়ে তো জেম্মা বলতে অজ্ঞান।
তিতির কে প্রথম দিন দেখেই মনে ধরেছিলো অনুশ্রীর।কৌশিককে বলেছিলো এই মেয়েকেই আমার বাবিনের বৌ করতে হবে।কৌশিক ও নাকচ করে দেয়নি।বাবিনের তো ছবি দেখেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু বিয়ের পর তিনি নিজেই কি তিতিরের সাথে ভালো মুখে কথা বলেছেন?মেয়েটা কাজকর্ম করেনি কখনো।তবু শিখে নেওয়ার ইচ্ছেটা আছে।অথচ মেয়েটাকে কাজ নিয়ে খোটা দিতে ছাড়েননি।
বৌমার স্থান থেকে যেই তিনি শ্বাশুড়ীর স্থানে এসেছেন, অমনি তার ল্যাজও মোটা হয়ে গেছে।অনুশ্রী বুঝতে পারছে এই কারনেই সব মেয়েদের গল্প এক।
আজ হঠাৎ নিজের ব্যবহারে নিজেরই মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।তিনিও তো টিপিকাল শ্বাশুড়ী সুলভ ব্যবহারই শুরু করেছেন।
বাবিনের সাথে মেয়েটাকে দেখলেই কেমন যেন গা কুটকুট শুরু হয়ে যায় অনুশ্রীর।
কারনটা তিনি নিজেও জানেননা।
ওরা যেন একসাথে বেশী সময় কাটাতে না পারে তার জন্য তিনি নিজেও কম ফন্দিফিকির করেননি।
প্রতিদিন ইচ্ছে করে রাতেই মনে করে করে তিতিরকে এটা সেটা কাজ দিয়ে নিজের কাছে আটকে রেখেছেন।যেমনটি তার শ্বাশুড়ী করতেন।
আজ বহুদিন পর আয়নায় নিজের শ্বাশুড়ীর রূপ নিজের মধ্যে দেখে,কেমন যেন দমবন্ধ লাগলো অনুশ্রীর।এই কারনেই কি তিনি তিতিরকে এই বাড়ির বৌ করেছিলেন?
তিনি তিতিরের মা হতে পারবেননা কিন্তু তিতিরকে বন্ধুতো করতেই পারেন।কি জানি মেয়েটা কতো কষ্ট মনে পুষে রেখেছে।
যাওয়ার আগেও তো কথা বলেননি কোন তিতিরের সাথে।আজ খুউউউব খারাপ লাগছে অনুশ্রীর।
‘কিগো দিদি তোমার আবার কি হলো?সেই কখন থেকে কি অমন ভেবে চলেছো?বড়দা যে চা-চা হাঁক দিলো দুবার’…তৃনার কথায় সম্বিৎ ফিরে আসলো অনুশ্রীর।বললো,’তুই একটু বসিয়ে দেতো চা টা,আমি একটু ঠাকুরঘর ঘুরে আসি’…
ঠাকুরঘরে কোন কাজ নেই,কিন্তু মনটা বড্ড উতলা আজ।শাড়ী পালটে ঠাকুরঘরে ঢুকে জোড় হাত করে মাকে নমস্কার করলেন।
মাকে বললেন,’জানো মা,আমাদের মেয়েদের জন্যই আজ মেয়েদের এতো দুঃখ।আমরা একে অপরের সমালোচনা করি,অথচ আত্ম-সমালোচনা করিনা।আমরা একে অপরের দুঃখে কপট হা-হুতাশ করি।অথচ মনে মনে বেশ খুশীই হই।আমরা নিজেদের সুখ নিয়ে মিথ্যে গাল গল্প শুনিয়ে অন্যের কালো হয়ে যাওয়া মুখটা দেখতে বড্ড ভালোবাসি।’
ঝরঝর করে জল পরতে থাকলো অনুশ্রীর চোখ দিয়ে।বললো,’আমাদের শক্তিশালী করো মা,আমরা যেন নিজেদের মনের আসুরিক প্রবৃত্তি গুলিকে শেষ করতে পারি।আশীর্বাদ করো যেন একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেরাই নিজেদের অস্ত্র হয়ে উঠি’,মাগো তোমার তুমিকে তুমি, আমাদের আমির আত্মশক্তিতে জাগ্রত করো’।(চলবে)