#তিতির_পাখির_বাসা(পর্ব-১৪)
#জয়া_চক্রবর্তী
ফায়ারপ্লেসের ঝলসে ওঠা আলোয় খোলা চুলে বসে থাকা তিতিরকে অসাধারণ লাগছে।
সুদর্শন কষ্ট করে চোখ ফিরিয়ে ডিনারে মনোযোগী হলো।
তিতির খেতে খেতে নিজেই সকালের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলো সুদর্শনকে।তুহিনের কথাও বাদ দিলোনা।
সুদর্শন বললো,কাল সকালে বের হতে হবে তাই ঘুমটা দুজনের জন্যই খুব জরুরী।
হাত মুখ ধুয়ে তিতির সোজা কম্বলের ভিতর।সুদর্শন লাইট নিভিয়ে কম্বলের ভিতর ঢুকতেই তিতির নিজে থেকেই ওকে জড়িয়ে ধরলো।
ঠান্ডার জন্য নাকি আবেগে সুদর্শন বুঝতে পারলো না।
তবে ভালো লাগলো।তিতিরের কপালে ঠোঁট ছুইয়ে চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে নিজেও ঘুমিয়ে পরলো।
সকালে দুজন রেডি হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে গাড়ীতে গিয়ে বসলো।আজ ওদের সাথে আর একটি হানিমুন কাপল শেয়ারে যাচ্ছে।
ওদের দেখে তিতিরের অচিন্ত্য আর দিয়ার কথা মনে পরে গেলো।
জীবনে কিছু কথা, কিছু ঘটনা স্মৃতি হয়েই রয়ে যায়,হারিয়ে যায় তার আগে পরের অনেককিছু।
সুদর্শন সামনে ড্রাইভারের পাশে বসেছে।তিতির সুদর্শনের ঠিক পেছনে।ওর পাশে ওরা দুজন।
সুদর্শন পাশে না থাকলেও মাঝেমাঝেই ঘাড় ঘুরিয়ে তিতিরের সাথে কথা বলছে।
পাশের দুজন হিন্দীভাষী।তিতির তাই ওদের সাথে কথা বাড়ায়নি।
সেবার চেন্নাইতে তিতিরের হিন্দী নিয়ে বন্ধুরা যেভাবে ওর পিছনে লেগেছিলো,তাতে তিতির সাহস করে আর হিন্দী বলতে যায়না।
সোলাং ভ্যালি আর রোটাং পাস দুটো জায়গাতেই ওরা অনেকক্ষণ সময় ধরে রইলো।
রোটাং পাসে বরফে স্লিপ করে দুজনেই পরলো বেশ কয়েকবার।
তারপর একসময় তিতিরের বায়নাতে সুদর্শনও ওর সাথে হাত লাগালো বরফ দিয়ে স্নো-ম্যান বানাবার।
বারবার করে ওরা স্নো-ম্যান বানাচ্ছে।
তারপর বরফের বল বানিয়ে নিজেরাই টিপ করে ভেঙ্গে ফেলছে।
বরফের ওপর রোদের দাপটে সোয়েটার, জ্যাকেট কিছুই গায়ে রাখা যাচ্ছে না।
তিতির এবার বুঝলো, মুভিতে কোন বরফের পাহাড়ে নায়িকারা কিভাবে স্বল্পবসনে নাচ গান করে থাকে।
অনেক হইচই করে দিনটা কেটে গেলো।
ফেরার পথেও সুদর্শন সামনেই বসলো।তিতিরের পাশের মেয়েটি নিজে থেকেই তিতিরের সাথে কথা বলতে শুরু করেছে।বাধ্য হয়ে তিতিরকেও বলতেই হচ্ছে।
তিতিরের দারুণ হিন্দী শুনে সুদর্শন আর নিজের হাসি ধরে রাখতে পারছে না।
ব্যাপারটা গাড়ীর লুকিং গ্লাসে খেয়াল করে তিতির গুম গুম করে দুটো কিল মারলো সুদর্শনের পিঠে।সুদর্শনের মুচকি হাসি এবার অট্টহাস্যে বদলে গেলো।তিতির নিজেও হেসে ফেললো।
হোটেলে ফিরে ফ্রেস হয়ে দুজনেই ব্যাগ গোছাতে শুরু করলো।সকালেই বাসে করে চণ্ডীগড়।ওখান থেকে ট্রেনে হাওড়া।
সুদর্শন বললো,’ফিরে গিয়েই ডিভোর্স চাই তাইতো?’।তিতির ছোট্ট করে বললো,’হুম’।
‘ডিভোর্স নেওয়ার পর বিয়ে করে নিও তোমার মনের মতো কাউকে’,সুদর্শনের কথায় তিতির হেসে বললো,’বিয়ে করবো কে বললো?’।
‘তাহলে ডিভোর্স চাইছো কেন তিতির?’সুদর্শনের কথায় ওর ভিতরের যন্ত্রণা ফুটে উঠেছে।তিতির কোন উত্তর দিলোনা।শুধু হাত বাড়িয়ে সুদর্শনের চুলটা ঘেঁটে দিলো।
সুদর্শন তিতিরের হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,’ডিভোর্সের পরের প্ল্যানিং টা তো জানাবে’।তিতির বললো,’পড়াশোনাটা কন্টিনিউ করবো হোস্টেলে থেকে,চাকরীর পরীক্ষা গুলোও দিতে থাকবো।তোমাদের বাড়ীতে থেকে সেসব হবেনা’।
সুদর্শনের ব্যথিত দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললো,তুমি বিয়ে করে নিও’।
সুদর্শন বললো,’একবার করেছি তো,আর নয়।তবে তোমায় আমার জন্য আটকাবো না।তুমি নিজের স্বপ্ন পূরণ করো।
তিতির চুপ করে আছে দেখে সুদর্শন বললো,’আমি কিন্তু ডিভোর্সের পরও তোমার সাথে যোগাযোগ রাখবো,তুমি ভালো আছো দেখলে ভালোই লাগবে আমার’।
তিতির কোন উত্তর না দিয়ে ছোট্ট করে হাসলো।
সুদর্শন বললো,’চলো ছাদে হেঁটে আসি’।তিতির জ্যাকেটটা চাপিয়ে ওর পিছন পিছন ছাদে গেলো।
সুদর্শন বললো,’বাড়ীতে যখন তুমি ঘুমিয়ে থাকতে,আমি ছাদে গিয়ে ঘুরতাম।মাঝেমাঝে মনে হতো তুমি ঘুম ভেঙে আমায় বিছানায় না দেখে ছাদে চলে আসবে।আমরা একসাথে বসে অনেকটা সময় গল্প করে কাটাবো’।
একটু থেমে বললো,’কিন্তু তুমি আসোনি কখনো।জানো তিতির জীবন বড়ো হোক চাই না,শুধু চাই দামী কিছু মুহুর্ত।চোখ বোজবার সময় সেই মুহুর্ত গুলো নিয়ে ভাবতে চাই’।
‘তিতির তোমার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহুর্ত আমার কাছে মূল্যবান,ভীষন ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়’।
সুদর্শনের কথা বলতে বলতে গলা ধরে যাচ্ছিলো।
তিতিরের নিজেকে এবার দারুণ অপরাধী লাগতে শুরু করলো।সুদর্শন কে বললো,’আপাতত ডিভোর্স কেন্সেল’।
‘প্লিজ করুণা করোনা।আমি নিতে পারিনা।একটু ইমোশনাল হয়ে পরেছিলাম মাত্র।তুমি ফিরে গিয়েই তোমার কাঙ্ক্ষিত সইটা পেয়ে যাবে।আমি গিয়েই ব্যবস্থা করবো মিউচুয়াল ডিভোর্সের’।
সুদর্শনের কথায় তিতির কি খুশী হতে পারলো!
এর উত্তর তিতিরেরও জানা নেই।
তবে সুদর্শনকে ছুঁয়ে আসা এক ঝাঁক মলয় বাতাসের পাগলামি তিতিরকেও ছুঁয়ে গেলো।শিরশির করে উঠলো তিতিরের শরীর,ওর গোলাপি আমন্ত্রনী ঠোঁট,অমাবস্যা চুল।
তিতির বললো,’নীচে চলো,খুব ঠান্ডা ছাদে’।সুদর্শন বললো,’তুমি যাও আমি একটু পরেই আসছি’।তিতির একাই নীচে চলে আসতে পারতো।কিন্তু সুদর্শনের মনের অবস্থা দেখে সেটা করলো না।
তিতির সুদর্শনের দিকে এগিয়ে গিয়ে জোর করে নিজের দিকে ওর মুখটা ফেরালো।অবাক হয়ে দেখলো,সুদর্শনের বন্ধ চোখ থেকে অঝোরে জল পরছে।
সুদর্শনের মুখটা দুহাতের মধ্যে তুলে নিয়ে, সামনের দিকের পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে, সুদর্শনের চোখের পাতার ওপর ঠোঁট ছোঁয়ালো তিতির।গালের গড়িয়ে পরা জল শুষে নিতে থাকলো ঠোঁট দিয়ে।সুদর্শন নিজের বুকে চেপে ধরলো তিতিরের মাথাটা।প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে যেতে থাকে তিতির,ভিজে যেতে থাকে সুদর্শন।(চলবে)