#তিতির পাখির বাসা (পর্ব-১৮)
#জয়া চক্রবর্তী।
দিনটি একটা অন্যরকম ভালো লাগা ছুঁয়ে ছুঁয়ে কেটে গেলো তিতিরের।এখন রাতের অবসরে এলোমেলো ভাবনার অগোছালো মনটাকে একটু গুছিয়ে নিতে চায় তিতির।
‘কীগো কিছু খাবে না নাকি তুমি?সেই কখন থেকে বলে যাচ্ছি ডিনারটা সেরে নাও,গ্রাহ্যই করছো না’।সুদর্শনের কথায় তিতির বাঙ্ক থেকে মুখ ঝুঁকিয়ে তাকালো।
দুষ্টু হাসি হেসে বললো,’এই মুহুর্তে আমি যা খেতে চাইবো খাওয়াতে পারবে আমায়?’
সুদর্শন বললো,’এটা ট্রেন ম্যাডাম,রেস্টুরেন্ট নয়।তবু শুনি কি খেতে চাইছেন আপনি?চেষ্টা করে দেখতে পারি’।
‘শশা-পেঁয়াজ-কাঁচালঙ্কা -ধনেপাতা কুচি,সেদ্ধ ছোলা,বাদাম ভাজা,চানাচুর,সর্ষের তেল আর চাট মশলা দিয়ে মাখা মুড়ি সঙ্গে গরম গরম আলুর চপ আর পেঁয়াজি’,এক নিশ্বাসে বলে গেলো তিতির।
সুদর্শন হেসে বললো,’না ম্যাডাম এই রাত সাড়ে এগারোটায় ছুটন্ত ট্রেনে সেটা সম্ভব নয়।কিন্তু মনে রাখলাম,নিজের হাতে মেখে খাওয়াবো।এখন অন্তত কেকটা খাও’।
তিতির নীচু হয়ে হাত বাড়িয়ে কেকের প্যাকেটটা নিলো।সুদর্শন এবার নিশ্চিন্ত মনে নীচের বাঙ্কে শুয়ে পড়লো।
তিতিরের চোখে ঘুম নেই।পায়ে পায়ে একনাগাড়ে ভালো খারাপ মুহূর্তরা ভিড় জমাচ্ছে মনে।আর মাত্র একটা রাত।
তিতিরের খুব ইচ্ছে করছে ট্রেনটা উল্টোদিকে চলুক।খুব ইচ্ছে করছে সুদর্শনকে নিয়ে ফিরে যেতে পাহাড়ে।
ইচ্ছে করছে পাশাপাশি বসে থেকে খাদের ভিতর পা ঝোলাতে।
হাতের মুঠোয় থাকবে হাত।
চুপ কথারা আঙুল ছুঁয়ে নিজেরাই কথা বলে নেবে পরস্পর।জন্মান্তরের শব্দরা মুক্তি পাবে নিবিড় অন্তরঙ্গতায়’।
‘কি হলো ঘুমোওনি পাখি?’তিতির তাকিয়ে দেখলো সুদর্শন বাঙ্কে উঠবার অর্ধেক সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে।হেসে বললো,’ঘুম আসছেনা আমার,কিন্তু তুমি কেন ঘুমোওনি?সুদর্শন বললো, ‘ঘুমটা আমারো আসছে না’।
‘তুমি চাইলে ওপরে আসতে পারো,আমরা গল্প করবো’।সুদর্শন বললো,’বাকীদের অসুবিধে হবে।সবাই তো আর তোমার মতো রাত জাগা পাখি নয়’।
‘রাত জাগা পাখি তো পেঁচা।আমাকে পেঁচা বলতে চাইছো কি?’তিতিরের কথায় সুদর্শন গম্ভীর মুখে বললো,একদম নয়,তোমাকে পেঁচী বলতে চাইছি।পেঁচা পুংলিঙ্গ’।তিতির বললো,বেশ তাহলে পেঁচীর সাথে কথা বলতে হবেনা।তুমি ঘুমোও গিয়ে’।
সুদর্শন কথা না বাড়িয়ে উঠে এসে বসলো তিতিরের পাশে।তিতিরের নাকটা ধরে নাড়িয়ে দিয়ে বললো,রাগ তো সবসময় নাকের ডগায় থাকে’।তিতির এক ঝটকায় সুদর্শনের হাত সরিয়ে বললো,’বেশ’।
‘আচ্ছা তখন কোথায় চলে গিয়েছিলে আমায় ফেলে?’তিতিরের প্রশ্ন শুনে সুদর্শন খানিক চুপ করে থেকে বললো,’কোথায় আর যাব?আসলে ঠিক নিতে পারছিলাম না ব্যাপারটা’।
তিতির অবাক মুখে জানতে চাইলো,’কোন ব্যাপারটা বলোতো?’
সুদর্শন বললো,’বুঝতে পারছিলাম তুহিনের গান,আবৃত্তি সব কিছুই তোমাকে কেন্দ্র করে’।
একটু থেমে বললো,’আগে পাত্তা দিচ্ছিলাম না কারন তুমিই বলেছিলে তোমার ওর প্রতি কোন ফিলিংস নেই।কিন্তু আজ তোমার চোখে ওর প্রতি মুগ্ধতা আমাকে কষ্ট দিচ্ছিলো’।
‘তাই?সেতো কারো কিছু গুন আছে দেখলে আমি এমনিতেই প্রশংসা করি।মুগ্ধ হই।তারমানে এই নয় যে তার প্রতি আমার বিশাল ফিলিংস জন্মে গেছে’।
সুদর্শন বললো,’তুহিন ছেলেটা বড্ড ভালোবাসে তোমায়’।
‘হ্যাঁ আর সেই ভালোবাসার কথাটা সে কখন জানালো?যখন আমি অন্য কারোর স্ত্রী।ডিসগাস্টিং’।একটু থেমে তিতির বললো,’ছাড়ো তো ওসব।এবার নিজের কথা বলো’।
সুদর্শন বললো,’কি বলবো?
‘তুমি ভালোবাসোনা আমায়?’তিতিরের প্রশ্নে
সুদর্শন তিতিরের চোখের দিকে সরাসরি চাইলো।
তারপর দুহাত দিয়ে তিতিরের মাথাটা কাছে টেনে এনে তিতিরের কপালে নিজের কপালে ঠেকালো।তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,’ভালোবাসি-ভালোবাসি’।
কথাটা কানে যেতেই চঞ্চল হয়ে উঠলো তিতিরের শিরা ধমনী, রিনরিন করে বেজে উঠলো দেহতন্ত্রী।বুক জুড়ে শিরশিরানি অনুভব।তিতির আবেশে চোখ বুজে ফেললো।
তিরতির করে কাঁপছে তিতির।সুদর্শন বললো,’এটা পাবলিক প্লেস ম্যাডাম।আপনি চাইলেও আমি কিন্তু…..’
তিতির চোখ খুলে বললো,’আমি আবার কি চাইলাম?’সুদর্শন বললো,বুঝি ম্যাডাম সবই বুঝি’।তিতির হেসে বললো,’কচুপোড়া বোঝো তুমি’।
‘ভাবছিলাম বাড়ীতে কথা বলে কালকেই তোমাকে তোমার বাড়ীতে রেখে আসবো’,সুদর্শনের কথায় অবাক হয়ে তিতির বললো,’রেখে আসবে মানে?’
‘দেখো আমাদের বাড়ীতে থেকে তোমার স্বপ্ন পূরণ হওয়ার নয়।একান্নবর্তী পরিবার।নানা জনের নানা মতামত।তার চাইতে নিজের বাড়ীতে থেকে পড়াশোনাটা কন্টিনিউ করো।চাকরীর পরীক্ষায় বসো’।
একটু থেমে বললো,’আমি বরং প্রতি সপ্তাহে গিয়ে দেখা করে আসবো’।
সুদর্শনের কথায় তিতির বললো,আমি পড়াশোনার পাঠ শেষ করে চাকরীর পরীক্ষায় বসলে তোমার কোন সমস্যা নেই তো?’
সুদর্শন বললো,একদমই নয়।প্রতিটি মেয়েরই উচিৎ নিজের পায়ে দাঁড়ানো।তিতির হেসে বললো,’তাহলে আর চিন্তা নেই আমার।আমি তোমাদের বাড়ীতে থেকেই সব করবো’।
একটু থেমে নিয়ে তিতির বললো,’তবে একটা কথা,তোমার বাড়ীর লোকজন আমায় কখনো কিছু বললে,তুমি কিন্তু আমার হয়ে তাদের সাথে কথা কাটাকাটি করতে যাবেনা।সেটা আমি বুঝে নিতে পারবো’।
‘এবার একটু ঘুমিয়ে নাও।নাহলে শরীর খারাপ হবে।আমি নীচে যাচ্ছি’,তিতির মাথা নেড়ে সম্মতি জানালে সুদর্শন নীচে নেমে গেলো।
তিতির হাওয়া বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পরলো।ঘুমিয়েও পরলো কিছু সময়ের মধ্যে।
‘পাখি ট্রেন এখুনি হাওড়া স্টেশনে ঢুকবে,উঠে পড়ো’।সুদর্শনের বেশ কয়েকবার ডাকে তিতির আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো।তারপর চোখে রাজ্যের ঘুম নিয়ে বাঙ্ক থেকে নীচে নামলো।
সুদর্শন বললো,’তুমি ফ্রেস হয়ে নাও।আমি ব্যাগ গুছিয়ে নিই’।তিতির টয়লেটের দিকে যেতেই সুদর্শন ব্যস্ত হাতে ব্যাগ গোছাতে শুরু করলো।
তিতির ফ্রেস হয়ে এসে ব্যাগ থেকে চিরুনি বের করে চুল আঁচড়ে নিলো।মুখে ক্রিম লাগিয়ে,হাল্কা লিপস্টিক বুলিয়ে নিলো।সুদর্শনের দিকে তাকিয়ে বললো,’আমি রেডি’।
সুদর্শন বিস্কুটের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললো,’খেয়ে নাও’।
‘
‘এতো জ্বালাও কেন তুমি আমায়?’তিতিরের কথায় অবাক সুদর্শন,’সেকি আমি আবার কখন জ্বালালাম?’
‘সারাক্ষণ শুধু পাখি খেয়ে নাও,পাখি ঘুমিয়ে নাও,আমি নিজেরটা বুঝি বুঝলে।খিদে পেলে অবশ্যই খাবো’।
তিতিরের কথা শেষ হতেই সুদর্শন বললো,’তোমার বলা শেষ?নাকি আরো কিছু বলবে এই বিষয়ে?বললে বলে নাও আমি শুনছি।বলা শেষ হলে বিস্কুটটা খাও,আমি জলের বোতল দিচ্ছি’।
তিতির রাগ রাগ মুখে বিস্কুট চিবোতে শুরু করলো।সুদর্শন হাসি চেপে জলের বোতল এগিয়ে দিলো।(চলবে)