তিতির পাখির বাসা পর্ব-২১

0
555

#তিতির পাখির বাসা(পর্ব-২১)
#জয়া চক্রবর্তী।

দুপুরে খাওয়ার টেবিলে বসে অনুশ্রী তিতিরকে বললো,’তিতির তোমাকে জানানো হয়নি,কাল রাতের ট্রেনে আমরা সবাই মিলে শিলিগুড়ি যাচ্ছি।ওখানে একদিন থেকে দার্জিলিং কালিম্পং হয়ে লক্ষ্মী পূজোর আগের দিন সকালে ফিরে আসবো’।

তিতির উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলো,’বাহ দারুণ খবর মামনি।ভালো করেছো আগে থেকে না বলে।আমার সারপ্রাইজ পেতে খুব ভালো লাগে।আমি আজ রাতেই প্যাকিং সেরে নেবো’।

একটু থেমে বললো,’অবশ্য আগে জানা থাকলে গতকালই ক্লাস করিয়ে সংশপ্তকে পূজোর ছুটি দিয়ে দিতাম’।

‘তুমি আর বাবিন তো বাড়ীতেই থাকছো।ওদের বরং আগামীকালই ছুটিটা দিও’,কাকিয়ার কথা আর মুখের তির্যক হাসিতে তিতিরের মুখ শুকনো হয়ে গেলো।বললো,’মামনি যে বললো আমরা সবাই যাচ্ছি।সবাইএর মধ্যে বুঝি আমি নেই?’

‘বাড়ী পুরো খালি রেখে কি যাওয়া যায়?বাবিন জব্বলপুর থেকে কালকেই ফিরবে।বাবিন আর তোমার ভরসাতেই তো বাড়ী রেখে যাচ্ছি’,মামনির কথার কোন উত্তর দিলোনা তিতির।চুপচাপ খেতে থাকলো।

মামনির ওপর অভিমানে ওর ভীষণ কান্না পাচ্ছে।ভাত গলা দিয়ে যেন নামতেই চাইছে না।অথচ একটু আগেও খিদে পেয়েছিলো খুব।

এই তো গত রবিবার মামনিকে নিয়ে গিয়ে প্রমীলা সহ পাঁচজন দুস্থ ছাত্রছাত্রীর জন্য পূজোর জামাকাপড় কিনে আনলো তিতির।

সংশপ্তকের টাকাপয়সার হিসেবের ভারটাও আজকাল মামনির ওপরেই থাকে।

মামনির সাথেই যা কিছু গালগল্প ওর।সেই মামনি ওকে না নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছে এই ব্যাপারটাই হজম হচ্ছেনা তিতিরের।

রান্নাঘরের পর্ব কোনরকমভাবে মিটিয়ে তিতির চুপচাপ ছাদে এসে দাঁড়ালো।ঝড় আসবে মনে হচ্ছে। এলোপাথাড়ি হাওয়ায় তিতিরের চুল অবিন্যস্ত।এই মুহুর্তে ওর খুব মন কেমন করছে বাড়ীর জন্য।

যদিও মাস চারেক আগে মামনির উদ্দ্যোগে বাপের বাড়ী থেকে একা একাই ঘুরে এসেছিলো তিতির।

সেদিনও ফিরবার সময় ট্রেনের জানলা দিয়ে দমকা হাওয়ার ঝাপটা এসে তিতিরের চুল গুলোকে ঘেঁটে দিচ্ছিলো বারবার ।

ও বারবার আঙুলের শাসনে চুল গুলোকে পোষ মানাতে চাইছিলো। হাওয়াটায় সোঁদা গন্ধ ছিলো।
হয়তো বৃষ্টি হচ্ছিলো কোথাও!

কোথায় বৃষ্টি হচ্ছে! কত দূরে! দূরে, নাকি খুব কাছাকাছি! হয়তো ওর আঁচলের নীচেই!

ওর যদি দুটো পালক থাকতো, তাহলে তো ও তক্ষুণি উড়ে চলে যেতে পারত ওই জলভরা মেঘ গুলোর কাছে!

সেদিন সন্ধ্যার ভাললাগা টা অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হয়ে ওর বুকের উঠোন বানভাসি হয়ে গিয়েছিলো।

ভাবতে ভালো লাগছিলো যে, সুদর্শনের সময়ের ওপর আর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে না তিতিরকে।মামনির প্রতি কৃতজ্ঞতায় তখন মাথা নত হয়ে আসছিলো তিতিরের মন।

কারন এবার থেকে তিতির একাই পারবে বাড়ীতে গিয়ে মা-বড়মার আঁচলের গন্ধে সমস্ত মেয়েবেলাকে ফিরে পেতে। বাবার বুকে মাথা রেখে সমস্ত ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে । অথবা উঠোনের যমজ কাঁঠাল গাছটার নিচে এসে সেই আগের মতো একলা হতে।

সেদিন তিতির বাড়ী ঢোকবার পর মামনি নিশ্চিন্তে হয়ে টিভি সিরিয়ালে মনোনিবেশ করেছিলো।

ভালো লাগার রেশ নিয়ে রাতের রুটি বানাবে বলে তিতির রান্নাঘরের বেসিনে গিয়ে হাত ধুয়ে ভিজে হাতে একফোঁটা হ্যান্ড ওয়াশ নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতেই, দুহাত ভর্তি নরম ফেনা ভরে উঠেছিলো।এই ফেনিল কোমলতা খুব ভালো লাগে তিতিরের।

তখনই গ্রানাইটের স্ল্যাবের ওপর লোহার চাটুটা বোধহয় একটু বেশিই জোড়ে আছড়ে পড়েছিলো।ধাতব শব্দের আতিশয্যে সম্বিত ফিরে পেয়েছিলো তিতির। তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে ও গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো ওভেনের কাছে।

‘কাকিয়া তুমি সরে এসো। আমি রুটি বানাবো বলেই ড্রেস চেঞ্জ না করে আগে রান্নাঘরে এসেছি’।তিতিরের কথায় কাকিয়া বলে উঠেছিলো,’হ্যাঁ মা উদ্ধার করেছো।বাইরের জামাকাপড়ে তোমায় আর রুটি করতে হবেনা। চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে খেতে এসে ধন্য করো দেখি’।

তিতির বুঝতে পারেনা কাকিয়ার ওর ওপর এত রাগ কেন! তিতির রান্নাঘরে আর না দাঁড়িয়ে ঘরে চলে এসেছিলো।তারপর গোলাপি রঙের নাইটিটা ঘর থেকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকেছিলো।

বৃষ্টিরা যখন শাওয়ার থেকে ইচ্ছের ধারা হয়ে নেমে এসে ভিজিয়ে দিয়েছিলো ওর সারাটা শরীর।
ও গুনগুন করে গাইছিলো,
“যে রাতে মোর দুয়ার গুলি ভাঙল ঝড়ে
জানি নাই তো তুমি এলে আমার ঘরে..”

সেদিন গভীর রাত পর্যন্ত দুজন ছাদে কাটিয়ে বেডরুমে আসবার পর সুদর্শন তিতিরের চুল গুলোকে নিয়ে খেলা করতে করতে বলেছিলো, ‘পাখি আর একবার গাইবে ওই গানটা, যেটা তোমার বাড়ী থেকে ফিরবার পরে তুমি বাথরুমে গাইছিলে’।

তিতির লজ্জা পেয়ে বলেছিলো,’ধ্যাত’।
তারপর নিজের বাঁ হাতে সুদর্শনের গলাটা জড়িয়ে ধরে চোখ বুজেছিলো পরম নিশ্চিন্তে। সুদর্শনও হাত বাড়িয়ে বেডসুইচ টিপে নিভিয়ে দিয়েছিলো ঘরের দৃশ্যমানতা।

পরের দিন,’হে নূতন দেখা দিক আরবার
জন্মের প্রথম শুভক্ষণ..”
মাইক থেকে ভেসে আসা সুর তরঙ্গে চোখ খুলেছিলো তিতির-সুদর্শন।

সেদিন ছিলো পঁচিশে বৈশাখ।

সুদর্শন বলেছিলো,’দেখো পাখি,কবিগুরুর গান,কবিতা ছাড়া হৃদয়ের সঠিক ভাবটি ভাষায় প্রকাশ করা সত্যিই বড়ো কঠিন’,তিতির সুদর্শনের কথায় সম্মতি জানিয়ে বলেছিলো,’একদম ঠিক বললে।কবিগুরুর বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন আবেগ উপাচার হিসেবে যেন তুলে দিয়েছেন আমাদের হাতে’।

সুদর্শন বলেছিলো,’রবীন্দ্রনাথের বৈশিষ্ট্যই হলো, তাঁর ভাব গভীরতা,গীতিধর্মিতা,আধ্যাত্মচেতনা,বাস্তবচেতনা,প্রগতিচেতনা,ঐতিহ্যপ্রীতি’।

তিতির সুদর্শনের কথার রেশ ধরে নিয়ে বলে গিয়েছিলো,’তাঁর প্রকৃতি প্রেম,স্বদেশ প্রেম,বিশ্বপ্রেম,মানবপ্রেম,রোমান্টিকতা, সৌন্দর্য্য চেতনা,ভাব,ভাষা,ছন্দ আঙ্গিকের বৈচিত্র্য। সবেতেই তিনি এক এবং অদ্বিতীয়’।

সুদর্শন বলেছিলো,’জানো তিতির আগে পাড়া থেকে প্রভাতফেরীতে যেতাম।এখন আর কাজের চাপে সময় হয়ে ওঠেনা’।

তিতির বলেছিলো,’আমি কিন্তু আজ একটা ছোট্ট ঘরোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি আমাদের ছাদে।সংশপ্তকের সবাই,আশেপাশের বাড়ীর কয়েকজন আর আমাদের বাড়ীর সবাই।তুমি থাকছো কিন্তু’।

সুদর্শন খুশী হয়ে বললো,’ওমা তাই নাকি!’
তিতির মাথা নাড়িয়ে বলেছিলো,’আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার।মামনি বলেছে বাবাই আর দুই কাকাইকে ছাদে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব মামনির’।

সুদর্শন বলেছিলো,’তাহলে পাখি একবার বাজারটা ঘুরে আসি’,তিতির অবাক হয়ে বলেছিলো,’বাজার তো করাই আছে।তুমি আবার কি আনবে বাজার থেকে?’

সুদর্শন বলেছিলো,’আমি কিছু নারকেল আর মুড়ির প্যাকেট কিনে আনি’।
তিতির বলে উঠেছিলো,’কি হবে তাতে?’

একটু থেমে বললো,
‘তুমি শিউলিদিকে বলে দিও বিকেলে এসে নারকেল কুঁড়িয়ে দিয়ে যেতে।
ভাবছি যারা আসবে তাদের সবাইকে ঘি দিয়ে মুড়ি মেখে নারকেল কোড়া আর চিনি দিয়ে বাটি চামচ ধরিয়ে দেবো’।

তিতির উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলো,’দারুণ আইডিয়া।তাহলে রসগোল্লাও এনো।সঙ্গে দুটো করে মিষ্টিও দেওয়া যাবে’।

সন্ধ্যে হতেই ধীরে ধীরে সুদর্শনদের ছাদ ভরে উঠেছিলো।ছাদের একদিকে তিতিররা ছিলো আর একদিকে দর্শকরা।

মাথার ওপর ত্রিপল টানিয়ে নীচে তক্তপোশ এর ওপর কার্পেট পেতে স্টেজ মতো বানানো হয়েছিলো ছাদের একপাশে।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে উদ্বোধনী সংগীত গেয়েছিলো সেদিন অনুশ্রী,
“তোমার কথা হেথা কেহ তো বলেনা,
করে শুধু মিছে কোলাহল।
সুধাসাগরের তীরেতে বসিয়া,
পান করে শুধু হলাহল”।

গানটা অনুশ্রীর গলায় দারুণ জমে গিয়েছিলো।কৌশিক পর্যন্ত চোখ বুজে শুনছিলো অনুশ্রীর গান।

অনুশ্রীর পরে সংশপ্তকের বাচ্চারা গানে,কবিতায়,নাটকে মাতিয়ে দিয়েছিলো সান্ধ্য আসর।সেদিন বাচ্চাদের মায়েরাও এসেছিলো ওদের সাথে।

অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে তিতির কখনো ঘোষিকা,কখনো আবৃত্তিকার,কখনো গায়িকার ভূমিকায় ছিলো।

অনুষ্ঠানের ফাঁকেই সুদর্শনের উদ্দ্যোগে দর্শকদের হাতে উঠে এসেছিলো ঘিয়ে মাখা মুড়ির সাথে নারকেল কোড়া-চিনি-মিষ্টি।

অনুষ্ঠানের মাঝেই তিতির লক্ষ্য করেছিলো কাকিয়া,অর্না,পর্নাকে অনুরোধ করে ছাদে আনবার পরেও ওরা তিনজনেই কখন যেন অনুষ্ঠান ছেড়ে চলে গিয়েছিলো।

না তিতির তা বলে দুঃখ পায়নি।কারন তিতিরের মামনি আর সুদর্শন পুরো সময়টা তিতিরের ছায়াসঙ্গী হয়ে তিতিরকে সাহায্যই করে গিয়েছিলো।

সেই মামনি কাল তিতিরকে ছেড়ে বেড়াতে যাচ্ছে শুনে মন তো খারাপ হবেই তিতিরের।(চলবে)

(পরের পর্ব আগামীকাল সকাল সাতটায়। এবং তারপর প্রতি ঘন্টায়। কালকে শেষ হবে উপন্যাসটি।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here