#তিতির_পাখির_বাসা(৪পর্ব)
#জয়া_চক্রবর্তী
বেলা করেই ঘুম ভাঙলো তিতিরের।না আজ আর কেউ তাকে আদর করে ঘুম ভাঙায়নি।ঘড়ির কাঁটাটা দশটা ছুঁই ছুঁই।তারমানে বাসি ঘরেই বেড়িয়ে গেছে সুদর্শন।
তিতির মুক্তির আকাশ দেখতে চাইলো,কিন্তু….
উধাও জানলার এপারে দাঁড়িয়ে,কিভাবে দেখবে আকাশ??বিষন্ন মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে তিতির,কোথায়ই বা পাবে যমুনার নীল জল?কিকরেই বা ভাসাবে,মনের নৌকো??
রাতপোশাকটা চটপট বদলে ব্রাশ করেই তিতির রান্নাঘরের দিকে ছুটলো।একটু পরেই বুঝলো,একরাতেই সবকিছু বদলে গেছে।
আজ আর রান্নাঘরে ঢোকবার আগে বাবা (শ্বশুর মশাই)তাকে সুপ্রভাত জানায়নি,চায়ের ফ্লাক্স এগিয়ে দিয়ে চা খেতেও বলেনি মামনি,আজ তো এক গামলা আটা দিয়েও তাকে মাখতে বলেনি কাকিয়া,বলেনি সবজি কুটে,বাটনা বেটে দিতে।
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে তিতির নিজেই জিজ্ঞেস করলো,তাকে কি করতে হবে?তারপর উত্তর না পেয়ে ফ্লাস্ক থেকে চা ঢেলে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।যেতে যেতেই পিছন ফিরে তাকিয়ে একবার দেখে নিলো,ভ্রুক্ষেপহীন খাপছাড়া চেহারাগুলো।
মনে মনে নিজেকে বললো,ভালোই হয়েছে।মাঝেমাঝেই তিতিরের কাজের অক্ষমতা নিয়ে প্রতিবেশীদের সাথে হাসাহাসি করতে দেখেছে মামনি আর কাকিয়াকে।এমনকি ফোনেও তাকে নিয়ে গাল ভরা গল্প শোনাতে শুনেছে।সত্যি বলতে কি,এসব শুনে ভীষন কষ্ট পেয়েছে তিতির।ডুবে গেছে নিজস্ব বিষাদে।বুক টান টান করা অনুভব সম্বিৎ ফিরে পেতেই ফুসফুস খালি করে বেড়িয়ে এসেছে দীর্ঘশ্বাস।
সুদর্শনকে এসব কিছুই জানায়নি তিতির,শুধু ভেবেছে যে,তিতিরের বাড়ির লোক সম্পর্কে যদি সুদর্শন কিছু বলতো, তাহলে কতটা বেশী খারাপ লাগতো তিতিরের।
আচ্ছা কি করে নিখুঁত কাজ করতে পারবে তিতির?বিয়ের আগে কি সে ঘরকন্নার কাজ শিখেছিলো?পড়াশোনা,গান,নাটক নিয়েই তো ব্যস্ত ছিলো সে।তবুও তো এই তিন মাস ধরে সব কাজ শিখে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে।অপটু হাতে কাজ ভুল হয়ে যাচ্ছে, সময়ে শেষ হচ্ছেনা।কিন্তু কি করতে পারে তিতির?মাঝেমাঝে ভাবে,তার না পারা গুলো নিয়ে সবাই এতো আলাপ-আলোচনা করে,কিন্তু তিতির যে কাজগুলোতে পারদর্শী, সেগুলো নিয়ে এদের কোন মাথা ব্যথাই নেই।
অথচ এরাই কাগজে ফলাও করে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলো,গান জানা,সুন্দরী,শিক্ষিতা, সংস্কৃতিমনা পাত্রী চাই।তিতির তো এখনো পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেনি বিজ্ঞাপনের সেই সব চাহিদার কারন!!
তিতিরের পরীক্ষার ফলাফলে যে সবাই খুব খুশি হয়েছে,তেমনটাও মনে হয়নি তিতিরের।বন্ধুরা যখন রেজাল্টের খুশিতে পার্টি করছে,তিতির তখন এক গামলা আটা ঠেঁসে ঠেঁসে মেখে সকলের জন্য একাঁ বেঁকা রুটি বানিয়েছে।
টুকরোটুকরো মনখারাপ গুলো কাউকে জানাবারও সুযোগ নেই তিতিরের
।সেবার মাকে জানাতেই তিতিরকে জ্ঞানের কথা শুনতে হয়েছে,মা বলেছে,”কেউ নিন্দে করলেই যেমন তুমি খারাপ হয়ে যাবেনা, তেমনি প্রশংসা করলেও ভালো হয়ে যাবে এমন নয়…কে-কখন-কাকে-কি বললো,সেসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে কাজ গুলো শিখে নাও”।
মা তো বলতেই পারে,অনেক কিছুই মুখে বলা সহজ।তার চাকরী করা মা কি করে বুঝবে যে দুটো করে মোচা,দুটো করে এঁচোড় কাটা মুখের কথা নয়,মিক্সি ছাড়া মিহি করে মটরডাল কি তার মা বেটেছে কখনো?বড় এক গামলা আটা ঠেঁসে ঠেঁসে নরম করে মাখতে তার মা থোড়াই পারবে।
আরো এমন অনেক কাজের লিস্ট মনেমনেই বানাতে বসলো তিতির,যেগুলো করতে তার মাও হিমসিম খেয়ে যাবে।একান্নবর্তী পরিবারের কাজ যে কতো শক্ত তার মা কি করে জানবে?চা এর কাপে চুমুক দিয়েই তিতির বেসিনে গিয়ে থুঃ থুঃ করে ফেলে দিয়ে আসলো,এসব এলোপাথাড়ি চিন্তার মাঝে চা জুড়িয়ে কখন ঠান্ডা জল হয়ে গেছে।
এক ফাঁকে বাবাও একবার শুনিয়েছিলো তিতিরকে,”adjustment is the best policy to maintain your family peace”….অথচ স্বপ্নপূরণ করতে হলে গ্র্যাজুয়েশনেই থেমে থাকলে চলবে না,আরো অনেক পড়াশোনা করতে হবে তিতিরকে।কিন্তু এরা তো পড়াতেই চাইছেনা।চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো তিতরের।
জোড় করে অন্যের বাড়িতে বিনে মাইনের পার্মানেন্ট ‘হাউজ-ওয়াইফ’ পদের চাকরীতে বহাল করিয়ে তার বাবা-মা যে কি সুখ পেলো,সেটাই তিতিরের কাছে পরিষ্কার নয়।কিন্তু এই বিনে মাইনের চাকরীই যদি সে করবে তাহলে কি দরকার ছিলো তাকে পড়াশোনা শেখাবার?কি দরকার ছিলো গান শেখাবার-নাটক করতে দেওয়ার?তিতিরের নিজের জীবনই আজ চলমান নাটক।
কতদিন যে তিতির গল্পের বই পড়েনি,কতদিন যে তানপুরা নিয়ে রেওয়াজে বসেনি।এরা খিল্লি বানিয়ে ছেড়েছে তিতিরের জীবনটাকে।
হয়তো বদলে যাওয়াটাই নিয়তি,বদলে যাওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ।মা-বাবাও চেয়েছে বদলে যায় তিতির।
ভালো থাকে,খুশী থাকে,আনন্দে থাকে এসব কিছুই নয়।শুধু যেন সব কিছু মেনে নেয়।
সব কিছু মেনে নিয়ে বদলে নেয় নিজেকে।
সেই কবে থেকে বদলাচ্ছে তিতির,স্পার্ম থেকে ভ্রুণ,ভ্রুণ থেকে মাংসপিণ্ড,মাংসপিণ্ড থেকে মানবশিশু।তারপর তো শরীর বড়ো হওয়ার সাথে সাথে মনের বদল ঘটেছে নিরন্তর।বদলে গিয়েছে তিতির।কখনো নিজেরজন্য,কখনো সবার জন্য।
গিরগিটি দেখেও ইদানীংকালে ভয় পায় তিতির।না আর নয়,আর বদলানো নয়।সিদ্ধান্তটায় অটুট থাকতে হবে।মিউচুয়াল ডিভোর্স নিয়ে,গিয়ে উঠবে কোন লেডিস হোস্টেলে,গয়নাগাটি বেচে পাওয়া টাকা ব্যাংকে রাখলে যা সুদ পাবে,তাতে নিশ্চিন্তে পড়াশোনাটা শেষ করতে পারবে,কন্টিনিউ করতে পারবে নাটক,গান।চাকরীর পরীক্ষাগুলোতেও এরপর নিয়মিত বসতে হবে তিতিরকে,জানে যতটা সহজ ভাবছে তত টা সহজ হবেনা ,অনেক সংগ্রাম করতে হবে তিতিরকে।
তবু কাঁটা বেছানো পথে চলেই তাকে ফুলের বাগানে পৌঁছোতে হবে,অন্ধকার রাস্তা দিয়েই হেঁটে পৌঁছোতে হবে আলোর সীমানায়।
হঠাৎ হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো সুদর্শন।তিতিরের দিকে একবার ও না তাকিয়েই ঢাউস ব্যাগ দুটো আলমারি থেকে নামিয়ে ব্যস্ত হাতে গোছাতে শুরু করলো,নিজের আর তিতিরের জামাকাপড়।
তিতির অবাক চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জানতে চাইলো,আমরা কি কোথাও যাচ্ছি?? ছোট্ট হেসে সুদর্শন বললো,”স্যরি পাখি আগে জানাইনি,আজ রাতেই ট্রেন,যাচ্ছি সিমলা কুলু মানালি,ফর হানিমুন..(চলবে)