#তিতির_পাখির_বাসা(পর্ব ৫)
#জয়া_চক্রবর্তী
রাত ৭টা৪০মিনিট নাগাদ হাওড়া থেকে কালকা মেইল ছেড়েছে।দেখতে দেখতে প্রায় দেড়ঘন্টা হতে চললো।সুদর্শনের তিতির পাখিটি কিন্তু ঠায় জানলার ধারে বসে।অবাধ্য চুল গুলো হাওয়ায় উড়ছে,মাঝেমাঝেই অলস হাতে কপাল থেকে চুলের গোছা সরাচ্ছে।পাতলা ঠোঁট দুটো অল্প ফাঁক করা।
উল্টো দিকে বসা সুদর্শনের ভীষন ইচ্ছে করছে,আঙ্গুল ছোঁয়াতে ঠোঁটে,ইচ্ছে করছে দুহাতের পাতায় মুখটা ধরে নাকে নাক ঘষে দিতে,দুষ্টুমি করে কানের লতিটা কামড়ে দিতে।ইচ্ছেগুলো গাছেদের মতো ক্রমশঃ শাখা প্রশাখা বিস্তার করে অস্থির করে তুলছে সুদর্শনকে।
আসবার সময় তো রাস্তায় কোন কথাই বলেনি তিতির।বলবে কি আসতেই তো চাইছিলো না,রীতিমতো সাধ্যসাধনা করে ম্যাডামকে রাজি করাতে হয়েছে।এমনকি একথাও সুদর্শন কে বলতে হয়েছে যে ফিরে গিয়েই ডিভোর্সের ব্যাপারে উকিলের সাথে কথা বলবে।
কথাটা মনে পরতেই সুদর্শনের চোখ জ্বালা-জ্বালা,বুক টনটন করে উঠলো।কত কথাই যে বলার ছিলো তিতিরকে।সেই সব না বলা কথা গুলো বলতে চায় সুদর্শন।বলতে চায়,
তোমার সমস্ত অভিমান নিয়ে
তুমি আছড়ে পড়ো আমার বুকে।
চারদিকে ছিটকে পড়ুক
জমে থাকা,সমস্ত পাওয়া-
না পাওয়ারা।
ঠিক যেমনটি জলরেনু
ছিটকে পড়ে পাহাড়ের বুকে,
আর তাতে খেলে যায়
রামধনু রঙ।
আমি হিমালয়ের মতো
শান্ত স্থির হয়ে,
সয়ে যাব তোমার অভিমান….
আমার না বলা কথারা সব,
তোমার অভিমানী কথার বুকে
সাঁকো বেঁধে দেবে পরম আদরে।
কিন্তু সুদর্শনের প্রকাশ কম।ও কি আদৌ এসব বলতে পারবে তিতিরকে?আর না বললেই কি তিতির কখনো বুঝে নিতে পারবে যে,সুদর্শনের মনের প্রতিটি শব্দ তিতিরের আঙুল ছুঁয়ে শুধু একটা কথাই বলে যায়,’ভালোবাসি’…..
এখন নভেম্বরের শেষ।ঠান্ডা হিমেল ভাব বাতাসে।এই সময়টাই ঠাণ্ডা লেগে যাওয়ার ভয় থাকে।জানলা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটায় শিরশির করছে গা।বেশ কয়েকবার তিতিরকে জানলা ছেড়ে সরে বসতে বললো সুদর্শন।তিতির এক চুল ও নড়লো না।
বাধ্য হয়েই তিতিরকে সরিয়ে কাঁচের জানলাটা নামিয়ে দিলো।খাওয়ারের ব্যাগটা বের করে বললো,এসো খেয়ে নিই।তিতির চুপচাপ সুদর্শনকে খাওয়ার বেড়ে দিয়ে,নিজেও একটা পরোটায় মাংস নিয়ে রোল করে আলতো কামড় দিতে থাকে।
বন্ধুদের সাথে সিমলা কুলু-মানালি ঘুরতে এসেই ঠিক করেছিলো সুদর্শন যে বিয়ের পর হানিমুনেও এখানেই আসবে।শীতকালে শ্বেতশুভ্র বরফের চাদরে আবৃত থাকে পাহাড়ের চূড়া।অসাধারণ লাগে যখন সেই চূড়ায় লুকোচুরি খেলে রোদ আর মেঘ।শুনেছিলো পূর্ণিমায় চাঁদের আলো পরলে আরো মায়াবি হয়ে ওঠে পাহাড়।তাই এমনভাবেই প্ল্যানিং করে টিকিট কেটেছিলো,যাতে মাঝে পূর্ণিমা পায়,আর হানিমুনটা স্বার্থক হয়ে ওঠে ওদের জীবনে।
কালরাতেই তিতিরের হাতে টিকিট দুটো দিয়ে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলো,কিন্তু তিতির নিজেই ওকে ভয়ঙ্কর রকমের সারপ্রাইজ দিয়েছে।
তিতির ঘুমিয়ে পরবার পর সারা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি সুদর্শন।ভেবেছিলো কেন্সেল করে দেবে টিকিট।কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বদলে নেয়।,কোন এক অজানা আশায় বুক বেঁধে।
সকাল হতেই রাতপোশাক বদলে,লেকের ধারে গিয়ে এক্সারসাইজ সারে।তারপর ওখান থেকেই সোজা চলে যায় লেক মার্কেট।দুদিনের বেশী ট্রেনজার্নি,তাই বেশ কিছু ড্রাই ফুড,মেডিসিন, শ্যাম্পুর পাতা,সাবান ইত্যাদি লিস্ট মিলিয়ে কিনে নেয়।তিতির ছাড়া বাড়ীশুদ্ধু লোক সবাই জানতো ওদের এই ট্রিপের কথা।
দুদিন আগেই বেশ কিছু গরম জামা-কাপড় কিনে মায়ের আলমারিতে রেখে দিয়ে এসেছিলো সুদর্শন। আজ যখন ব্যাগ গোছাচ্ছিল,তিতিরের হাঁ মুখটা দেখবার মতো ছিলো।
তিতির বেসিনে হাত-মুখ ধুয়ে হ্যান্ড ব্যাগ খুলে ক্রিম বের করে হাতে মুখে লাগিয়ে নিয়ে,ওপরের বাঙ্কে গিয়ে শুয়ে পরলো।সুদর্শন ওকে ভালো করে কম্বলে মুড়ে দিয়ে,নিজেও শুয়ে পরলো নতুন ভোরের আশায়,ক্রমে হারিয়ে গেলো ঘুমের অতলে।(চলবে)