তুমি নামক প্রাপ্তি’ পর্ব-১১

0
2142

#তুমি_নামক_প্রাপ্তি
#part:11
#Suraiya_Aayat

কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দক্ষিণে ও হিমছড়ি থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ইনানী বিচ ৷ প্রবালগঠিত সমুদ্রসৈকত। পশ্চিমে সমুদ্র আর পূর্বে পাহাড়ের এক অপূর্ব মনোরম দৃশ্য নিয়ে তৌরি ৷

আরুর পাহাড় অনেক পছন্দের কিন্তু আর্শিয়ান তার পাপার মতো সমুদ্র ভালোবাসে কারন সমদ্রূ নাকি কোন জিনিস কেড়ে নিয়ে ফিরিয়ে দিতে যানে !

আর্শিয়ানকে কে নিয়ে বাসে করেই যাচ্ছে যদিও বা সম্ভব হলে প্লেনে করেই যেতো কিন্তু আপাতত এত টাকা আরুর কাছে নেই, কারোর কাছে চাইলেই হয়তো পাওয়া যেত কিন্ত ও যে তা চাই না ৷
ঢাকা থেকে কক্সবাজের উদ্দেশ্যে গ্রিন লাইন বাসে উঠেছে সকাল সকাল ৷ বেশ অনেক ঘন্টা হয়ে গেছে ওরা বাসে রয়েছে, আর্শিয়ান জানালার ধারে বসে সবকিছুকে উপভোগ করছে , ছেলেটার মুখে খুশির ছটা দেখে আরুর চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে ৷ আর্শিয়ানের জন্মের পর আরু সেভাবে আর্শিয়ানকে নিয়ে কোথাও যেতে পারেনি তবে এই প্রথম ওরা ঢাকার বাইরে কোথাও যাচ্ছে ৷ শহরের কুলষিতায় ওর মন বিষিয়ে গেছে, এই কদিন একটু প্রানভরে নিশ্বাস নেবে ও ৷

বেশ কয়েক ঘন্টা জার্নি করার পর ওর কক্সবাজারে পৌছে গেছে ৷ টানা রোদের মাঝে আর্শিয়ানকে নিয়ে হাটছে আরু , আর্শিয়ানকে দেখে বোঝা যাচ্ছে যে সে ক্লান্ত ৷ অনেকে কক্সবাজার থেকে প্রাইভেট কার নেই তাতে অনেক খরচ, আর আরু অযথা অপচয় পছন্দ করে না, তাই আর্শিয়ানকে নিয়ে একটা সি এন জি তে উঠে পড়লো ৷ হোটেলের রুমটা আবির বুক করে দিয়েছিলো তাই আলাদা করে আর আরুকে কষ্ট করতে হয়নি ৷

সিএনজি তে উঠে আরু ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলো,,,
” মামা এখান থেকে ইনানী রয়্যাল রিসোর্ট টাতে যেতে কতক্ষন লাগবে ?”

উনি একটু ভাবুকস্বরে বললেন,,,,
” আপা ওই 45 মিনিট মতো লাগবে ৷”

” সে তো অনেকটা সময় ৷”( চিন্তাসুরে বলল)
আর্শিয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখল ঘুমে আর্শিয়ানের চোখ ছোট হয়ে আসছে, তা দেখে আরু বলল,,,,
” তুমি আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাও আর্শিয়ান, আমাদের এখনো অনেক দেরি আছে পৌছাতে ৷”

আর্শিয়ান আর কোন কথা না বলে আরুর কোলে মাথা রেখে চোখটা বন্ধ করতেই একরাশ ঘুম ভর করে এলো ওর চোখে ৷
আরু ছেলেকে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে যাতে রাস্তার ঝাকুনিতে আর্শিয়ান পড়ে না যাই বা ঘুম না ভেঙে যাই ৷

🎀

” মাইয়া ডারে কবে তুইলা আনবা ? সেই পাঁচ বছর ধরে অপেক্ষা করতাছি , তুমি খালি কও মাইয়া পাঠাইবা আর তারপর খালি কথা ঘোরাও…..নিজের মাইয়া বলে কি দরদ উতলাইয়া পড়তাছে নাকি ইমরান !”

” অআ বললা নিজের মাইয়া ! ও আমার মাইয়া ! ও হারামযাদীরে আমি কখনো আমার মাইয়া মনে করিনাই, ওরে তো আমি রাস্তা থেকে কুড়াইয়া লইছি ,ও আমার মাইয়া হলো কেমনে ?”( গলা খাকিয়ে আরমান সাহেব কথাটা বললেন )

ফোনের বিপরীতে থাকা লোকটা খানিকটা ভাবুকসুরে বললো
” তাহলে মাইয়াডারে আবার অন্য ছেড়ার লগে বিয়ে দিতে চাও কেন ?”

কথাটা শুনে আরমান সাহেব খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে বললেন,,,,
” ওই ছেড়ার আমার মাইয়াডার লগে বিয়ে করার শখ গজাইছে তার বিয়া করতে চাই তাই আরকি ৷”

” পরে সেই ছেলে যদি জানতে পারে যে তুমি তার বউরে পাচার করতে চাও তাইহে সে কি তোমার ছাইড়া দিবে ইমরান ৷”

” সে আমি ঠিক সামলাইয়া নিবো,তুমি এ নিয়ে চিন্তা করোনা ৷”

” সে না হয় একটা কথা হইলো কিন্ত তোমার মাইয়া আর তার পোলাপানডারে তাড়াতাড়ি দাও , এমনিতেই পুলিশ আমাদেরকে খুঁজতাছে ,একটা পুলিশের হাতে ধরা খাইয়া গেলে আর রেহায় নাই,তুমিও কিন্তু পার পাইবা না, আর তোমার মাইয়াডারে লইয়া বিদেশে চইলা যামু তারপর কয়েকবছর দেশে ফিরুম না রিস্ক আছে ৷”

“হহহ ঠিক আছে আমি দেখতাছি কি করা যাই ৷”

” যা করবা একটু তাড়াতাড়ি করিও ৷”

বলে ফোনটা আরমান সাহেব কেটে দিয়ে বলল,,,
” এখন এই ইলমাজ ছেলেটাকে কি করে আমার রাস্তা থেকে সরাই, ও থাকলে যে কোন কাজ ঠিক করে হইবো না ৷ ওকেও কি তাহলে আরাশের মতো শেষ করে দেবো ?”

কথাটা বলে আরমান সাহেব চেয়ারে মাথা ঠেকিয়ে রাখলেন ৷

ওনার রূমের কালো পর্দার আড়ালে থাকা দুটি পা সরে গেল,,,,,,,এতখন ধরে সব কথা তার শোনা হয়ে গেছে, এখন শুধু তার কার্যসিদ্ধির অপেক্ষা ৷

🎀

সিএনজি টা এসে হোটেলের সামনে থামতেই আরু আর্শিয়ানকে কোলে নিয়ে নামলো সিএনজি থেকে নামলো ৷
” কতো ভাড়া মামা?”

” আপনাদের দুইজনের 200 টাকা আপা ৷”

আরু পার্স থেকে 200 টাকা বার করে তাকে নিয়ে বললো
” ধন্যবাদ মামা ৷”
বলে লাগেজ নিয়ে বিদায় নিলো ৷

আরু চলে যেতেই সিএনজি ড্রাইভার চারিপাশে একটু ভালোভাবে তাকিয়ে দেখে নিলো যে আরু আছে কিনা,তারপর দেখলো যে আরু নেই, তা দেখে তাড়াতাড়ি করে ফোনটা ধরিয়ে বলল
” Sir madam কে হোটেলের সামনে পৌছিয়ে দিয়েছি ,আপনি কোন চিন্তা করবেন না ৷”

ফোনের বিপরীতের মানুষটা মুচকি হেসে বলল
” ধন্যবাদ তুফান, ঠিকঠাক কাজ করেছো ৷ যাওয়ার আগে হোটেলের সামনে হলুদ রঙের ড্রেসআপ করা যে সিকিউরিটি দাড়িয়ে আছে তার নাম মাহিম,ওকে গিয়ে একটু বলো যে madam কখন হোটেল থেকে বেরোচ্ছে না বেরোচ্ছে তার সব খবরাখবর যেন সে আমাকে দেই ৷ madam আর আমার চ্যাম্পের সামনে বিপদ আসতে চলেছে, একটু গন্ডগোল হলেই সব হারাবো আমি ৷ যদিও তা আমি কখনোই হতে দেবো না ৷”

কথাটা বলে রকিং চেয়ার থেকে নেমে কাঁচের দেওয়ালটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ৷

” Sir madam রে খুব ভালোবাসেন তাইনা ৷”

কথাটা শুনে মানুষটা মুচকি হাসলো ,চোখের কোনে জল চিকচিক করছে, হয়তো আবেগটা কাজ করছে খুব দৃঢ ভাবে,নিজেকে আটকাতে পারছে না ৷
ওপাশ থেকে নিস্তব্ধতা দেখে তুফান বললো
” আচ্ছা sir আমি যাচ্ছি, পরে কথা হবে আল্লাহ হাফেজ ৷”

” হমম ৷”

গলাটা ধরে আসছে, আল্লাহ হাফেজ বলে কল কাটার মতো অনুভুতিটা কাজ করছে না, কষ্টে গলাটা ধরে আসছে ৷চোখের কোনে জল,পলক ফেললেই গড়িয়ে পড়বে ৷কথায় বলে পুরুষদের সবথেকে দুর্বলতা নাকি একটা নারী,,,, কথাটা সত্তিই ৷ একটা নারীর জন্য একটা পুরুষ চোখের জল ফেলার ক্ষমতা রাখে ৷
খুব বেশি দিন হয়তো থাকবেনা এ দুঃখ ,এ কষ্ট, এ দূরত্ব , এ নিরবতা , এ মান-অভিমান ৷ সবকিছুর অবসান ঘটিয়ে একদান এক নব্য দিনের সূচনা হবে আর সেদিনের অপেক্ষায় সবাই ৷

🎀

অযথা টাকা খরচ বিলাসিতার লক্ষন ,আর সেই বিলাসিতা থেকে আরু সবসময় দূরে সরে থাকতে চাই, বিশ্বাস করে না কষ্ট না করে সবকিছু সহজভাবে পেয়ে গেলে তার আর কোন মূল্য থাকে না ,তাই অযথা সুযোগ সুবিধা ভোগকারীদের পর্যায়ে নিজেকে টানতে চাই না আরু ৷ সবকিছুতে কষ্ট করে পেতে শিখেছে আর আর্শিয়ানকেও ও সেই ভাবেই বড়ো করতে চাই ৷

টাকা খরচ করে আরু ঘুরতে এসেছে আর টাকা গুলো এমনকিছুতে ও খরচ করতে চাচ্ছে যাতে মানসিক ভাবে তৃপ্তি মেলে ৷
ইনানী বিচ হলো প্রবাল পাথরের সমাহারের জায়গা। অনেকটা সেন্টমার্টিনের মতই। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের মত এখানে বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে না সৈকতের বেলাভূমিতে। অনেকটাই শান্ত প্রকৃতির সৈকত এই ইনানী। জোয়ারের সময় প্রবাল পাথরের দেখা মেলে যা অতীব মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেই । ভাটার সময়েই কেবল মাত্র বিশাল এলাকা জুড়ে ভেসে উঠে প্রবাল পাথর । প্রবাল পাথরে লেগে থাকে ধারালো শামুক ঝিনুক। আর এগুলো ছোট্ট আর্শিয়ানের মনকে ছুঁয়ে যাওয়ার জন্যই যথেষ্ট ৷

আর্শিয়ানকে সুন্দর করে গুছিয়ে দিয়ে নিজে একটা চুড়িদার আর একটা প্লাজো পরেছে, অনেকদিন চুড়িদার শরীরে ছোঁয়ানো হয় না ৷ আজ অনেকদিন পর একটু খোলামেলা পোশাক পরে আরু নিজেকে ওর 5 বছর আগের জীবনে নিয়ে গেছে ৷ চুলগুলোকে খোলা রেখেছে অদ্ভূত এক টানে হয়তো এই আশা নিয়ে যে প্রিয় মানুষটা পিছন থেকে জাপটে জড়ায়ে ধরে এর খোলাচুলের ঘ্রান নেবে ৷ পুরোনে সেই অনুভূতিগুলো ফিরে পেলে মন্দ হয় না ৷
বিচ থেকে আরুর হোটেলটা খুব বেশি দুরে নয় ৷ আর্শিয়ানকে নিয়ে হেটে যাচ্ছে আর আর্শিয়ান এটা ওটা প্রশ্ন করছে , কখনো বালিয ওপর পড়ে থাকা ঝিনুক পায়ে বাধতেই ভয়ে পা সরিয়ে নিয়ে আরুকে জাপটে ধরছে আবার কখনো সমুদ্রের ঢেউ এ পা ভেজাচ্ছে ৷
আজ আরু আর্শিয়ানকে মুক্ত পাখার মতো উড়তে দিচ্ছে, কারন এই ছোট্ট প্রানোচ্ছল মনটাকে বেঁধে রাখার ক্ষমতা ওর নেই ৷
পাথরের ওপর বসে আছে আরু ৷ বিচের ধারের একাকীত্ব নামক জিনিসটা ওর ভালো লাগছে, বড্ড উপভোগ করছে এই সমুদ্রকে ৷ চারপাশে হাতে গোনা দু থেকে তিন জন লোক ছাড়া কেউ নেই ৷
আর্শিয়ান ওর সামনেই খেলা করছে দেখে আরু একটু সময় চোখ বন্ধ করে বসলো , অনুভুতিটা মন্দ না ৷
কিছুক্ষন পর আরশিয়ানের খিলখিল আওয়াজ শুনে আরু হুঠ করে চোখ খুলে আর্শিয়ানকে সামনে দেখলো না ৷ আর্শিয়ানকে খুঁজতে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো অর্শিয়ান নিহান নামক লোকটার কোলে রয়েছে, লোকটা ওর সাথে আজগীবি সব কথা বলছে আর তা শুনে আর্শিয়ান খিলখিল করে হাসছে ৷ প্রথমে নিহানকে দেখে একটু রাগ লাগলেও পরে আর্শিয়ানের মুখের হাসিটা দেখে ওর সব রাগ মটি হয়ে গেলো ৷

একটু দ্রুত পায়ে নিহান আর আর্শিয়ানের কাছে গিয়ে নিহানকে উদ্দেশ্য করে বলল
” আমার ছেলেকে আমার কাছে ফেরত দিন ৷”

নিহান ভ্রু কুঁচকে বলল
” একি আপনি এখানেও চলে এসেছেন আমার পিছন পিছন ! আমার প্রমে টেমে পড়ে গেলেন নাকি !”( চোখ মেরে)

কতটা শুনে আরু আর্শিয়ানকে ছো মেরে নিহানের কোল থেকে কেড়ে নিয়ে বলল
” আপনি এখানে কি করছেন ? আপনার tour না কক্সবাজার ?”

কতটা শুনে নিহান আরুর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল
” আপনি জানলেন কি করে ? আমি তো আপনাকে বলিনি !”

আরু নিহানের দিকে রাগী চোখে তকিয়ে বলল
” মজা করছেন?”

” একদম না ৷”

আরু আর কোন কথ না বড়িয়ে বিরক্ত হয়ে চলে যেতে নিলেই নিহান আরুর হাতটা ধরে বলল
” আমার নায়িকা হরিয়ে গেছে , খুঁজতে এসেছিলাম তাই, এসে আপনার দেখা পেলাম , নট সো bad luck. বাট ঘুরতে এসেছেন ঘুরূন , আমার জন্য নিজের আনন্দটাকে কেন নষ্ট করবেন !”
.আরু নিহানের দিকে তাকালো , তখনই আর্শিয়ান বললো
” মাম্মাম আমি এখন এখানেই থাকবো, প্লিজ তুমিও থাকো ৷”

আরু আর্শিয়ানের দিকে তাকালো, কি বলবে বুঝতে পারছে না ৷
আরুর নিস্তব্ধতা কাটিয়ে নিহান বলল
” সমুদ্রটা সবার , যে নোনাজলে আপনার পা ভিজছে তাতে আমি আমিও ভেজাচ্ছি , তাই একসাথে তিনজন পা ভেজালে সমস্যা কি !”
কথাটা বলে আর্শিয়ানকে আরুর কোল থেকে নিয়ে খানিকটা দুরে হেটে গায়ে আর্শিয়ানকে কোল থেকে নামিয়ে ওর হাতটা ধরে দাড়িয়ে রইলো ঢেউয়ের মাঝে ৷
আরুও অদ্ভুত এক টানে আর্শিয়ানের পাশে গিয়ে দাড়ালো, সূর্যের আলোর ধীমে ছটা ছড়িয়ে যাচ্ছা সারা বিচ জুড়ে, আর্শিয়ান খিলখিল করে হাসছে আর একবার আরুর দিকে তাকাচ্ছে আর একবার নিহানের দিকে তাকাচ্ছে ৷

হঠাৎ নিহান বলে উঠলো
” এই যে আরিশের ফুলনদেবী আমার প্রেমেটেমে পড়ে যাচ্ছেন না তো ? সাবধান !”

আরু চোখ গরম করে নিহানের দিকে তাকালো, নিহান আরুর দিকে চোখ মেরে আবার সামনের দিকে তাকালো ৷

#চলবে,,,,

কেমন লাগলো জনগন 🥱

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here