#তুমি_অন্য_কারো_সঙে_বেঁধো_ঘর(০৩)
সকাল থেকে নবনী রান্না শুরু করে দিয়েছে। নবনীর মনে পড়লো এর আগে একবার লুবনাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে,পাত্র পক্ষের লুবনাকে পছন্দ না হওয়ায় সমস্ত দোষ গিয়ে পড়েছে নবনীর উপর। নবনী পাত্রপক্ষকে নাশতা কম দিয়েছে বলে না-কি তারা লুবনাকে পছন্দ করে নি।নবনীর আজ হাসি পেলো সেসব ভেবেই।তাই সকালে নিজেই গিয়ে শাশুড়িকে বললো,”মা,আজকে তো পাত্রপক্ষ দুপুর বেলা আসবে,আজকে কি শুধু নাশতার আইটেম দেওয়া যাবে?দুপুরে তো লাঞ্চের সময়। ”
তাহেরা বেগম মুখ ঝামটা দিয়ে বললো,”শুধু নাশতা দিবে কেনো,পোলাও রোস্ট সব কিছুর ব্যবস্থা করো।আমাদের কি তোমার বাবার বাড়ির লোকেদের মতো ছোট লোক ভেবেছ না-কি যে শুধু চা শরবত খাইয়ে বিদায় দিবো?
আমরা উঁচু বংশের মানুষ,আমাদের আলাদা একটা সম্মান আছে।”
নবনী চুপ করে চলে এলো।এই বাড়িতে কোনো কথা উঠলেই সব নবনীর বাবার বাড়িতে গিয়ে থামে।মাঝেমধ্যে খুব প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করে তার।
নবনীর পিছনে উঠে এলো নবনীর শ্বশুর। দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকায় রান্নাবান্নার সব জানেন হামিদুর রহমান। নবনীকে বললেন,”নবনী মা,তুমি আমাকে সব কেটে কুটে দাও আমি রান্না করবো আজকে সব।”
নবনী লজ্জা পেয়ে বললো,”না বাবা,আমি একাই পারবো সব।আপনি যান এখান থেকে। মা দেখলে রাগ হবেন।”
হামিদুর রহমান আফসোস করে বললেন,”আমার উপর তোমার অনেক রাগ তাই না নবনী?আমার জন্য তোমাকে এই বাড়ির বউ হয়ে আসতে হলো।তারজন্য উঠতে বসতে সবার কথা শুনতে হয়।সবসময় এভাবে চুপ করে সব মেনে নিও না।মাঝেমধ্যে একটু প্রতিবাদ করো মা”
নবনী হেসে বললো,”আপনি চা খাবেন বাবা?”
হামিদুর রহমান কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন।সব রান্না শেষ করতে নবনীর দুপুর হয়ে গেলো। ঘেমে-নেয়ে নবনীর অবস্থা খারাপ।
মেহমান এলো বিকেল বেলা।লুবনাকে দেখতে আসবে শুনে চট্টগ্রাম থেকে দিশার স্বামী সামিম ও এসেছে। ড্রয়িং রুমে তাহেরা,হামিদুর রহমান,তামিম,সামিম,দিশা মিলে মেহমানদের সাথে কথা বলছে।
নবনী দ্রুত হাতে টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে। খাবার সাজিয়ে নবনী তাহেরা বেগমকে ইশারা করলো।তাহেরা বেগম মেহমানদের নিয়ে টেবিলে এলেন।
নবনী সামনে এলো না কারো।তাহেরা বেগমের পছন্দ না লুবনাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এলে নবনী তাদের সামনে যাওয়া।আরো একবার নবনী নাশতা নিয়ে যাওয়ায় পাত্রপক্ষের নবনীকে পছন্দ হয়ে যায়।
এসব নিয়ে কম কথা শুনতে হয় নি নবনীকে।
রুমে এসে দেখে লুবনা নবনীর জন্য গতকাল রাতে আনা সব কসমেটিকস,চুড়ি,জুতা পরে বসে আছে। নবনী কিছু বললো না।কিন্তু নবনীর রাগ হলো তখন যখন লুবনা বললো,” গতকাল বাবা এনে দেওয়া কাঞ্জিভরম শাড়িটি দাও ভাবী,আমি ওটা পরে যাবো।”
শুনেই নবনীর বুকের ভেতর কেমন দুরুদুরু করে কাঁপতে লাগলো। নবনী জানে এই শাড়ি একবার লুবনার হাতে গেলে নবনী আর পাবে না।
এখন পর্যন্ত লুবনা নবনীর যেই জিনিস ব্যবহার করতে নিয়েছে একবার সেই জিনিস আর ফেরত দেয় নি নবনীকে।নবনী একটুক্ষণ চুপ থেকে বললো,”না লুবনা,ওটা বাবা আমার জন্য এনেছে।আমি এখনো ভাঁজ খুলি নি ওই শাড়ির তোমার বিয়েতে পরবো বলে। ওটা না,তুমি অন্য শাড়ি পরো।”
শুনে লুবনা হতভম্ব হয়ে বললো,”ভাবী,তুমি আমার সাথে তর্ক করছো!”
নবনীর কিছুটা রাগ হলো লুবনার কথা শুনে।বিরক্ত হয়ে বললো,”তর্ক করছো মানে কি লুবনা?তুমি শাড়ি চেয়েছ আমি দিবো না বলেছি ব্যস,এখানে তর্ক এলো কোথায় থেকে।”
লুবনার শ্যামলা মুখখানা অন্ধকার হয়ে গেলো।
নবনী নরম স্বরে বললো,”লুবনা,এতো ভারী মেকাপ না করলে ভালো লাগতো তোমাকে।তুমি ন্যাচারালি ভীষণ সুইট।তোমার চেহারার লাবণ্যতা ঢেকে গেছে মেকাপের আড়ালে।”
লুবনা রেগে গিয়ে বললো,”তুমি তো দেখছি আজকাল উপদেশ দিতে শুরু করেছো।মা আসুক,সব বলবো আমি মা’কে। তুমি কি ভেবেছ বাবা তোমাকে প্রোটেকশন দিবে?
বাবার ছুটি আর ১৫ দিন আছে।বাবা আবারও কানাডা চলে যাবেন।”
নবনী হেসে বললো,”আমাকে রক্ষা করার জন্য তো আমার আল্লাহ যথেষ্ট লুবনা।”
লুবনা গজগজ করতে করতে নিজের রুমে চলে গেলো। তারপর দিশার রুমে গিয়ে দিশার একটা শাড়ি পরলো।
খাবার পর সবাই গিয়ে পুনরায় ড্রয়িং রুমে বসলো।দিশা উঠে এলো লুবনাকে নেয়ার জন্য। লুবনার রুমে এসে দেখে লুবনা তার শাড়ি পরে বসে আছে। মুহুর্তেই দিশার মাথা গরম হয়ে গেলো। কিন্তু কোনো সিনক্রিয়েট করলো না বাসায় গেস্ট থাকায়।গেস্ট গেলেই একটা ব্যবস্থা নিবে ভেবে লুবনাকে নিয়ে গেলো ড্রয়িং রুমে।
লুবনা গিয়ে সবাইকে সালাম করলো।পাত্রের সঙ্গে পাত্রের এক বন্ধু,চাচা,বোন,মা,খালা,মামী,ফুফু এসেছে।
সবাই লুবনা কে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে লাগলো। লুবনা সব উত্তর দিলো।
সবার কথা বলার পর লুবনাকে আর পাত্রকে আলাদা কথা বলার জন্য ভেতরে নিয়ে আসতে বললো সবাই।তাহেরা বেগম এসে নবনীর দরজা নক করতে লাগলেন।নবনীর রুমে কথা বলতে দিবেন।কেননা তিনি জানেন লুবনার রুম এখন অগোছালো পড়ে আছে। সাজতে গেলে লুবনা আলমারির সব কিছু বের করে বিছানায় ফেলে রাখে।দিশার রুমে গেলে দিশা রাগ হবে।তাই নবনীর রুমেই নিয়ে এলেন।
নবনী বের হয়ে লুবনার রুমের দিকে যেতেই পাত্রের মা,খালা সবার সাথে দেখা হয়ে গেলো। তাহেরা বেগমকে ডেকে পাত্রের মা জিজ্ঞেস করলো,”এই কে আপা?”
তাহেরা বেগম বিরক্তি চেপে বললো,”আমার বড় বউ।”
পাত্রের মা খালারা কানেকানে ফিসফিস করতে লাগলো শুনে।নবনী আর না দাঁড়িয়ে লুবনার রুমে গিয়ে দরজা চাপিয়ে দিলো।তারপর সব গোছাতে লাগলো।
লুবনার সাথে ৫ মিনিটের মধ্যে কথা শেষ করে পাত্র বের হয়ে গেলো রুম থেকে।তারপর সবাই বিদায় নিয়ে চলে গেলো। হামিদুর রহমান তাদের সাথে গেলেন এগিয়ে দিয়ে আসার জন্য।
মেহমান বাসা থেকে বের হতেই দিশা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে সামিমকে বললো,”তোমার বোন কার থেকে অনুমতি নিয়ে আমার শাড়ি পরেছে?আমার শাড়িতে হাত দিলো কিভাবে ও?এই শাড়ি আমার বড় আপার দেওয়া। ও কেনো আমার শাড়ি পরেছে?”
লুবনা চমকে গেলো দিশার কথা শুনে।দিশাকে সবাই যেহেতু সমঝে চলে তাই তাহেরা বেগম মিনমিন করে বললো,”রাগ করো না দিশা,নবনীকে বলবো শাড়িটি ধুয়ে দিতে।ও বুঝতে পারে নি।আর কখনো এরকম করবে না।”
লুবনার কান্না চলে এলো।কাঁদতে কাঁদতে বললো,”আমি কি করবো?বড় ভাবীকে বলেছি গতকাল বাবা আনা শাড়িটি দিতে উনি তা দেয় নি,উল্টো বলেছে মেজো ভাবীর শাড়ি নিয়ে পরতে।তাই তো আমি নিয়েছি।”
তাহেরা বেগমের প্রচন্ড রাগ উঠলো। লুবনার রুমে গিয়ে নবনীর চুল চেপে ধরে বললেন,”আমার স্বামীর এনে দেওয়া শাড়ি তুই আমার মেয়েকে দিলি না কেনো?
তোর বাবার বাড়ি থেকে এনেছিস না-কি শাড়ি তুই?তোর সাহস হলো কি করে নিজে শাড়ি না দিয়ে দিশার শাড়ি দেখিয়ে দিতে?”
ব্যথায় নীল হয়ে নবনী বললো,”এটা সত্যি আমি শাড়ি দিই নি,কিন্তু দিশার শাড়ি ও আমি পরতে বলি নি মা।”
সামিম এসে বললো,”আহা মা,কি করছো?ভাবী ব্যথা পাচ্ছে?”
তাহেরা চিৎকার দিয়ে বললো,”যা এখান থেকে তুই।”
তারপর নবনীর চুল ছেড়ে দিলো।লুবনা কাঁদতে কাঁদতে বললো,”শুধু এই না মা।আমি ভাবীর কসমেটিকস দিয়ে সেজেছি বলে ভাবী আমাকে অপমান করেছে।আমাকে বলেছে আমি না-কি দেখতে কালো।সাজলে আমাকে মানায় না।বিচ্ছিরি লাগে দেখতে। ”
নবনী হতভম্ব হয়ে গেলো লুবনার কথা শুনে। কিন্তু লুবনা বানিয়ে বানিয়ে আরো কথা বলতে লাগলো।নবনীর আর সহ্য হলো না।গতকাল থেকে নবনীর মন ভালো নেই। কিন্তু এখন নবনীর মনে হলো এমনিতে ও এই বাড়িতে ওর দিন শেষ হয়ে আসছে।তবে আর কিসের আশায় সে চুপ করে থাকবে?
লুবনার দিকে এগিয়ে গিয়ে লুবনার গালে একটা কষে থাপ্পড় দিলো নবনী।তারপর বললো,”আমি সবসময় সব মেনে নেই বলে এই না আমার নামে তোমরা সবাই এভাবে মিথ্যা অপবাদ দিবে। যা বলি নি আমি কখনো তা বানিয়ে বলবে।”
নবনী লুবনাকে থাপ্পড় দিতেই তামিম তেলেবেগুনে জ্বলে উটলো,তাহেরা বেগম কিছু করার আগে তামিম এসে নবনীর দুই গালে দুটো থাপ্পড় দিলো। তারপর বললো,”ছোটলোকের বাচ্চা,তোর সাহস কিভাবে হলো আমার ফুলের মতো বোনের গায়ে হাত তোলার?”
নবনী গালে হাত রেখে বললো,”যেভাবে তোমার আর তোমার মায়ের সাহস হয়েছে আমার গায়ে হাত তোলার সেভাবে।”
তামিম আরো ক্রুদ্ধ হয়ে গেলো, এগিয়ে এসে নবনীর চুল চেপে ধরে বললো,”তোকে আজ খুন করে ফেলবো আমি।”
নবনী দমে গেলো না আর এবার।তামিমের হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,”তা তো মারবেই,তাহলে তো সুযোগ হবে বুকপকেটে যার ছবি নিয়ে ঘুরে বেড়াও তাকে বউ করে আনতে।”
তামিম রেগে দিশা হারিয়ে বললো,”সে অন্তত তোর মতো ফকিরের মেয়ে না।মাস শেষে ২৫ হাজার টাকা বেতন পায়।”
নবনীর কথা শুনে সবাই চমকে গেলো। তাহেরা বেগম তামিমের হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,”কি বলছিস এসব?”
তামিম নবনীকে ছেড়ে দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। তামিমের থাপ্পড়ের সাথে নবনীর ঠোঁট কেটে গেলো দাঁতের সাথে লেগে।নবনী টলমল পায়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো।
চলবে….
রাজিয়া রহমান