তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (৪১) (শেষ পর্ব-শেষ অংশ)

#তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (৪১)
(শেষ পর্ব-শেষ অংশ)

শুক্রবার বিকেল বেলা।তাহেরা বেগম ফ্ল্যাট থেকে বের হবার সময় তামিমকে বললেন,”আমি একটু আসছি।তুই থাকিস বাসায়।”

তামিম অবাক হলো মায়ের কথায়।লুবনাকে বিয়ে দেয়ার পর থেকে তাহেরা বেগমের পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে।কথাবার্তা যেমন কমে গেছে তেমনই বেড়ে গেছে উদাসীনতা।
আজকাল সবসময় তাকে গোমড়া মুখে বসে থাকতে দেখা যায়।নিজের খাবারের অনিয়মের সাথে সাথে পুরো সংসারে কেমন বিশৃঙ্খলতা চলে এসেছে।

নবনীদের বাসায় ফাল্গুনী,চৈতালী, সাব্বির,মেঘ মিলে বসেছে লুডু খেলতে।২ লিটার সেভেন আপ বাজি ধরেছে।তবে বাজির নিয়ম হচ্ছে যেই দল হারুক,সেভেন আপ খাওয়াতে হবে মেঘকে।
মেঘ হাসিমুখে এই শর্ত মেনে নিলো।এদের সাথে মেঘের সময় ভীষণ আনন্দে কাটে।ওদের ছোট ছোট আবদার,সামান্য আবদার পূর্ণ হলেই সবাই ভীষণ খুশি হয়।

নবনী কিছুতেই ওদের জন্য খেলতে পারে না। কেউ-ই নবনীকে খেলায় নিতে চায় না।নবনীকে একদিন খেলায় নিয়েছিল,মেঘ নাকি বউয়ের প্রতি আদর দেখিয়ে নবনীর একটা গুটি ও কাটে নি।নবনীকে জিতিয়ে দিয়েছে। এজন্য ফাল্গুনী,চৈতালীর সোজা কথা,আপাকে তারা খেলায় নিবে না।

নবনীদের ডোর বেল বাজতেই নবনী চৈতালী কে বললো,”কে এসেছে গিয়ে দেখ।”

চৈতালী গম্ভীর হয়ে বললো, “খেলায় এখন টান টান উত্তেজনা চলছে।এক সেকেন্ডের জন্য ও আমি যাবো না।তুমি যাও।তুমি তো দর্শক শুধু।”

অনিচ্ছা সত্ত্বেও নবনী গিয়ে দরজা খুললো। তাহেরা বেগমকে দেখে নবনী ভুত দেখার মতো চমকে গেলো। তাহেরা বেগম কাচুমাচু করে বললেন,”তোমার মা বাবাকে একটু ডেকে দাও।”

নবনী হতভম্ব হয়ে বাবা মা’কে ডাকলো।নবনীর অস্থির ডাক মেঘের কানেও গেলো। নবনী কোনো কারণে চমকে গেছে বুঝতে পেরে মেঘ খেলা রেখে উঠে এলো।
মেঘের সাথে সাব্বির,ফাল্গুনী, চৈতালী ও এলো।

মেঘ নবনীর হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে নবনী? ”

হাশেম আলী রাবেয়া বেগমকে দেখে থমকে গেলেন।এগিয়ে গেলেন রাবেয়া বেগম। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,”আপনি এখানে?”

তাহেরা বেগম এগিয়ে গিয়ে রাবেয়া বেগমের হাত চেপে ধরলেন।ঝরঝর করে কেঁদে বললেন,”আমাকে মাফ করে দিয়েন আপা।আমি যা করেছি তার কোনো ক্ষমা হয় না আমি জানি।অভিশাপ দেয়ার হলে আমাকে দিয়েন।তবুও একটু দোয়া কইরেন আমার মেয়েটা যেনো সুখী হয়। নিজের মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি শ্বশুর বাড়িতে মেয়েরা কষ্ট পেলে বাবা মায়ের কেমন লাগে।বাড়ির বউদের উঠতে বসতে অপমান করলে তাদের কেমন কষ্ট হয়।
আমার অন্যায়ের জন্য আজ আমার মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে।নবনী মা,তুমি আমাকে মাফ করে দিও।আমরা কেউ ভালো নেই।আমার সংসার একেবারে ভেসে গেছে আজ।দিনরাত এখন আল্লাহর কাছে মৃত্যু কামনা করি।”

মেঘ নবনীর হাত শক্ত করে ধরে রাখলো। ভাবখানা এমন যেনো ছেড়ে দিলেই নবনীকে তাহেরা বেগম ছিনিয়ে নিয়ে যাবেন।
নবনী হাতে মৃদু ব্যথা পাচ্ছিলো,মেঘের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে মেঘের চোখ মুখ শক্ত হয়ে আছে।কেমন কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেঘ তাহেরা বেগমের দিকে।

তাহেরা বেগম নবনীর সামনে এসে দাড়ালেন।নবনীর কেমন যেনো অস্বস্তি হলো। এই মহিলার জন্যই তো একদিন তাকে সংসার ছেড়ে আসতে হয়েছে।তবুও মনে কোনো কষ্ট নেই,চলে এসেছে বলেই তো মেঘের মতো একজনকে পেয়েছে।

তাহেরা বেগম মেঘের দিকে তাকিয়ে বললো, “এই মেয়েটা ভীষণ লক্ষ্মী বাবা।ভীষণ শান্ত এই মেয়ে।আমি ওর মূল্য বুঝি নি।আমার মতো ভুল করো না বাবা।খাঁটি সোনাকে পেয়েছ,তাকে যত্ন করে রেখো।”

মেঘ মুচকি হেসে বললো, “নাকের আগায় নিশ্বাস যতোক্ষণ আছে,এই মেয়েটা ততক্ষণ আমার।এই হাত আমার হাতের মুঠো থেকে আলাদা হবে না। আমি পুরো পৃথিবীকে বলে যাবো,এই মেয়েটা শুধু আমার ভালোবাসা।”

সবার কাছে মাফ চেয়ে তাহেরা বেগম চোখ মুছে চলে গেলেন নিজের ফ্ল্যাটে।তামিমের পাশে বসে বললেন,”এক জীবনে অনেক ভুল করেছি,অন্যায় করেছি।আজ সব কিছুর ফল পাচ্ছি।অকালে স্বামী হারিয়েও আমার শিক্ষা হয় নি।নিজের লোভ আজ নিজের পতন টেনে এনেছে।
তুই আর ভুল করিস না বাবা।নিতু ‘কে নিয়ে আয় তুই যেভাবে পারিস।আমার সংসারের লক্ষ্মীকে আমি দুইবার পায়ে ঠেকেছি,এবার পেলে মাথায় তুলে রাখবো।”

তামিম কিছু বলতে পারলো না। নিজেই দেখতে পাচ্ছে সংসারের ভাঙ্গন।নিতু না হলে কেউ পারবে না এই ভাঙা সংসার আবারও জোড়া দিতে।

শনিবার সকালে তামিম নিতুদের বাসায় গেলো। বরকত সাহেব, রেবেকা বেগমের পায়ে ধরে ক্ষমা চাইলো।বরকত সাহেব ভীষণ রেগে গেলেন। তামিম নানা অনুনয় বিনয় করে তাদের কনভিন্স করলো।

নিতু কোথায় জানতে চাইলো।বরকত সাহেব জানালেন নিতুর চাকরি হয়েছে,সে অন্যত্র থাকে কিন্তু কারো কাছে নিতুর ঠিকানা পেলো না।নিতু কিছুতেই নিজের ঠিকানা দিয়ে যায় নি।
নিতুর ফোন নাম্বার বরকত সাহেব দিলেও তামিম কল দেয়ার পর বন্ধ পেলো।
বরকত সাহেব শুকনো মুখে বললেন,”নিতু বলেছিলো ও আমাকে কল দেয়ার সময় এই সিমকার্ড অন করে,কথা শেষ হলে আবার খুলে ফেলে এটা।যাতে কেউ কখনো ওর খোঁজ না পায়,ওর সাথে যোগাযোগ করতে না পারে।”

এরপর দুইদিন তামিম নিতুদের বাসায় রইলো নিতুর সাথে ফোনে কথা বলার জন্য। সোমবার সকালে নিতু কল দিতেই বরকত সাহেব তামিমকে ডাকলেন।কল রিসিভ করে তামিম ব্যতিব্যস্ত হয়ে হ্যালো বললো।
তামিমের গলার স্বর পেয়ে নিতু কল কেটে দিলো।তামিম কল দেয়ার পর সুইচ অফ পেলো।কয়েকবার তামিম চেষ্টা করলো কিন্তু কিছুতেই কল গেলো না।

তামিমের হঠাৎ করে মনে হলো সারাজীবনের জন্য সে বুঝি তার নিতুকে হারিয়ে ফেললো। নিজেকে নিজে ধিক্কার দিয়ে নিতুদের বাসা থেকে বের হয়ে আসলো।
নানাভাবে চেষ্টা করে ও তামিম নিতুর ঠিকানা পেলো না।নিতুর সাথে কথা বলতে পারলো না।

নিতুর খোঁজ পেলো তামিম আরো ছয় মাস পরে।মেঘের সাহায্যে।মেঘ কিছুদিন ধরে তামিমের চলাফেরা, কাজকর্ম খেয়াল করছে।তারপর একদিন নিজেই ডাকলো কেবিনে।কিছুক্ষণ কথা বলার পর তামিম নিজেকে সামলাতে পারলো না। মেঘের কাছে সব কথা বলে দিয়ে বললো নবনী যেনো তাকে ক্ষমা করে দেয়।

সব শুনে মেঘ ভাবলো একটা চান্স পাওয়ার অধিকার সবারই আছে।দুজনের দেখা হলে হয়তো একটা ব্যবস্থা হবেই।
নিতু যেই পেইজ থেকে হোমমেড তেল নিতো সেই পেইজ মেঘ খুঁজে বের করলো। তারপর মেঘ,তামিম মিলে পেইজের ওনার সুইটির সাথে দেখা করলো। তাকে সব কিছু বুঝিয়ে বললো।বরকত সাহেবকে ও মেঘ আসতে বললো।বরকত সাহেব নিজেও বললেন সুইটিকে সব ব্যাপার খুলে ।অনেক রিকুয়েস্ট করার পর সুইটি সেই এড্রেস দিলো যেই এড্রেসে সে নিতুর জন্য তেল পাঠায়।

৮ মাসের গর্ভবতী নিতুর চেহারা ইদানীং আরো সুন্দর হয়েছে। স্বাস্থ্য বেড়েছে কিছুটা যার ফলে নিতুকে একেবারে গোলগাল লাগছে।কলেজ থেকে বের হয়ে বাসার সামনে আসতেই নিতু চমকে গেলো। বাসার সামনে বড় একটা ব্যানারে লিখা, “সরি নিতু।আমার ভুল হয়ে গেছে, আমার বাচ্চাটার কথা ভেবে না হয় আমাকে একটা বার সুযোগ দাও।কথা দিলাম,এবার একেবারে একজন পারফেক্ট বাবা হয়ে দেখিয়ে দিবো।তোমাকে কোনো অভিযোগ করার সুযোগ দিবো না।
-তামিম”

নিতুর কেনো জানি ভীষণ কান্না এলো। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেলো না। সিড়ি বেয়ে দুই তলায় উঠতে উঠতে দেখলো সিড়ির প্রতিটি ধাপে ধাপে লিখা,”সরি নিতু।”

ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তামিম,সামিম,তাহেরা বেগম, বরকত সাহেব,রেবেকা বেগম।

কতোদিনের জমানো কান্নারা সবাইকে দেখে হুহু করে স্রোতের মতো বের এলো। তামিম এগিয়ে এসে নিতুকে জড়িয়ে ধরলো সবার সামনে। আজ আর তামিম কিছুতেই লজ্জা পাবে না।নিতুর রাগ ভাঙ্গাতে প্রয়োজনে নিতুর পা ধরার জন্য ও হুকুম দিয়েছেন তাহেরা বেগম। এই প্রথম বার তামিমের মনে হলো তাহেরা বেগম একটা ভালো কাজের আদেশ দিয়েছেন।

নিতু তামিমের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দরজা খুললো। তামিম ছাড়া বাকি সবার সাথে কথা বললো।তামিম অনেকক্ষণ ধরে উশখুশ করছে নিতুর সাথে আলাদাভাবে কথা বলার।কিন্তু নিতু সেই সুযোগ দিচ্ছে না।

তাহেরা বেগম এগিয়ে এসে নিতুর হাত চেপে ধরলেন।নিজের সব কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইলেন।নিতু সেসব মনে রাখে নি।তাহেরা বেগমের সাথে সুন্দর করে কথা বললো।সব শেষে তাহেরা বেগম যখন বললেন বাসায় ফিরে যাবার কথা। নিতু তখন মিষ্টি হেসে তাহেরা বেগমের অনুরোধ ফিরিয়ে দিলো।

নিজের চোখের জল মুছে বললো, “নিজের স্ত্রী থাকার পরেও যেই মানুষ আমার সাথে প্রেম করতে পারে,আমাকে পাবার জন্য তাকে ডিভোর্স দিতে পারে। এরপর প্রাক্তন স্ত্রীকে হারিয়ে তার মূল্য অনুভব করে বর্তমান স্ত্রীকে কষ্ট দিতে পারে। শেষ পর্যন্ত নিজে জন্মদাতা পিতা হয়েও আমার গর্ভের সন্তানকে অস্বীকার করতে পারে,তাকে আর যাই হোক বিশ্বাস করা যায় না।আমার প্রেগন্যান্সির ৮ মাস চলে। আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করে দেখুন না,তার কাছে ভিখিরির মতো আমি কতোবার ফিরে যেতে চেয়েছি।শুধু আমার গর্ভের সন্তান যেনো তার বাবার আদর পায় এই টুকুর জন্য।অথচ সে বারবার আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এতো বার প্রত্যাখ্যাত হয়ে আমি নিজেকে সামলে নিয়েছি।আমার সন্তানের বাবা ও আমি,মা ও আমি।”

তামিম নিতুর পা চেপে ধরে বললো, “আর একটা বার নিতু।এই শেষ বার সুযোগ দাও আমাকে।আর এরকম হবে না।তোমার সব ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত করে দিবো।আমার কাছে আর একবার ফিরে চলো।”

নিতু করুণ হাসলো।তারপর বললো, “তোমার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য।”

তামিম নিজের সপক্ষে বলার মতো কোনো যুক্তি খুঁজে পেলো না। কি বলবে সে?
কোন মুখে নিজের সাফাই গাইবে?

বিকেলে সবাই চলে এলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিতু সবার চলে যাওয়া দেখছে।বুকের ভেতর ভীষণ তোলপাড় হচ্ছে।

সবাই চলে গেলেও তামিম গাড়িতে উঠলো না।সন্ধ্যার দিকে তামিম আবারও এলো নিতুর বাসার সামনে। নিতু তখনো বারান্দায় দাঁড়িয়ে, তামিম নিচে দাঁড়িয়ে রইলো।

কিছুক্ষণ পর তামিম নিজ থেকে বললো,”আমি এরপর হাজার বার তোমার সামনে আসবো নিতু,কতোদিন তুমি রাগ করে থাকতে পারো আমি দেখবো। তোমার অভিমানের পাহাড় যেদিন গলবে সেদিন না হয় আমার কাছে ফিরে এসো।আমি অপেক্ষায় থাকবো।”

নিতু কোনো কথা বললো না।তামিম অন্ধকারে দেখলো না নিতুর দুই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।

তামিম অপেক্ষায় আছে একদিন এই মান অভিমান শেষ হবে।

সেই দিন কবে আসবে?
কে জানে?

(সমাপ্ত)

রাজিয়া রহমান

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here