#তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (১২)
নবনীরা পরদিন রাত দুইটার সময় গ্রাম থেকে বের হলো শহরের উদ্দেশ্যে। সাথে শুধু নিজেদের ব্যবহার করার কাপড় নিলো।নবনী নিজের সব গহনা এবং হামিদুর রহমানের দেওয়া সব টাকা নিলো অনেক দিন আগে নেওয়া সেই সিদ্ধান্ত নবনী ভুলে যায় নি।
বাসে বসে হাশেম আলী নবনীকে জিজ্ঞেস করলো,”আমরা এখন কোথায় যাবো রে মা?কোনো বস্তিতে থাকনের ব্যবস্থা করা লাগবে মনে হয়। ”
নবনী বাবার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,”বস্তি নয় বাবা,আমরা এখন সরাসরি গিয়ে একটা হোটেলে উঠবো।দুই দিনের ভেতর একটা ফ্ল্যাটে উঠবো।”
রাবেয়া জিজ্ঞেস করলেন,”সে তো অনেক টাকার কারবার। ”
নবনী হেসে বললো,”টাকা আমার কাছে আছে মা।তোমরা চিন্তা করো না।”
হাশেম আলী বললেন,”না না,তোর ওই টাকা শুধু তোর মা।তোর কাছে রাখ।আমাদের জন্য টাকা খরচ করতে হবে না।”
নবনী বাবাকে বললো,”কেনো বাবা,আমি কি তোমার মেয়ে না?আমার কি শখ নেই নিজের বাবা-মা এর জন্য কিছু করার? তাছাড়া এই টাকা যদি আমার স্বামীর দেওয়া হতো,বৈবাহিক সম্পর্ক থাকতো তাহলে আমি তোমাদের জন্য এই টাকা খরচ করতে চাইতাম না তার অনুমতি ছাড়া। এখন আমার কাউকে জবাব দিতে হবে না।আমার টাকা আমার বাবা মায়ের জন্য খরচ করার পূর্ণ অধিকার আছে। ”
হাশেম আলী তবুও লজ্জা পেলেন।নিজে সন্তানের জন্য কিছুই করতে পারছেন না।অথচ নির্দ্বিধায় মেয়ে তাদের জন্য কতো কিছু করতে চাচ্ছে।
গাড়ি থেকে নেমে নবনীরা সিএনজি নিয়ে বনানীতে এলো।বনানী একটা হোটেলে তিনটা রুম নিলো। দুপুর পর্যন্ত বিশ্রাম নিয়ে নবনী বাবাকে নিয়ে বের হলো।
এই প্রথম বার নবনী সাহস করে বের হলো নিজের ইচ্ছে তে।রাস্তায় বের হতেই নবনী বুঝতে পারলো তার ভীষণ ভয় করছে।গলা শুকিয়ে আসছে।দোকান থেকে একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল নিয়ে নবনী বাবাকে নিয়ে রিকশায় উঠলো। গন্তব্য বেশিদূর না।
রিকশাওয়ালা কে এড্রেস বলতেই হাশেম আলী চমকে গেলেন।
নবনীর হাত ধরে বললো,”কি বলছস তুই এইটা?ওই বাসায় যাবি ক্যান?”
নবনী বললো,”ওই বাসায় যাবো না তো বাবা,ওই বিল্ডিং এ ফ্ল্যাট নিবো আমরা। ”
হাশেম আলী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন।কি বলছেন তার মেয়ে এটা?
ওখানে কেনো থাকবে?নবনীকে জিজ্ঞেস করতেই নবনী বললো,”বাবা,আমি ভুলে যাই নি সেদিনের কথা।যেদিন তুমি আমাকে দেখতে গিয়েছিলে সেদিন কি করেছিলো ওরা?
ওই মহিলা পাশের বাসার লোকদের কাছে তোমাকে আমার বাবা বলে পরিচয় দেয় নি।তার মান সম্মান না-কি চলে যাবে লোকে যদি জানে তুমি আমার বাবা।ওনার স্ট্যাটাস নষ্ট হবে।
আমার বাবা যেমনই হোক,যতোই খারাপ হোক তার আর্থিক অবস্থা,আমার জন্য তো তিনি আমার বাবা।আমার তো জন্মদাতা।আমার তো লজ্জা লাগে না তাকে বাবা বলতে।তাহলে ওদের কেনো লজ্জা লাগবে?
তারপর থেকে তুমি আর আমাকে দেখতে আসো নি।সেদিনের সেই অপমান আমি ভুলি না বাবা।আমি সেদিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি একদিন না একদিন এই বিল্ডিং এ আমার বাবা মা’কে এনে রাখবো।এটাই হবে আমার বাবাকে অপমান করার উত্তম প্রতিশোধ ”
হাশেম আলীর ভীষণ লজ্জা লাগলো। কবে কে কি বলেছে তিনি এসব নিয়ে মাথা ঘামান নি।তবে তারপর থেকে আর মেয়েকে নিজে দেখতে ও যান নি।তিনি এতোদিন ভাবতেন তার প্রবল আত্মসম্মানবোধ,এখন দেখলেন তার মেয়ের ও কোনো অংশে কম নেই।
১০ তলা বিল্ডিংটির সামনে রিকশা থেকে নামতেই নবনীর শরীরে অন্যরকম একটা শিহরণ বয়ে গেলো।একদিন এই বিল্ডিং থেকে অপমান আর হতাশা নিয়ে ফিরে গিয়েছিলো,আজকে আবার সেই বিল্ডিং এ এসেছে এক বুক স্বপ্ন নিয়ে।
দারোয়ান নবনীকে দেখে অবাক হয়ে বললো,”আপনি তামিম ভাইয়ের বউ না?”
নবনী হেসে বললো, “আগে ছিলাম এখন নেই,এখন তো তার সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে। ”
দারোয়ান অবাক হলো শুনে।তারপর বললো,”কি কন ভাবী?এই জন্যই কি আপনি হামিদ চাচা মরনের পরেও আসেন নাই? ”
নবনীর মাথায় যেনো বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। নবনী এই কথাটা শুনে সেখানেই সেন্স লেস হয়ে পড়ে গেলো। হাশেম আলী ভয় পেয়ে গেলেন মেয়ের অবস্থা দেখে। দারোয়ান আর তিনি মিলে পাঁজাকোল করে তাকে দারোয়ানের রুমে নিয়ে শুইয়ে দিলো।তারপর পানির ছিটকা দেয়ার পর নবনীর জ্ঞান ফিরে এলো। নবনী বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
হামিদুর রহমান মারা গেছেন এটা নবনীর কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। সুস্থ একটা মানুষ কিভাবে মারা গেলো,তাকে কেউ কিছু জানালো ও না পর্যন্ত?
দারোয়ান বললো,”আপনি খবর পান নাই ভাবী?চাচা একদিন সকালে লিফটেই অজ্ঞান হয়ে পইরা আছিলো।তারপর সামিম ভাই হাসপাতালে নিয়া গেলো।ডাক্তার কইলো স্ট্রোক করছে উনি।মইরা ও গেছে।”
নবনী জিজ্ঞেস করলো,”কতোদিন হয়েছে?”
দারোয়ান ভেবে বললো,”এই ধরেন ৩ মাসের মতো তো হইছে।”
নবনী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এতোক্ষণে বুঝা গেছে কেনো হামিদুর রহমানের সাথে সে ফোনে যোগাযোগ করতে পারে নি।
হতবিহ্বল হয়ে নবনী বসে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর দারোয়ান কে বললো,”ম্যানেজার আংকেল কে একবার কল দেন তো ভাই।”
দারোয়ান নবনীর কথামতো ম্যানেজারকে কল দিলো। ম্যানেজার থাকে ৭ তলায়।দারোয়ানের কল পেয়ে নিচে এলো। নবনীকে দেখে বললো,”তুমি তো মনে হয় তামিমের বউ?”
নবনী বললো,”এখন আমি কারো বউ না চাচা।আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। আমি এসেছি একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়ার জন্য। ফ্ল্যাট খালি আছে কি কোনো? ”
ম্যানেজার বললো,”হ্যাঁ তা তো আছেই।দুই তলায় একটা খালি আছে আর চার তলায় একটা। ”
নবনী যেনো আকাশের চাঁদ পেলো।বললো,”আমরা চার তলার ফ্ল্যাটে উঠতে চাই চাচা।”
চারতলায় তামিমরাও থাকে।নবনী এডভান্সের টাকা দিয়ে এলো ম্যানেজারকে।এরপর সোজা চলে গেলো হোটেলে।হোটেলের বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পড়লো।
রাবেয়া মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন মেয়ের মন খারাপ। হাশেম আলীকে জিজ্ঞেস করতেই হাশেম আলী বললো,”নবনী বাসা ঠিক কইরা আসছে।কোথায় জানো?তামিমদের পাশের বাসা নিছে নবনী।”
রাবেয়া চমকে গেলেন এই কথা শুনে। হাশেম আলী বললো,”রাবেয়া,হামিদ ভাই আর বাঁইচা নাই।আমার মাইয়া এই জন্য এরকম ভাইঙ্গা পড়ছে।”
রাবেয়া এই কথা শুনে হতবাক হয়ে গেলেন। সাব্বির,চৈতালী,ফাল্গুনী ও অবাক হলো শুনে।কেউ ভাবতেও পারে নি এরকম কিছু হতে পারে।
————–
নিতু আর তামিমের বিয়ে আজকে।তাহেরা বেগমের চাপে পড়ে তামিম বিয়ে করে নিতে বাধ্য হলো।তামিম আরেকটু সময় নিতে চেয়েছিলো সব জড়তা কাটিয়ে উঠার জন্য।নবনীকে ভুলতে।কিন্তু তাহেরা বেগম সেই সুযোগ দিলেন না।বিয়েতে তেমন কোনো আত্মীয় স্বজনকে জানানো হয় নি।তামিম আর নিতুর কয়েকজন কলিগ,অফিসের বস,লুবনা,তাহেরা,দিশা,তাহেরার দুই বোন আর পাশের ফ্ল্যাটের কয়েকজনকে বলা হয়েছে।সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ জনের মতো মেহমান হলো।বউ নিয়ে বরযাত্রী রাতে ফিরে এলো তামিমদের বাসায়।
বউ নিয়ে তামিম লিফটের জন্য অপেক্ষা করছিলো লিফট উপর থেকে নামার।লিফট নামতেই দরজা খুলে নবনী আর সাব্বির বের হয়ে এলো।
নবনীকে দেখে তামিম একটা ধাক্কা খেলো যেনো।নবনী ভালো করে তাকালো নিতুর দিকে।তাকিয়ে বুঝতে পারলো এই সেই মেয়ে যার ছবি নবনী দেখেছে।
তাহেরা বেগমসহ যারা ছিলো নবনীকে চিনতো তারা সবাই হতভম্ব হয়ে গেলো নবনীকে এখানে দেখে।নবনী কারো সাথে কোনো কথা না বলে বের হয়ে গেলো লিফট থেকে।তারপর লিফটের সামনে থেকে সাব্বির আর নবনী দুইটা তোষক মাথায় নিয়ে লিফটে গিয়ে দাঁড়ালো। তামিমেরাও লিফটে উঠলো।
চারতলায় লিফট থামতেই নবনী আর সাব্বির বের হয়ে গেলো। তারপর সোজা নিজেদের ফ্ল্যাটে ঢুকে গেলো। পিছনে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো বাকিরা সবাই।
সবাইকে এরকম অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিতু বললো,”কি হয়েছে?বাহিরেই দাঁড়িয়ে থাকবো না-কি? ”
তাহেরা বেগম নিজেকে সামলে ফ্ল্যাটের দরজা খুললেন। তামিম সোফায় বসে পড়লো ধুম করে। অনেকদিন পরে আজ নবনীকে দেখতে পেয়েছে সে।সেই নবনী যে কি-না তিন বছর তামিমের অর্ধাঙ্গিনী ছিলো।অথচ আজ দুজনের মধ্যে কতো যোজন যোজন দূরত্ব।
নবনীকে আজ ভালো করে খেয়াল করলো তামিম।খেয়াল করতেই দেখতে পেলো নবনী যেনো নিতুর চাইতে হাজার গুণ বেশি সুন্দর।
তামিমের মনে হলো নবনী আগের চাইতে অনেক বেশি সুন্দর হয়ে গিয়েছে। অনেকদিন পরে তামিম নবনীর হাতে সবুজ রেশমি চুড়ি দেখেছে।ফর্সা হাত দুটো কেমন কোমল মনে হচ্ছে।
তামিমের চরম অশান্তি শুরু হলো। বাসায় সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী আছে সেই কথা বেমালুম ভুলে গেলো তামিম।
দিশা মোটামুটি বিরক্ত এই বিয়েতে।দিশা চেয়েছিলো তামিমের বিয়ে তার বান্ধবী রুমির সাথে করাতে।তাহলে দুজন মিলে যখন যা ইচ্ছে করবে কিন্তু তাহেরা বেগম যেনো পাগল হয়ে গেছেন নিতুকে বিয়ে করাতে।
দিশা তবুও হাল ছাড়ে নি।মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো,যেভাবেই হোক তামিমের সাথে নিতুর ও বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ছাড়বে সে।
তাহেরা বেগম ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন নবনীকে দেখে।নিতু এখনো জানে না তামিমের আগে বিয়ে হয়েছে।জানলে হয়তো বিয়ে করতে রাজি হতো না সে।এজন্য তাহেরা বেগম তাড়াহুড়ো করে বিয়ে করিয়ে আনেন।এখন তার মনে হচ্ছে নিতু যেকোনো সময় জেনে যাবে সব।
তাহেরা বেগম ভেবে পেলেন না কি করবেন তিনি এখন।
নিতু অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে তামিমের জন্য।কিন্তু তামিম ড্রয়িং রুম থেকে যাচ্ছে না এখনো। ঘড়িতে রাত ১১ টা বাজে।নিতু এবার আর অপেক্ষা করলো না।উঠে এসে দেখে তামিম শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছাদের দিকে। নিতু এসে একটা ধাক্কা দিলো তামিমকে।তারপর বললো,”আমাকে একা রেখে তুমি এখানে এভাবে বসে আছো কেনো? সমস্যা কি তোমার? ”
তামিম জবাব দিতে পারলো না।তার যে আসলে কি সমস্যা তা সে নিজেই ভেবে উঠতে পারছে না।নিতু কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো। তামিম ও চলে গেলো। পরনের পাঞ্জাবি খুলে শুয়ে পড়লো বিছানায়। নিতুকে বললো,”আমার প্রচন্ড টায়ার্ড লাগছে নিতু।আজকে ঘুমাও।তুমিও টায়ার্ড। ”
নিতু ভীষণ অবাক হলো তামিমের কথায়।যে লোকটা সারাদিন নিতুর সাথে ফিজিক্যাল রিলেশন করার জন্য ঘ্যানঘ্যান করতো সে কি-না আজকে বিয়ে হয়ে আসার পরেও তার সাথে একটা কথাও বলছে না।অন্যসব তো পরের বিষয়। প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো নিতুর।নিজেকে মনে হলো ফেলনা কেউ।
রেগে গিয়ে সেই অবস্থায় নিতু শুয়ে পড়লো।
সকালে নিতুর ঘুম ভাঙলো তাহেরা বেগমের ডাকে।ঘড়িতে সবে সাতটা বাজে। নিতু বিরক্ত হলো। আটটার আগে নিতু ঘুম থেকে উঠে না।তাহেরা বেগমের ডাক শুনে নিতু বের হলো রুম থেকে শাড়ি চেঞ্জ করে।
তাহেরা বেগম মিষ্টি হেসে বললো,”নিতু মা,গহনাগাঁটি আমার কাছে দাও,আমি রেখে দিচ্ছি আমার আলমারিতে। ”
নিতু ভীষণ অবাক হলো শুনে।তারপর বললো,”কেনো মা?আমি যথেষ্ট ম্যাচিউর একজন মেয়ে,নিজের জিনিস নিজে সামলে রাখতে পারি। ওগুলো আমার স্বামীর দেওয়া অর্নামেন্টস,ওগুলো আমার কাছেই থাকবে।”
তাহেরা বেগমের মনে হলো তার গালে যেনো নিতু দুটো জুতার বারি মেরেছে। এরকম মুখের উপর কেউ তাকে মুখের উপর জবাব দিবে তা সে কখনো ভাবতে পারে নি।
নিতু আর কথা না বলে চলে গেলো।আজকে অনেকক্ষণ ঘুমাবে সে।তিন দিনের ছুটি পেয়েছে অফিস থেকে। এই তিন দিন ঘুমাবে সে।
তাহেরা বেগমের সারা শরীর ঘামে ভিজে গেলো। মনে মনে তাহেরা বেগম ভাবলেন,”আমি কি খাল কেটে কুমির নিয়ে এসেছি না-কি! ”
চলবে……..
রাজিয়া রহমান