তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (২৩)

#তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (২৩)

ক্যান্টিনে বসে নবনী কফিতে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছে।এরা কফি বেশ ভালো বানায়।নবনীর আজকাল কফি ছাড়া আর কিছু খেতে ইচ্ছে করে না।নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করে পারছে না আর।কেন জানি সে মেঘের দিকে তাকাতে পারে না কিছুতেই।
তার নিজের কাছেই নিজেকে বিরক্তিকর লাগে।।
একটা জীবনে এতো নাটক কেনো তার সাথেই ঘটলো?
কি হতো যদি বাবা তাদের লেভেলের কোনো পরিবারে তাকে বিয়ে দিতো!
তিন বেলা মাছ ভাত না হলেও ডাল ভাত খেয়ে তো স্বামী সংসার নিয়ে তার জীবন কাটিয়ে দিতে পারতো।
না হয় ঘর খানা আধভাঙ্গা হতো,জানালার শিক ভাঙ্গা থাকতো,ঝড় এলে ঘড়ের চাল উড়ে যাবার ভয় থাকতো,বৃষ্টি এলে চালের ফুটো দিয়ে পানি পড়তো,জোছনা রাতে ঘর ভেসে যেতো বাঁধভাঙ্গা চাঁদের আলোয়।
তবুও মনে সুখ থাকতো। দিন শেষে ক্লান্ত একজন তাকে বউ বলে ডেকে কাছে টেনে নিতো।

জীবনে তামিম নামে কোনো কালো অতীত থাকতো না,মেঘ নামের একটা ভাবনা থাকতো না। মেঘের কথা শুনলেও নবনীর বুক ধড়ফড় করে।

নবনীর সামনের চেয়ারে এসে নিতু বসে পড়লো এক প্লেট নুডলস নিয়ে।তারপর খেতে খেতে নবনীকে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি তো স্যারের পিএ তাই না?আসলে আমার ডেস্ক ৭ তলায় তো। আপনি আসার আগে যদিও একই ফ্লোরে ছিলাম আমি আর আমার হাজব্যান্ড।কিন্তু বিয়ের পর দিন থেকে আমাদের দুজনকে দুই ফ্লোরে দেওয়া হয়েছে,তাই আপনার সাথে ওভাবে কথা বলা হয়ে উঠে নি।আমি আর আমার হাজব্যান্ড এই অফিসেই জব করি।বাই দ্য ওয়ে,আমি নিতু।আপনি?”

নবনী শুকনো হেসে বললো, “নবনী।”

নিতু কিছুক্ষণ নবনীর দিকে তাকিয়ে বললো, “এক সেকেন্ড,আপনাকে মনে হচ্ছে অন্য কোথাও দেখেছি,মনে পড়ছে না। ”

নবনীর হাসি পেলো ভীষণ। ইচ্ছে করলো বলতে,”মনে পড়বে না তো আমি জানি মিসেস নিতু,আমার সংসার আপনার হয়ে গেলো, আমার জীবন আপনার জন্য তছনছ হয়ে গেলো, আপনি তা জানবেন না কিছুতেই।”

নিতু কিছুক্ষণ ভেবে বললো, “আমি ভুল না করে থাকলে আপনি আর আমরা একই বিল্ডিংয়ের একই ফ্লোরে থাকি,এম আই রাইট?”

নবনী হেসে বললো, “হ্যাঁ। ”

নিতু চোখ বড় করে তাকিয়ে বললো, “কি আশ্চর্য বলুন তো,একই ফ্লোরে থাকি আমরা, একই অফিসে জব করি,অথচ কেউ কাউকে চিনি না।দিন দিন আমরা রিয়েল লাইফে কেমন আনসোশ্যাল হয়ে যাচ্ছি দেখেছেন।অথচ আগে পরিচয় থাকলে ছুটির দিনগুলো আমাদের এতো বোরিং লাগতো না।একে অন্যের বাসায় গিয়ে চুটিয়ে আড্ডা দিতাম।”

নবনীর ভীষণ রাগ লাগছে নিতুর সাথে কথা বলতে। নিতুকে মনে হচ্ছে তার সবচেয়ে বড় ভিলেন তার লাইফের।যার এন্ট্রিতে নবনীর জীবন তছনছ হয়ে যেতে দেরি হয় নি।নিতুর সাথে হাসিমুখে কথা বলতে নবনীর ভীষণ রাগ লাগছে। ইচ্ছে করছে এক গ্লাস পানি নিতুর গায়ে ঢেলে দিতে। নিজেকে সামলে নবনী দাঁড়িয়ে বললো, “আমার একটু কাজ আছে,এখন আসি। পরে কথা হবে।”

নিতুর জবাবের অপেক্ষা না করে নবনী চলে গেলো ক্যান্টিন থেকে।
নিতু অবাক হলো নবনীর ব্যবহারে।নবনীর গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর নিতু নিজের খাওয়াতে মন দিলো।

নিজের ডেস্কে এসে বসার পর নবনীর কান্না এসে গেলো।
ইদানীং নবনী সবকিছুর উপর বিরক্ত হয়ে যায় সহজে।নিজেকে বারবার বুঝায় এভাবে বিরক্ত হবে না কিন্তু তাতে লাভ হয় না।
চেয়ারে বসে লম্বা একটা শ্বাস নিলো নবনী।তারপর ভাবলো,নিতুর সাথে এরকম ব্যবহার করা উচিৎ হয় নি তার।মেয়েটার কি দোষ!
মেয়েটা হয়তো এসব কিছু জানেই না,জানলে নিশ্চয় এরকম ইজিলি কথা বলতে পারতো না নবনীর সাথে।নবনীর যেমন অস্বস্তি লেগেছে ওর ও তেমন লাগতো।

আড়চোখে একবার মেঘের কেবিনের দিকে তাকালো। তারপর উঠে গেলো আবার ক্যান্টিনের দিকে।

তামিম আজকে অফিসে আসে নি।তাহেরা বেগমের হাঁটুতে ব্যথা,ডাক্তার দেখাতে গিয়েছে। নিতু ক্যান্টিনে বসে অলস সময় কাটাচ্ছে।লাঞ্চ টাইম এখনো ১৫ মিনিটের মতো বাকি আছে।
নবনী আবার এসে নিতুর সামনে বসে হাসলো। তারপর বললো,”সরি,তখন তাড়াহুড়ো করে চলে গিয়েছিলাম।”

নিতু মুচকি হেসে বললো, “ইটস ওকে।আপনি এর আগে কোথাও জব করেছেন না-কি এটাই ফার্স্ট? ”

নবনী হেসে বললো, “না এটাই ফার্স্ট আমার। ”

নিতু বললো, “আপনার লাক ভীষণ ভালো বলতে হবে তাহলে। ”

নবনী কিছুক্ষণ নিতুর দিকে তাকিয়ে বললো,”আপনার চাইতে ভালো হতে পারে নি। ”

নিতু বুঝতে পারলো না। আবার জিজ্ঞেস করতেই নবনী নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,”এই যে কি সুন্দর স্বামী স্ত্রী একই অফিসে জব করেন,একই সাথে আসা যাওয়া করতে পারেন,তাই বলছি।”

নিতু হাসলো শুনে।তারপর বললো,”সেটা ঠিক বলেছেন।তবে কি জানেন,আমরা তাই ভাবি যা বাহিরে দেখি।ভেতরে কার কি হচ্ছে আমরা তা জানি না তো,তাই বুঝি না কার বুকে কি আগুন জ্বলছে। ”

নবনী চমকালো এই কথা শুনে।অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “বুঝলাম না।”

নিতু হেসে বললো, “আসলে ঠিকই বুঝেছেন,কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছেন না মনে হয়। যাই হোক,আপনার সাথে কথা বলে ভীষণ ভালো লাগলো।”

নবনী ও হেসে বিদায় নিয়ে চলে এলো,লাঞ্চ টাইম শেষ হয়ে যাওয়ায়।

শুক্রবার বিকেলে নবনী রাবেয়া বেগমের বানানো সবগুলো কাঁথার ছবি তুললো।সর্বমোট ১৮ টা কাঁথা হয়েছে বিভিন্ন রঙের, বিভিন্ন ডিজাইনের।
ঘরের ভেতর ছবি ভালো আসছে না দেখে সাব্বির বললো,”চল আপা,ছাদে যাই।ওখানে ছবি তুলবো।অনলাইনে বিজনেস করার জন্য এই ছবি তলার ব্যাপারটা কিন্তু সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ছবি আর বাস্তবে ১৯/২০ পার্থক্য হলে তবুও মানা যায় কিন্তু এরকম ১৬/২০ হলে কিন্তু কেউ মেনে নিবে না।”

রাবেয়া বেগম বললেন, “চল তো মা,ছাদডা কেমন দেখি নাই তো কোনোদিন। আইজ একটু দেখি।”

ভাইবোন সবাই মিলে হৈহল্লা করে ছাদের দিকে গেলো। কাঁথা,শীতলপাটি,কিছু রঙিন স্টোন নিয়ে সবাই ছাদের দিকে গেলো।
ছাদে গিয়ে দেখে বিল্ডিংয়ের সব মহিলাই ছাদে আছে।এ যেনো এক মিলনমেলা বসেছে।সবার সাথে তাহেরা বেগম, দিশা,লুবনা ও আছে।

নবনী নিজেকে নিজে চোখ বন্ধ করে বললো, “এরা আমার অচেনা। এদের সামনে আমি মোটেও নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করবো না।এদের সাথে আমার এখন আর কোনো সম্পর্ক নেই।তাই কিছুতেই নিজের মন কে অশান্ত করা যাবে না।”

এক পাশে পাটি বিছিয়ে একটা গাঁদা ফুলের গাছ পাশে এনে সেখানে কাঁথা রেখে নবনী ছবি তুলছে।সাব্বির দাঁড়িয়ে বোনকে ডিরেকশন দিচ্ছে।
রাবেয়া বেগম ছাদে তাহেরা বেগমকে দেখে কিছুটা বিরক্ত হলেন যেনো।তার ফুলের মতো মেয়েটার জীবনে এই মহিলা কালবৈশাখী ঝড় হয়ে সব এলোমেলো করে দিয়েছে।এক সময় এই মহিলাকে তিনি প্রচন্ড ভয় পেতেন।নিজেকে তার ভীষণ অপরাধী লাগতো। এর সাথে কথা বলতে গেলে।অথচ এখন সময় পালটে গেছে।আজ তাকে রাবেয়া বেগমের ভয় লাগছে না।বরং বিরক্ত লাগছে এই ভেবে যে এরকম একটা ছোট মনের মানুষের সাথে দেখা হয়ে গেলো।

নবনী ছবি তুলতে তুলতে কয়েকজন অল্প বয়সী মহিলা এগিয়ে এলো নবনীর দিকে। যারা এতোদিন নবনী কে,এটা জানতো না,তারাও অন্যদের থেকে জেনে গেলো একসময় নবনী তাহেরা বেগমের পুত্রবধূ ছিলো,এখন ডিভোর্স হয়ে গেছে।
তারা সবাই তাহেরা বেগমকে ঘিরে ধরলো।

নবনীর পাশে গিয়ে একজন জিজ্ঞেস করলো, “এগুলো কি আপনি বানিয়েছেন? ”

নবনী হেসে বললো, “না,আমরা অল্প অল্প সাহায্য করেছি,আমার মা বানিয়েছেন মূলত। ”

অন্য একজন জিজ্ঞেস করলো, “কি করবেন এত কাঁথা?”

নবনী হেসে বললো, “সেল করবো।”

মহিলাদের মধ্যে ফিসফিস শুরু হয়ে গেলো। প্রায় ৫-১০ মিনিট ফিসফিস করার পর একজন বললো,”আমরা তিনজন,তিনটি কাঁথা কিনতে চাই।”

৩ টা বললেও সেখানেই নবনীর ৪ টা কাঁথা বিক্রি হয়ে গেলো। তাহেরা বেগম বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন নবনীর দিকে। এই নবনীকে তার ভীষণ অচেনা লাগছে।আত্মবিশ্বাসে ভরপুর এই নবনী তো তার ছেলের বউ ছিলো না।

নবনী টাকা মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বললো, “তোমার প্রথম উপার্জনের টাকা মা।”

রাবেয়া বেগম চমকে গেলেন। সামান্য একটা কথা,অথচ শুনেই তার বুকের ভেতর কেমন আন্দোলিত হয়ে উঠলো। চোখ টলমল হয়ে গেলো।

নবনী মা’কে জড়িয়ে ধরে বললো, “হুররে,আমার মা নিজে এখন স্বাবলম্বী হয়ে গেছে।”

নবনী বাসায় এসে সবগুলো ছবি বিভিন্ন গ্রুপে শেয়ার করলো।তারপর সোজা হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। সন্ধ্যায় নিতু এলো নবনীদের বাসায়। দরজা খুলে দিলো সাব্বির।নিতুকে দেখে সাব্বিরের মুখ কালো হয়ে গেলো। নিতু হেসে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছো?নবনী কোথায়? ”

সাব্বির ইশারায় নবনীর রুম দেখিয়ে দিলো। তারপর নিজের রুমে ঢুকে গেলো।

নিতু কিছুটা অবাক হলো এরকম ব্যবহারে,তারপর নবনীর রুমের দিকে গেলো।নবনীরা মা বোন সবাই মিলে গল্প করছে।নিতু গিয়ে সালাম দিল।

নবনী হেসে রাবেয়া বেগমকে বললো,”মা উনি হচ্ছে নিতু,আমরা একই অফিসে কাজ করি।আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের তামিম সাহেবের স্ত্রী উনি।”

মুহুর্তেই সবার মুখ থমথমে হয়ে গেলো,দু এক কথা বলে সবাই চলে গেলো। নিতু সবটা খেয়াল করলো। কিছু একটা সমস্যা হয়েছে নিতু বুঝতে পারলো। তবুও কিছুক্ষণ বসে সবার সাথে কথা বললো।

২০ মিনিট পর নিতু চলে গেলো। নিজেদের বাসায় ঢুকেই নিতু নিজে নিজে তামিমকে বলতে লাগলো, “জানো, আমাদের অফিসে যে কাজ করে নবনী,ওদের বাসায় গিয়েছি আমি।মেয়েটা এতো ভালো! আমার তো ভীষণ ভালো লেগেছে ওকে।”

তামিম চা’য়ে চুমুক দিচ্ছিলো,নবনীর কথা শুনে তামিমের হাত থেকে চায়ের কাপ পড়ে গেলো ফ্লোরে। তাহেরা বেগম নিজেও চমকালেন।নিতু সবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে? ”

তাহেরা বেগম দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,”ছোটলোকের বাচ্চা,কার অনুমতি নিয়ে তুই বাসার বাহিরে গিয়েছিস,তোকে আমি প্রথম দিনেই বলেছি আশেপাশের বাসায় যাওয়া আমার পছন্দ না।”

নিতু হেসে বললো, “আমি ছোট লোকের বাচ্চা না,বরং আপনি হলেন ফালতু মহিলা,যিনি কি-না নিজে সবার বাসায় গিয়ে মানুষের কাছে নিজের পুত্রবধূর বদনাম করেন।নিজেকে সবার কাছে অসহায়, সহজ সরল প্রমাণ করতে চান।প্রতিদিন অফিসে আসা যাওয়ার সময় আশেপাশের সব মানুষের কথা আমার কানে আসে।মূলত ওদের কথা শুনতেই আমি সিড়ি দিয়ে আসা যাওয়া করি।”

তারপর নিজের রুমে চলে গেলো নিতু।তামিম মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “এসব মোটেও ভালো কাজ করো নি তুমি মা।সহ্যের একটা সীমা থাকে,মনে রেখো।”

তামিম চলে যেতেই তাহেরা বেগম বিলাপ শুরু করলেন।ছেলে বউয়ের গোলাম হয়ে গেছে,তাকে দুই পয়সার দাম দেয় না।এসব বলে কাঁদতে লাগলেন।

নিতু বিছানায় শুয়ে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে লাগলো। তবুও খটকা রয়েই গেলো যেনো।

চলবে…..

রাজিয়া রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here