তুমি_আছো_মনের_গহীনে
পর্ব- ৩৩
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)
চোখের সামনে নিজের প্রাক্তন স্ত্রীর সাথে নিজের ভাইয়ের এতো চোখাচোখি অভ্রের কাছে অতিরিক্ত মাত্রায় বিরক্তির কারণ হয়ে উঠছে। অভ্র জানে মেহেভীন এখন আরহামের স্ত্রী,তবুও প্রাক্তন স্ত্রীকে অন্য কারো সাথে দেখলে অভ্রের বুকে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হয়। এই ব্যাথা উৎস কি তবে ভালোবাসা? গাড়ি প্রায় পার্বত্য চট্টগ্রামে অঞ্চলে প্রবেশ করলো। এই অঞ্চলে একটা ঝর্না রয়েছে। ঝর্নাটা প্রায় সবার কাছেই বেশ পরিচিত এবং জনপ্রিয়। আরহামদের গাড়ি পাহাড়ের কাছে আসতেই, মেহেভীন চিল্লিয়ে গাড়িটা থামাতে বলে। মেহেভীনের চিল্লানাতো সবাই কিছুটা অবাক হয়। আরহাম গাড়ি থামিয়ে দেয়। গাড়ি থামাতেই, মেহেভীন গাড়ি থেকে কিছুটা হন্তদন্ত হয়ে বেড়িয়ে যায়। মেহেভীনকে এইভানে বেড়োতে দেখে, আরহাম মেহেভীনকে থামাতে রাগান্বিত গলায় বলে,
‘ স্টুপিড মেয়ে, এইভাবে দৌড়াচ্ছো কেন? পড়ে যাবে তো। ‘
মেহেভীন থামে না। সে ঝর্নার দিকে ছুটে যেতে থাকে। আরহাম ও মেহেভীনের পিছনে পিছনে যেতে থাকে। মেহেভীন ও আরহাম ঝর্নার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। প্রকৃতির অপরুপ মুগ্ধতায় তারা যেন একপ্রকার ঢুবে গেছে।ঝর্ণার জলরাশি উঁচু পাহাড় থেকে আছড়ে পড়ছে। জলধারা নীচে নেমে যাচ্ছে উচু পাহাড় গড়িয়ে। ঝর্ণার কাছে দাড়ালেই দেহ মন ভরে উঠছে পবিত্র স্নিগদ্ধতায়। মেহেভীনের কাছে ঝর্ণার সৌন্দর্য সম্পর্কে যতটুকু কল্পনা ছিলো তার থেকেও অধিক সুন্দর ঝর্নাটি। ঝর্নাটির কাছা-কাছি অনেকগুলো পাহাড় রয়েছে।
মেহেভীন কছর্ণা পর্যন্ত যাতায়াতের উচুনিচু রাস্তা আর পাশের তাকালেই সে বুঝতে পারে, পাহাড় তাকে যেন এনে দিচ্ছে রোমাঞ্চকর অনুভুতি। বাকিরাও চলে আসে ততক্ষনে। সকলেই পরিবেশটা বেশ উপভোগ করছে। আরিয়ান ক্যামেরা নিয়ে চারদিকে ছবি তুলছে। রুশা ও তাহসান নিজেদের মাঝে কথা বলছে। যদিও রুশা চুপ। তাহসানই কথা বলে রুশার মন ভালো করার চেস্টা করছে। এতো সুন্দর পরিবেশ দেখে, মায়রা নিজেকে সামলাতো পারলো না, অভ্রের হাত ধরে মহান্দনের সাথে বললো,
‘ অভ্র তোমার কিছু মনে পড়ে? আমরা যখন বিদেশে ছিলাম,তখন এইরকম কত সুন্দর জায়গায় আমরা একা একা বেড়িয়ে পড়তাম। আজ যেন সবকিছুই অতীত। ‘
শেষের কথাটি বলতে গিয়ে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো মায়রার। অভ্রের সেদিকে খেয়াল নেই, সে তো অন্য চিন্তায় মগ্ন, তার দৃষ্টি বরাবরের মতো সামনের দিকে মিষ্টি কপোতির দিকে। মেহেভীন বার বার ঝর্না থেকে বার বার পানি নিয়ে আরহামের মুখে ছিটাচ্ছে আরহামকে জ্বালানোর জন্যে এবং আরহাম বার বার স্টুপিড বলছে মেহেভীনকে। মেহেভীন তা শুনে খিলখিল করে হাঁসতে থাকে, মেহেভীনের সাথে তাল মিলিয়ে মৃদ্যু হাঁসে আরহাম। মেহেভীনকে এতোদিন পরে এতেটা প্রানবন্তভাবে হাসতে দেখে অভ্রের ভালালাগা কাজ করে। তার মনে শুধু একটাই কথা বলে, তার একটা ভূলের জন্যে মেয়েটার এই মায়বী হাসিটা হারিয়ে গেয়েছিলো, সে যদি মেহেভীনের সাথে ভালোবাসার নাটক না করতো,তাহলে তো আজ আরহামের জায়গায় সে থাকতো। মেহেভীন সব হাসি -খুশি থাকার কারণ অভ্র হলে কি খুব ক্ষতি হতো? অভ্রের ধ্যান ভাঙ্গে আরহামের কর্কষ গলা শুনে। আরহাম এইবার কিছুটা রেগে গেছে মনে হয়। বার বার মেহেভীনকে মানা করছে, তবুও মেহেভীন শুনে কার কথা? সে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে আরহামের উপর।
‘ মেহেভীনের স্টুপিডের মতো এইভাবে পানি ছিটাচ্ছো কেন? আমি একদম ভিজে গেছি। ‘
মেহেভীন আরহামের কথা না শুনে খিলখিল করে হেসে আরহামকে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। এইবার আরহাম ও পানি নিয়ে, মেহেভীনকে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। মেহেভীন হেসে উঠে। আরিয়ান এইরকম সুন্দর মুহুর্তাটাকে ক্যামেরাবন্দী করে ফেললো।
অভ্রকে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে, মজনু অভ্র এবং মায়রার কাছে এসে মায়রাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ভাবি গো? অভ্র ভাইজানের কি জ্বীনের আচর লাগছে নি? ‘
মজনুর এমন কথা শুনে, অভ্র ও মায়রা ভরকে যায়। অভ্র ধমকে বলে,
‘ এই তুমি বলতে চাইছো কি? ‘
মজনু তার ৩২টা দাঁত বের করে বলে,
‘ আসলে আপ্নারে যখনি দেখি তখনি খেয়াল করি আপনি খালি চাইয়া থাকেন আমার বড় ভাইজান আর ভাবির দিকে। আমাগো গ্রেরামে এক বেডা আছিলো বুঝছেন নি? নাম আছিলো মদন। দেখতে কি কালার কালা। দাঁত তো একেবারে নাই বলতে গেলে চলে। একবারে আপনার মতো।
‘ মানে কি বলতে চাইছো তুমি? আমি দেখতে কালো? আমার দাঁত নেই?
অভ্রের রাগান্বিত গলায় বলা প্রশ্নের জবাবে, মজনু বলে,
‘ আরে ভাইজান আফনে আবার উল্টা বুঝেন কেন?
আফনে তো মাশা-আল্লাহ হিরোর মতো দেখতে।
আমি তো কইতাছি যে আপনার ওর মতো অভ্যাস।
মদন সারাদিন খালি চাইয়া থাকতো হুদাই।পরে সবাই জানতে পারলাম আসলে ওর জ্বীনের আচর লাগছিলো। পরে অনেক ঝাড়া–ঝাড়ির পরে ওইডা ঠিক হয়। আমাকো গ্রেরামে কাব্লা বাবা ঠিক করে দিছিলো। ভাবি আপনার কি কাব্লা বাবার নাম্বার লাগবো? ‘
মায়রা হেসে দিলো।
অভ্র এইসব সহ্য করতে না পেরে, বললো,
‘ হেই ইউ ইডিয়েট। জাস্ট গেট লস! ‘
‘ এমন করেন কে? আজ-কাল কারো ভালোও করতে নাই। ‘
মজনু মুখ বেকিয়ে চলে যায়।
______ [লেখিকা ঃজান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি]
আরিয়ান নিজের হাতের ক্যামেরাটা নিয়ে, ছবি তুলতে থাকে। তখনি কেউ এসে তাকে খপ করে জড়িয়ে ধরে। এইভাবে কেউ হুট করে জড়িয়ে ধরায়, আরিয়ান চমকে পিছনে তাকাতেই দেখে ফারিয়া। ফারিয়াও আরিয়ানকে দেখে একপ্রকার শকড হয়ে যায়। সে এই মুহুর্তে আশা করেনি আরিয়ানকে।
‘ ডাক্তার সাহেব! আপনি এখানে? ‘
‘ আমারও একি প্রশ্ন! আপনি এখানে কি করে? ‘
ফারিয়া এদিকে সেদিকে তাকিয়ে শুকনো মুখে বললো,
‘ আসলে আপনাকে বলেছিলাম না? আমি ট্যাুরে যাচ্ছি বান্ধুবিদের সাথে। আমি আমার বান্ধুবিদের সাথে চট্টগ্রামে এসেছিলাম, আজ আমাদের এখানে শেষ দিন ছিলো। আমার ফ্রেন্ডগুলো এতো হারামি আমাকে ছেড়েই কই যেন হারিয়ে গেলো। এখন ওদের পাচ্ছিও না। আমার ফোনটাও নষ্ট হয়ে গেছে।
ওরা এখন কোথায় কীভাবে আছে কে জানে? ‘
‘ আমি যে যদি ভূল না হই,তাহলে ওরা নয় আপনি হারিয়ে গেছেন তাইতো? আপনি পথটা হারিয়ে ফেলেছেন? ‘
আরিয়ানের প্রশ্নে মাথা নিচু করে, ফারিয়া জবাব দেয়,
‘ আসলে ওদের হোটেলে রেখেই, আমি চট্টগ্রাম ঘুড়তে বেডিয়েছিলাম সকাল-সকাল। এখন পথটাও হারিয়ে ফেলেছি। তার মধ্যে কয়েকজন বাজে লোক আমার পিছন নিচ্ছিলো, তাই দৌড়ে এসে আপনাকে দেখে জড়িয়ে ধরলাম।’
আরিয়ান নিজের চশমাটা পড়ে বললো,
‘ এইরকম বাদরামী করলে, হারিয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক।’
ফারিয়া কিছুটা রেগে বললো,
‘ কি বললেন? আমি বাদরামী করি? ‘
‘ সত্যিই তো বললাম। এখন ভাবুন আপনি কিকরে নিজের হোটেলে ফিরবেন? ‘
ফারিয়াও চুপ হয়ে যায়। সে আসলে বুঝতে পারছে না, সে কি করবে? আরিয়ান এইবার টেডি স্মাইল দিয়ে বলে,
‘ আমি আমার ফ্যামেলির সাথেই এখানে এসেছি।চাইলে আজকে তুমি আমাদের সাথে জয়েন করতে পারো, কালকে তোমার ফ্রেন্ডদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিবো। ‘
ফারিয়া কিছু একটা ভেবে সম্মতি জানায়। এমনিতেও এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখন আরিয়ানের কথাটাতেই সায় দেওয়া ঠিক মনে করলো ফারিয়া। আরিয়ান ফারিয়াকে নিয়ে, সবার কাছে গিয়ে ফারিয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দে, ফ্রেন্ড বলে। ফারিয়ার সাথেও সবাই হাঁসিমুখে মিশে যায়।
_________
সবাই মিলে অনেক্ষন ঘুরাঘুরিও করলো।মায়রাও আজ প্রচন্ডভাবে সবকিছু উপভোগ করেছে, যদিও অভ্র শুধুমাত্র নিরব দর্শকের মতোই ছিলো।
এখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। সবাই ঠিক করেছে, এখন হোটলে ফিরবে,কিন্তু পাশে নাঁচগানের আওয়াজ শুনে, মেহেভীনের খুব ইচ্ছে ছিলো একটিবার দেখার,কিন্তু আরহাম তাতে ব্যাঘাত ঘটিয়ে বললো,
‘ একদম না। এখন আমাদের হোটেলে যাওয়া দরকার,এতোক্ষন বাইরে থাকা তোমার পক্ষে ঠিক নয় মেহেভীন। ‘
মেহেভীন মনটা খারাপ করে ফেলে।
ফারিয়াও মেহেভীনের সাথে তাল মিলিয়ে বললো,
‘ শুনেছি এই অঞ্চলে অনেক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী থাকেন। হয়তো তারাই নাঁচ গান করছেন। আমার কিন্তু দেখার খুব শখ। আমিও যাবো মেহেভীন আপুর সাথে। ‘
মেহেভীন ফারিয়ার কথা শুনে হাসিমুখে আরহামের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ দেখলেন? ফারিয়াও যেতে চায়। আচ্ছা আমিও যাই কেমন? ‘
মেহেভীন ও ফারিয়া একে -অপরের হাত ধরে সামনের দিকে যেতে থাকে।
এক কয়েক ঘন্টায় ফারিয়া এবং মেহেভীনের ভালোই বন্ধত্ব হয়ে গেছে। ফারিয়া ও মেহেভীনকে যেতে দেখে, বাকিরাও তাদের সাথে যায়। তাদের দেখে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীরা তাদেরকে নিজেদের অনুষ্টানে যোগ দেওয়ার জন্যে আমন্ত্রন জানায়। তারা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী হলেও, তারা শুদ্ধ ভাষাতেই কথা বলে। তারাও যোগ দেয়। মেহেভীন খেয়াল করছে, অনেক মেয়েরা আরহামের দিকে নিজেদের সাথে ফিসফিস করে বলছে,
‘ দেখ শহর থেকে ছেলেগুলো আসছে, কি সুন্দর দেখতে তাইনা? ‘
‘ হু সব গুলোই সুন্দর,কিন্তু মাঝখানের টা দেখ একেবারে রাজপুত্র যেন। ‘
মেহেভীন খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে, তারা আরহামকে উদ্দেশ্য করেই বলছে। মেহেভীনের কেন যেন ভালো লাগছে না শুনতে।
কয়েকজন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মেয়েরা নাঁচতে নাঁচতে আরহাম ও আরিয়ানকে ঘিড়ে ধরে নাঁচতে থাকে। ফারিয়া কি মনে করে যেন আরিয়ানকে টেনে নিয়ে, আরিয়ানের সাথে নাঁচতে থাকে। তার ভাষ্যমতে তার ডাক্তার সাহেবের সাথে অন্য কেউ নাঁচতে পারেনা। ফারিয়ার এমন কান্ডে আরিয়ান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। তাহসান ও রুশা বসে আছে নিজেদের মতো। অভ্র ও বেশ খানিক দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মায়রাও অভ্রের পাশে দাড়িয়ে আছে। আরহাম বেচারা পড়েছে বিপাকে। এতোগুলো মেয়ের মাঝে সে বড্ড অস্বস্হিতে ভোগছে। আরহান স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মেহেভীন কেমন একটা আগুনরুপী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে,ভিতরের রাগটা ঠিক প্রকাশ করতে পারছে না। মেহেভীন নিজেও জানে না কেন তার এতো রাগ হচ্ছে মেয়েগুলোর প্রতি। শুধু অসহ্য লাগছে তার কীভাবে আরহামের সাথে চিপকে নাঁচানাচি করছে। আরহাম কিছু একটা ভেবে নাঁচে যোগ দিলো। মেহেভীনের রাগ তো নাকের ঢগায় চলে আসলো, তখনি কিছু বৃদ্ধ মহিলারা এসে, মেহেভীনকে কিছু একটা বলে তাদের সাথে নিয়ে গেলো। মেহেভীনকে হঠাৎ গাঁয়েব হয়ে যেতে দেখে আরহাম নাঁচ বন্ধ করে দিলো। মেহেভীন কোথায় গেলো?
চলবে……কী?
[কেমন হয়েছে জানাবেন কিন্তু, প্লিয ঘটনমূলক কমেন্ট করবেন 😎]