ত্রয়ী পর্ব ১৩

0
1307

ত্রয়ী
মোর্শেদা হোসেন রুবি
১৩||

মায়ের মুখের সামনে অষুধ ধরে বসে আছে মিলি। ওকে এ মুহূর্তে ঠিক মুর্তির মত দেখাচ্ছে। বাম হাতে পানির গ্লাস। ডান হাতে অষুধ। মা সেই পানি নিচ্ছেন না। বুকে হাত চেপে ধরে কাশছেন। কাশতে কাশতে তার গলা ছিলে যাবার দশা হয়েছে কিন্তু কাশি থামার কোন লক্ষণ নেই। মিলির তাতে কোন ভাবান্তর হচ্ছে না। সে একদৃষ্টিতে মায়ের কাশি দেখছে। একটা দৃশ্য যতই উত্তেজক হোক না কেন। বারবার দেখলে উত্তেজনা মরে গিয়ে অনুভূতি ভোঁতা হতে বাধ্য। মিলির অবস্থা অনেকটা সেরকম। মায়ের সবচেয়ে কাছে থাকে সে। বড়আপা মাঝেমধ্যে আসে দুচার দিন বা সপ্তাহখানেক থেকে চলে যায়, শিরি গায়ে বাতাস দিয়ে বেড়ানো মেয়ে। সে মায়ের সাতে পাঁচে নাই। সারাদিন নাকের কাছে বই ধরে রাখবে আর মিটমিট করে হাসবে নয়ত হাঁ করে হিন্দী সিরিয়াল গিলবে। সে তুলনায় সাবা অন্যরকম। বয়সে সবার ছোট হয়েও সে ঘরের অনেক দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছে। ঘরের ছোটখাট পুরুষালি কাজগুলো সেই করে থাকে। যেমন বাজার করা, বিল দেয়া, পিচ্চিদুটোর স্কুলে খোঁজখবর করা ইত্যাদি। মিলি আর সাবার কাজ প্রায় একই। একজনের অনুপস্থিতিতে আরেকজন ঘর সামলায়। সে তুলনায় শিরি ঝাড়া হাত পা। আর বিপুল এখনও দায়িত্ব নেবার মত বয়সে আসেনি। মাত্র এগার চলছে তার।

সাবা ঘরে ঢুকে মিলিকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে গিয়ে হাত থেকে গ্লাস আর অষুধ নিয়ে বলল, ” মিলি আপু, তুমি সামনের ঘরে যাও। আমি মা’কে অষুধ খাওয়াচ্ছি। ” মিলির ধ্যান ভঙ্গ হল। সে তাকাল বোনের দিকে।
-” সামনের ঘরে কী ? ”
-” গেলেই দেখবে। তবে বিনীত অনুরোধ থাকবে। রাগারাগি করবে না। রাগলে তোমার কণ্ঠ ফাঁটাবাশের মত বিশ্রী শোনায়। ”
মিলি কঠিন কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে সামনের ঘরে চলে এল। মঈন বসে আছে। ঠিক বসে নেই। বিপুলকে ছবি আঁকা শেখাচ্ছে। মিলি তীব্রস্বরে বলল, ” এত রাতে আপনি ? ”
মঈন প্রায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। ইতস্তত করে অনেকটা কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলল, ” ইয়ে, আমি আসলে একটা পারিবারিক কাজে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম। সে কারণেই সন্ধ্যায় আসতে পারিনি।”
– ” সেটা আপনার ব্যপার। আপনি তো সেই কৈফিয়ত আমাকে দিতে বাধ্য নন, তাই না ? আমি জানতে চেয়েছি, এত রাতে কেন এসেছেন ? ”
-” না মানে, আমার তো সন্ধ্যায় আসার কথা ছিল।”
-” ছিল নাকী ? ” ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বলল মিলি। মঈন লজ্জিত স্বরে কিছু বলতে যাবার আগেই মিলি বলে উঠল, ” আসলে কী জানেন, আপনার নীলিমা আপা আপনার মত অন্তত দ্বিমুখী নন। অযথাই মহিলাকে ভিলেন বানিয়ে উপস্থাপন করে কিছু সস্তা সিমপ্যাথী পাবার চেষ্টা না করলেই পারেন। তিনি যেমন মানুষ তেমনই ভাব ধরেন। আপনার মত মেকি ভদ্রতা দেখান না। ”
-” আমি মেকি ভদ্রতা দেখাই ? এমন কোন আচরণ দেখেছেন আমার মধ্যে যেটা আপনার কাছে মেকি বলে মনে হয়েছে ? ”
-” বাহ্, হাসপাতাল থেকে পৌঁছে দিয়ে পাগলপারা হয়ে সবাইকে ফোন করে এমনভাবে ঘরোয়া মিটিং ডাকলেন যেন আমাকে বিয়ে করতে না পারলে আপনার সব আটকে আছে। আজই সব করতে হবে। অথচ আপনার ডাকা মিটিং এ সবাই যখন এসে বসে থাকে তখন ন্যুনতম একটা ফোন দিয়ে নিজের ব্যস্ততার ফিরিস্তি দেবার মত সময় আপনার হয় না। আপনাকে মেকি বলব না তো কী বলব বলুন। শোকর করুন, ফ্রড বলিনি। আপনি ভাব ধরেন এক কিন্তু কাজ করেন আরেক। এ ধরণের লোককে আমরা মেকিই বলি।”
-” দেখুন, আমার পরিস্থিতি যদি বুঝতেন তাহলে এসব বলতেন না।”
-” আপনার পরিন্থিতি বুঝি বলেই ধীরে সুস্থে এগােতে বলেছিলাম কিন্তু আপনিই তাড়াহুড়া করলেন। এখন আপনিই নানান অযুহাত দাঁড় করাচ্ছেন। ”
-” আমি কী করতে পারতাম বলেন। বিয়ের তাড়াটাও তো আমার, আবার সমস্যাটাও আমারই তৈরী। আজ আমি ঐদিকে না থাকলে আপা হাঙ্গামা খাড়া করতেন। ”
-” সেক্ষেত্রে আমি আপনার মধ্যে আরো স্বাবলম্বীতা আশা করব। এরকম লেস পার্সোনালিটির লোককে সাথে নিয়ে আর যাই হোক জীবনযুদ্ধে জেতা যায় না। আপনার প্রতি বিনীত অনুরোধ থাকবে, বিয়ে নিয়ে আর কোন সুর তুলবেন না, প্লিজ। যথেষ্ট হয়েছে।’
-” মানে ? ”
-” মানে সহজ। আমার পরিবারকে আমি আর সেধে অপদস্থ হতে দেব না। কারণ বিয়ে করার পরও দেখা যাবে বউকে বোনের সামনে ঠেলে দিয়ে আপনি হাওয়া হয়ে যাবেন। আর আপনার ঐ অহংকারী বোনের সাথে এতটা তর্কবিতর্কের জন্য আমি এখনই এতটা প্রস্তুত নই। রাত অনেক হয়েছে। আপনি এখন বাড়ী গিয়ে বিশ্রাম নিন। আর চা খেতে চাইলে বসুন, আমি কারো হাতে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

মিলি চলে গেল মঈন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার আজ অনেক কথা বলার ছিল মিলিকে। কিন্তু সেটা আর বলা হলো না। সব ঠিক থাকলে আজ হতো মিলি আর ওর বিয়ের প্রথম রাত। কিন্তু শুধু ওর বোকামীর কারণে আজ মিলি পর হয়ে গেল। লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল মঈনের। ক্লান্ত পায়ে রাস্তায় বেরিয়ে এল। জীবনে এই একটা জিনিসই মন থেকে চেয়েছিল। আর নিজের ভুলেই বুঝি আজ তা হারাল।

=====

সায়রার ব্যাগ গোছানো শেষ। নীলিমা মেয়েকে ছোটখাট উপদেশের সাথে নানান ধরণের বুদ্ধিও ভরে দিলেন ঘটে। কীভাবে একটা ছেলের মন জয় করতে হয় আর এবং ব্যক্তিত্ব যাচাই করতে হয়। যদিও নীলিমা জানেন, বারসাত একজন ভাল ছেলে। দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা। বয়সেও ফিঁচকে নয়। তারপরেও সায়রার উচিত হবে বারসাতের সম্পর্কে যতটা সম্ভব জেনে নেয়া। আর এটা চোখ কান খোলা রাখলেই সম্ভব।
আজ রাতেই বারসাত তার মা’কে নিয়ে দার্জিলিং রওনা দিচ্ছে। নীলিমা বুদ্ধি করে ওদের সাথেই ভিড়িয়ে দিয়েছেন সায়রাকে। তার ধারণা ঢাকা থেকে দার্জিলিং যেতে যেতে বারসাতকে অর্ধেক জানা হয়ে যাবে সায়রার। তাছাড়া বারসাতের মা সায়রাকে ভীষণ পছন্দ করেছেন। সে তুলনায় বারসাত রির্লিপ্ত। সে এখনও তার মতামত জানায়নি। বারসাতের মা জানিয়েছেন, ছেলের সাথে কথা বলে শীঘ্রই জানাবেন তিনি। তাঁরও ইচ্ছা বারসাত সায়রার ব্যপারে আরো ভাল করে জানুক। সায়রাকে নিজেদের সাথে গাড়ীতে নেবার বুদ্ধিটা মূলত তাঁরই। আজ সেই পরিকল্পনারই বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। সায়রা ব্যাগ গুছিয়ে হিজাব বাঁধতে বাঁধতেই শুনল নিচে গাড়ীর হর্ণ দিচ্ছে। উঁকি দিতেই দেখল নিচে বারসাতের গাড়ী এসে দাঁড়িয়েছে। সায়রা চটপট আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সযত্নে হিজাব বেঁধে ফেলল। তারপর নিজেকেই দেখে নিয়ে বলল, ” হুঁহ্, আমাকে দার্জিলিং নিয়ে যাবার এত আগ্রহ। দেখা যাবে, এই আগ্রহ কতক্ষণ টেকে। সায়রা বাণুকে তো চেনোনা। যখন চিনবে তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি বলে পালাবে । ”

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here