ত্রয়ী পর্ব ১৪

0
886

ত্রয়ী
মোর্শেদা হোসেন রুবি
১৪||

নিচে নামার আগে দ্রুত মোবাইল বের করে তোয়াকে ফোন দিল সায়রা। তারপর সাবাকে। ওদের সাথে দেখা না করে সে বাংলাদেশ ছাড়বে না। ওরাও দেখা করার জন্য একপায়ে খাড়া। দুজনের সাথে প্রয়োজনীয় কথা শেষ করে খানিক ইতস্তত করে আরমানকে ফোন দিল সায়রা। ওর আগের নাম্বারেই। পাওয়া গেল ওকে।
ফোন ধরে কিছুটা নির্লিপ্ত গলায় বলল, ” হ্যাঁ, বলো সায়রা। ” সায়রা চটে গেল ওর বলার ভঙ্গি দেখে। যেন রোজ একবার ফোনে কথা হয় এমন ভাব আরমানের। তবে দ্রুত নিজেকে সামলে নিল। শান্ত ভঙ্গিতেই বলল, ” কিছু বলার জন্য ফোন দেইনি আরমান। বিদায় নেবার জন্য ফোন দিয়েছি। একইসাথে ক্ষমা চাইতেও।”
-” মানে ? কীসের ক্ষমা ? ”
-” বাহ্, আপনাকে যে এত বিরক্ত করলাম। তার জন্য ক্ষমা চাইব না ? ”
-” বুঝলাম। আর বিদায় ? ”
-” বিদায় মানে আমি চলে যাচ্ছি। বাংলাদেশ ছেড়ে। আর কোনদিন এই আধাপাগল মেয়েটা আপনাকে জ্বালাতে আসবেনা। তাই ক্ষমা এবং বিদায় দুটোই চাইছি। ”
এপাশে আরমান নিরব। সায়রা কান্নাভেজা কণ্ঠে বলল, ” রাখি আরমান ভাই। ” আরমান তবু কোন জবাব দিল না।
সায়রা ফের বলল, ” আর একটা কথা আরমান ভাই। আপনাকে আমি কোনদিন ভুলব না। বুড়ো হয়ে যাবার পরও না। কোন একদিন হয়ত আমার নাতি নাতনীদের নিয়ে গল্প করার সময় বলব, জানো, একদিন আমি সাভার গিয়েছিলাম। আরমান নামের একটা ছেলের বাইকে করে। তারপর সেখানে কিছু গুন্ডা আমাদের এটাক করল। তারপর….!’
-” সায়রা। ”
-” জি ? ”
-” তুমি কী সত্যি চলে যাচ্ছ ? ”
-” বিশ্বাস না হলে এসে দেখে যান।”
-” কোথায় আসব ? ”
-” আমি মৌচাকের সামনে দিয়ে যাব। ওখানে মৌচাক মার্কেটে আমার দুই বান্ধবী আসবে আমার সাথে শেষ দেখা করার জন্য।”
-” শেষ দেখা মানে ? তুমি কী জীবনে বাংলাদেশ আসবা না ? ”
-” কেন আসব, কে আছে এখানে ? ”
-” একদম ঢং করবা না বলে দিলাম।”
-” আমি আর কিছুই করব না, গুড বায়….!” ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সায়রা।
আরমান ধমকের সুরে বলল, ” ফালতু কথা বন্ধ কর। আচ্ছা তোমার সাথে আর কে যাচ্ছে। তোর বাবা-মা?”
-” নাহ্। আমার পাণীপ্রার্থী বার্সাত মির্জা। টল ব্রাইট হ্যান্ডসাম। একটু পুতুপুতু ভাব আছে। মানিযে নেব। কী আর করা।”
-” আমাকে দেখলে উনি মাইন্ড করবেন না? ”
-” আপনি যদি ওনাকে দেখে মাইন্ড না করেন তাহলে উনি কেন করবেন ? আমি আপনাদের দুজনের কাউকেই তো বিয়ে করিনি। ”
আরমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ” আচ্ছা, ফোন রাখ। আমি মৌচাক আসছি।”
-” তারপর..?”
-” তারপর কী ? ”
-” আপনি কেন আসবেন ? আমাকে বিদায় দিতে ? ”
-” তাহলে ? ”
-” তাহলে আপনার আসার দরকার নেই।” কঠিন স্বরে বলেই ফোন কেটে দিল সায়রা। শান্ত মুখে নিচে নামল। গাড়ীতে ওঠার আগ পর্যন্ত নীলিমা ফিসফিসিয়ে বারবার মেয়েকে এটা সেটা বলে বুঝিয়ে দিতে লাগলেন। একপর্যায়ে সায়রা বিরক্ত হয়ে গেল।
-” উফ্, মা। মাত্র সাতদিনের জন্য যাচ্ছি আমি । সাত বছরের জন্য না।”
-” আহা, সাতদিনের কথা কে বলেছে তোকে ? তোর ভাল লাগলে তুই আরো কিছুদিন থেকে যাবি। কে তোকে দিব্যি দিয়েছে যে সাতদিনের মধ্যেই ফিরে আসতে হবে ? ”
-” কেউ দেয়নি। কিন্তু এদেশ ছেড়ে আমি বেশীদিন থাকতে পারব না। তোমার আর আব্বুর পীড়াপীড়িতে যাচ্ছি। নয়ত যেতাম না। এখানকার লোকগুলোকেও একটু শিক্ষা দিতে চাই। কাজেই তোমরা যদি মনে কর আমি এখানকার সব ভুলে দার্জিলিং এ বসে থাকার জন্য যাচ্ছি তাহলে বলব দিবা স্বপ্ন দেখা বন্ধ কর। হাম উঁয়াহা সাতদিন সে জেয়াদা একদিন ভি নাহি রাহেঙ্গে। এন্ড আই থিঙ্ক ইউ নো মি।”
-” আমাকে রাগাবি না সায়রা। কী আছে এখানে যে বাংলাদেশে আসার জন্য পাগল হয়েছিস ? ”
-” আমার সবই তো এখানে পড়ে রইল আম্মু। কী আছে মানে ? ” বলতে গিয়ে চোখ ভিজে উঠল সায়রার।
নীচে নামার পর বারসাতের সাথে দেখা হল। তার মা আসেন নি। তার এক বোনের বাড়ীতে আছেন। যাবার পথে তাকে সেখান থেকে তুলে নিতে হবে। জানালেন নীলিমা। সায়রা কোন কথা না বলে সোজা গাড়ীতে উঠে পড়ল। বারসাত ফোনে কারো সাথে কথা বলছিল। তার ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করল ওর মারাঠী ড্রাইভার । বারসাত কথা শেষ করে সায়রার আম্মুর কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলে নীলিমা বিনয়ী কণ্ঠে বললেন, ” আমার মেয়েটা বড় অভিমানী বাবা। একটু জেদী প্রকৃতির। আমাকে আর ওর বাবাকে রেখে যেতেই চাচ্ছিল না। ঐদিকে রুৎবা পাগল হয়ে আছে ওর জন্য। রুৎবা ওর মেয়েটার রেজাল্ট সেলিব্রেট করবে। সায়রাকে ছাড়া করতে চাচ্ছেনা। ভাবলাম তোমরা যখন যাচ্ছই। নইলে ওকে প্লেনে তুলে দিলেই হতো। পঁয়ত্রিশ মিনিটের বেশী লাগেনা, তুমি তো জানোই।”
-” আন্টি। আপনি এত ব্যখ্যা করছেন যে আমারই খারাপ লাগছে। সায়রা আমাদের সাথে যাবে এতে আমার কোন সমস্যা নেই। তবে সায়রার সম্ভবত আছে। ওকে দেখলাম বেশ রেগে আছে। কারণটা কী আন্টি ? ”
-” কোন কারণ নেই। ও এমনই। তোমরা এবার আল্লাহর নাম করে রওনা দাও বাবা।”

বারসাত পেছনে বসতে যাচ্ছিল সায়রা হালকা ধমকের সুরে বলল, ” পেছনে বসছেন কেন ? সামনে জায়গা নেই ? ”
-” কেন, পেছনে অসুবিধা ? ”
-” আমি একা বসতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।”
-” আর আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি পেছনে বসতে ।” বলে বারসাত পেছনে বসে দরজা আটকে দিল। ড্রাইভার কে হিন্দীতে বলল, ” মানসুর ভাই, আপ গুলশান হোকে যাইয়েগা। আম্মি কো পিকআপ কারনা হ্যায়।”
” জি, বেটা।” মারাঠি ড্রাইভার গাড়ী স্টার্ট দিলে বারসাত সায়রার দিকে তাকাল।
-” সব ঠিক আছে ? ”
-” না, সব ঠিক নেই ! ”
-” মানে ? ” বারসাত হকচকিয়ে গেল। এ কেমন মেয়ে ! মুখের ওপর পটপট করে কথা বলে দেখি। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ” কী ঠিক নেই জানতে পারি ? ”
-” পারেন।”
-” বলেন শুনি।”
-” আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারব না। ”
বারসাত রীতিমত আছাড় খেল। মেয়েটা যে সরাসরি এই কথাটাই বলে বসবে বোঝেনি। সে নিজেও যে বিয়ে করার জন্য মুখিয়ে আছে ব্যপারটা এমন নয়। তাই বলে এভাবে মুখের ওপর ? একটু রয়ে সয়েও তো বলা যেত। বারসাত গম্ভীর হল।
-” আমি আপনাকে বিয়ে করব বলে অস্থির হয়ে আছি এটা কে বলল ? ”
-” বলেনি, কিন্তু আমাদের অভিভাবকরা সেভাবেই সব সাজিয়েছে।”
-” হম, তা আপনার পছন্দের পাত্রটি আপনাকে এভাবে একা ছেড়ে দিল ? ”
-” আমার পছন্দের পাত্র আছে কে বলল ? ”
-” কেউ বলেনি। অনুমান করলাম। ভুলও হতে পারে।”
-” না, ভুল হয়নি। ওকে বলেছি আমার সাথে শেষবারের মত দেখা করতে চাইলে মৌচাকে আসতে হবে। ধরে নিচ্ছি ও সেখানে চলে আসবে। ”
-” মৌচাক ? ইউ মিন টু মৌচাক মার্কেট ? ”
-” হম।”
-” আপনি তো সাংঘাতিক মেয়ে। আমি সাথে থাকার পরও আপনি তাকে আসতে বলেছেন ? ”
-“শুধু ও একা না। আমার ঘনিষ্ট দুই বান্ধবীও আসবে। ওদের সাথে দেখা না করে দেশ ছাড়ি কী করে বলুন ? আপনি নিশ্চয়ই অমত করবেন না ? “কাতর কণ্ঠ সায়রার। বার্সাত কিছুটা বিব্রত বোধ করল।
-” না, অমত করব কেন। কিন্তু আমাদের দেরী হয়ে যাবে যে।” কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখল বার্সাত।
সায়রা অনুনয়ের সুরে বলল, ” বেশী না। মাত্র এক ঘন্টা সময় নেব আপনার ।” এমন ভাবে বলল যেন পাঁচ মিনিট বলছে। বার্সাত ওর কথার ধরণে আরেকবার চমকিত হল। কিন্তু এবার আর কোন মন্তব্য করল না। বাকি পথ আর কোন কথা হল না ওদের। গাড়ী সোজা মৌচাকের সামনে চলে এলে সায়রা ঝটপট নেমে গেলে বারসাত বাধ্য হল ওর পিছু পিছু নামতে। এই মেয়ে যে এমন পাগলা কিসিমের কে জানত।

মার্কেটে ঢুকেই সায়রা ফোন দিল সাবাকে। ওর কল বাজার আগেই একটা কফি শপ থেকে বেরিয়ে এল সাবা।
অদূরে দাঁড়িয়ে বারসাত দেখল একটা ছিপছিপে গড়নের মেয়ে প্রায় উড়ে এসে জড়িয়ে ধরল সায়রাকে। তার পেছনে আরেকটা মেয়ে। তিনজন প্রায় একরইরকম দেখতে। তিনজনের পুনর্মিলনী শেষে কলকল করে কথা বলতে লাগল ওরা। সায়রা যেন ভুলেই গেছে ওর সাথে কেউ আছে। বার্সাত ওদের বিরক্ত করল না। চুপচাপ এক কোণে দাঁড়িয়ে ওদের কান্ড কারখানা দেখতে লাগল।
একটু পর দুটো ছেলে আসল। একজনকে ছেলে না বলে লোক বলাই ভাল। তবে কোনজন সায়রার সেই প্রিয়জন বুঝতে বেগ পেতে হচ্ছে বার্সাতের। সামান্য একটু এগোতেই বার্সাত চিনতে পারল ‘লোক ‘ চিহ্নিত সেই লোকটা আর কেউ না সায়রার মঈন মামা। যে ওদের আনতে নিকুঞ্জ গিয়েছিল। সে ওখানেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখাই যাক না কী হয় এখানে। বার্সাত নিজের মধ্যে তারুণ্যকে অনুভব করছে।

সায়রা আরমানকে দেখে অভিমানে থমকে গেল। মঈনের দিকে তাকিয়ে বলল, ” মামা, তুমি এখানে? ”
-” হ্যাঁ, আরমান আমাকে ফোন দিয়ে আনাল।”
-” কেন? ”
-” তো কী করব। মেয়ের গার্ডিয়ান ছাড়াই বিয়ে করব নাকি ? মেয়ের পক্ষের তো একজন লাগে।” আরমান ইঙ্গিতপূর্ণ হাসল। সায়রা হতভম্ব।
-” বিয়ে ? ”
-” হ্যাঁ, তুমিই তো বলেছ। শুধু দেখা করার জন্য হলে যেন না আসি। তাই বিয়ে করার প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি। আজ হয় এসপার হবে নয় ওসপার। চল, এই বিল্ডিং এর থার্ড ফ্লোরে একটা কাজী অফিস আছে।” বলে আরমান মঈনের দিকে তাকাল। ” কী বলেন মামা ? ”
মঈন সায়রার দিকে তাকাল, ” তুই সত্যিই এভাবে বিয়ে করবি ? তোর বাবা সহ্য করতে পারবে না। এটা করিসনা সায়রা।” সায়রা মুখ নামাল।
-” তাহলে কী করব আমি ? গাড়ীতে গিয়ে দেখো গে আমার সম্ভাব্য পাত্র বসে আছে। আমি জানি, দার্জিলিং গেলে জোর করে এর সাথে আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে আম্মু ।”
-” এই ফর্সা বিলাতি ইন্দুরের সাথে ? ইয়াক্।” মুখ বাঁকাল সাবা। ” আমি দেখেছি লোকটাকে। কেমন মেয়েলি ভাবভঙ্গি। ” শুনে তোয়াও হেসে ফেলল। সাবা ফের বলল, ” সত্যি, পুরুষ মানুষ পুরুষ মানুষের মত না হলে ভাল লাগেনা। এসব গাড়ী হাঁকানো ধনকুবের আমার দু চোখের বিষ। একে দেখে তো মনে হয় ফুল দিয়ে বারি মারলেই লুটিয়ে পড়বে।”
-” তুই কখন দেখলি ? ” সায়রা অবাক।
-” ওমা। তোর পেছনেই তো বেরোতে দেখলাম। লম্বা ফর্সামত না ? তোর পেছনেই তো এল দেখলাম। ”
-” তাই…?” বলে ঘাড় ফিরিয়ে সামান্য খুঁজতেই বার্সাতকে পাশের দোকানে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সায়রা। লোকটাকে একমনে পত্রিকা পড়তে দেখে আঁতকে উঠে বন্ধুদের দিকে তাকাল। সবাই বুঝে ফেলল এটাই সায়রার সেই সম্ভাব্য পাত্র। সাবার মুখ এবার পাংশৃু বর্ণ ধারণ করল। তবে বার্সাতকে দেখে বোঝা গেল না সে কথাগুলো শুনেছে কী না।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here