তৃষ্ণার্থ_প্রেয়সী পর্ব ০৬

তৃষ্ণার্থ_প্রেয়সী পর্ব ০৬
#লাবিবা_ওয়াহিদ
|| ||

বিকালের দিকে ফারিশ বাড়ি ফিরলো। বাড়ি ফিরে সোজা সানামের ঘরে ঢুকলো। সানাম তখন বেলকনি থেকে শুকনো জামাকাপড় নিয়ে রুমে ঢুকছিলো। ফারিশ সানামকে দেখতেই সানামকে বললো,

-“তোমার জন্য একটা টিউশনি পেয়েছি। আমাদের এপার্টমেন্টের ৫ম ফ্লোরের ৫.০২ নং ইউনিটে কাল বিকালে অথবা সন্ধ্যায় পড়িয়ে দিয়ে আসবে। স্টুডেন্ট ক্লাস সেভেনের। মেয়ে। তোমার কোনো সমস্যা হবে না তো? আর সেলারি কতো দিবে সেটা তুমি নিজেই বুঝে নিও তার থেকে।”

টিউশনির কথা শুনে সানামের খুশি দেখে কে। সে হাসিমুখে ফারিশকে একটা ধন্যবাদ জানালো। ফারিশ মুচকি হেসে সানামের রুম থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। সানাম খুশিতে পারে না লাফ দিতে। হঠাৎ তার মনে হলো, একটা টিউশনিতে তার কী হবে? তার তো আরও টিউশনি প্রয়োজন। ভাবতেই সানাম মুখটা বেজার করে ফেলে। পরমুহূর্তে ভাবলো টিউশনি খোঁজা মুখের কথা না, এই দুইদিনে যে একটা পেয়েছে তাতেই অনেক। আস্তে আস্তে ইনশাল্লাহ আরও আসবে। ভেবেই সানাম ঠোঁট দুটি প্রসারিত করলো।
এমন সময়ই অন্তু সানামের রুমে প্রবেশ করলো।

-“সানাম কি করছো?”

সানাম চমকে পিছে ফিরে দেখে অন্তু আন্টি। সানাম ঠোঁটে বিনয়ের হাসি হেসে বলে,

-“তেমন কিছু না আন্টি। আসুন, বসুন।”

-“না, না। আমি ঠিক আছি। জানো বড্ড বরিং ফিল হচ্ছে। ফারিশের বাবা তো তার বন্ধুদের সাথে টঙে আড্ডা দিতে গেলো, মাও ঘুমোচ্ছে। কি করা যায় বলো তো একা একা?”

-“একা কোথায় আন্টি আমি তো আছি।” মুচকি হেসে বললো সানাম। সানামের হাসির সাথে তাল মিলিয়ে অন্তু আন্টি বললেন,

-“তা অবশ্য ঠিক। ও হ্যাঁ মনে পরেছে। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের ভাবী আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলো সকালে কিন্তু কাজের চাপে ভুলে গেছি। এখন চলো তার বাসায় যাই, সাথে তুমিও আসো। জানো ভাবীর খুব মিষ্টি একটা মেয়ে আছে। নাম রুবা। তুমি চাইলে তার সাথে মিশতে পারো।”

-“ঠিক আছে আন্টি। আমি আপনার সাথে যাবো।”

-“তাহলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো আমি মাকে একটু দেখে আসছি।”

বলেই অন্তু আন্টি বেরিয়ে গেলো। সানামের পানি পিপাসা পাওয়ায় সেও বেরিয়ে চলে গেলো কিচেনের দিকে। ফারিশের রুম ক্রস করতেই ফারিশ দরজার দিকে না তাকিয়েই বলে উঠলো,

-“মা এক কাপ কফি দিও তো। শরীরটা বেশ ম্যাজম্যাজ করছে।”

ফারিশের কথায় সানাম দাঁড়িয়ে গেলো। অতঃপর আশেপাশে তাকিয়ে দেখে অন্তু আন্টি নেই। তাই সানামই গেলো ফারিশের জন্য কফি করতে। যেহেতু ফারিশ তাকে একটা টিউশনি খুঁজে দিয়েছে সেহেতু এইটুকু সানাম ফারিশের জন্য করতেই পারে। কফি বানাতে গিয়ে সানাম কিছুটা চিন্তায় পরে গেলো। ফারিশ কফি কেমন খায় সানাম তা জানে না। কফিতে চিনি দিবে নাকি দিবে এ নিয়ে সানামের কনফিউশান। তখনই তার ফারিশের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠে। সানাম আন্তাজে সিদ্ধান্ত নিলো চিনি দিবে। তাক থেকে চিনির বোয়াম নিতে গিয়ে ভুলবশত লবণের বোয়াম নিলো সানাম। ৩ চা চামচ দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে দেয়। সানাম হাসিমুখে কফি আর কিছু বিস্কিট ট্রে-তে করে নিয়ে ফারিশের ঘরের দিকে চলে গেলো। এদিকে সানাম ধারণাও করতে পারছে না সে ঠিক কি করেছে। ফারিশের দরজায় নক করতেই ফারিশ কাবার্ড থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালো। সানামের হাতে ট্রে দেখে ফারিশ কিছুটা অবাক হলো। তার বিস্ময় প্রকাশ না করে স্বাভাবিকভাবেই বললো,

-“তুমি?”

-“হু আমি…” বলেই সানাম ট্রে নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো। অতঃপর ট্রে-টা সেন্টার-টেবিলে রেখে সানাম বললো,

-“আন্টি আপনার নানীর ঘরে। তাই ভাবলাম আমি-ই আপনাকে কফি বানিয়ে দেই।”

তখনই অন্তু আন্টি বাইরে থেকে সানামকে ডাকলো। সানাম “যাচ্ছি” বলে চলে গেলো। ফারিশ সানামের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। অতঃপর মিনমিন করে বললো,

-“যাক মেয়েটা বকবক ছাড়াও কাজ পারে। উফফ, কি সুন্দর করে কফিতে ধোঁয়া উড়ছে।”

বলতেই ফারিশ চেয়ার টেনে বসলো। কফির মগ নিয়ে কফিতে ফুঁ দিয়ে চুমুক দিতেই সবটা ফ্রুত করে ফেলে দিলো।

-“ইয়াক! এটা কফি নাকি তিতা করলা। ছিঃ! এ তো আমাকে মারার জন্য লবণ নামক বিষ ঢেলে দিয়ে গেছে। আসলেই মেয়েটা ফালতু ধুর,ধুর! মুডটাই নষ্ট করে দিলো। ”

বিরক্তি নিয়ে বললো ফারিশ। কফির মগ সাথে নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে বেসিনে সবটা কফি ফেলে দিলো। অতঃপর কল ছেড়ে মগটায় পানি নিয়ে আবারও সেগুলা ফেললো। এতে মগটাও পরিষ্কার হলো, বেসিনটাও। ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে কফির মগটা কিচেনে রেখে আবারও রুমে ফিরলো। রুমে এসে ট্রের বিস্কিটগুলা দেখে ফারিশের খুদা পেলো। তাই সে আবার গিয়ে চেয়ারে বসে বিস্কিট খাওয়া শুরু করলো।

-“এই মেয়েটা কে ভাবী?”

সানাম মহিলার প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো। হঠাৎ তার লজ্জা লাগতে শুরু হলো। অন্তু আন্টিদের বাসায় কী পরিচয় তার? আশ্রিতা? কোন মুখে অন্যদের বলবে সানাম? তার তো একটাই পরিচয়, সে এতিম। নাহ সানাম তো তাদের আশ্রিতা নয়, ফারিশ তো বলেছেই তার ঘরের ভাড়া মেটাতে। তাহলে কী ভাড়াটিয়া? সানামের এমন নানান কথা মাথায় ঘুরপাক করছে। সানামের ভাবনার অবসান ঘটিয়ে অন্তু আন্টি বলে উঠলো,

-“আরে না ভাবী, ও আমার বড় বোনের মেয়ে। বুঝেনই তো তারা শহরের বাইরে থাকে। তাদের অনেক ইচ্ছা তাদের মেয়ে শহরের নামি-দামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। তাই আর কী আমার এখানে থেকেই পড়াশোনা করবে।”

অন্তু আন্টির কথায় সানাম একবার অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো। অতঃপর নিজেও ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে রাখলো। মহিলা বিনয়ের সুরে বলে,

-“ভারী সুন্দর মেয়েটা। ফারিশকে চোখে চোখে রাখিয়েন, এমন রমনীদের দেখলে ওদের মতো জুয়ান ছেলেদের তো আবার মাথা ঠিক থাকে না।”

মহিলার কথায় মহিলা এবং অন্তু আন্টি অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। এদিকে সানাম বিষম খেলো। ফারিশ কেমন ছেলে সে ভালো করেই জানে। ফারিশ তো কখনো তাকে অসম্মান করে কথা বলেনি। আর অন্তু আন্টিও-বা কেমন? তার সামনে তারই ছেলেকে খোঁচা করে এতোবড় কথা বললো আর তিনি হাসছেন? এসবই মনে মনে ভেবে চলেছে সানাম। অন্তু আন্টি হাসি থামিয়ে বলে,

-“তুমি কিছু মনে করো না সানাম। ভাবী বরাবরই রসিক মানুষ। তার মুখে অনেক কিছুই শুনেছি বুঝলে?”

সানাম হাসার চেষ্টা করে মাথা নাড়ালো। তারা দুজন বেশ কিছুক্ষণ কথা বললো। অতঃপর মহিলা আবারও কথায় কথায় বলে উঠলো,

-“তা ভাবী ফারিশের বিয়ে দিচ্ছেন কবে?”

-“ছেলেটা মাত্র চাকরি পেয়েচাকরি পেয়েছে। তাই আপাতত বিয়ে নিয়ে ওকে চাপ দিচ্ছি না। আস্তে আস্তে নিজের কাজ বুঝুক, নিজেকে সময় দিক। তারপরই বিয়ে নিয়ে ভাবা যাবে।”

-“কেন আপনার ছেলে কী বিয়ের কথা বলে না?”

-“আরে না। সে তো সবসময় এক কথাই বলবে। আগে নিজের ফ্যামিলি সামলাবে তারপর বিয়ে করবে। আমি আমার ছেলের মতামতকে যথেষ্ট সাপোর্ট করি। আমার বিশ্বাস আমার ছেলে নিজেকে ভালোভাবেই গড়ে তুলবে।”

সানাম মুগ্ধ হয়ে অন্তু আন্টির দিকে তাকিয়ে আছে। মায়েরা বুঝি এমনই হয়। ফারিশ কতো লাকি যে এমন একজন মা পেয়েছে। আচ্ছা আমার মা কী আছে? থাকলে কী সে আমাকে মনে করে? সানামের চোখে কোণ ভিজে গেলে সে নিজেকে সামলে নিলো। তখনই সদর দরজা দিয়ে একটা ছোট মেয়ে ভোঁ দৌড় দিয়ে ভেতরে চলে গেলো। আন্টি চেঁচিয়ে বলে,

-“আরে সাবধানে যা মা, পরে যাবি তো। আর হ্যাঁ ওয়াশরুম গিয়ে ভালো করে হাত-পা, মুখ ধুঁয়ে নিবে আম্মুনি। এতে করে তুমি জীবানু মুক্ত হবে।”

ছোট্ট মেয়েটির পক্ষ হতে কোনো উত্তর এলো না। মহিলা নিরাশ হয়ে বলে,

-“এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারি না ভাবী। মেয়েটা আমার কোনো কথাই শুনবে না। সারাদিন ফোন, গেম, বল এগুলা নিয়ে পরে থাকবে। পড়তে তো বসাতেই পারি না। যে ক’জন হোম টিউটর রেখেছি একজনও এই মেয়েটার জ্বালায় টিকতে পারিনি। কি যে করবো মেয়েটাকে নিয়ে।”

-“আরে কিছু হবে না। বড় হতে হতে স্বভাব চেঞ্জ হয়ে যাবে। আপনি চিন্তা করবেন না ভাবী।” মুচকি হেসে উত্তর দিলো অন্তু আন্টি। সানামের মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। তাই সে বিনা সংকোচে বলে উঠে,

-“আন্টি, আপনি যদি রাজি থাকেন তাহলে আমি আপনার মেয়ের হোম টিউটর হতে চাই।”

মহিলাটি যেন সন্তুষ্ট হলেন। অতঃপর খুশি হয়ে বললো,

-“তুমি পারবে সানাম?”

-“জ্বী আন্টি ইনশাল্লাহ।”
-“তাহলে প্রতিদিন সকাল ৭টায় চলে এসো। সাড়ে আটটা থেকে ওর স্কুল তাই সকাল সকাল পড়তে রুবারই সুবিধা হবে। তুমি রাজি তো?”

-“জ্বী আন্টি, আমি রাজি।” মুচকি হেসে বললো সানাম। সানাম আজ একটু বেশিই খুশি। দুই-দুইটা টিউশনি পেয়ে গেছে সে। আর কী লাগে? ভেবেই আবারও মুচকি হাসলো সে।

~চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here