তৃষ্ণা
পর্ব ৫
মিশু মনি
.
দ্রুত হৃদ স্পন্দিত হচ্ছে অংশীর। মাহিবের স্পর্শ! এ যেন স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই না। খুব অস্থির লাগতে শুরু করেছে। অংশী জংগলে একটা গাছে হেলান দিয়ে হাফাচ্ছে আর ভাবছে মাহিবের কথা। সে চায় কি? কেন বারবার এভাবে পাগল করে দিচ্ছে কে জানে! কোন অচিন দেশের রাজকুমার, হুট করে এসে সবকিছু লুট করে নিতে চাইছে। নাহ, আর ভাবতে পারছে না অংশী।
অনেক্ষণ পরে গুটিগুটি পায়ে বাড়ির দিকে ফিরে এলো। বাবা মা কাউকেই বাসায় দেখছে না। বাবার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো মাহিব আছে কিনা। এমন সময় পিছনে মাহিবের গলা শুনে চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকালো অংশী। ভয়ে শুকিয়ে গেছে মুখ। মাহিব হেসে বললো, ‘চোরের মত উঁকি মারছো কেন?’
অংশী কিছু না বলে দুই পা পিছিয়ে গেলো। এই লোকটার কাছাকাছি আসলেই কেমন যেন লাগে। বুকের ভিতর শুধু ঢিপঢিপ করতে থাকে। মাহিব এগিয়ে এসে বললো, ‘কি গো সুন্দরী, আমাকে খুঁজছিলে?’
কেঁপে উঠে অংশী বললো, ‘আপনারে কেন খুঁজুম? আমি আব্বা আম্মারে খুঁজতেছিলাম।’
– ‘আমার চোখের দিকে তাকাও তো।’
– ‘আপনে লোকটা ভালা না। খালি চোখের দিকে তাকাইতে বলেন। আপনে কি জানেন আপনার চোখে তাকাইতে মেলা সাহসের দরকার হয়?’
– ‘বাব্বাহ! এসবও বোঝো? তাকাও তো।’
– ‘না, তাকান যাইবো না।’
– ‘উহ তাকাও না।’
বাধ্য হয়ে অংশী মাহিবের চোখের দিকে তাকালো। মাথার পিছন দিকে ঠিক ঘাড় বরাবর একটা রগে রক্ত ছলকে ওঠার মত শিরশির করে উঠলো। মাহিবের চোখের দিকে তাকালেই কেমন যেন লাগে। মেরুদণ্ড বরাবর কিছু একটা নাড়া দিয়ে যায়। তবুও কেন যে তাকাতে বলে কে জানে।
মাহিব চোখের দিকে তাকিয়ে কবিতার লাইন খুঁজছে। এমন মায়াবী চোখ শত রাজ্য খুঁজেও খোঁজ পায়নি মাহিব। যা এই প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে এসে আবিষ্কার করেছে। এই চোখে সমুদ্র আছে, গভীর ভাবে তাকালেই ছলকে ওঠে জল। তীব্র বেগে ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে সমুদ্রের তীরে। মাহিবের তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে। কবিমন বড্ড উচাটন। যেখানে একবার কবিতার উপাদান খুঁজে পায়, সেখান থেকে সহজে বেরিয়ে আসতে পারে না। যেমন, অংশীর চোখ, এলো চুল, টানা টানা ভ্রু যুগল। খুব টানছে মাহিবকে।
মাহিব মুচকি হেসে বললো, ‘পেয়ে গেছি!’
কাঁপা কাঁপা গলায় অংশী বললো, ‘কি পাইছেন?’
– ‘যা খুঁজছিলাম।’
– ‘কি?’
– ‘মায়া!’
– ‘মায়া!’
– ‘এ চোখের সমুদ্রে অবগাহন করে তৃষ্ণা মেটাবো, অনন্ত তৃষ্ণা…’
– ‘তৃষ্ণা! তৃষ্ণা কি?’
– ‘পিপাসা..’
– ‘কিসের পিপাসা?’
– ‘প্রেমের, হৃদয়ের, পবিত্র অনুভূতির।’
কথার আগা গোড়া কিছুই বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো অংশী। লোকটা কি সব যে বলে কিছুই মাথায় ঢোকে না। ওকে এভাবে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাহিব বললো, ‘কিছু মনে কোরো না ডিয়ার, কবিতার লাইন খুঁজছিলাম তোমার চোখে। তোমাকে দেখলেই আমার কবি হয়ে যেতে ইচ্ছে করে।’
– ‘আপনে লোকটা অদ্ভুত!’
– ভয় হয়?’
মাহিব এমনভাবে কথাটা বললো যে সত্যিই ভয় হতে লাগলো অংশীর। ও দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইছিলো এমন সময় মাহিব ডেকে বললো, ‘কোথায় যাচ্ছো? আমাকে নিয়ে যাবে না?’
– ‘কই যাইবেন?’
– ‘দূর পাহাড়ে। শুধু অরণ্য দেখলাম, পাহাড় দেখবো না?’
– ‘টিলায় যাইবেন? আসেন আমার সাথে।’
অংশী খুব দ্রুত স্বাভাবিক করে নিলো নিজেকে। ঘাটে এসে নৌকা পেয়ে মাহিবকে নিয়ে উঠে পড়লো। আজ বৈঠা সাথে করেই নিয়ে এসেছে অংশী। মাহিব নৌকায় উঠেই মিষ্টি সুরে গান ধরেছে। অংশী নৌকা বাইতে শুরু করে বললো, ‘আপনে চমৎকার গান করেন।’
– ‘তাই!’
– ‘হু। আপনের ছবি একটিং করা শুরু হইবো কোনদিন থিকা?’
– ‘আর তিন চারদিন পরেই লোকজন চলে আসবে।’
– ‘নায়ক নায়িকা আইবো?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘আমি নাইকারে দেখমু?’
উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো অংশী। মাহিব হেসে বললো, ‘হ্যাঁ। কথাও বলবে নায়িকার সাথে।’
– ‘খুব মজা হইবো।’
– ‘অবশ্যই। দূরে একটা পাহাড় দেখা যাচ্ছে, ওখানে যাওয়া যাবে না?’
– ‘ওইখানে কেউ যায় না। কাইল সকাল সকাল বাইর হইলে আপনারে দূরে একটা পাহাড়ে নিয়া যামু।’
– ‘আচ্ছা বেশ। কাল খুব সকালেই বেরিয়ে পড়বো তবে।’
– ‘বাঁশের ভেলায় চড়বেন?’
– ‘হ্যাঁ। কোথায়?’
– ‘এই যে সামনে।’
বাঁশের বিশাল বিশাল ভেলা দেখে পুলকিত হয়ে মাহিব বললো, ‘এগুলো ভেলা! ওয়াও দারুণ তোহ!’
মাহিবের আনন্দিত মুখ দেখে অংশীরও আনন্দ হলো। ও হাসতে হাসতে নৌকা বয়ে নিয়ে চললো। বললো, ‘আপনারে পরে উঠামু। আগে টিলা থাইকা ঘুইরা আনি।’
– ‘চুলে কি তেল দিয়েছো?’
চমকে উঠে অংশী ভ্রু কুঁচকে ফেললো। এই লোকটা সত্যিই যে অদ্ভুত সেটা আর আলাদা করে প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। চুলে কি তেল দিয়েছে সেটাও কেউ জানতে চায় নাকি?
মাহিব বললো, ‘তুমি পাহাড়ের মত সুন্দর, ঝরনার মত উচ্ছল, নদীর মত প্রশস্ত, বহমান..’
– ‘আমারে কইলেন?’
– ‘না। আমি এই নৌকাকে বলেছি। নৌকা ভাই, তুমি দেখতে অনেক সুন্দর। আলকাতরার মত সুন্দর নৌকা ভাই।’
খিলখিল করে হেসে উঠলো অংশী। ওর হাসি নদীর তীরের গহীন অরণ্যে প্রতিফলিত হয়ে আবার ফিরে এসে কানে লাগলো। মাহিব মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলো অংশীর হাসি। বড্ড মায়াবী একটা মেয়ে। দ্রুত মায়ায় বেঁধে ফেলেছে।
অংশী নৌকা চালানো বন্ধ করে বৈঠা নিয়ে বসে পড়লো। নৌকাকে ছেড়ে দিলো স্রোতের টানে। ধীরেধীরে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চললো ছোট্ট নৌকা টি। দুদিকে দুজন বসে আছে। মাহিব উচ্ছ্বসিত হয়ে উপভোগ করছে নদীর সৌন্দর্য। দুদিকেই পাহাড় ও অরণ্য। গাঢ় সবুজের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট্ট নদী। তারই বুকে ভেসে চলেছে অংশী ও মাহিব। রৌদ্রজ্জ্বল একটা দিন। রোদের আলোয় অংশীর মুখ ঝলমল করছে। অংশী হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে আছে মাহিবের দিকে। মাহিব অংশীর দিকে ফিরতেই অংশী দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে মুচকি হাসলো।
মাহিব আবারও তাকালো পাহাড়ের দিকে। দূর থেকে পাহাড় গুলোকে ছবির মত সুন্দর লাগছে। যত কাছে এগিয়ে যাচ্ছে, ততই রূপ বাড়ছে। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই।
অংশী বললো, ‘একটা গান শুনাইবেন?’
চমকে উঠলো মাহিব। হঠাৎ গান? অবশ্য এই সময়ে গান ছাড়া জমেও না যেন। মাহিব জোরে গলায় গান ছেড়ে দিলো। কয়েক লাইন গাওয়ার পর ছেড়ে দিয়ে বললো, ‘রাতে শোনাবো। আমাদের টিম আসলে রাতে জংগলে একটা ক্যাম্পিং হবে। কেমন হবে বলো তো?’
– ‘ভালো।’
যদিও ক্যাম্পিং কি সেটা বোঝে নি অংশী। তবুও কথার উত্তর দিয়ে বসে রইলো চুপ করে। পাহাড়ের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা।
৫
পাহাড় উপরে উঠে ফটাফট বেশ কিছু ছবি তুলে নিলো মাহিব। জায়গার সাথে সাথে অংশীরও তুলে নিলো বেশ কিছু ছবি। অংশী মাহিবের প্রত্যেকটা কাজ খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করছে। কিছুক্ষণ পা ঝুলিয়ে বসে রইলো দুজনে। মাহিব দু চোখ ভরে অবলোকন করছে পাহাড়ের সৌন্দর্য। লোকেশন হিসেবে এই জায়গাটা মন্দ না, রাখা যায়। নায়িকা এখানে নায়কের সাথে দেখা করবে, ব্যাপারটা খারাপ হবে না। মাহিব অংশীর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘অংশীইই, থ্যাংক ইউ।’
– ‘ধইন্যবাদ? কি জন্যে?’
– ‘এত সুন্দর একটা জায়গায় নিয়ে আসার জন্য।’
অংশী হাসলো। মাহিব ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে বললো, ‘এবার চলে যাওয়া যাক। অনেক কাজ আছে আমার।’
কি কাজ আছে সেটা জানার ইচ্ছা হলেও জিজ্ঞেস করার সাহস পেলো না অংশী। মাহিব দ্রুত হাঁটা ধরেছে নদীর দিকে। পিছুপিছু ছুটলো অংশী।
বাড়িতে ফিরে অংশী দেখলো টয়লেট বানাতে যা যা লাগে সবই নিয়ে আসা হয়েছে। মিস্ত্রি এসে কাজেও লেগে পড়েছে। সবকিছুই বেশ উন্নত জিনিসপত্র। মাহিব অংশীকে বললো, ‘তোমার খুব দুঃখ ছিলো বাসায় ওয়াশরুম নেই বলে। তোমার জন্য অত্যাধুনিক ওয়াশরুম বানানোর ব্যবস্থা করেছি।’
লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে অংশী। মাহিব এমন ক্যান?
অংশী ছুটে নিজের ঘরে চলে গেলো। শুয়ে শুয়ে জল্পনা কল্পনা করতে লাগলো নানান কিছু। মাহিবের কোনো সারা শব্দ পাওয়া গেলো না। অংশী একবার উঁকি মেরে দেখলো মাহিব ল্যাপটপে কাজ করছে। অনেক্ষণ পাশে দাঁড়িয়ে রইলো, মাহিব ওর দিকে একবার ফিরেও তাকালো না। চলে যাওয়ার সময় ডাক দিলো, ‘অংশীইই..’
অংশী দাঁড়িয়ে পড়লো। মাহিব বললো, ‘কিছু বলবে?’
– ‘না।’
– ‘আসো, বসো এখানে। মুভি দেখবে?’
খুশিতে চকচক করে উঠলো অংশীর চোখ- ‘হু।’
মুচকি হাসলো মাহিব।
চলবে..