তৃষ্ণা পর্ব ৩৩:৩৪ শেষ পর্ব

0
2958

তৃষ্ণা
পর্ব ৩৩ +৩৪ শেষ
মিশু মনি
.
অংশীর প্রেমে নতুন করে পড়ে গেলো মাহিব। অংশীর কোনো খোঁজ না পেয়ে আরো বেশি করে ওর প্রতি টান বেড়ে গেলো। যত সময় এগিয়ে যেতে লাগলো, ততই অংশীকে দেখার তৃষ্ণা বেড়ে যেতে লাগলো। মেয়েটা কোথায় আছে কে জানে! সবকিছু ছাড়িয়ে এই একটা কষ্টই ভেতরে জেঁকে বসলো।

খেতে ভালো লাগে না, ঘুমাতে ভালো লাগে না, কোনো কিছুই মনে ধরে না মাহিবের। অংশী কেমন আছে, কোথায় আছে তা জানার জন্য মনটা আকুপাকু করছে। অংশী বিয়ে করেনি এটা নিশ্চিত। কারণ প্রীতম ওকে সবটা খুলে বলেছে। প্রীতমকে ফিরিয়ে দিয়েও যে মেয়েটা মাহিবের কাছে ছুটে এসেছে, সে যে আর কারো হতে পারে না, এ মাহিব মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে।
“গ্রামে সহজ সরল বোকা বোকা কিছু মেয়ে থাকে, যাদের জ্ঞানের বহর স্বল্প অথচ ভালোবাসবার প্রচন্ড ক্ষমতা এদের শিরা উপশিরায় মিশে আছে।”
কিন্তু অংশী কোথায় আছে তা কিভাবে খুঁজে বের করবে?

তাকে দেখার জন্য চোখ জ্বলে আজকাল। দেখার জন্য আবার চোখ জ্বলে নাকি? হু জ্বলে। এ জ্বলুনি কেবল অন্তর টের পায়। কাউকে দেখবার জন্য বুকের ভেতর যে ব্যকুলতা জেগে ওঠে, সে অস্থিরতার বীজ দেহ মন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। চোখ দুটো কেমন যেন করে। মনে পড়ে যায় কয়েক বছর আগের সেই দিনগুলো। পাহাড়ের ভাঁজে একসাথে পা ফেলা, জংগলে একসাথে নেচে বেড়ানোর দিনগুলো। অংশী মাহিবকে ঘুরেঘুরে সবকিছু দেখাতো, কিন্তু পুরোটা সময় মাহিব কেবল অংশীর দিকেই চেয়ে থাকত। অংশীর মায়া মায়া দুটো চোখ ক্রমশ ব্যকুল করে তুলতো মাহিবকে। হৃদস্পন্দন বেড়ে যেত, কেউ কারো চোখের দিকে তাকাতে পারতো না। সে দিনগুলোকে আবার ফিরে পেতে ইচ্ছে করছে। কত আবেগ ছিলো অংশীর, সে ভালোবাসায় কোনো খাঁদ ছিলো না।

আবার যদি সেই সময় ফিরে আসতো। উচ্ছল মেয়েটা দূরন্তপনায় মেতে উঠতো। আগে আগে ছুটতো ও, মাহিব ছুটত ওর পিছনে। বনের মাঝখানে অংশীর সেই প্রিয় জায়গাটায় দুজনে বসে থাকতো আর হাসি গল্পে মেতে উঠতো। কতই না সুন্দর ছিলো দিনগুলি!

দুজনের একটা সুখী সংসার হতে পারতো! ছোট্ট সোনামণিকে নিয়ে দুষ্টুমি করে দিনের সূচনা হতে পারতো। একসাথে সূর্যোদয় দর্শনও হয়তো স্বপ্নের মত লাগতো। মাঝেমাঝে কাঁধে মাথা রেখে আকাশ দেখা কিংবা জড়িয়ে ধরে আলতো করে স্পর্শ করা। খুব বেশি সুন্দর হতো রাতগুলো। একে অপরকে লতার মত পেঁচিয়ে জড়াজড়ি করে ঘুমানো। সবটাই আজ- “হতে পারতো!” এই দুটো শব্দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস।
মাহিবের কষ্ট হতে লাগলো, ভীষণ কষ্ট। অংশীকে দেখার জন্য ছটফট করতে লাগলো ও। আর দেরি না করে রাতের বাসে ছুটে এলো অংশীর গ্রামে।

আমির আলী আচমকা মাহিবকে দেখে অবাক হলেন। মাহিবের চেহারার হাল দেখে ওনার অবাক হওয়া ছাড়া কিছু বাকি নেই। মাহিব ছুটে গিয়ে আমির আলীকে জাপটে ধরলো। উনি অবাক হয়ে বললেন, ‘সাহেব আপনে!’

মাহিবের চোখে পানি চলে এলো। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বললো, ‘অংশী কোথায়?’

আমির আলী এবার আরো বেশি অবাক হলেন। এত বছর পর অংশীর খোঁজে এসেছে তাও মাহিব! অংশী বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর কেউই তো ওর খোঁজ পায় নি। উনি চোখের পলক ফেলতে পারলেন না।

মাহিব বললো, ‘অংশী গ্রামে আসে নি?’

আমির আলী যন্ত্রের মত মাথা দুদিকে নেড়ে বললেন, ‘না।’

– ‘ওর কোনো খোঁজ আপনি জানেন?’

– ‘না।’

– ‘অংশী কারো সাথে যোগাযোগ করেনি?’

– ‘না।’

মাহিব মাটিতে বসে পড়লো। মনের ভেতর উথাল পাথাল ঝড় বইছে। একটা অচেনা কষ্টের বৃত্ত ঘিরে ফেললো ওকে। জীবনে কত যন্ত্রণাই তো সয়েছে, কিন্তু এর মত যন্ত্রণা হয়তো কখনো টের পায় নি। রক্তে রক্তে আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। হারনোর ব্যথা যে কি কঠিন!
কিন্তু অংশী গ্রামেও আসেনি, তবে কোথায় আছে!

মাহিবকে চিন্তিত মুখে দেখে আমির আলী বললেন, ‘আপনে হঠাৎ অংশীরে খুঁজতাছেন ক্যান?’

মাহিব আমির আলীর হাত চেপে ধরে বললো, ‘আমাকে মাফ করে দিয়েন। আমি কিছু বলতে পারবো না। আমাকে ক্ষমা করবেন।’

মাহিব ছুটে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। গেটের বাইরে এসে অংশীর মায়ের মুখোমুখি হলো। মায়ের চোখ বিস্ফোরিত হয়ে উঠলো। উনি বললেন, ‘আমার মেয়ে কই?’

মাহিব কোনো কথা বলতে পারলো না। উনি আবারও জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার মেয়েরে কই রাখছেন?’

মাহিব কিছু না বলে দ্রুতপদে হেঁটে চলে এলো সেখান থেকে। কিইবা বলার থাকতে পারে। অংশীর মা দূর থেকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আমির আলী এসে জানতে চাইলেন, ‘অংশীর খোঁজ তুমি সাহেবরে জিগাও ক্যান?’

– ‘অংশী সাহেবের জন্যেই বাড়ি ছাইড়া চইলা গেছিল।’

– ‘এতদিন আমারে কও নাই ক্যান?’

আর্তনাদ করে উঠলেন আমির আলী। ওনার স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে কাঁপতে লাগলেন ক্রমাগত। উনি বললেন, ‘মাহিব সাহেব কি কইলেন আপনারে?’

আমির আলী মাটিতে বসে পড়লেন। এতদিন পর মেয়ের খোঁজ পেয়েছেন উনি। কিন্তু মেয়ের খোঁজ পেয়েও যেন পেলেন না। সবকিছু ধোঁয়ার মত মনে হতে লাগলো। চোখের সামনের সমস্ত কিছু ধীরেধীরে ঝাঁপসা হয়ে এলো।

মাহিব বেরিয়ে এসে সোজা নদীর ঘাট থেকে নৌকা বেয়ে নদীর মাঝখানে চলে এলো। এই নদীতে কতবার একসাথে নৌকায় ভেসেছে দুজনে। কত সুখ দুঃখের কথা বলেছে। আজকাল একটা প্রশ্নই মনে ঘুরপাক খেতে থাকে- “প্রেমটা তো সত্যি ছিলো, তবে মিথ্যে ছিলো কোনটা?” কেন ওরকম নিষ্ঠুরতা করলো মাহিব! সব ভেবে নিজের প্রতি ধিক্কার জন্মাতে লাগলো।

জংগলের ভেতর প্রবেশ করে দেখে সবকিছু আগের মতই আছে। চেনা জায়গাটা নতুন করে বুকে আঘাত করলো। এখানকার সবকিছুতে অংশীর স্পর্শ লেগে আছে যেন। কতবার এ পথে হেঁটেছে একসাথে। সবকিছু আজ স্মৃতি! অংশী তুমি কোথায়?

জংগলের মাটিতে বসে অংশীর স্মৃতি আওড়াতে লাগলো মাহিব। প্রত্যেকটা গাছে অংশীর স্পর্শ খুঁজে বেড়াচ্ছে ও। মনেমনে প্রার্থনা করছে যেন অংশীর সাথে একবার দেখা হয়ে যায়, যেন অংশীর খোঁজ পেয়ে যায়।

পাগলের মত আর্তনাদ করতে লাগলো মাহিব। চিৎকার করে ডাকতে লাগলো অংশীর নাম ধরে। অংশীর সেই প্রিয় জায়গাটায় এসে দাঁড়ালো। সবকিছু আগের মতই আছে। শুধু আগের চেয়ে বেশি পাতার স্তর পড়েছে মাটিতে। জায়গাটায় অনেকদিন কেউ আসে না। মাহিব অংশীর পায়ের ছাপ খুঁজতে লাগলো সবখানে। গাছগুলোকে জাপটে ধরে নখ দিয়ে গাছের চামড়া ছিলে জিজ্ঞেস করতে লাগলো, ‘অংশী কোথায় তোমরা জানো? জানো? আমার জানটা কোথায় আছে?আমার কলিজাটা কোথায়?’

মাহিবের কেন যেন মনে হতে লাগলো গাছগুলো ওকে অভিসম্পাত করছে। এই দিনটা দেখার জন্যই হয়তো গাছগুলো আগের মতই আছে। ওরা অপেক্ষা করে ছিলো মাহিবের জন্য। প্রকৃতি কাউকে শাস্তি দিতে ভোলে না। মাহিব মাটিতে বসে কষ্টে চিৎকার করতে লাগলো। এই চিৎকার কি অংশীর কানে পৌঁছবে?

পাহাড়ে, জংগলে সারাদিন ঘুরে ঘুরে রাত্রিবেলা জংগলেই ঘুমিয়ে পড়ে মাহিব। সারা রাত মশা ও পোকা মাকড়ের উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ওর মনে পড়ে যায় অংশীর কথা। অংশী কি ওকে ছেড়ে বস্তিতে গিয়ে এইভাবেই কষ্ট পেয়েছিলো! অংশীকে ফেলে আসার পর ওর মুহুর্ত গুলোও কি একইভাবে কেটেছে?

মাহিব কল্পনায় দেখতে পায় নোংরা বস্তিতে মেঝেতে শুয়ে ছটফট করছে অংশী। থেকে থেকে আর্তনাদ করছে মাহিবের নাম ধরে। হয়ত ক্ষুধার জ্বালায় কত রাত ঘুমায় নি, হয়ত মাহিবকে হারানোর বেদনায় কত অশ্রু ফেলেছে। সেসব ভেবে মাহিব সারারাত জংগলে বসে ছটফট করলো। রাগে নিজের বুকের উপর খামচি দিয়ে দাগ করে ফেললো। তারপর ক্রমাগত আর্তনাদ করতে লাগলো অংশীর নাম ধরে।

বিখ্যাত ফিল্ম মেকার আজ পরিত্যক্ত জংগলে পাগলামো করছে এ যেন অবিশ্বাস্য এক দৃশ্যপট। মানুষের জীবনে কখন কোন সময় আসে কেউ জানে না। জংগলে বসে ঝিঁঝিঁর ডাকে অংশীর স্মৃতি আঁকড়ে ধরে পড়ে আছে মাহিব। গায়ে মাটি লেগে আছে। চুল, দাঁড়ি অনেকদিন কাটা হয় না। পুরো দেবদাস বনে গেছে মাহিব আহসান। নিজের দিকে তাকাতে নিজেরই ঘৃণা জাগছে আজ। জীবনের স্রোত আজ মাহিবকে এখানে বয়ে এনেছে। যে জংগলে আর কখনো আসার কথা ছিলো না, সেখানে আজ রাত্রিবেলা পড়ে আছে একলা। বিষন্নতার চাদর ঘিরে রেখেছে বেশ ভালো করে।

ভালোবাসা আগুন বাড়িয়ে দিয়েছে আজ। অংশীকে কষ্ট দেয়ার অপরাধে ছেলেটা নিজেই নিজেকে পোড়াচ্ছে।

সেখান থেকে ফিরে এসে মাহিব অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তার, ওষুধপত্র, সেবাযত্ন অনেক কিছুর পর ধীরেধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। ওকে ধরে বেঁধে চুল দাঁড়ি কেটে দেয়া হয়। মাহিবের মা সময় নিয়ে ছেলেকে পরিপাটি করে তুললেন। আবারও আগের জীবনে ফিরে এলো মাহিব। কিন্তু এখনো বুকের ভেতর বেদনার বীজ ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে কোনো শান্তি নেই।

নতুন করে একটা নাটকের কাজ শুরু করতে গিয়েও করতে পারলো না। ভালো লাগে না কাজ করতে। সবকিছু ঝেড়ে ফেলে দিয়ে কেবল সিনেমা নিয়েই পড়ে থাকতে চাইলো মাহিব। সে চেষ্টাও ব্যর্থ হলো। কাজে মন বসে না।

বেশ কয়েক বছর পাহাড়ে জংগলে ঘুরে বেড়াতে লাগলো ছন্নছাড়া হয়ে। পাহাড়ের বিভিন্ন রিসোর্টে গিয়ে সারাদিন বই পড়ে আর বিকেলবেলা পাহাড়ের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করে। রাত হলে আলো জ্বালিয়ে দু একটা গল্প লিখতে লিখতে ঘুমিয়ে পড়ে। এভাবেই চলে মাহিবের একলা জীবন।

মাহিবের দুচোখে বড্ড তৃষ্ণা। এ তৃষ্ণা কাউকে দেখবার, কাউকে কাছে পাবার, কাউকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করার। অংশীকে দেখার জন্য বুকের মাঝে কিছু একটা ঢিপঢিপ করে, কেমন উথাল পাথাল করে। সবকিছু এলোমেলো লাগে মাহিবের। কতগুলো দিন পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরেই কেটে গেলো। দুচোখ যাকে দেখার জন্য জ্বলে যায় তাকে একটিবারের জন্যও দেখা হলো না। এরচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার আর কি আছে!
সময় বয়ে যাচ্ছে, জীবন চলে যাচ্ছে। শুধু বুকভরা তৃষ্ণা নিয়ে রাজ্যের সমস্ত বেদনা জড়ো করে পাগল হয়ে ঘুরে বেড়ায় একটি মানুষ। কেউ জানে না তার বুকের ভেতর কি চলছে!

চলবে..
শেষ পর্ব১
প্রত্যেক বারের মত এবারও পাহাড়ে এসে একটা বাংলোয় আশ্রয় নিয়েছে মাহিব। পাহাড়ের গন্ধ ছাড়া আজকাল আর কিছুই ভালো লাগে না ওর। বাইরে রোদে বসে বই পড়ছিলো আর মাঝেমাঝে চোখ তুলে পাহাড়ের দিকে তাকাচ্ছিলো। পাহাড়ের উপর মেঘের উড়াউড়ি দেখতে বেশ ভালো লাগে। কখন যেন একটা ছোট্ট ছেলে এসে পাশে বসেছে খেয়ালই করেনি মাহিব।

ছেলেটার মুখে অজস্র মায়া এসে ভর করেছে। চোখ দুটো টানা টানা, ঘন পাপড়ি। ছেলেটা চোখ পিটপিট করছিলো বারবার৷ মাহিব হেসে বললো, ‘কি গো বাবু, নাম কি তোমার?’

ছেলেটা হাসিমুখে উত্তর দিলো, ‘অমি।’

– ‘বাহ, সুন্দর নাম তো৷ এখানে একা একা কি করছো?’

– ‘একা কোথায়? এই তো আপনি আমার সাথে আছেন।’

– ‘তুমি তো অনেক চালাক।’

ছেলেটা চোখ পিটপিট করে বললো, ‘তাহলে আপনি কি বোকা?’

মাহিব হেসে ফেললো। ছেলেটাও মাহিবের দেখে হো হো করে হাসতে লাগলো।

মাহিব বললো, ‘এখানে কার সাথে এসেছো?’

– ‘আপনার সাথে।’

– ‘আমার সাথে!’

– ‘হ্যাঁ। ওই যে দূরে ঘরটা দেখছেন ওখানে আমরা থাকি। ওখান থেকে দেখলাম আপনি একা বসে আছেন। তাই আসলাম। একা একা আপনার ভয় করে না?’

মাহিব হেসে বললো, ‘না ভয় করে না।’

– ‘কেন করে না?’

– ‘আমি তো বড় হয়েছি। তাই।’

– ‘আমিও তো বড় হয়েছি। আমার কেন ভয় করে?’

– ‘তোমার বুঝি ভয় করে?’

– ‘খুব করে।’

মাহিব ছেলেটাকে টেনে নিয়ে নিজের কোলে বসালো। গাল টেনে আদর করে দিয়ে বললো, ‘তোমার বাবা মা বুঝি এখানে বেড়াতে এসেছেন?’

– ‘না। এটা আমাদের বাড়ি। আমার আব্বু নেই।’

মাহিব আফসোস করে বললো, ‘ইস। মায়ের সাথে থাকো বুঝি?’

– ‘হ্যাঁ। আমার আম্মু আমার আমাকে অনেক ভালোবাসে।’

– ‘খুব ভালো কথা। চকোলেট খাবে?’

– ‘না।’

– ‘কেন?’

অমি কোনো কথা বললো না। মাহিব ওকে কোলে নিয়ে ঘরে চলে গেলো। ছেলেটা এত মিষ্টি হয়েছে যে দেখলেই কোলে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে। মাহিবের সারাক্ষণ ইচ্ছে করছে ওকে কোলে বসিয়ে রাখতে। পরক্ষণে মনে পড়ে গেলো নিজের সন্তানের কথা। আজ যদি অংশীকে সে সময়মত ঘরে নিয়ে আসতো, ওদেরও একটা এরকম সন্তান থাকতো। যাকে আদর করতে পারতো, ভালোবাসতে পারতো। কেন যে সেদিন বাচ্চাকে নষ্ট করতে উঠে পড়ে লেগেছিলো। প্রীতম বলেছে অংশীর বাচ্চা হয়েছে আর বাচ্চাটা অংশীর সাথেই আছে। কিন্তু বাচ্চাটা ছেলে নাকি মেয়ে তা মাহিবের জানা হয়নি। মাহিব অমিকে কোলে নিয়ে এসবই ভাবছে।

গল্প করতে করতে এক পর্যায়ে দুজনের মাঝে খুব ভাব হয়ে গেলো। অমিকে খাবার খাওয়ালো মাহিব। কিছুটা সময় একসাথে কাটিয়ে অমি নিজের ঘরে ফিরে গেলো।

অমিকে দেখার পর থেকে আজ রাতে ঘুমাতে আরো কষ্ট হলো মাহিবের। নিজের অনাগত সন্তানের কথা বারবার মনে পড়ছে। ভুলগুলো শুধুই ভুল ছিল না, সেগুলো ছিলো মাহিবের অন্যায়। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যেতে চায়। অংশীকে মনে পড়ে বারবার। এ এক নিদারুণ কষ্ট। যার কোনো সীমানা নেই।

পরেরদিন অমি আবারও এলো মাহিবের ঘরে। দরজায় দাঁড়িয়ে থেকে উঁকি মারছিলো ঘরের দিকে। মাহিব অমিকে দেখে হেসে বললো, ‘এসো বাবু।’

মাহিব ওর সিনেমার পোস্টার দেখছিলো। এটা সেই সিনেমা যা অংশীদের গ্রামে শুট করা হয়েছিলো। অমি কাছে এসে জানতে চাইলো, ‘এটা কি?’

– ‘এটা পোস্টার। আমি ছবি বানাই, তার পোস্টার।’

অমি পোস্টারটা হাতে নিয়ে বসে রইলো। আজও গল্প চললো দুজনাতে। ছোট্ট বাচ্চাটিকে দেখলেই মাহিবের বুকটা আনচান করে। নিজের সন্তানের কথা মনে পড়ে যায়। একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসে থাকার সাধ জাগে। মাহিব জানে না অংশী কোথায়, তার সন্তান কোথায়!

অমি আজ চলে যাওয়ার সময় পোস্টারটা সাথে নিয়ে চলে যায়। ওর মা ঘরে কাজ করছিলো। অমিকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘কই ছিলি?’

– ‘একটা আংকেলের সাথে গল্প করতে গিয়েছিলাম মা। এই দ্যাখো আমি কি এনেছি।’

অনেক উল্লাস নিয়ে অমি পোস্টারটা মেলে ধরলো মায়ের সামনে। পোস্টারে চোখ পড়তেই তীব্র বেগে বুকের ভেতর ঢেউ আছড়ে পড়লো অংশীর। সমস্ত শিরা উপশিরায় রক্ত উছলে উঠতে লাগলো। শিরদাড়া বেয়ে একটা শীতল রক্তের ঢেউ বয়ে গেলো। কাঁপতে কাঁপতে পোস্টারটা হাতে নিলো অংশী।

সিনেমার পরিচালকের জায়গায় “মাহিব আহসান” নামটা দেখে বুকের ভেতরটা জ্বলে উঠলো। এত বছরের জমিয়ে রাখা রাগ ও ঘৃণাটা কবে যে ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়েছিলো অংশী জানে না। কেমন কেমন লাগছে যেন! মাহিবকে দেখার জন্য, মাহিবের ভালোবাসা পাবার জন্য অংশী বুকের ভেতর অনন্ত তৃষ্ণা বয়ে নিয়ে চলছিলো। মাহিব সত্যি আছে এই বাংলোয়! বুকটা চিনচিন করে উঠলো।

স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারলো না অংশী। ভাগ্য কি তবে আবারও মাহিবের সামনে নিয়ে এলো ওকে? অংশী তো ধরেই নিয়েছিলো আর কোনোদিনো দুজনের দেখা হবে না। মাহিবকে দেখার জন্য অন্তর জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। তবুও মনের ভেতর একটা পুরনো যন্ত্রণা উঁকি দিচ্ছে। মাহিব যদি আবারও অপমান করে! অবহেলায়, তাচ্ছিল্যে যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়। এত বছর পর সে কষ্টটা সইতে পারবে না অংশী। ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। তারচেয়ে বরং ওকে দর্শন না দেয়াটাই ভালো।

আজ থেকে কয়েক বছর আগে অংশীর একজন লোকের সাথে পরিচয় হয়। তার পাহাড়প্রীতি শুনে অংশী মুখ ফুটে বলে ফেলেছিলো, আমি পাহাড়ে জন্মেছি, পাহাড়েই বড় হয়েছি। পাহাড়েই আবার ফিরে যেতে চাই। কথায় কথায় এক পর্যায়ে অংশী জানতে পারে লোকটার পাহাড়ে একটি বাংলো আছে। সেই বাংলো পরিচালনা ও দেখাশোনার জন্য উনি একজন লোক খুঁজছেন। অংশী নিজে থেকে সেই দায়িত্ব নেয়। তারপর চলে আসে পাহাড়ে। মাস শেষে যে বেতন পায় তাই দিয়ে ওর একলা সংসার চলে যায়। সারাদিন পাহাড়ে ছুটে বেড়ায়, অমিকে নিয়ে বনে বাদাড়ে ঘুরে, ফলমূল সংগ্রহ করে। অবসরে ঘরে বসে শাড়ি বুনে, সে শাড়ি আবার বাজারে বিক্রি করে। এভাবেই দূর পাহাড়ে একাকী চলছিলো অংশীর জীবন। সন্ন্যাসীর মত এ জীবনে না আছে কারো ভালোবাসা, না আছে কারো ভালোবাসা প্রাপ্তির আশা। শহরের নিষ্ঠুরতা অংশীকে সবসময়ই পীড়ন করে। তাই শহরে থাকার ইচ্ছেটাও মরে গেছে ওর। একলা একা পাহাড়ে ছোট্ট ছেলেটিকে নিয়েই ওর সময় কাটে। আবারও কখনো মাহিবের সাথে দেখা হবে এ আশা ভুলেও জাগে নি মনে।

অংশী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অমি অংশীর আঁচল টেনে ধরে বললো, ‘কি হলো মা? দেখো।’

অংশী কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, ‘লোকটার সাথে কি আর কেউ আছে বাবা?’

অমি দুদিকে মাথা নাড়লো। অংশী অমিকে বুকে জাপটে ধরে শুয়ে পড়লো বিছানায়। এত বছর বুকের ভেতর চাপিয়ে রাখা যন্ত্রণাগুলো সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মত জেগে উঠতে লাগলো। অংশী বুকের উপর খামচে ধরে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে লাগলো। মাহিবকে দেখার জন্য যে আকুতি, তাকে আটকে রাখা ওর পক্ষে দুঃসাধ্য। তবুও সয়ে যাচ্ছে। চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে টপটপ করে।

সারা রাত দু চোখের পাতা এক হলো না অংশীর৷ অমি সকালে ঘুম থেকে উঠেই বেরিয়ে গেছে। নিশ্চিত মাহিবের কাছে গেছে ও। অংশী ঘরের মেঝেতে শাড়ি বুনতে বসে গেলো। আজ কাজে হাত উঠছে না। মন আনচান করছে। এভাবে কতক্ষণ যন্ত্রণা সহ্য করা যায়?

অংশী জানালায় মাথা রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। বিশাল দিগন্ত জুড়ে নীলের মিশ্রণ। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে৷ মানছে না কিছুতেই। জোর করে নিজেকে আটকে রাখা যে কি যাতনার। সে সয়েছে কেবল সে- ই জানে। অপলক দৃষ্টিতে চেনা পাহাড়গুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো অংশী।

এমন সময় দরজা ঠেলে কে যেন প্রবেশ করলো। দরজার দিকে তাকাতেই হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড় হলো অংশীর। মাহিব অমিকে কোলে নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে!

মাহিবের সমস্ত শরীর ঝনঝন করে উঠলো। জানালা দিয়ে আসা আলতো আলোয় অতি পরিচিত সব’চে আপন অংশীর মুখ দেখে অনেক্ষণ নিশ্বাস নিতে পারলো না ও। চোখের পলক থমকে গেছে কিছুক্ষণের জন্য। এই সন্তান তবে মাহিবের নিজের! অংশী এখানে এভাবে!

সবকিছু স্বপ্নের মত মনে হতে লাগলো মাহিবের। অমিকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে এলো অংশীর দিকে। অংশী জানালা ধরে পিছিয়ে গেছে। চেহারা নীল হয়ে উঠেছে অংশীর।

মাহিব অংশীর একদম কাছে গিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো। ঘনঘন জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে সমানে দুহাত দিয়ে চোখ কচলাতে লাগলো। অংশী অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অশ্রুপাত করলো।

মাহিব আস্তে আস্তে অংশীর আরো কাছে এসে দাঁড়ালো। আর্দ্র কণ্ঠে বললো, ‘অংশী…’

মাহিবের মুখে নিজের নাম শুনে কলিজার ভেতরটা নড়েচড়ে উঠলো যেন। অংশী কোনোমত মুখ ফিরিয়ে মাহিবের দিকে তাকালো। মাহিব বললো, ‘অংশী, তুমি!’

অংশী মাথা নিচু করে ফেললো। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এসেছে ওর৷ মাহিব কিছু বুঝে ওঠার আগে আচমকা বুকের ভেতর চেপে ধরলো অংশীকে। অংশীর মাথাটা একহাতে বুকের উপর শক্ত করে ধরে ক্রমাগত রোদন করতে লাগলো। অংশী দুহাত দিয়ে মাহিবকে আঁকড়ে ধরতেও পারছে না। শিরশির করে শরীরে একটা কিছু বয়ে যাচ্ছে ওর। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলের ধারা।

মাহিব অংশীর মুখ দুহাতে ধরে নিজের মুখের সামনে তুলে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি অংশী। আমি তোমাকে.. তুমি যে আমার কি আমি তোমাকে বোঝাতে পারবো না। আমার নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। এটা স্বপ্ন নয়ত? অংশী, কি বললে বুঝবে তুমি? কিভাবে বোঝাবো তোমাকে? আমার উপর অনেক রাগ তাইনা?’

আচমকা মেঝেতে বসে অংশীর পা চেপে ধরতে যাচ্ছিল মাহিব। লোকটা এমন পাগলের মত আচরণ করছে যে অংশী আর স্থির হয়ে থাকতে পারলো না। হাত দিয়ে মাহিবের হাত ধরে ওকে টেনে তুলে বললো, ‘এমন করছেন কেন আপনি?’

– ‘আমাকে ক্ষমা করো অংশী। জানি আমাকে মাফ করতে পারছো না। তবুও করতে হবে। ক্ষমা না করলে আমার.. আমি শেষ হয়ে যাবো এভাবে। প্লিজ অংশী আমাকে ক্ষমা করো।’

অংশী মাহিবের হাত চেপে ধরে বললো, ‘এমন করবেন না। আমার আপনার উপর কোনো রাগ নেই।’

– ‘কেন রাগ নেই? আমাকে মারো। আমাকে মেরে ফেলো। আমি তোমার সাথে যে অন্যায় করেছি তার শাস্তি আমাকে দাও, দাও প্লিজ দাও।’

অংশী নির্বাক ভঙ্গিতে চেয়ে রইলো। মাহিবের এ কি পরিবর্তন! এ কি হয়েছে চেহারার হাল। আগের মাহিব আর এখনকার মাহিবের মাঝে আকাশসম ব্যবধান। তবে কি শুধরে গেছে মাহিব!

মাহিব বললো, ‘এই কয়েকটা বছর আমি তোমাকে পাগলের মত খুঁজেছি। আমি কেবল তোমার জন্যই বেঁচে আছি অংশী। আমি তোমাকে ছাড়া আর বাঁচতে চাইনি। কোথায় না খুঁজেছি বলো? পাহাড়ে আছো শুনে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করছি তোমার কথা। অংশী, আমি বুঝাতে পারবো না অংশী।’

মাহিব মেঝেতে বসে পড়লো। আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন লোকটাকে নিতান্তই অসহায় দেখাচ্ছে আজ। অংশী ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো মাহিবের দিকে। মাহিবের চোখের নিচে কালো দাগ, অবিশ্রান্ত শরীর। উশকো খুশকো চুল। এ কেমন পরিবর্তন!

মাহিব মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে মেঝেতে। ছটফট করছে অস্থিরতায়। অংশী আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। মেঝেতে বসে মাহিবের মাথাটা ধরলো দুহাতে। তারপর বুকের ভেতর চেপে ধরলো। এতদিন প্রতীক্ষার পর বহু আকাঙ্খিত অংশীর স্পর্শ পেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেলো মাহিব। ও অংশীকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। কেঁদে ফেললো অংশী নিজেও।

দুজনকে এভাবে জড়াজড়ি করে কাঁদতে দেখে স্তব্ধ অমিও কান্না করে দিলো। এতক্ষণে ওদের হুশ হলো অমি’র কথা।

অংশী বললো, ‘অমি, তোমার ছেলে।’

মাহিব অমি’কে বুকে টেনে নিয়ে বললো, ‘বাবা আমার। তুই আমারই সন্তান। আমার!

অমি কিছুই বুঝতে পারছে না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে শুধু। অংশী অমি’র মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ‘বাবা, উনি তোর আব্বু। ও হারিয়ে গিয়েছিলো।’

অমি কি বুঝলো কে জানে। মাহিবের কোলে বসে মাহিবকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে রইলো। একহাতে চেপে ধরলো অংশীর হাত। অনন্ত তৃষ্ণার পর প্রতিক্ষীত অমৃত সুধা পানের মত হৃদয়টা ভরে উঠলো সুখে, অনন্ত সুখে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here