#তোমাতে
লেখনীতে~আগ্নেস মার্টেল
/পর্ব ১৪/
লজ্জায় মাথা নুয়িয়ে হাঁটতে গিয়ে রাস্তা গুলিয়ে ফেললাম। সিড়ির মাথায় বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে যাই। এখান থেকে দুদিকে রাস্তা গেছে। একটা ডানদিক যেটা দিয়ে মাত্র আসলাম। আরেকটা বাম। ঐদিকে যাব কিনা তা নিয়ে কনফিউশনে ভুগছি। বাম দিকের রাস্তায় শুধু রুম চোখে পরছে। উড়নার কোণ মুঠোয় চেপে ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ ভাবলাম। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে বিভ্রান্ত আমি সেদিকে পা বাড়াই, উপর থেকে কণ্ঠ এল, “কোথায় যাও?”
চমকে উপরে তাকাই। ইফাজ ট্রাউজারের পকেটে হাত রেখে সিড়ির ওপর দাঁড়িয়ে। সিল্কি চুলগুলো এলোমেলোভাবে কপাল ছুয়ে। হাত দিয়ে ডানদিক দেখিয়ে বিভ্রান্ত কণ্ঠে বললাম, “রাস্তা গুলিয়ে ফেলেছি।”
সে একগাল হাসে। মৃদুতালে সেই অবস্থায় নেমে আসে। আমি বিভ্রান্ত হয়ে তাকিয়ে থাকি। সামনে এসে বলল, “সাহায্য লাগবে?”
বিরক্তি চেপে সম্মতি দিলাম। ইফাজ আগেকার আমলের সেবকের মতো ডানদিক দেখাল। সেদিকে একটু হেলে বলল, “ঐদিকে চলুন রানী সাহেবা।”
নিরুত্তর কথাটি মেনে নেই। অস্বস্থি লাগে খুব। ছেলেটা নিশব্দে হাঁটছে। কখনো চুলে আঙুল বুলিয়ে নিচ্ছে। কখনো আড়চোখে, কখনো সরাসরি তাকাচ্ছে। চোখ চোখ পরলে সরল হাসিতে মুখ ঝলমলিয়ে উঠছে।
“তুমি এখন আর আমার মেসেজের উত্তর দাও না!”
মনে মনে এর ভয়ই পাচ্ছিলাম। সামনে তাকিয়ে গলা খাকারি দিলাম, বললাম, “অনলাইনে ঢু মারা হয় না।”
ইফাজ কিছুক্ষণ চুপ থাকে। হয়ত আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি অস্বস্তিতে কাটা হয়ে সামনে তাকিয়ে থাকি। যেন সাথে কেউ নেই! থাকলেও অদৃশ্য। যাকে আমি দেখছি না।
“তোমাকে আমি গতকালও একটিভ দেখেছি।”
উনার দিকে তাকালাম। বিরক্তি উপচে পরতে চাইছে। এসময় কিছু সম্মিলিত কণ্ঠের সুর ভেসে আসল। সামনে তাকালাম। ড্রয়িং রুমের আগের রুমটায় তারুণ্যের বিশাল জটলা। তাদের দৃষ্টি আমাদের ওপর। জটলার মধ্যমনি জিসান ভাই ভ্রু কুচকে তাকিয়ে। বিরক্ত কণ্ঠে বলেন, “কই গেছিলি তুই?”
ওদের মুখভঙ্গিতে বিস্মিত হয়ে উত্তর দিতে ভুলে গেলাম। ইফাজ বলল, “ও রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিল।”
জিসান ভাই কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। আমি চুপসে যাই। তাকিয়ে থাকি উনার দিকে। ওদের মতো তিনিও কি ভুল ভাবছেন? উনি কিছুক্ষণ নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। রূক্ষ্ম দৃষ্টি ধীরে ধীরে নম্র হল। বললেন, “যা ড্রয়িং রুমে যা।”
নেহা আপুর ছোট বোনটা লাফিয়ে উঠে। জটলা থেকে উঠে আসে। বলে, “না ভাবীর সাথে আমাদের পরিচয় হয়নি।”
জটলায় আবার একই ধরনের শোর উঠল। আমি একবার জিসান ভাই আরেকবার ইফাজের মুখের দিকে তাকাই। জিসান ভাই ত্যক্ত মুখে বসে। ইফাজের মাথা নিচু। মুখভঙ্গি দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটা এগিয়ে এল। আমার একহাত দুহাতে ধরে বলল, “নাম কি ভাবী?”
আমি বিভ্রান্ত হলাম। এ মেয়েটি আমাকে কোন হিসেবে ভাবী ডাকছে? এই মুহূর্তে একটু আগের শোরের ওপর নির্ভর করে? নাকি তখনকার লজ্জাজনক পরিস্থিতিটা মনে রেখে? আমি এখন সাড়া দিব? নাকি দিব না! উঁউঁ মাথার ভেতর এত প্রশ্নের ভিড়ে পাগল লাগছে নিজেকে। আমাকে নিরুত্তর দেখে মেয়েটি একবার ইফাজের দিকে তাকায়। একবার পেছনে। প্রশ্ন করে, “ভাবী কি কথা বলতে পারে না?”
জিসান ভাই নিরুত্তর ফোন ঘাটতে থাকেন। আমি অসহায় মুখে বলি, “এই না আমি কথা বলতে পারি।”
মেয়েটি চোখ বড় বড় করে তাকায়, “তোমার কণ্ঠ এত পিচ্চি পিচ্চি! কিসে পড়ো? আমার থেকে ছোট?” কুটিল হেসে, “ছোট হলে ভাবী ডাকা বাদ। অনলি ফাইফরমাশ চলবে!”
আমি থতমত হলাম। বললাম, “এবার এইচএসসি দিয়েছি।”
মেয়েটা বিস্মিত চোখে তাকায়। জটলায় হাসির রোল পরে। ইফাজ ইতিমধ্যে জিসান ভাইয়ের পাশে জায়গা করে নিয়েছে। একটা কিশোর কণ্ঠ আসে, “ছোট তোর ফাই ফরামাশ গেল!”
আবার হাসি। আমি বড় বড় চোখে শুধু দেখছি। মেয়েটা বলল, “সেমব্যাচ তাহলে? ঝামেলা! কি ডাকব? নাম ধরে?”
সম্মতি দিলাম। মেয়েটা বলল, “নাম কি?”
“ঝুমুর। তোমার?”
একগাল হেসে, “নিকিতা। কই চান্স পেয়েছ?”
“মেডিক্যালে।”
নিকিতার চোখ আবার বড় বড় হয়, “এখন এটা বলো না জিসান ভাইয়ের মেডিক্যালেই চান্স পেয়েছ।”
ফিক করে হেসে ফেলি। নিকিতা বিস্মিত কণ্ঠে বলে, “অর্থাৎ সেইখানেই চান্স হয়েছে?”
“হ্যা। কেন? তুমিও চান্স পেয়েছ?”
মেয়েটা সম্মতি দিল। ওদের সাথে পরিচয় করাল। আমি লুকিয়ে আরেকবার জিসান ভাইয়ের দিকে তাকাই। চোখাচোখি হয়। তিনি ছোট্ট শ্বাস ফেলেন।
বিয়ে ঠিক হলো। সাতদিন পর বিয়ে। আমাদের সবার মধ্যে এখুনি বিয়ে বিয়ে আমেজ এসে গেছে। আপু, মামী কেনাকাটার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। ফিরতি পথে আমি নিসাদের বাসায় নেমে গেলাম। মামী বারণ করল। মানলাম না। নিসাদের বাসার কলিং বেল চাপব। ফোনে কল এল। দেখি জিসান ভাইয়ের কল। কলিংবেলের চেপে ফোন ধরলাম।
“পৌছে গেছিস?”
“না। নিসাদের বাসায় এসেছি।”
“ওখানে কেন আবার!”
“ওর খবর নিতে এলাম। কতদিন দেখা হয় না। ভাইয়ার বিয়ের কথা বলব না?”
“আজকেই কিন্তু বাসায় ফিরবি!”
মৃদু হাসি। এসময় সামনের দরজাটা খুলে যায়। নিসা আমায় দেখে মৃদু চেঁচিয়ে উঠল। জড়িয়ে ধরল। ফোনটা মুখের সামনে এনে বললাম,“পরে কল করছি।”
ওপাশ থেকে তিনি কিছু বলছিলেন। কল কেটে দেই। নিসা বাইরে রেখেই আমার হাত ধরে ঘুরতে থাকে খুশিতে। বললাম, “ভেতরে তো বসা।”
“ও হ্যা।”
আন্টি খোজ-খবর নিলেন। নিসা ডিরেক্ট ওর রুমে এনে বসাল। দুজনে কথার ঝুলি মেলে বসি। নিসা একসময় ঠোঁট ফুলিয়ে অভিযোগ করে, “রিলেশনে গিয়ে বদলে গেছিস ঝুম! এখন আর আমাকে পাত্তা দিস না।”
“মিথ্যে বলবি না। আমি গতকালও ফোন দিয়েছি তোকে পাইনি!”
নিসা গাল ফুলিয়ে রণচন্ডী রূপ ধারন করে। গল্প করতে করতে সময় গড়াল। আন্টি ছাড়লেন না। এতদিন পর আসায় বেশ কয়েকদিন রেখে তারপর ছাড়বেন। আমি থাকতে পারব। কিন্তু উনি? বাসায় ফোন করে জানালাম। সকালে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাঠিয়ে দিতে বললাম।
তখন মধ্যরাত। বিছানার দুপাশে আমি আর নিসা ফোন ঘাটছি। মেসেঞ্জার আর মেসেজ টোন দুটাই একসাথে বেজে উঠল। নিসা নিজের ফোন থেকে মুখ তুলে তাকায়। আবার নিজেরটায় ধ্যান দেয়। নোটিফিকেশন বারে উঁকি দেই। ভ্রু কুচকে আসে। একটা ইফাজের আইডির। স্তুতি বাক্য লেখা! মুখটা আপনাই ভেটকে গেল। সেটাকে দ্রুত নোটিফিকেশন বার থেকে সরাই। আরেকটা জিসান ভাইয়ের। উনার মেসেজে কথার থেকে বকাঝকা বেশি। রাগ লাগল, লিখলাম, “এত বকছেন কেন? আজকে আপনার বাসায় আসার কথা? গতকালই বাসায় এসেছেন। আজকে দেখা হলো। এত হাইপার হওয়ার কি আছে? তাছাড়া কয়েকটা দিনই তো।”
মেসেজ সেন্ড করেছি অনেকক্ষণ। তিনি উত্তর দিচ্ছেন না। ফোনটা রেখে দিব এমন সময়ে উত্তত আসে, “কথা না কথার ব্যাপার না। ইচ্ছে হবে দেখা করব। তোর আমার জন্য সময় বের করতে হবে। না থাকলে খুচিয়ে খুচিয়ে বের করবি! এখুনি বাসায় আয়! তিনদিন কি একরাতও থাকতে হবে না!”
“পাগল হলেন? আন্টি সন্ধ্যে হয়েছে বলেই ছাড়ল না এখন ছাড়বে? তিনদিন মাত্র। মানিয়ে নেন।”
“অসম্ভব! গেলি কেন আজ?”
“আজব মানুষ আপনি! একবারও বলেছেন আজকে রাতে দেখা করবেন?”
“তুই বুঝে নিবি! ভদ্র মেয়েরা এতরাতে বাড়ির বাইরে থাকে?”
বিরক্ত হয়ে ফোনস্ক্রিনে তাকিয়ে থাকি, “কোথাকার ডায়লগ কোথায় আনছেন!”
“আমি পাগল হয়ে যাব ঝুম। আজকে থাকছিস থাক। কালকেই বাড়ি আসবি।”
“বাড়ি গেলেও তো দেখা হবে না।”
“তবু মনস্তাত্ত্বিক শান্তি থাকবে!”
মৃদু হাসলাম, “ইদানিং ক্ষেপাটে হয়ে গেছেন!”
তিনি এবার সাথে সাথে উত্তর দেন না। আমি ফোনস্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকি। একবার মনে হলো হয়ত ঘুমিয়ে গেছেন। রেখে দেই। তবু উনার মেসেজগুলো বারবার পড়তে থাকি। একসময় ভয়েস মেসেজ আসল, “ভালবাসি ঝুম।”
এই রাতের বেলা আমার ইচ্ছে হলো এখুনি এই ক্ষেপাটে পুরুষকে বিয়ে করি! সারাক্ষণ ঘাপটি মেরে উনার বুকের কাছে লেপ্টে থাকি। হুটহাট ইচ্ছের তাড়নায় বশিভূত হয়ে উনাকে অজস্র উষ্ণ ছোয়ায় রাঙিয়ে দেই। আমাদের অসংখ্য রাত কাটুক গল্পে মজে। স্মৃতির পাতা জুড়ে থাকুক উনার আমার খুনসুটিময় একান্ত এক পৃথিবী। যার গল্পটা ভালবাসার। এবং শুধুই ভালবাসার। এই যে এখন এত ইচ্ছদের মধ্যে সবচেয়ে বাজেভাবে যেটা চাইছি সেটাই এই মুহূর্তে পূরণ হবার নয়। ইচ্ছেটা উনাকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরি আর তোতাপাখির সুর অনুকরণ করে বলি, ‘এত পাগল কেন তুই?’
~চলবে❤️