তোমাতে পর্ব-১৫

0
1212

#তোমাতে
লেখনীতে~আগ্নেস মার্টেল

/পর্ব ১৫/

নিসাদের বাড়িতে তিনদিন থাকা হলো না। সকালে ড্রাইভার কাকা এসে বললেন মামী আমাকে বাসায় যেতে বলেছেন এবং কারনটা বিশেষ। আন্টি তা উড়িয়ে দেন। প্রবল আত্মবিশ্বাসে মামীকে কল করেন। আমার নাছোড়বান্দা মামীর সাথে পেরে উঠলেন না। আমি বিস্মিত হলাম। কি নিয়ে মামীর এত উচাটন? এই জরুরি ভিত্তিটা আমার কাছে ধোয়াশা লাগছে। খুজেও কোন কূল কিনারা পাচ্ছি না। ফোন করলাম জিসান ভাইকে। কলটা ব্যস্ত আসল। ছোট্ট এক শ্বাস ফেলে বাসায় আসি। দরজা খোলাই ছিল। মুখোমুখী পরলাম মিশেল আপুর। আপু চিন্তিতমুখে বসে। বলল, “শুধু শুধু আসতে গেলি কেন?”

“মামীই তো বলল।”

আপু বিরক্ত দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। ভাবলাম নিত্যকার রুটিন। সেসবকে পাত্তা না দিয়ে মামীকে ডাকতে ডাকতে রান্নাঘরে আসি। মামী আঁচলে হাত মুছে পেছন ফিরেন, একগাল হেসে বলেন, “এলি তাহলে?”

রান্নাঘর জুড়ে এত আয়োজনের আভাস দেখে ভ্রু কুচকে গেল। বললাম, “আজকে কোন অনুষ্ঠান?”

মামী কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমার থুতনি ধরে বললেন, “বাপের ধাত পেয়ে ভারী সুন্দর হয়েছিস তুই! বড় হচ্ছিস এখন ভাগ্য খারাপ না হলে সামনে আরও কত আয়োজন হবে!”

বিস্মিত হলাম, “কি বললে বুঝিনি।”

মামী ফিরে দাঁড়ান। মাছ ভাজায় মন দেন। আমি উৎসুক চোখে রেনু খালার দিকে তাকাই। ভ্রু উঁচিয়ে কারন জিজ্ঞেস করি। খালা মাথা নিচু করে নেন। আশ্চর্য হলাম। মামী আমার দিকে পিছু ফিরে থেকেই বলেন, “আজকে তোকে ইফাজের পরিবার দেখতে আসবে। বিছানার ওপর তোর পছন্দের শাড়ি রেখেছি। একা শাড়ি পড়তে পারিস না? নইলে মিশেলকে বলবি ও পড়িয়ে দিবে!”

বাকরুদ্ধ হয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। জবাব না পেয়ে মামী পিছু ফিরেন। বললাম, “মামী আমার আগে মিশেল আপু আছে! এত তাড়াহুড়ো কিসের? গতকালই না ভাইয়ার বিয়ে ঠিক হলো? ভাইয়ার বিয়ে শেষ হলো না, আপুর বিয়ের নামধাম নেই কোথা থেকে আমার বিয়ে নিয়ে এসব উটকো ঝামেলা!?”

“উটকো বলছিস কেন? দেখতে আসা অর্থই কি বিয়ে? ওদের পছন্দ হলে খুব বেশি বাগদান হবে। নইলে মিশেলের আগে তোর বিয়ে হচ্ছে না। এমনি পছন্দ করে রাখা। দোষ কি?”

ত্যক্ত কণ্ঠে বলি, “তোমরাই না বলেছিলে পড়াশোনা শেষ করার আগে কোন বিয়ে নয়?”

“আরে বোকা, ওরা শুধু তোকে দেখে যাবে। পছন্দ হলে হয়ত আংটি পরাবে। ব্যাস এটুকুই। মিশেলের বিয়ের পরই তোর পালা…”

তীব্র রাগে আমার কান্না পেল। সে রাগ প্রকাশ করতে না পারায় সারা শরীর ছটফটিয়ে উঠল। মামীর দিকে একপলক তাকাই। মামীর হাসি দ্রুত মিলিয়ে যায়। হতভম্ব কণ্ঠে বলেন, “ওমা কাঁদছিস কেন? আমরা ভাবলাম ছেলে তোর পছন্দ। ওরা যখন রাতে বলল দেখতে আসবে তোর মামা তাই মানা করেনি!”

আমার সারা শরীর রাগে কাঁপছে। চোখের কোল থেকে এসময় বড় বিন্দুফোটা গাল গড়ায়। দুচোখ থেকেই পরতে থাকে। রোধ হয়ে আসা কণ্ঠে বললাম, “আমি একবারও বলেছি আমি ইফাজকে পছন্দ করি?”

মামী কথা গুলিয়ে ফেললেন। রেনু খালা নিশ্চুপ তাকিয়ে আছেন। মামী বিভ্রান্ত কণ্ঠে বললেন, “গতকাল ইফাজের মা..”

“উনার কথাটাই বড়? আমাকে প্রশ্ন করবে না? ওদের মানা করে দাও! আমার যাকে পছন্দ তার বাগদত্তাই হব। আমার অন্যের বাগ দত্তা হওয়ার বিন্দুমাত্র রুচি নেই!”

বিস্মিত কণ্ঠে, “সে কি! আসতে বলে এমন মুখের ওপর মানা করা যায়? দেখে যাক। পছন্দ হবে না মানা করে দিব।”

চেয়ার ছেড়ে উঠে পরি, “আমি আবারো বলছি অন্যের বাগদত্তা হতে পারব না। একেবারেই না।”

মামীকে বিস্মিত রেখে দ্রুত পায়ে রুমে আসলাম। রাগে খাটের এক কোণে গাট হয়ে বসে রইলাম। বিছানার ওপর রাখা প্রিয় শাড়িটাও কুৎসিত কদাকার ঠেকছে। এমন তিতকুটে বিচ্ছিরি অনুভূতি আমার আজ পর্যন্ত হয়নি। কিছুক্ষণ লম্বা দম নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম। জিসান ভাইয়ের সাথে কথা বলব। উনি হয়ত কোন পথ বাতলে দিবেন। কল লাগালাম। ফোন বরাবরের মতো ব্যস্ত এল। রাগ কয়েক ধাপ বাড়ল। ঘন্টা পেরনোর পর হয়ত কল ব্যাক করলেন। আবেশি কণ্ঠটা কানে এলে রাগ দমাই। বলি, “আপনি আপনার পরিবারকে বলেননি আমাদের সম্পর্কের কথা?”

তিনি হয়ত প্রশ্নটায় ভড়কালেন। সেই ভড়কানোর ছাপ পরল কণ্ঠে, “হ্যা বলেছি। কেন?”

দাঁতে দাঁত চেপে, “তাহলে কোন সাহসে ওরা আমাকে দেখতে আসবে?”

বিস্মিত কণ্ঠে, “কে দেখতে আসছে? মা তো কিছু বলেনি!”

গর্জে উঠলাম, “আপনার মা এলে আমার কোন সমস্যা ছিল না। আমাদের সম্পর্কের কথা জেনেও আপনার চাচাতো না ফুপাতো কি ভাই হয় সে কেন আসছে আমাকে দেখতে? ওর সেল্ফরেস্পেক্ট নেই? নিজের ভাইয়ের প্রেমিকাকে দেখতে আসে ছিঃ!”

“শান্ত হ। ধীরে বল কার কথা বলছিস।”

“আপনার ভাই একটা..”

বিরক্তি সূচক শব্দে, “মূল কথাটা বল!”

“ইফাজের পরিবার আমাকে দেখতে আসছে! আমার অবাক লাগছে মানুষ এত নিচে কিভাবে নামতে পারে! আমাদের সম্পর্ক জেনেও কেন..”

তিনি ধমকে উঠেন, “ঝুম! না জেনে কথা বলবি না। ইফাজের পরিবার জানে না তোর আমার সম্পর্ক! জানলে হয়ত যেত না!”

“আপনি তাহলে কোন পরিবারকে বললেন?”

“ভালভাবে কথা বল! আমার বাবা-মা জানে। পুরো গুষ্টিকে বলে বেড়ানোর এখনো সময় হয়নি।”

চোখের পানি মুছে কিছুক্ষণ চুপ রইলাম। ধাতস্থ হয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম, “ফাইন আপনার সঠিক সময় আসুক। অপেক্ষা করুন। সঠিক সময় এলে বউয়ের জায়গায় ভাবী ডাকবেন। মন্দ কি?”

“ঝুম!”

“চেঁচাবেন না একদম। এখনো পরিবারকে জানাননি কোন প্রজাতির মানুষ আপনি!”

ক্ষুব্ধ কণ্ঠ এল, “থাপ্পড় চিনিস বেয়াদব? বেশি বড় হয়ে গেছিস, না? চেঁচিয়ে কথা বলা হচ্ছে! তোর আমার রিলেশন কতদিনের? সবোর্চ্চ এক বছর। তবু নিজের বাবা-মা’কে বলেছি! তুই সবে ভার্সিটিতে উঠেছিস। তুই না বলেছিলি তোর পরিবার এখুনি বিয়ে দিবে না! বিয়ে দেবার এত তাড়া আগে বলেনি কেন? মিশেলকে টপকেই বিয়ে দিচ্ছে! আজাইরা পরিবার! কথার কোন ঠিক ঠিকানা নাই! আমার সময়েই যত আপত্তি অন্যের বেলায় ঢেই ঢেই করে রাজি হচ্ছে! তোর বিয়ে অন্যের সাথে ঠিক করলে খুন করে আসব পুরো পরিবারকে!”

বিস্ময়ে বললাম, “আপনি এসব বলছেন? কবে থেকে এমন বেয়াদব হলেন আপনি? বড়দের টেনে..”

কথা শেষ হওয়ার আগেই কল কেটে যায়। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। একসময় শব্দ করে কাঁদতে থাকি। পাগলদের মতো কখনো চুল টেনে ধরি। আপু এসে এসময় পাশে বসল। অসহায় মুখে তাকালাম। আপুর চোখে পানি দেখে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকি। আপু পিঠে হাত বোলায়। বলে, “এমন ভেটকে ভেটকে কাঁদা বন্ধ কর। ওরা শুধু দেখতে আসবে। পছন্দ হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলে স্রেফ এড়িয়ে যাবি। সরাসরি তো প্রত্যাখান করতে পারবি না। বাড়ি গেলে পর কল দিয়ে বলে দিবি পছন্দ হয়নি।” কিছুক্ষণ চুপ থেকে, “আরেকটা অপশন আছে। ইফাজের সাথে কথা বলতে দিলে ঐখানেই বলে দিবি তুই শাফিকে ভালবাসিস। ইফাজ নাটকের ভ্যাম্প না যে ভ্যাম্পগিরি করে হলেও তোকে বিয়ে করবে।”

“আমার ভাবতেই অস্বস্তি লাগছে আপু। আমি সং সেজে ওদের সামনে বসব? অসম্ভব! ইফাজ লোকটিকেই আমার বিদঘুটে অসহ্য লাগে!”

আপু এসময় ফিক করে হাসে। বলে, “ওকেই তো জীবনের ফার্স্ট লাভ লেটার দিলি!”

“উঁ আপু!”

“তিয়াসকে বলি বরং। ও কিছু একটা করতে পারবে।”

চোখ মুছে সোজা হয়ে বসি। বলি, “সত্যি?”

“ট্রাই করতে দোষ কি?”

চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে বেরই। নিজেকে স্বাভাবিক করে আপুর সাথে বেরলাম। ভাইয়া রুমে আছে কিনা সেটাও ভাবনার। রুমে উঁকি দেই। ভাইয়া আছে। বলল, “আমি কোন হ্যাল্প করতে পারব না।”

আপুর দিকে তাকাই। আপু বিরক্ত কণ্ঠে বলে, “কথা শুনে নে আগে।”

“বললাম তো পারব না। যা সামনে থেকে যা।”

অসহায় মুখে ভাইয়ার পাশে বসে যাই, “ভাইয়া?”

ভাইয়া কাগজ পত্র ঘাটছিল। মুখ তুলে চায়ল, “আমি কিছু করতে পারব না রে। দুজনই আমার বেস্টফ্রেন্ড!”

নিরুপায় হয়ে গাল ফুলিয়ে বসে রইলাম। বিকেল নাগাদ ওরা সত্যিই এল। চোখ-মুখ শক্ত করে গিয়ে বসলাম। পূর্ণাঙ্গভাবে ওদের কোন প্রশ্নেরই উত্তর দেইনি। ‘হু’, ‘হা’ দিয়ে কাজ চালিয়েছি। নয়ত মাথা নেড়ে। একসময় আমাদের আলাদা কথা বলতে পাঠাল। ইফাজের ঐ পলকহীন দৃষ্টির সামনে অস্বস্তি লাগল। বিরক্তিতে ভ্রু কুচকে এল।

“চোখ-মুখ এমন শক্ত করে রেখেছ কেন? তোমার আমাকে পছন্দ নয়?”

আমি নিরুত্তর ছেলেটার দিকে তাকাই।

_____

ওরা চলে যাবার পর কোনদিকে না তাকিয়ে নিজের বিছানায় এসে গড়ালাম। মাঝখানে মামী এসে সিদ্ধান্ত নিয়ে গেছে। কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে, “ঠিক তো?” বিরক্ত হয়ে একসময় তাকিয়ে ছিলাম। মামী চলে গেলেন। শান্ত মাথায় ভেবে মনে হলো দোষটা আমারই। এবং আরেকটি ভুল করে বসলাম।

~চলবে

ওকে বাই
আমি নাই🐸

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here