তোমায়_পাবো_বলে পর্ব_৩৪

তোমায়_পাবো_বলে
পর্ব_৩৪
#নিশাত_জাহান_নিশি

“আলবাদ বলতে হবে! ঠিক এভাবেই আহ্লাদী স্বরে বলতে হবে! দেখি, বলা শুরু করুন। আমি অপেক্ষা করছি!”

প্রবল ঝোঁক চেঁপে বসল বাবার আপাদমস্তকে। ধৈর্য্যশীলতা ক্রমশ হ্রাসমান হয়ে কঠোর সংকল্পে পরিনত হলো! একগুঁয়ে ভাব নিয়ে বাবা সশব্দে চেঁচিয়ে বললেন,,

“দিচ্ছি না আমি আমার মেয়েকে কোথাও। আমার মেয়ে এই বাড়িতেই থাকবে। আমার সাথে থাকবে, আমার পরিবারের সাথে থাকবে। নমনীয়, কোমলীয়, মধুময় ভাষায় কথা বলতে পারব না আমি! রাতারাতি নিজস্ব স্বভাব পাল্টানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”

পরশ খানিক ভড়কে উঠলেন। কিঞ্চিৎ নীরবতায় নিজেকে প্রতিস্থাপন করলেন। অতঃপর শান্ত গলায় বললেন,,

“কুল শ্বশুড় আব্বা। প্লিজ বি কুল! বুঝলাম না এত চটকে যাচ্ছেন কেন? এই যে এইমাত্র হুটহাট রেগে সিদ্ধান্ত নিলেন আপনার মেয়েকে আপনার বাড়িতে আপনার কাছে রেখে দিবেন। আদৌ কি সিদ্ধান্তটা যুক্তিযুক্ত হয়েছে? সমাজ মানেন তো আপনি? মানে, সমাজের কর্ণধার তো আপনি নিজেই। এমনিতেই আপনার মেয়ে আমার সাথে পালিয়ে বিয়ে করে আপনার নাক কেটেছিল। এখন যদি আপনি, আপনার মেয়ে এবং তার গর্ভে বেড়ে উঠা আমার সন্তানকে আপনার কাছে পার্মানেন্টলি রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিন, সমাজে কি তবে এই বিষয় নিয়ে কোনো অনধিকারচর্চা হবে না? অভিজ্ঞ মা, চাচী, খালাম্মা, আন্টিরা এই বিষয়ে কথা তুলবেন না? মুখ ভর্তি পান চিবুতে চিবুতে পাড়ায় পাড়ায় এসব রটিয়ে বেড়াবেন না? তখন আপনার মান- সম্মান ঠিক কোথায় যাবে শ্বশুড় আব্বা? পারবেন তো নিজের মান-সম্মান ঠেকাতে?”

“তো কি করব আমি হ্যাঁ? কি করব? তোমার হাতে-পায়ে ধরে বলব এসো আমার মেয়েকে নিয়ে যাও?”

“বুঝেছি, আপনার হাই প্রেশারের ব্যামো আছে! তাই অল্পতেই রেগে যান। আরে মেরি শ্বশুড় আব্বা! আমি তো বলি নি, আমার হাতে-পায়ে ধরে আমায় আমন্ত্রণ জানাতে! আমি জাস্ট বলতে চাইছি, সামান্য আদুরে গলায় আমার সাথে কথা বলুন। ভালোবাসা এবং আবেগঘন অনুভূতি নিয়ে আমায় আহ্বান জানান! মানে, বাকি শ্বশুড় আব্বারা যেভাবে তাদের জামাইদের সাথে নমনীয়, কোমলীয়, মধুরময় আচার-ব্যবহার করেন ঐ রকম আর কি!”

“শুনো? তোমার সাথে আমার আর কোনো কথা নেই। সব কথা মিটে গেছে। এবার যা কথা হবে তোমার মা-বাবার সাথে হবে। উনাদের নিমন্ত্রন জানিয়েই আমি আমার ভূমিকা শেষ করব!”

“আরে ওয়েট ওয়েট শ্বশুড় আব্বা। আমার সাথেই তো আপনার সমস্ত কথা বার্তা! আমি যদি আসতেই রাজি না হই তবে আমার বাবা-মা কোন কারনে, কোন জোরে, কোন অধিকারে আপনাদের বাড়িতে আসবেন? আমিই তো হলাম রেড পেন দিয়ে আন্ডারলাইন করা মেইন পয়েন্ট! সো যেন তেন প্রকারেই হউক আমাকে আপনার মানাতেই হবে!”

ফট করে বাবা কলটা কেটে দিলেন। রাগ, জেদ, সংকীর্ণমনতায় এক বিমূর্ষ অবস্থা বাবার। উপস্থিত সবার মুখমন্ডলে আতঙ্কের ছাপ প্রগাঢ় ভাবে দৃশ্যমান। হুট করে বাবা বসা থেকে উঠে ঝাঁঝালো গলায় বললেন,

“এমন মেয়ের জামাই আমার চাই না। যে মেয়ের জামাই শ্বশুড়কে ঠাট্টা পাত্র হিসেবে দেখা। আমার চেনা-জানা কোনো শক্রুর ও যেন এমন বাজিগর জামাই না হয়!”

শুকনো মুখে আমি বাবার রক্তিম বর্ণ ধারন করা মুখমন্ডলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললাম,,

“পরশ তোমার সাথে মজা করছিলেন বাবা। তুমি সিরিয়াসলি নিও না প্লিজ। পরশ মন থেকে সত্যি তোমাকে অনেক ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন, এমনকি সম্মান ও করেন। পরশ খামোখা তোমায় রাগাতে চান বাবা। আর তুমি ও উনার কথায় হুটহাট রেগে যাও! এসব প্লিজ ছাড় বাবা! মা-বাবাকে কল করে নিমন্ত্রণ জানিয়ে দাও। এরপর তোমাকে আর কিছু করতে হবে না! যা করার আমরা করব!”

বাবা রাগে গজগজ করে স্থান পরিত্যাগ করে বললেন,,

“রুমে যাচ্ছি আমি। ঐ বাজিগর, ধূর্ত, বজ্জাত ছেলের বাবা-মায়ের সাথে আমি ঠান্ডা মাথায় রুমেই কথা বলছি!”

বাবা উনার কক্ষের চৌকাঠে পদার্পণ করতেই সবাই বুক ফাঁটা হাসিতে মত্ত হয়ে উঠল। মিলি আপু, রুম্পা আপু, নীলা, স্নিগ্ধা দাঁত কেলিয়ে হেসে সমস্বরে বলছে,,

“ইশশশ! এই প্রথম জেঠু জব্দ হয়েছে! তর্কে আমাদের জিজুর সাথে ঠিক পেরে উঠতে পারেন নি! ঠিক দু দু বার বাধ্য হয়ে জেঠুকে হার মানতে হয়েছে!”

মা হাসি চেঁপে রুক্ষ গলায় বোনদের শাসিয়ে বললেন,,

“এই থাম তোরা। এখন যদি উনি রুম থেকে শুনতে পান না, তোরা উনার খিল্লি উড়াচ্ছিস? তো আজ বাড়িতে দক্ষযজ্ঞ বেঁধে যাবে, এই বলে দিলুম!”

হাসি থামিয়ে সবাই নিশ্চুপ, নির্বিক, নিস্তব্ধতার, রূপ নিলো। আমি আড্ডা মহল ছেড়ে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলাম। পরশের সাথে অনেক বুঝা পড়া বাকি আছে আমার। লোকটা কেন বার বার আমার বাবার পেছনে লাগছেন, কেন বাবাকে কষ্ট দিচ্ছেন, কেন কটু কথা শুনাচ্ছেন এ সবকিছুর জবাবদিহি লোকটাকে দিতে হবে! এসব ইয়ার্কি, দুষ্টুমি আর চলবে না বাবার সাথে। বাবাকে বাবার মতো সম্মান দিতে হবে। প্রচুর ক্ষিপ্র হয়ে আমি রুমে প্রবেশ করে পরশের নাম্বারে ডায়াল করলাম। ঐ প্রান্ত থেকে পরশ কলটা তুলতেই আমি তটস্থ গলায় লোকটাকে শুধিয়ে বললাম,,

“কি চাইছেনটা কি আপনি? কেন আপনি বাবার সাথে রীতিমতো অসভ্যতামো করছেন?”

পরশের অট্ট হাসির আওয়াজে আমার কান শুদ্ধ ঝালাফালা হয়ে যাচ্ছিল! নাক, মুখ খিঁচে বন্ধ করে আমি কপালে কয়েক দফা বিরক্তির ভাজ ফুটিয়ে বললাম,

“কি হয়েছেটা কি? এভাবে বিচিত্র প্রাণিদের মতো হাসছেন কেন?”

“উফফফ, আর পারছি না আমি। সিরিয়াসলি টয়া। জীবনে এই প্রথমবার এত হেসেছি আমি! ইউ নো হোয়াট? আমার আশে পাশের কলিগরা আমাকে কম/বেশি পাগল ভাবতে শুরু করেছে! রীতিমতো আমার চোখে জল এসে গেছে বিলিভ মি! পেটে জাস্ট খিল ধরে গেছে। জাদরেল শ্বশুড় মশাই আজ আমাকে অনেক বেশি মজা দিয়েছে!”

“খু্ব মজা হচ্ছে না? খুব মজা হচ্ছে? আমার বাবাকে যা তা বলে ক্ষেপিয়ে খুব মজা পাচ্ছেন আপনি?”

“হ্যাঁ পাচ্ছি। সাংঘাতিক মজা পাচ্ছি। এইটা তো জাস্ট ডেমো ছিল আমার বউ। পিকচার তো এখন ও বাকি আছে!”

“মানে? আর ও কি কি করার বাকি রেখেছেন আপনি?”

“আগে তো স্ব-সম্মানে শ্বশুড় বাড়িতে আসতে দাও। এরপর না হয় দেখে নিবে, আর কি কি করার বাকি আছে!”

“আসছেন কবে আপনি?”

“আমি এবং বাবা আগামী কাল বা পরশুর মধ্যে আসছি। মা, পিয়ালী এবং পায়েল বিকেলের মধ্যে কুমিল্লা পৌঁছে যাবে আশা করছি।”

বিষন্ন গলায় আমি লোকটাকে শুধিয়ে বললাম,,

“আপনি আসবেন না আজ?”

“না বউ! অফিসে অনেক গুলো কাজ।”

কিঞ্চিৎ মুহূর্ত থেমে লোকটা ম্লান হেসে পুনরায় বললেন,,

“পরশু চলে আসব পাক্কা!”

“আজ মিলি আপুর বিয়ের পাকা কথা হবে! আর আপনি থাকবেন না? খুব মিস করব আপনাকে!”

“আমি ও খুব মিস করব বউ! কিন্তু কি করব বলো? আমার পেশা আমাকে আটকে দিচ্ছে! মন খারাপ করবে না একদম। পরশু ঠিক চলে আসব আমি!”

বিমূর্ষ গলায় আমি বললাম,,

“ঠিক আছে, রাখছি।”

কলটা কোনো মতে কেটে আমি মন খারাপের মেঘ নিয়ে রুম থেকে প্রস্থান নিলাম। প্রায় এক মাস হতে চলল, লোকটাকে আমি ঠিক মতো কাছে পাচ্ছি না! এই বাড়িতে আসার পর মাত্র দুবার এসেছেন উনি আমার কাছে। মন চাইলে ও দেখতে পারছি না, ছুঁতে পারছি না, লোকটার সেবা-যত্ন করতে পারছি না! বুকটা খাঁ খাঁ করছে৷ লোকটার শূণ্যতায় বুকটা খাঁ খাঁ করছে। চাঁপা শ্বাস নির্গত করে আমি রান্নাঘরে মা এবং চাচীমনিদের কাজে সাহায্য করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আজ সন্ধ্যায় মিলি আপুকে দেখতে আসছেন পিয়াস ভাইয়ার পরিবার। দেখতে আসা বলতে, পাকা কথা বলতে আসছেন। হয়তো আগামী দু/তিন দিনের মধ্যেই তাদের বিয়ের ডেইট ফিক্সড করা হয়ে যাবে!

,
,

সন্ধ্যা ৭ টা বাজছে ঘড়িতে। আমরা সব বোনরা মিলে মিলি আপুকে নিয়ে মাত্র বসার ঘরে এলাম। আমাদের সঙ্গে পিয়ালী আপু এবং পায়েল ও আছেন। পিয়াস ভাইয়ার পরিবাররের পাশাপাশি আমার শ্বাশুড়ী মা এবং বাড়ির বাকি সদস্যরা ও উপস্থিত আছেন। বিকেলের দিকেই আমার শ্বাশুড়ী মা এবং ননদরা এই বাড়িতে এসে পৌঁছেছেন। সবার সামনে ট্রে ভর্তি শরবত, চা, নাশতা এবং হরেক রকম মিষ্টান্ন পরিবেশন করা হয়েছে। আমরা প্রথমে চাই নি, মিলি আপুকে সামনে আনতে। কারন, কনে তো খালামনির অতি পূর্ব থেকেই পরিচিত। তবে খালামনি হুট করেই প্রস্তাব রাখলেন মিলি আপুকে শাড়ি, চুড়ি পড়িয়ে সাজিয়ে, গুজিয়ে সামনে আনতে। দেখতে চান, শাড়ি পরিহিত অবস্থায় মিলি আপুকে কতটা সুশ্রী এবং মাধূর্যমন্ডিত দেখায়! আদৌ বাড়ির বউ বউ দেখায় কিনা! তাই খালামনির প্রস্তাব রাখতে আমরা বোনরা মিলি আপুকে শাড়ি পড়িয়ে সাজিয়ে, গুজিয়ে সবার সামনে নিয়ে এলাম। খালামনির পাশে মিলি আপুকে বসিয়ে দিতেই পিয়াস ভাই অন্য পাশের সোফা থেকে আড়চোখে কেবল মিলি আপুকে বিরামহীন ভাবে প্রেমময়ী দৃষ্টিতে হারাচ্ছেন! খালামনি ব্যস্ত আপুকে নানা ধরনের প্রশ্ন করতে। অপরিচিত কোথাও মেয়ে দেখতে গেলে মুরুব্বিরা যেভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মেয়ে দেখেন? জিজ্ঞাসাবাদ করেন? খালামনি ও ঠিক তাই করছেন। আপুর হাত দেখছেন, পা দেখছেন, চুল দেখছেন, বডি ফিটনেস দেখছেন, লম্বা-চড়া দেখছেন! পরিশেষে আপুকে জায়গা থেকে উঠিয়ে হাঁটতে পর্যন্ত বাধ্য করলেন! খালামনির কার্যকলাপে নিজেরই খুব বিরক্তি লাগছে। না জানি মিলি আপুর কতটা বিরক্তিকর লাগছে! বাড়ির বাকিদের মুখভঙ্গি দেখে তো মনে হচ্ছে না, তারা অন্তত বিষয়টাকে বিরক্তির দৃষ্টিতে দেখছেন। কোথাও যেন মনে হচ্ছে বিষয়টা তারা ভীষণ এন্জ্ঞয় করছেন! শাড়ি পড়া অবস্থায় আপুর হাঁটা চলা দেখার পর খালামনি পুনরায় মুখের উপর আপুকে বললেন,,

“মিলি মা? এক কাজ কর! এবার একটা থ্রি-পিস পড়ে এসো। এবার দেখি থ্রি-পিস পরিহিত অবস্থায় তোমায় ঠিক কতটা ভয়ঙ্কর সুন্দুরী দেখায়!”

মিলি আপু দাঁতে দাঁত চেঁপে প্রত্যত্তুর করার পূর্বেই মা তটস্থ গলায় আপুকে শাসিয়ে বললেন,,

“আপা যা বলছেন তাই কর মিলি। শাড়িটা পাল্টে জলদি থ্রি-পিসটা পড়ে আয়।”

প্রত্যত্তুরে আপু খড়তড় গলায় বললেন,,

“কিন্তু জেঠিমনি….

“যা বলছি তাই কর। অযথা কথা বাড়াস না!”

মিলি আপু রাগে গজগজ করে প্রস্থান নিলেন। পরিবারের সবার ঠোঁটের কোনে এক রহস্যময়ী হাসি! সবাই কি প্ল্যান মাফিক আপুকে হেনস্তা করতে চাইছেন? মানে, আপুকে কোনো বিশেষ কারনে শিক্ষা দিতে চাইছেন?

প্রায় ২০ মিনিটের মাথায় মিলি আপু লাল টুকটুকে একটা থ্রি-পিস পড়ে মাথা নুঁইয়ে খালামনির পাশ ঘেঁষে বসলেন। গলা খাঁকিয়ে খালামনি পুনরায় আপুর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“তো মিলি বলো? রান্না বান্না কতটুকু পারো? মানে আমি বলতে চাইছি ভাত, ডাল, ডিম এর বাইরে আর কি কি পারো?”

মিলি আপু অতি রাগে আঙ্গুল কচলে বললেন,,

“ভাত, ডিম, ডাল এর বাইরে আর অন্য কিছু রাঁধতে পারি না!’

“এ্যাঁ! মানে কি? তো বিয়ের পর আমাদের রান্না করে খাওয়াবেটা কে? মাসের ত্রিশ দিনই কি আমাদের ডাল, ভাত, ডিম খেতে হবে?”

চাচীমনি মুখ চেঁপে হেসে বললেন,,

“এই নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না আপা। মিলিকে ঠিক আমরা সব শিখিয়ে পড়িয়ে দিব! আমার মেয়ে আস্তে ধীরে সব মানিয়ে নিবে। সংসারের কাজ শেখা এ আবার বড় ব্যাপার কি?”

“হ্যাঁ আপা। শিখাতে তো হবেই। আমি আবার বাড়ির কাজের বুয়াদের হাতের রান্না তেমন খেতে পারি না। তাছাড়া বাড়ির বউ থাকতে কাজের বুয়ার হাতের রান্না কেন খেতে হবে?”

আমার শ্বাশুড়ী মা বোধ হয় এই সুযোগটার অপেক্ষাতেই ছিলেন। মুখমন্ডলে বিদ্রুপাত্নক ছাপ ফুটিয়ে মা আড়চোখে আমার এবং বাবার দিকে চেয়ে খানিক ঢ্যাশ দিয়ে বললেন,,

“হ্যাঁ! ঠিকই তো আপা। বাড়ির বউরা থাকতে আমাদের শ্বাশুড়ীদের কেন কাজের বুয়াদের হাতের রান্না খেতে হবে? আপনি একদম ঠিক বলেছেন আপা। বাড়ির বউদেরই উচিত আমাদের রান্না বান্না করে খাওয়ানোর! পরিবার থেকে সব শিখে যাওয়া!”

বাবা গলা ঝেঁড়ে প্রসঙ্গ পাল্টে খালামনির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“আচ্ছা? এবার বিয়ের পাকা কথাতে আসি? তো বলুন আপা? বিয়ের ডেইট কবে ফিক্সড করতে চাইছেন আপনারা?”

খালামনি স্বল্প সময় মৌন থেকে অতঃপর মলিন হেসে প্রত্যত্তুরে বাবাকে বললেন,,

“আগামী সপ্তাহে। আগামী সপ্তাহে হলে খুব ভালো হয় ভাই। এরেন্জ্ঞমেন্টের একটা ব্যাপার আছে। তাছাড়া আমার একমাত্র ছেলের বিয়ে। মহা ধুমধাম করেই দিতে চাই। তাই অনেকটা সময়ের প্রয়োজন।”

বাবা ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন,,

“তাহলে বিয়ের আর ও প্রায় ১০ দিন বাকি আছে। ঠিক আছে ব্যাপার না। এতে আমাদের ও গুছিয়ে আনতে অনেকটা সুবিধে হবে।”

উপস্থিত সবার মুখে খুশির হাসির রেখা ফুটে উঠল। মা, চাচীমনিরা আনন্দে হতবিহ্বল হয়ে সবাইকে মিষ্টি মুখ করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লন। কাজিনরা তো খুশিতে হাই ফাইভ করছে। মিলি আপু ফোঁস করে শ্বাস নিয়ে কেবল অনবরত শুকনো ঢোক গিলতে থাকা পিয়াস ভাইয়ার দিকে তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন। পিয়াস ভাই পাঞ্জাবির কলার ঠিক করে কিয়ৎক্ষনের মধ্যে মাথা নুঁইয়ে নিলেন। বাবা এবং চাচারা মিষ্টি মুখ করে আসর ছেড়ে উঠতেই খালামনি মিলি আপুর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“চা বানিয়েছে কে মা? তুমি? নাকি বাড়ির অন্য কেউ?”

“রুম্পা আপু করেছেন!”

“কেন কেন? রুম্পা করল কেন? করার কথা তো তোমার ছিল!”

“আমি তখন রেডি হচ্ছিলাম আন্টি। তাই আপুই এসব করেছেন!”

“উঠো তুমি! এক্ষনি উঠো। আমার জন্য এক কাপ গরম গরম মালাই চা করে নিয়ে এসো! অবশ্যই তোমার নিজের হাতের তৈরী। বিয়ের পর কিন্তু দৈনিক চার বার করে আমাকে চা বানিয়ে খাওয়াতে হবে। কোনো অলসতা করলে চলবে না!”

মিলি আপু নাক কেঁদে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ধপাধপ পা ফেলে রান্না ঘরের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন আর বলছেন,,

“শিক্ষে হয়ে গেছে আমার! বিয়েতে রাজি হওয়ার শিক্ষে হয়ে গেছে আমার। টয়ার মতো আমার ভবিষ্যত ও অন্ধকার। পরের জন্য খাঁদ করলে এই খাঁদে নিজেকে ও পড়তে হয়!”

আপু প্রস্থান নিতেই বসার ঘরে উপস্থিত সব সদস্যরা দাঁত কপাটি কেলিয়ে হাসতে আরম্ভ করলেন। খালামনি ও খুব হাসছেন। সবাই এক জোট হয়ে মিলি আপুকে রাগাতে উঠে পড়ে লেগেছেন! মাঝখান থেকে বেচারা পিয়াস ভাই ভয়ে দুর্বল হয়ে আছে! সবার উপর জমতে থাকা রাগ, জেদ, ক্ষোভের পুরো অংশ বিশেষ যে পিয়াস ভাইয়ার ঘাড়ের উপর বর্তাবে বেশ আঁচ করতে পারছেন আমার অবলা পিয়াস ভাইটা!

,

,

মাঝখানে কেটে গেল এক সপ্তাহ। শ্বাশুড়ী মাকে এক প্রকার জোর পূর্বক রেখে দিয়েছেন মা, বাবা এবং বাড়ির অন্যান্য সদস্যরা মিলে। বাবার কড়া নির্দেশ মিলি আপুর বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর পরই আমি সহ আমার শ্বশুড় বাড়ির সকলকে ঢাকা ফিরতে হবে। অনেকটা অপারগ হয়েই শ্বাশুড়ী মা পিয়ালী আপু এবং পায়েলকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে রয়ে গেছেন। এক সপ্তাহ পর আজ পরশ এবং শ্বশুড় আব্বু আমাদের বাড়িতে আসছেন। অফিস থেকে ৪ দিনের ছুটি নিয়েছেন উনারা। হিমেশ ভাই ও উনাদের সাথে আসছেন! মিলি আপুর বিয়ে উপলক্ষ্যে আমি নিজ থেকেই হিমেশ ভাইকে আমন্ত্রণ করেছি। পায়েল ও ভীষণ আনচান আনচান করছিল হিমেশ ভাইকে দেখতে। তাই আর ও বিশেষ করে হিমেশ ভাইকে আমন্ত্রণ করা।

রাত প্রায় ৯ টা বাজতে চলল ঘড়িতে। তবে এখন ও অবধি শ্বশুড় আব্বু এবং পরশের আসার সাথে কোনো নাম নিশানা নেই। ফোন হাতে নিয়ে আমি রুমের ডিভানে দাঁড়িয়ে প্রায় অনেকক্ষন যাবত পায়চারী করছি। মেইন গেইটের দিকে সূক্ষ্ম নজর আমার। বাড়িতে আসা মাত্রই যেন আমি উনাকে দেখতে পাই। মেইন গেইট থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমি যেই না রুমের দিকে অগ্রসর হতে যাব অমনি আমার ফোন বেজে উঠল। স্ক্রীনের দিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করতেই দেখলাম পরশের নাম্বার থেকে কল! অতি আগ্রহের সহিত আমি কলটা তুলতেই পরশ ঐ প্রান্ত থেকে ব্যস্ত হলায় বললেন,,

“শ্বশুড় আব্বা কোথায়?”

“বাড়িতেই আছেন। কেন?”

“তো উনি আমার কল তুলছেন না কেন? সেই কখন থেকে কল করেই চলছি তো করেই চলছি। মেয়ের জামাইকে এভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার মানে কি?”

“কল করছিলেন কেন কারনটা বলুন? অযথা প্রসঙ্গ টেনে বাড়াতে হবে না!”

“বাবাকে বলো, আমি বাস স্ট্যান্ড চলে এসেছি। এসে আমাকে পিক করে নিয়ে যেতে!’

“মানে কি? রাস্তা-ঘাট চিনেন না আপনি? সি.এন.জি করে বাড়ি অবধি চলে আসুন। তাছাড়া আপনি গাড়ি থাকতে বাসে করে কেন এসেছেন?”

“ইট’স মাই চয়েজ! আমার বাসে করে আসতে ইচ্ছে করেছে তাই আমি এসেছি। এখন আমার শ্বশুড় আব্বার দায়িত্ব হলো কোনো কথা না বাড়িয়ে উৎসাহের সহিত মেয়ের জামাইকে বাস স্ট্যান্ড থেকে পিক করে আনা!’

“ইশশ। সবসময় আপনার মাথায় বাদড়ামী বুদ্ধি ঘুড়ে তাই না? কিভাবে আমার বাবাকে হেনস্তা করতে পারবেন সেই সুযোগটাই আপনি খুঁজেন তাই না?”

“বাবার হয়ে উকালতী করা বন্ধ করো। যত দ্রুত সম্ভব বাবাকে বলো গাড়ি নিয়ে বাস স্টপ চলে আসতে!”

“আমি বলতে পারব না। পারলে আপনি বলুন।”

“আচ্ছা আমিই বলছি। ফোনটা বাবার কাছে দাও!”

“একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছেন আপনি!”

“বারে! নতুন জামাই আমি৷ বিয়ের পর এই প্রথম বার শ্বশুড় বাড়িতে নিমন্ত্রণে আসছি। শ্বশুড় আব্বা হিসেবে উনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না আমাকে এই বাড়িতে রিসিভ করে আনাটা?”

“উফফ৷ আপনার দেখছি লজিকের শেষ নেই! দাঁড়ান একটু, বাবাকে পাঠাচ্ছি গাড়ি করে।”

লোকটা কদাচিৎ হেসে বললেন,,

“এই তো আমার লক্ষী বউটা৷ আসতে দাও শুধু। অফুরন্ত আদর, ভালোবাসা জমে গাঁ বেয়ে একদম গলে গলে পড়ছে আমার।”

অসভ্য লোকটার মুখের উপর কলটা কেটে দআমি বাবার রুমের দিকে অগ্রসর হলাম। রুমের কাছাকাছি আসতেই দেখলাম বাবা পাঞ্জাবি, পায়জামা পড়ে পাঞ্জাবির হাতা ফোল্ড করতে করতে রুম থেকে বের হচ্ছেন। দৃষ্টির সম্মুখে আমাকে দেখা মাত্রই বাবা ব্যস্ত গলায় বললেন,,

“তোর শ্বশুড় আব্বু বাস স্টপে অপেক্ষা করছেন। ভাবছি পিয়াসকে নিয়ে উনাদের পিক করতে যাব!”

“মানে কি? পরশ তোমাকে কল করেছিলেন?”

বাবা অধৈর্য্য গলায় অনর্গল বলতে আরম্ভ করলেন,,

“হাজারটা ম্যাসেজ করে রেখেছে! শ্বশুড় আব্বা আপনি কোথায়, শ্বশুড় আব্বা আপনার মেয়ের জামাই আসছে, শ্বশুড় আব্বা আপনার মেয়ের জামাইকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাতে আসবেন না? তাকে পিক করতে আসবেন না? একই ম্যাসেজ বার বার ফরওয়ার্ড করে করে আমার মাথা খেয়ে নিচ্ছে। সন্ধ্যা সাতটা থেকে চালু করে এই অবধি ম্যাসেজ আসছে তো আসছেই! ম্যাসেজ আর থামছে না! ফোনের ৫০% চার্জ অলরেডি ম্যাসেজ আসতে আসতে খেয়ে নিয়েছে। এখন আমি বাধ্য হচ্ছি তোর জামাইকে পিক করে আনতে! বিশেষ করে আর ও বাধ্য হচ্ছি কারন, তোর শ্বশুড় আব্বু ও সাথে আছেন!”

ফোঁস করে এক দফা দম নিয়ে বাবা পুনরায় আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,,

“হ্যাঁ রে? পৃথিবীতে কি ছেলে মানুষের অভাব পড়েছিল প্রেম করার, ভালোবাসার? বেছে বেছে তোকে ঐ হাড় বজ্জাত, ধড়িবাজ ছেলেটাকেই ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করতে হলো?”

এর মধ্যেই বাবার ফোন বেজে উঠল। পায়জামার পকেট থেকে ফোনটা বের করে বাবা স্ক্রীনের দিকে একবার তাকিয়ে অতঃপর আমার দিকে অবলা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,

“এই যে দেখ! আবার কল করেছে! দাঁড়া লাউডে দিচ্ছি। শুন, তোর গুনধর জামাই আমায় কি কি বলে!”

ফোনটা পিক করে বাবা লাউড স্পীকার অন করতেই পরশ ঐ প্রান্ত থেকে উচ্চ শব্দে চেঁচিয়ে বললেন,,

“শ্বশুড় আব্ববাবাবাবাবাবাবা! আপনি কোথায়য়য়য়? মেয়ের জামাইকে পিক করতে আসবেন না?”

#চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here