তোর অপেক্ষায় পর্ব-১০

0
3404

#তোর_অপেক্ষায়
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_১০

‘ দেখুন চাচা আমি আপনাকে চিনি না জানি না তো আগে থেকেই কেনো টাকা দিতে যাব?কেনো আমাকে ফাঁসাচ্ছেন বলুন।আপনি মনে করে দেখুন নিশ্চয়ই অন্যকারো কাছে পাখি দিতে গিয়ে ভুল করে আমাদের বাড়ির ঠিকানায় চলে এসেছেন।’

‘ না আম্মা।গতকাল তুমিই পাখি চেয়েছিলে আমার কাছে স্পষ্ট মনে আছে।ধরো পাখির খাঁচাটা।’

প্রবীণ লোকটি অনেকটা জোর করে খাঁচা আমার হাতে গছিয়ে হনহন করে বের হয়ে গেলেন।আমি আর কিছু বলার সুযোগই পেলাম না।
এদিকে মা মুখ ফুলিয়ে চলে গেল।সকাল সকাল এ কোন ঝামেলায় পড়লাম আমি।
দৌড়ে কিচেনে গিয়ে কাঁদকাঁদ হয়ে মাকে বলতে লাগলাম,

‘ আমি এই খাঁচা কিনিনি মা।সত্যি বলছি।উনাকে টাকা দেই নি আমি।’

মা গোমড়া মুখে বলল,
‘ টাকা না দিলে শুধু শুধু ওই লোক কেনো পাখি দিতে আসবে?এত কি ঠেকা পড়েছে উনার?এখন যাও এখান থেকে।এই খাঁচাটা নিয়ে বারান্দায় রাখো।’

আমি হতাশা মিশ্রিত শ্বাস ফেললাম।মাকে আর কিছু বলা বৃথা।কেনো বিশ্বাস করছে না আমার কথা।
বড়মা’কে চোখ দিয়ে ইশারা করলাম মাকে একটু সামলানোর জন্য। তবে আমি জানি মায়ের এই রাগ সাময়িক।

বারান্দায় আসার পর খাঁচার পাখিদুটো ডাকতে লাগল।ওদের দুরন্তপনা দেখে নিমিষেই মন খারাপ ভাবটা উধাও হয়ে গেল।আমার তো কত্ত শখ ছিল পাখি পুষব।যেভাবেই হোক আমার শখ তো পূরণ হয়ে গেল।কে জানে ওই লোক কার পাখি এনে আমাকে দিয়ে গেছে।
যাই হোক এসব নিয়ে ভেবে কাজ নেই।এই পাখি দুটো এখন আমার সেটাই মূল কথা।
বারান্দার গ্রিলের সাথে খাঁচাটা ঝুলিয়ে দিতেই ওরা আরো ডানা ঝাপটানো শুরু করল।বুঝতে পারছি না ওদের এই জায়গাটা পছন্দ হয়েছে কিনা।খাঁচার ফাঁক গলিয়ে ওদের ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই দূরে সরে গেল।
অভিমানী হয়ে বললাম,
‘ এই এই কি হচ্ছে এটা! এমন করে লাভ নেই।আজ থেকে আমিই তোদের শিক্ষক।আমি যখন যা বলব তোদেরকে সেটাই মানতে হবে।আচ্ছা তোদের কি নামে ডাকা যায়?

কিন্তু আগে এই দুটোর শরীরের কিছু অমিল খুঁজতে হবে নাহলে কাকে কোন নামে ডাকব।ভালোকরে একটু পর্যবেক্ষণ করতে খুব সহজেই বৈসাদৃশ্য পেয়ে গেলাম।একটা পাখির লেজ অন্যটার থেকে সামান্য ছোট।তাহলে লেজ ছোট পাখিটার নাম চিনি আর লেজ বড় পাখিটার নাম মিনি।
চিনি মিনি নাম দুটো মুখে আওড়াতে গিয়ে নিজেই হেসে ফেললাম।এগুলো তো বিড়ালছানার নাম হলে ভালো মানাতো।
‘ এই চিনি মিনি তোদের কি নাম পছন্দ হয়েছে?বিড়ালের নামে তোদের নাম রেখেছি বলে কষ্ট পাস না।দেখবি তোদের নামগুলো সবাই পছন্দ করবে।’

আমার কথার উত্তরে ওরা শুধু ডানা ঝাপটানো ছাড়া আর কোনো সাড়া দিল না।বোধ হয় নাম রাখার সিদ্ধান্ত ওরা মেনে নিয়েছে।

.

বিকেলে চিনি মিনিকে খাবার দিচ্ছি তখন হঠাৎ মনে পড়ল আমি তো গতকাল দুর্জয় ভাইয়ার কাছে পাখি নিয়ে কথা বলেছিলাম।উত্তরে তিনি চুপ করেছিলেন।তাহলে কি উনিই এই পাখিদুটো পাঠিয়েছে আমার জন্য? আনন্দে চোখ চকচক করে উঠল আমার!উনি কবে থেকে এত ভালো হয়ে গেল।ইশ্! এই লোকটা যে কি!এভাবে মিথ্যা প্ল্যান না বানিয়ে সরাসরি বাড়িতে এসে পাখির খাঁচা গিফট্ দিলেই তো পারতো।
উনার জন্য আজ খুশিতে ধেইধেই করে নাচতে মন চাইছে।উনাকে একটা ধন্যবাদ দিতেই হবে।

ফোন নিয়ে উনার নাম্বারে কল দিয়ে দিলাম।কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল ধন্যবাদ না হয় পরে দেওয়া যাবে আগে উনাকে একটু সাইজ করে নেই।উনাকে কিছু কড়া কথা শুনানো এটাও তো আমার অনেকদিনের শখ।আর সেই সুযোগ এখন আমার সামনে রয়েছে।তাহলে ফটাফট কাজে লাগাতে হবে।
তিনবার রিং হতেই দুর্জয় ভাইয়া রিসিভ করলেন।অতি ব্যস্ততার সহিত বললেন,

‘ হ্যাঁ বল কি বলবি।’

আমার মুখ থমথমে হয়ে গেল।একি কান্ড!এই প্রথম আমি নিজে থেকে উনাকে কল দিলাম আর উনি এমনভাবে বলছেন যেন উনাকে চব্বিশঘণ্টার মধ্যে বারো ঘন্টা আমি কল দিয়ে বিরক্ত করি।
উনার কথার উত্তরে সহসা কি বলব তা ঠিক করতে না পেরে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম,
‘ আপনি কেনো আমার জন্য পাখি পাঠিয়েছেন?আমি কি বলেছি একবারো?মা আমার উপর রেগে আছে কারণ সামনের সপ্তাহে আমার এক্সাম।মা ভাবছে পড়াশোনা বাদ দিয়ে আমি পাখির পেছনে সময় ব্যয় করব।তাই…

আমাকে মাঝপথে আটকে দুর্জয় ভাইয়া বলে উঠলেন,
‘ তোর তো ইচ্ছে ছিল পাখি পুষবি তাহলে এখন খামোকা মায়ের রাগের বাহানা দিচ্ছিস কেনো?’

‘ মানে আমি বাহানা দিচ্ছি? ঠিক আছে মাকে জিজ্ঞেস করুন মা রেগে আছে কিনা।আর আপনাকে তো বলিনি আমি পাখি দিতে।আমি নিজে টাকা জমাচ্ছিলাম। আর কিছুদিন গেলে পুরো টাকা জমিয়ে ফেলতাম।আমার এভাবে আপনার থেকে পাখি নিতে ভালো লাগছে না।’

‘ তাহলে এক কাজ কর।তুই যে টাকাগুলো জমিয়েছিস সব দিয়ে দে আমাকে।শোধবোধ হয়ে যাবে।যদি এতেও রাজি না থাকিস তো খাঁচার দরজাটা আস্তে করে খুলে দে পাখিদুটো উড়ে যাক।আর যদি তাতেও আপত্তি থাকে তাহলে একদম চুপ থেকে আমার পাঠানো জিনিসের যত্ন নে।’

রাগে আমার চেহারা গরম হয়ে উঠছে।সবসময় আমি যা ভেবে রাখি তার উল্টোটা কোনো হয়?বিশেষ করে উনার ক্ষেত্রে। কোথায় ভাবলাম একটু মেজাজ দেখাব কিন্তু বিপরীতে আমাকেই হেনস্তা হতে হচ্ছে।

গজরাতে গজরাতে বললাম,
‘ আমি রাখব না আপনার পাখি।এক্ষুনি উড়িয়ে দেব।এরপর আমার জমানো টাকা দিয়ে নতুন করে কিনব।’

ফোনের ওপাশ থেকে দুর্জয় ভাইয়া শব্দ করে হেসে উঠলেন।
‘ তাই?এত সাহস?ঠিক আছে উড়িয়ে দে।দেখি কেমন পারিস?কল কেটে আমাকে ভিডিও কল দে তো।আমিও দেখতে চাই কিভাবে তুই পাখি দুটো উড়িয়ে দিস!’

আমি কল কেটে দিলাম।এই ব্যক্তিকে শায়েস্তা করা আমার কর্ম নয়।সত্যি সত্যি পাখি গুলো ছেড়ে দেওয়ার কথা বলছে!আবার বলেছে ভিডিও কল দিতে।
আমি তো চিনি মিনিকে কিছুতেই ছেড়ে দিতে পারব না।কারণ ওদের আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে।এক মুহূর্তের জন্যও বারান্দা থেকে নড়তে ইচ্ছে করে না।ওরা যখন লাল ঠোঁট ফাঁক করে ডেকে উঠে তখন ইচ্ছে করে টকাস করে একটা চুমো খেয়ে নেই।

________________________

আজ ছিল লাস্ট পরীক্ষা। বাড়িতে ঢুকতেই মনে হচ্ছে প্রশান্তি ভরা সমুদ্রে ভাসছি।হালকা লাগছে খুব।যেদিন থেকে পরীক্ষা শুরু হয়েছে সেদিন থেকেই আমার পড়ার প্রতিযোগিতা শুরু। পড়তে পড়তে শহীদ হওয়ার মত অবস্থা। কারণ আমি হলাম সেই ক্যাটাগরির ছাত্রী যারা অন্যসময়গুলোতে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু পরীক্ষার আগের রাতগুলোতে নাওয়া খাওয়া ভুলে টেবিলে ঘাড় গুঁজে বসে থাকে।এই অভ্যাস নিয়ে নিয়মিত মায়ের কাছে বকুনি খাই।খেলেও আমার কোনো পরিবর্তন আসে না।

যেহেতু পরীক্ষা শেষ তাই হঠাৎই প্ল্যান হলো যে আমরা আমার নানুর বাড়িতে বেড়াতে যাব। ফারাজের এখন পড়ার তেমন চাপ নেই।সুহানা আপুর পরীক্ষাও শেষ।তাই এখনই কোথাও ঘুরতে যাওয়ার অনুকূল সময়।কিম্তু আমাদের দল থেকে শুরুতেই কয়েকজন বাদ পড়ে গেল।বড়মা এবং বড়আব্বু নাকি বাড়ি খালি রেখে যাবে না। বড়আব্বু যেখানে নেই আমার আব্বুও সেখানে থাকবে না।আর ইমন ভাইয়াও অফিসের কাজ ফেলে যেতে চায় না।যদিও ভাইয়ার যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে ছিল।
সবাই মিলে ঠিক করলাম আসছে শনিবার আমরা খুব সকাল সকাল যাত্রা করব।অনেকটা দূরের রাস্তা কিনা।জ্যামে আটকে গেলে সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে যেতে পারে।

দুপুরের পর সুহানা আপুকে নিয়ে কিছু টুকটাক মেয়েলি শপিং করতে বের হলাম।মূলত নানু বাড়ি যাওয়া উপলক্ষেই শপিং করা।
দুজন গল্পগুজব করতে করতে একঘন্টার মধ্যে শপিং শেষ করে ফেললাম।ততক্ষণে বাইরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে।শপিংমলের বাইরে এসে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় নজর গেল রাস্তার অপর পাশে জেরিন আপু। আপু একা নয় তাঁর সাথে তিনটে ছেলে।ছেলেগুলো দেখতে ভদ্র মনে হচ্ছে না।কেমন যেন বখাটে ধরনের।মনে হঠাৎ খটকা লাগল।ভরসন্ধ্যা বেলায় জেরিন আপু এই ছেলেদের সাথে কি করছে?
রাস্তা মোটামুটি মানুষ এবং যানবাহনে ভরপুর। তাই জেরিন আপু আমাদের খেয়াল করে নি।তিনটে ছেলের সাথে মুখ গম্ভীর করে কি যেন আলোচনা করছে।দূর থেকেও বুঝতে পারছি ওদের মধ্যে সিরিয়াস কিছু নিয়ে কথাবার্তা চলছে।

সুহানা আপুকে ইশারায় দেখিয়ে বললাম,
‘ দেখতে পাচ্ছো জেরিন আপুকে?ওর সাথে এরা কারা?তোমাদের ক্লাসের নাকি?’

আপু ভ্রু উঁচিয়ে ওদের চারজনকে ভালোকরে লক্ষ্য করে বলল,
‘ এই ছেলেগুলোকে চিনি না আমি।চল তো গিয়ে জেরিনের সাথে কথা বলি।’

‘ না আপু। দেখছো না ওরা কোনো জরুরি বিষয় নিয়ে ডিসকাস করছে।ছেলেগুলো বোধ হয় জেরিন আপুর কাজিন হবে।’

‘ হতে পারে।আচ্ছা পূর্ণী আমি একটা কথা ভাবছি।আমরা যদি জেরিনকে আমাদের সাথে তোর নানুর বাড়ি নিয়ে যাই তাহলে আপত্তি করবি?না মানে জেরিন তো কোথাও তেমন যায় না।ওর জন্য খুব খারাপ লাগে জানিস।প্রায়ই মেয়েটা মনমরা হয়ে বসে থাকে।আমার একটুও ভালো লাগে না দেখতে।’

‘ এমা আপত্তি করব কেনো?জেরিন আপু আমাদের সাথে গেলে মাও খুব খুশি হবে।মা আপুকে খুব স্নেহ করে।’

‘ তাহলে তো হলোই।বাড়িতে গিয়ে ওকে ফোন করে সব বলে দেব।আশা করি রাজি হবে।এখন চল।ওই যে রিকশা আসছে।এই মামা যাবেন?’

বাড়িতে পৌঁছে মায়ের কাছে জানতে পারলাম আমাদের সাথে খালামণিরাও যাবে।এই কথা শুনে খুশির চোটে লাফাতে গিয়েও থেমে গেলাম।খালামণিরা যাওয়া মানে তো দুর্জয় ভাইয়াও যাবে।ওহ্ শিট!
কেনো যে উনি আমার খালামণির ছেলে হতে গেল।আমি যেখানে যেখানে যাই উনিও সেখানে যাবে।উনি আশেপাশে থাকা মানেই আমাকে হাবাগোবার মত চুপচাপ বসে থাকতে হবে।কেনো জানি উনার সামনে আমি সহজ হতে পারি না কোনোমতেই। আজব ব্যপার।কই সুহানা আপু তো এমন করে না।সে তো কি সুন্দর দুর্জয় ভাইয়ার সাথে হেসে কথা বলতে পারে। আর আমি কথা বলা দূরে থাক দেখলেই বুকের মধ্যে ধকধক আওয়াজ শুরু হয়ে যায়।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here