তোর অপেক্ষায় পর্ব-২৪

0
366

#তোর_অপেক্ষায়
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২৪

প্রজাপতি পার্ক নামটা শুনতেই চোখে ভেসে উঠল চারদিকে হাজারো প্রজাপতি ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়াচ্ছে।তাঁদের রঙ বেরঙের ডানায় বিভিন্ন নকশা।ছুঁয়ে দিতে গেলেই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ধরার বাইরে চলে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি প্রজাপতি পার্কের সামনে।সবাই বলাবলি করছে এটাই নাকি বাংলাদেশের একমাত্র প্রজাপতি পার্ক।আজ সকালে ইমন ভাইয়া বোধহয় এই পার্কটার কথাই বলতে চেয়েছিল।কিন্তু এত সুন্দর নামটা ভাইয়া কি করে ভুলে যেতে পারল সেটাই মাথায় ঢুকছে না।প্রজাপতি যেমন সুন্দর তাঁর নামটাও তেমনি।আমি তো মাঝেমধ্যে কল্পনায় দেখি বিয়ের পর আমার দুটো পুঁচকে হয়েছে।একটার নাম প্রজা অন্যটার নাম পতি।সারাক্ষণ আমি প্রজাপতি প্রজাপতি বলে ডাকব আর ওরা ছুটে ছুটে আসবে আমার কাছে।কি মজাই না হবে তখন!

সবাই সিরিয়ালে গেইট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকছে।সিরিয়ালের অনেকটা পেছনে আমি এবং আমার পেছনে দুর্জয় ভাইয়া ও তুষার ভাইয়া।সমুদ্রের পাড়ের সেই ঘটনার পর থেকে দুর্জয় ভাইয়া আমাকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখের বাইরে ফেলছেন না।এমনকি লাঞ্চ করার জন্য যখন আমরা সবাই রেষ্টুরেন্ট গিয়েছি উনারাও পিছন পিছন সেখানে গেছেন।আমার বরাবর টেবিলে বসে সিসিটিভির মতো সবকিছু রেকর্ড করে গেছেন।আমি অত্যন্ত ভয়ে ভয়ে কাঠপুতুলের মত বসে বসে গপাগপ খেয়েছি।নিজেকে কেনো জানি ভয়ঙ্কর অপরাধের দন্ডিত আসামীর মত লাগছে।আর দুর্জয় ভাইয়া যেন এই আসামীর পেছনে লেগে থাকা জাঁদরেল পুলিশ অফিসার।পোড়া কপাল বুঝি একেই বলে।
ভেতরে ঢুকেই আমি চারদিকে প্রজাপতি খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।কোথায় প্রজাপতি?

দুর্জয় ভাইয়া আমার মুখের ভাবভঙ্গি বুঝতে পেরে বলে উঠলেন,
‘ ওই যে ওখানে দেখ!’

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম আমি।পাশেই সাইনবোর্ডে লেখা বাটারফ্লাই জোন।তর সইতে না পেরে দৌড়ে চলে গেলাম সেখানে।জাল দিয়ে ঘেরা চারদিক।ভেতরে গাছপালার ঘন ঝোপ।ডালপালার ফাঁকে ফাঁকে কিছু উড়ন্ত প্রজাপতি নজরে আসছে।আমি তাহলে যেমন ভেবেছিলাম তেমন নয়।তবুও এতগুলো প্রজাপতি একসাথে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলাম।

বাটারফ্লাই জোন পেরিয়ে কিছুটা সামনে যেতেই দৃষ্টি আকর্ষণ করল একটি কৃত্রিম ঝরণা।অনবরত ছপছপ শব্দ তুলে পানি গড়িয়ে পড়ছে।আমি একটা পাথরের উপর দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলাম ঝর্ণার পানি।ইস্ যদি আমাদের বাড়ির ছোট বাগানটার পাশে এমন একটা ঝরণা থাকত!আমি প্রতিদিন বিকেলে সেখানে বসে গল্পের বই পড়তাম!

‘ এই যে দুর্জয়ের মিসেস!’

কানের কাছে এমন ফিসফিসানির আওয়াজ শুনে চমকে পেছনে ফিরলাম।দুর্জয় ভাইয়া হাসিহাসি মুখ করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।উনার হাসি দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল। কি চলছে উনার মনে?অকারণে হাসার লোক তো নন উনি।
আরেকটু ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

‘ কি বললেন আপনি?’

‘ বললাম যে তুই এমন অদ্ভুতুরে চেহারা নিয়ে ওই ঝরণার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো?খুবই বিচ্ছিরি লাগছে।’

দুর্জয় ভাইয়ার কথা শুনে আমার সমস্ত মুখে কালো ছায়া নেমে আসলো।মাথার ভেতর রাগ টগবগ করে ফুটতে আরম্ভ হলো।উনার দিকে কঠিন চাহনি দিয়ে বুঝাতে চাইলাম আমি রেগে যাচ্ছি। অতিরিক্ত মাত্রায়।
কিন্তু হায়! দুর্জয় ভাইয়ার চেহারার প্রতিক্রিয়া আগের মতই।ঠৌঁটের কোণে মুচকি হাসি।উনাকে যতবারই রাগ দেখাতে চাই ততবারই হতাশ হতে হয় আমাকে।তবে উনার মুখে বিচ্ছিরি শব্দটা শুনে হঠাৎ খুব কষ্ট লাগল।আগে তো কখনো এমনভাবে বলেননি।
মুখ ভার করে বললাম,

‘ বিচ্ছিরি সেটা আমি জানি।আপনাকে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করতে হবে না।আমার চেহারা যেমনই হোক সেটা নিয়ে আমি খুশি।আপনাকে মাথা ঘামাতে কে বলেছে?সরুন সামনে থেকে আমি এখানে আর এক মিনিটও থাকব না।’

পরনের স্কার্টটা উঁচু করে ধরে পাথরটা থেকে নামতে যাব ঠিক তখনই দুর্জয় ভাইয়া স্বজ্ঞানে ল্যাং মেরে ফেলে দিলেন আমায়।আমি সোজা গিয়ে পড়লাম দুর্জয় ভাইয়ার প্রশস্ত বুকে।নিজেকে সামলাতে উনার কাঁধের দুদিকের টি-শার্টের হাতা খামচে ধরলাম।কি হচ্ছে এসব?আমাকে এভাবে ফেলতে চাইলেন কেনো?অবাক হয়ে তাকাতেই উনি নিচুস্বরে ফিসফিস করে বললেন,

‘ এত রাগ! মনে এবং মাথায় এত রাগ পুষে রাখলে আমার ভালোবাসা গুলো কোথায় রাখবি?’

আমি অবুঝের মত চেয়ে রইলাম।এমন সময় তুষার ভাইয়ার কথা শুনে হুঁশ ফিরল আমার।

‘ পার্ফেক্ট! অসাধারণ! এর থেকে সুন্দর ছবি আর হতেই পারে না দুর্জয়।আমি সাথে আমার মোবাইল দুটোই ধন্য আজ এমন একটা ছবি তুলতে পেরে।’

আমি তৎক্ষনাৎ দুর্জয় ভাইয়াকে ছেড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম।এতক্ষণে সব ক্লিয়ার আমার কাছে।বজ্জাত ডিজে আমার সাথে ছবি তোলার জন্য এমন করেছে।শুধু শয়তানি বুদ্ধি মাথায়। কিন্তু একটু আগে দুর্জয় ভাইয়ার কথাটা মনে পড়তে গালে রক্তিম আভা টের পেলাম।বয়েই গেছে উনার ভালোবাসা রাখতে।হুহ্।
দুর্জয় ভাইয়া আমার দিকে একবার চোখ মেরে হেলতে দুলতে তুষার ভাইয়ার কাছে চলে গেলেন।হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি।ভাগ্যিস আশেপাশে তেমন কেউ ছিল না।নাহলে বিনা টিকিটে সবাই রোমান্টিক দৃশ্য দেখে ফেলত।
মুচকি মুচকি হেসে কিছুদূর এগুতেই দেখি হিমু,ঈশিতা এবং সুস্মিতা রোবটের মত দাঁড়িয়ে আছে।আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম।ওরা কি একটু আগের ঘটনা দেখে ফেলেছে!ও নো! এখন আমাকে বড়সড় একটা ইন্টারভিউয়ের সম্মুখীন হতে হবে।এই কুটনী গুলোর বদনজর থেকে আমি ওই সুদর্শন দুজন মানুষকে বাঁচাতে পারব?

ঈশিতা সন্দেহাতীত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি চলছিল রে একটু আগে?তুই গিয়ে পড়লি একজনের উপর।ছবি তুলে ফেলল আরেকজন।সত্যি করে বলতো ওই দুর্জয় না কি যেন ছেলেটার নাম ওর সাথে তোর কি চলছে?তোর বডিগার্ড নাকি ওরা?বডিগার্ডের সাথে প্রেম করছিস?’

আমি সকলের অলক্ষ্যে একটা ঢোক গিললাম।তিনজনের দিকে তাকিয়ে বোকার মত হেসে ফেললাম।
হিমু চটেপটে গলায় প্রশ্ন ছুড়ল,

‘ তুই তো গাড়িতে বলেছিলি দুর্জয় ভাইয়ার নাকি দুটো বউ আছে।সামনের বছর আরেকটা বিয়ে করার প্ল্যান আছে।তৃতীয় বউটা কি তুই?’

হিমুর দিকে তিক্ত চাহনি দিলাম আমি।নাকমুখ কুঁচকে ধমকে উঠে বললাম,
‘ থাম ফকিন্নি বাহিনী।একটা অবিবাহিত সুন্দর ছেলেকে তোরা দুই বউয়ের স্বামী বানিয়ে আমাকে তৃতীয় বউ বানাচ্ছিস?ঠাডা পড়ুক তোদের উপর।তোরা একে অপরের সাথে যুদ্ধ লেগে শহীদ হয়ে যা।শোন তোরা! দুর্জয় আমার।আমি ছাড়া উনার কোনো বউ টউ নেই।আমিই বর্তমান এবং ভবিষ্যত বউ।উফ্ মাথাটা গরম করে দিলি একদম।’

ওদের তিনজনকে হতভম্ব বানিয়ে দিয়ে আমি স্কার্ট দুলিয়ে এগিয়ে চললাম।বুকটা এখনো ধুকপুক করছে।আমি দুর্জয় ভাইয়ার নাম ধরে ডেকেছি।উনি শুনে ফেললে কি হত?
মাথাটা হালকা পেছনে ফিরিয়ে দেখি ওরা এখনো নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মনে মনে দম ফাটানো হাসি পেল আমার। ওদের যে শক দিয়েছি সেটা কখন শেষ হয় বলা মুশকিল।আমি মনের সুখে গুনগুন করে গান গেয়ে উঠলাম,

‘ নান্না রে নান্না রে নান্না রে নারে না…’

___________________________

সূর্য ডুবে গিয়ে আধার নেমে আসল চারপাশে।পার্কের ভেতর জায়গায় জায়গায় বসানো বাল্ব গুলো জ্বলে উঠল।এবার যেন পুরো পরিবেশটা মোহনীয় হয়ে উঠেছে।লাল নীল লাইটের আলো প্রত্যেকটা জিনিসের অদ্ভুত ছায়া ফেলছে মাটিতে।
সন্ধ্যা মিলাবার আগেই সমস্ত পার্ক চক্কর দেওয়া শেষ।এখন বুখতে পারলাম এই পার্কের নাম প্রজাপতি পার্ক হলেও এটা ছোটো বাচ্চাদের খেলাধুলা করার উপযুক্ত স্থান।হাতি,ঘোড়া,দোলনা অনেককিছুই আছে।বাচ্চারা মহানন্দে চারদিকে ছুটাছুটি করে বেড়ায়।পার্কের ভেতরে এক জায়গায় নড়তে চড়তে থাকা বিশালকার এক ড্রাগন দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিলাম।কিন্তু মুহূর্তেই বুঝতে পারলাম এটা আসল ড্রাগন নয়।বাচ্চাদের মনোরঞ্জন করার জন্য একটি বিশেষ ব্যবস্থা।

পার্ক থেকে বেরিয়ে সবাই বাসের কাছে চলে আসলো।প্রত্যেকের চেহারায় ক্লান্তির ছাপ।আমিও তার বাইরে নই।চোখ ভেঙে ঘুম নেমে আসতে চাইছে।তবে পুরো ভ্রমণটা ভীষণ উপভোগ করেছি আজ।
দুর্জয় ভাইয়াকে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠতে যাব এমন সময় উনি সামনে এসে হাজির।আমার হাতে কিছু কেক,বিস্কিট,পানির বোতল ধরিয়ে উনি কড়া নির্দেশ দিলেন,

‘ সিটে বসেই আগে এগুলো শেষ করবি।বাসায় কখন পৌঁছাবি তার ঠিক নেই।জ্যামে আটকালে দেরি হতে পারে।’

আমি বাধ্য মেয়ের মত মাথা নেড়ে উঠে পড়লাম।আগের মতই আমার পাশে হিমু এসে জায়গা দখল করল।সে ধপ করে বসে সিটে মাথা হেলিয়ে চোখ বুজে পড়ে রইল।আমি একবার হাতের প্যাকেট গুলোর দিকে তাকিয়ে হিমুকে অনুসরণ করলাম।এখন কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না।দুর্জয় ভাইয়া তো আর দেখতে আসবে না আমি খেয়েছি কিনা।

.

গাড়ির তীব্র ঝাঁকুনিতে আমার ঘুম কিছুটা পাতলা হয়ে আসল।ক্ষীণভাবে হর্নের শব্দ কানে প্রবেশ করছে।চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই টের পেলাম আমার হালকা ঠান্ডা লাগছে এবং কেউ একজন জড়িয়ে ধরে আছে আমায়।কিছুটা নড়ে উঠলাম।এভাবে কেউ ধরে থাকলে আমার মেজাজ গরম হয়ে যায়।এখনো ব্যতিক্রম হলো না।বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলাম,

‘ হুিমু! ছাড় আমায়।গায়ের সাথে লেগে আছিস কেনো মূর্খ মেয়ে?’

হিমু আমার কথা বোধহয় কানে তুলল না।সে আরো চেপে আসল আমার দিকে।বিরক্তি এবার চরমে উঠল।দাঁত খিচিয়ে বলে উঠলাম,
‘ আমার সত্যিই রাগ উঠে যাচ্ছে হিমু।দূরে গিয়ে বোস।’

‘ এত দূরত্ব সহ্য হয় না আমার।খামোখা চেঁচামেচি না করে চুপ করে থাক।’

কানের কাছে পরিচিত কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে ন্যানো সেকেন্ডে আমার মস্তিষ্ক সক্রিয় হয়ে উঠল।ঝট করে চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলাম।পাশের মানুষটিকে দেখে আমার ঘুমন্ত চোখ দুটো বারকয়েক পলক ফেলল।
‘ আশ্চর্য! আপনি এখানে আসলেন কি করে? ‘

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here