তোর অপেক্ষায় পর্ব-২৬

0
643

#তোর_অপেক্ষায়
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২৬

সকালে ডাইনিং টেবিলে বসে অহনা আপুর সাথে গল্প জুড়ে দিলাম।গতকাল পিকনিকের ঘুরাঘুরি নিয়েই আড্ডা চলছে।তবে সমুদ্রের পানিতে সেই দুর্ঘটনার কথাটা সতর্কতার সাথে চেপে গেলাম।গাড়িতে দুর্জয় ভাইয়া এবং আমার সেই খুনসুটির মুহূর্তগুলোও এড়িয়ে গেছি।কিছু কিছু আনন্দের মুহূর্ত অন্যের সাথে ভাগাভাগি করে আলাদা সুখ পাওয়া যায় আবার কিছু আনন্দ মনের ভেতর সযত্নে পুষে রাখার মধ্যে প্রশান্তি খুঁজে পাই আমি। দুর্জয় ভাইয়ার সাথে কাটানো সময়গুলো থাক না মনের ভেতর বন্দী হয়ে!

খালামণি পাশের চেয়ারে বসে আমাদের গল্প শুনে যাচ্ছিল।একপর্যায়ে বলে উঠল,
‘ খাবার খেতে বসে এত কথা কিসের অহনা?পূর্ণী মা তুই আস্তে ধীরে খা তো।এরপর দুজন একসাথে ভার্সিটির জন্য বের হয়ে যাস।’

টেবিলের অপর প্রান্তে বসে খালু খবরের কাগজ পড়তে পড়তে চা খাচ্ছিলেন।পেপার থেকে মাথা তুলে জিজ্ঞেস করলেন,

‘ কি ব্যাপার দুর্জয়ের আম্মু?তোমার ছেলে আজ নাস্তা করতে নিচে আসেনি?’

‘ রাতে বোধ হয় দেরি করে ঘুমিয়েছে।অন্যদিন তো আরো আগে উঠে যায়।আমিও আজ ইচ্ছে করেই ডাকিনি ওকে।’

খালামণির কথা শেষ হতে হতেই দুর্জয় ভাইয়ার আগমন ঘটল।দুহাতে চোখ কচলাতে কচলাতে সিড়ি দিয়ে নামছেন। উনার গায়ে সাধারণ জামাকাপড়। উনি কি আজ অফিস যাবেন না?চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে আজ উনি কুম্ভকর্ণের মত নাক ডেকে সারাদিন ঘুমাবেন।ধুর কোথায় ভাবলাম আমাকে ভার্সিটি দিয়ে আসবে তা না।
দুর্জয় ভাইয়া চেয়ার টেনে বসে পড়লেন আমার পাশে।সকলকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
‘ গুডমর্নিং আব্বু আম্মু,গুডমর্নিং সিস্টার।’

কিছুক্ষণ থেমে আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বললেন,
‘ গুডমর্নিং তেজপাতা।’

আমি মাত্রই পানির গ্লাস মুখের সামনে নিচ্ছিলাম আর এমন সময় তেজপাতা নামটা শুনে বড়সড় ধাক্কা খেলাম।কোনোরকমে পানির গ্লাস রেখে মুখ ফুলিয়ে তাকালাম উনার দিকে।খালামণি অহনা আপু খিকখিক করে হাসছে বারবার।এমনকি খালুও বাদ নেই।পেপার সামনে ধরে ওপাশে হাসছে।

‘ এই আপনি আমাকে তেজপাতা কেনো বললেন?’

‘ এছাড়া কি বলব?দিনদিন খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো না করার ফলে শরীরের কি অবস্থা করেছিস দেখ একবার।অনার্স পড়ুয়া মেয়ে অথচ খাওয়া দেখলে মনে হয় টু থ্রিতে পড়া বাচ্চা। ‘

‘ শুনুন আমার পেটে যতখানি জায়গা আছে ততটুকুই তো খাবো নাকি!আশ্চর্য। আপনি নিজের খাবার নিজে খান না।আমার পেছনে কেনো লেগেছেন?’

‘ তোর পিছনে কেনো লাগব?তুই সুপারগ্লু?এভাবে অল্প খেয়ে খেয়ে ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে ফেলছিস।শুকনা পাটকাঠির ট্যাগ লাগিয়ে কেউ তোকে বিয়েও করবে না।তখন কি হবে?’

আমাদের ঝগড়া যখন তুঙ্গে উঠার পালা ততক্ষণে সবাই নিঃশব্দে হেসে যাচ্ছে। আমার সেদিকে খেয়াল নেই।ক্ষুব্ধ হয়ে পরোটার টুকরা হাতে নিয়ে পিষে ফেলার চেষ্টা করছি।
খালামণি হাসি থামিয়ে কপট ধমকের সুরে বলে উঠল,

‘ আহ্ বাবু।মেয়েটাকে রাগিয়ে দিচ্ছিস কেনো?ওর স্বাস্থ্য ঠিকই আছে।হ্যাংলা পাতলা শরীরই ভালো।পূর্ণী তুই চুপচাপ খা তো।ফাজিলটার কথায় কান দিস না।’

আমি দুর্জয় ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙচি দিলাম।তালগাছের মত লম্বা এক হাতি সে নাকি আবার বাবু।কালে কালে কত কি শুনব।আসছে আমাকে তেজপাতা বলতে।আমি একটা ছোট মানুষ হয়ে হাতির মত খাবার খেতে পারি নাকি?নিজে তো খায় হাতির মতো।আমি এখনো একটা পরোটা উল্টেপাল্টে দেখছি আর উনি চেয়ারে বসতে না বসতে দুটো পরোটা গোগ্রাসে খেয়ে আরেকটা ছিড়তে বসেছে।সকাল সকাল উঠেই আমার সাথে ঝগড়া করতে শুরু করেছে।শয়তান লোক!

নাস্তা শেষ করে দুর্জয় ভাইয়া উঠতে যাবেন এমন সময় খালু উনাকে হাত তুলে বসতে বললেন।খালামণির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করলেন।কিন্তু খালামণি নাকচ করে দিয়ে বলল,

‘ তুমিই আগে শুরু করো না!এরপর আমি বলছি।’

দুর্জয় ভাইয়াসহ আমি এবং অহনা আপু কৌতুহল নিয়ে তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছি কিছু শোনার জন্য। তাঁদের দেখে মনে হচ্ছে কোনো সিরিয়াস বিষয় ঘোষণা করতে চলেছেন।খালু তাঁর হাতের পেপার ভাঁজ করে রেখে স্বচ্ছন্দ্যে জিজ্ঞেস করল,

‘ বিয়ে নিয়ে কিছু ভেবেছো দুর্জয়?’

এমন এক প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলাম আমি।হঠাৎ একটা অজানা ভয় এসে ঘিরে ধরছে আমায়।খালামণিরা দুর্জয় ভাইয়ার বিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করছে তারমানে আমাদের সম্পর্কটা সামনে আসতে চলেছে?
কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরছে আমার।অহনা আপু টেবিলের নিচে আমার হাত ধরে ভয় না পেতে বারণ করলেন।কিন্তু দুর্জয় ভাইয়া?
আড়চোখে পাশে তাকিয়ে দেখি উনার মুখ প্রতিক্রিয়া শূন্য। বেশ আয়েশ করে বাটি থেকে প্লেটে সবজি তুলে নিচ্ছেন। আল্লাহ এই লোক প্রশ্নের কোনো উত্তর দিচ্ছে না কেনো।খালামণি হেসে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করল,

‘ চুপ করে থাকলে হবে?বিয়ের বয়স হয়েছে বিয়ে দিতে হবে না?তোর বিয়ের পরেই না মেয়েটাকে পার করব।’

‘ উফ মা। আমি আগেই বলেছি এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করব না।শুধু শুধু আমাকে নিয়ে হৈচৈ করবে না তো।’

অহনা আপু বিরক্তি নিয়ে জবাব দিল।কিন্তু আমি দুর্জয় ভাইয়ার জবাব শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি।উনার এমন নিশ্চুপ থাকার অর্থ কি বুঝতে পারছি না।উনি কি ভয় পাচ্ছেন নাকি দ্বিধায় ভুগছেন?
খালামণি এবার বেশ জোর দিয়ে বলে উঠল,

‘ ওমা ছেলে তো দেখি একদম চুপ।কিছু একটা বল।আমরা কিন্তু একটা মেয়ে দেখেছি।দেখতে শুনতে ভালো।আচার-আচরণ মার্জিত।তোর সাথে মানাবে।এখন তুই যদি হ্যাঁ বলিস তাহলে আমরা আগাবো।’

দুর্জয় ভাইয়া নীরব।
খালু তাঁর মোটা চশমার ফাঁক দিয়ে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ দুর্জয়ের আম্মু, মনে হচ্ছে তোমার ছেলের পছন্দের কেউ আছে।মুখে তো কুলুপ এঁটে রেখেছে।’

আমার অবস্থা এবার করুণ।অস্থির হয়ে ডানে-বামে তাকাতে লাগলাম।আমার বোধহয় হার্ট অ্যাটাক হতে যাচ্ছে। কেউ আমাকে হসপিটাল নিয়ে যাও।
হঠাৎ দুর্জয় ভাইয়া মৌনতা ভঙ্গ করে বলে উঠলেন,

‘ আব্বু একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না?একবার দেখো আমার পাশের জনকে।এমন কাঁপা-কাঁপি করছে যেন কেউ কারেন্টের শক দিচ্ছে ওকে।আর এই যে তুই বলতে পারছিস না আমি বিয়ে করব তোমাদের ছেলেকে।অলরেডি বউ হয়েই আছি।ইদানীং তো আমার সাথে খুব মেজাজ দেখাস এখন কি হলো হুম?চোখের সামনে আমাকে আরেকটা মেয়ের সাথে বেঁধে দিচ্ছে তাও চুপ করে আছিস!’

দুর্জয় ভাইয়ার কথা শুনে আমি হতভম্ব। খালামণি এবং খালু শব্দ করে হেসে উঠলেন।আমি অদ্ভুত ভাবে তাঁদের দিকে তাকিয়ে পুনরায় দুর্জয় ভাইয়ার দিকে ফিরলাম।এগুলো কি হচ্ছে আমার সাথে?কিছু না করেও আমি যেন অনেক কিছু করে ফেলেছি।সবাই আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসছে!
পরক্ষণেই মাথা নিষ্ক্রিয় থেকে সক্রিয় হয়ে উঠতেই লজ্জায় মর্মর হয়ে উঠলাম।এরা সবাই সবকিছু জানতো। জেনেশুনেই আমার সামনে এত নাটক করে গেল।হায় খোদা! মাটি ফাঁক হোক আমি ভেতরে ঢুকে যাই।টের পাচ্ছি আমার গালদুটো গরম হয়ে উঠছে।চোখ তুলে সামনে তাকাতেও পারছি না কিন্তু বুঝতে পারছি আমার অবস্থা দেখো সবাই মুখ টিপে হাসছে।

‘ হয়েছে অনেক।মেয়েটাকে আর লজ্জা দিস না তো।অহনা খাওয়া শেষ হলে পূর্ণীকে নিয়ে ভার্সিটি যা।বিয়ে টিয়ে নিয়ে পরেও কথা বলা যাবে।’

অবশেষে খালামণি আমাকে বাঁচিয়ে দিলেন।আমি ঝটপট চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। দুর্জয় ভাইয়ার দিকে চোখ পড়তে উনি বাঁকা হাসলেন।ইস এত লজ্জা লাগছে কেনো?

চলবে…

[ ছোট পর্ব] 💁💁

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here