তোর অপেক্ষায় পর্ব-৭

0
3610

#তোর_অপেক্ষায়
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_৭

[ আমি সত্যি ভেবেছিলাম গল্পটা আর লিখব না।কারণ বুঝতে পারছিলাম না গল্পটা আপনাদের কেমন লাগছে।নাইস,নেক্সট,স্টিকার কমেন্ট দ্বারা গল্প কেমন হচ্ছে সেটা বুঝা যায় না।তাই এমন সিদ্ধান্ত।
গতকাল অনেকে বলেছে গল্পটা কন্টিনিউ করার জন্য তাই নিজে নিজেই উৎসাহ নিয়ে এই পর্ব লিখলাম।দয়া করে কমেন্টে বলে দিবেন ভালো লাগছে নাকি খারাপ।এর উপরই নির্ভর করবে পরবর্তী পর্ব দিব কি দিব না।]
…………………

বাড়ি পৌঁছাতে কিছুটা দেরি হয়ে গেল।দেরি কেনো হলো তার কারণ আমার অজানা।সারা রাস্তায় আমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম।হয়তোবা রাস্তায় জ্যাম থাকার কারণে লেট হয়েছে। খেয়াল করিনি।
গাড়ি থামতেই দুর্জয় ভাইয়া বাদে আমরা তিনজন নেমে গেলাম।সুহানা আপু ঘুমন্ত ফারাজকে কোলে নিয়ে গেইট পেরিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। আমি দাঁড়িয়ে আছি ইমন ভাইয়ার সাথে।কেনো দাঁড়িয়ে আছি তাও জানি না।
ইমন ভাইয়া বলল,
‘ দুর্জয় ভেতরে আয়।ডিনার করে যা।চাচী বোধ হয় তোর জন্য রান্না করে রেখেছে।’

ইমন ভাইয়ার কথায় না বোধক উত্তর দিলেন উনি।বুঝতে পারছি আমারও বলা উচিত উনাকে যেন খাওয়াদাওয়া করে যায়।কিন্তু কিছুই বলতে পারলাম না।উনি গুডনাইট বলে ধুলো উড়িয়ে শাঁ করে চলে গেলেন।তাকিয়ে রইলাম কালো চকচকে গাড়িটার দিকে।ধীরে ধীরে এটা আমার চোখের বাইরে চলে যাচ্ছে। এত অদ্ভুত কেনো এই লোকটা?নিজের চারপাশে কেমন একটা বেড়াজাল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।সত্যিই অদ্ভুত নাকি আমিই উনাকে নিয়ে ভেবে ভেবে অদ্ভুতের কাতারে ফেলে দিচ্ছি।

.

রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি। পড়ার টেবিলে বসে বসে ঘুমের তাড়নায় ঝিমচ্ছি। ডিনার শেষে পড়তে বসা আমার বাধ্যগত কাজ।ঘুমাতে যাওয়ার আগে আম্মু এসে চেক দিয়ে যায় আমি পড়ার টেবিলে আছি কি না।অনেকটা জোর করেই বসে থাকি।
ঘুমের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বইখাতা গুছিয়ে উঠে এলাম বিছানায়।এমন সময় মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠল মিষ্টি একটা সুর তোলে।স্ক্রিনে দুর্জয় নামটা দেখে চোখ থেমে ঘুম উধাও হয়ে গেল।উনি এতরাতে কল দিচ্ছেন কি কারণে।আবার কিছু হয়েছে নাকি।তখন যেভাবে রেগে ছিলেন!কিন্তু আমি তো কিছুই করিনি তাহলে ভয় কিসের।
বেশ সময় নিয়ে কল রিসিভ করলাম।হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে ভরাট গলার আওয়াজ আসলো,

‘ বারান্দায় আয়।’

আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম।উনি রাত বারোটার সময় এখানে কি করছে।উনাকে তো আর শুধু শুধু অদ্ভুত বলি না।ভাবলাম নাকচ করে দিই কিন্তু উনার কন্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যা আমাকে বাধ্য করল বারান্দা পর্যন্ত পৌঁছতে।
মনটা খুঁতখুঁত করছে।সত্যিই উনি এসেছে নাকি…
ওইতো দেখা যাচ্ছে। গাড়িতে হেলান দিয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছেন।উনার গায়ে কালো ফুলহাতার শার্ট কনুই পর্যন্ত ভাঁজ করা।সন্ধ্যায় যে পোশাকে দেখেছিলাম এখনো তেমনি।তারমানে উনি তখন বাসায় যাননি?

ফোন কানে গুঁজে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ এখানে কি করছেন?আপনি বাড়ি যাননি?’

‘ না।অফিসে গিয়েছিলাম।কাজ ছিল অনেক।ওখান থেকে ডিরেক্ট এখানে এসেছি।’

‘ কিন্তু কেনো?কিছু বলবেন?’

দুর্জয় ভাইয়া এবার চুপ করে গেলেন।এতক্ষণের কথোপকথনে একবারের জন্যও উনার দৃষ্টি আমার থেকে সরে যায়নি।
হঠাৎই বলে উঠলেন,
‘ পূর্ণতা!’

উনার এমন মাদকতা জড়ানো কন্ঠ শুনে কেঁপে উঠলাম আমি।রাস্তা থেকে আমার বারান্দার দূরত্ব বেশি না হওয়ায় উনাকে বেশ স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। কিন্তু রাস্তার স্ট্রিট লাইটের নিয়ন আলোয় উনার মুখে হলদে আভা খেলে যাচ্ছে। রাতের এমন অন্ধকারাচ্ছন্নতায় উনি কি আরো সুদর্শন হয়ে উঠেন?নাকি আমার চোখের ভ্রম!ইস্ কি মায়া জড়ানো ওই চেহারায়। কিন্তু এর পেছনেই বাস করে ভয়ানক এক রূপ।

‘ তোকে অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করে পূর্ণতা!কিন্তু পারি না।একটা জায়গায় এসে আটকে যাই আমি। চেয়েও কিছু করার নেই আমার।নিরুপায় হয়ে আছি। খুব কষ্ট হয় আমার।আর কত অপেক্ষা করতে হবে জানি না!অপেক্ষা খুবই যন্ত্রণা দেয় প্রতিটা সেকেন্ড। ‘

দুর্জয় ভাইয়ার এমন আকুলতা মাখা কথা শুনে কেমন মিইয়ে গেলাম আমি।বুকের ভেতর ধকধক শব্দটা যেন হৃৎপিণ্ডটাকে অধিক অশান্ত করে তুলছে।
নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,

‘ কি বলতে চান বলে ফেলুন।’

কথাটা বলে নিজেকে বেকুব মনে হচ্ছে। উনি তো বলেছে উনি বলতে চেয়েও পারছেন না। কিন্তু কি এমন কথা যা উনার এবং আমার মধ্যে থাকতে পারে!আমি তো কিছুই বুজে উঠতে পারছি না।হতে পারে এক্সিডেন্টের আগের কোনো ঘটনা।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে উনি বললেন,
‘ সময় হলে বলব সব।এখন যা ঘুমাতে।এত রাতে বারান্দায় থাকার দরকার নেই।’

‘ আরেহ্ আপনি তো চরম ধাপ্পাবাজ! আপনি ডেকেছেন বলেই তো আমি এসেছি। নাহলে রাতে আমি বারান্দায় কেনো থাকব?’

‘ এখন থেকে যখনই ডাকি তখনই সাড়া দিতে হবে তোকে।এটা ঢুকিয়ে নে মাথায়।কল কাট।’

উনার কথা শুনে মুখ থমথমে হয়ে গেল আমার।এমন ব্যবহার করছে মনে হয় যেন আমি উনাকে কল করে এখানে ডেকেছি।কত বড় সাহস আবার অর্ডার দিচ্ছে আমায়।রাগে কানদুটো গরম হয়ে উঠছে।অন্যদের লজ্জায় কান লাল হয় আর আমার রাগে।

‘ আমি কেনো কাটব? কল কাটার অপশন আপনার ফোনেও তো আছে আপনি কল কাটুন!’

‘ আমিও কাটব না তুইও কাটবি না তাহলে সারারাত এভাবেই চলতে থাকুক।’

বেশ বুঝতে পারছি উনি মজা নিচ্ছেন।আড়চোখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি হাসছেন মিটমিট করে।কি আশ্চর্য আমার রাগকে কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না।

নাক ফুলিয়ে কল কাটতে গেলাম তখনই উনি আবার বললেন,
‘ শোন পূর্ণতা!’

‘ বলুন।’

‘ হ্যাপি বার্থডে।’

‘ মানে!’

‘ তোকে এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি মানে বুঝাবো? আমাকে পাগল মনে হয় তোর?যা ঘুমাতে যা।’

আমাকে একঝাঁক বিস্ময়ে ডুবিয়ে রেখে চলে গেলেন উনি।যেমন আচমকা এসেছেন তেমনি করে হাওয়া!তাড়াতাড়ি ফোনের তারিখ এবং সময় চেক করলাম।বারোটা বেজে একমিনিট! ও মাই আল্লাহ্ আজ আমার বার্থডে এটা উনি জানেন আর এইমাত্র আমাকে উইশ করে গেলেন।খুশি হব না দুঃখী হব বুঝতে পারছি না।কেউ কাউকে এভাবে উইশ করে জানা ছিল না।
প্রথমে কিছু রহস্যময় কথা এরপর আমাকে রাগিয়ে দিয়ে উইশ করে আস্ত একটা ধমক দিয়ে বিদায় নিলেন।মানে কিভাবে সম্ভব! হাহ্ আমি তো ভুলেই যাই উনি স্বাভাবিক মানুষের দলে নেই।কাউকে হুটহাট চমকে দিয়ে ভড়কে দেওয়া উনার ক্যারেক্টারেই থাকতে পারে।

দরজায় নকের শব্দে হুঁশ ফিরল আমার।এইসময় আবার কে আসতে পারে! কারো কোনো সমস্যা হলো নাকি!বারান্দার থাই বন্ধ করে দরজা খুলে দিলাম।
ইমন ভাইয়া, সুহানা আপু এবং ফারাজ হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকে পড়ল।হঠাৎ এমন হওয়ায় আমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবার মত অবস্থা।

চোখ বড়বড় করে বললাম,
‘ তোমরা রাতবিরেতে ডাকাত দলের মত আমার রুমে হামলা দিলে কেনো?আরেকটুর জন্য আমার জান বেরিয়ে যায়নি।’

ততক্ষণে আমার নজরে পড়ে গেছে আপুর হাতে ছোট সাইজের একটা ভ্যানিলা কেক উঁকি মারছে।আমি কিছু বলার আগেই ওরা তিনজন সমস্বরে চিৎকার করে উঠল,

‘ হ্যাপি বার্থডে পূর্ণী!মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দ্যা ডে।’

দুহাত দিয়ে কান চেপে ধরলাম আমি।এমন চিৎকারে বাড়ির সবাই নিশ্চয়ই ভূমিকম্প ভেবে জেগে উঠেছে।ওদের সাথে রাগ দেখাতে গিয়েও পারলাম না।কত ভালোবেসে রাতের বেলা উইশ করতে চলে এসেছে আমায়।
হেসে বললাম,
‘ থ্যাংক ইউ অল।খুব খুশি হয়েছি আমি।এই কেক টা কি আপু বানিয়েছো?’

‘ অফকোর্স আমি।চল এবার কেক কাটবি।’

কেক কাটতেই ফারাজ ফটাফট মোবাইলে ছবি তুলে নিল।আমি কেক নিয়ে ওদের সবাইকে খাইয়ে দিলাম।ইমন ভাইয়া আস্ত একটা পিস মুখে ঢুকিয়ে বলল,

‘ জন্মদিনে কি উপহার চাস বল্ পূর্ণী।জুতা হতে জামাই সব দেওয়ার চেষ্টা করব।আফটার অল আমার প্রিয় ছোটবোন তুই।’

আমি মুখ ভার করে বললাম,
‘ প্রিয় যেহেতু তাহলে এত তাড়াতাড়ি শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার চিন্তা করছো কেনো ভাইয়া!’

‘ তাড়াতাড়ি কই দেখলি।তোর আগে সু যাবে শ্বশুরবাড়ি। কিরে সু যাবি না?’

ভাইয়া সুহানা আপুর মাথায় গাট্টা মেরে কথাটা বলল।আমি আর ফারাজ একপাশে দাঁড়িয়ে হাসছি মুখ চেপে।কারণ আপু রাগে সাপের মত ফুসফুস করছে শুধু।বিকট এক যুদ্ধ লাগার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি ওদের দুজনের মধ্যে। কারণ বিয়ের কথা শুনলে আপু এমনিতেই রেগে বোম্ব হয়ে থাকে।
আমার ভাবনাকে সত্যি করে আপু আমার হাত থেকে ছুড়ি নিয়ে তেড়ে গেলেন ভাইয়ার কাছে।
‘ আমার বিয়ে নিয়ে আর কখনো টু শব্দ করলে তোকে আমি গুম করে দেব ইমইন্না।’

এমন সময়,
‘ কি হচ্ছে এখানে?’

বড়আব্বুর গলা পেতেই আমরা সবাই তটস্থ হয়ে গেলাম।এতক্ষণ এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম আমি।ওরা যেভাবে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেছিল তাতে মনে হয়ে এলাকার অর্ধেক লেকের ঘুম ভেঙে গেছে।

বড়আব্বু ঘরে ঢুকে সবকিছু দেখে জিজ্ঞেস করল,
‘ কেক মোমবাতি এসব কেনো?কি করছিলে এতরাতে?’

ইমন ভাইয়া এখনো কেক খেয়ে চলেছে।হাসতে হাসতে বলল,
‘ আমাদের পূর্ণীর আজ বার্থডে। আমরা সেটারই সেলিব্রেশন করছিলাম।আসো তুমিও কেক খেয়ে যাও।কেক কিন্তু সু বানিয়েছে।’

বড়আব্বু ভারী চশমার ফাঁক দিয়ে সকলকে একবার দেখে নিয়ে এগিয়ে আসলেন।ভাইয়ার কথামতো সত্যি সত্যি একটুকরো কেক নিয়ে খাইয়ে দিলেন আমায়।মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘ শুভ জন্মদিন মা।তোমার জন্য কাল গিফট থাকবে আমার তরফ থেকে।’

আনন্দে আমার চোখ চিকচিক করে উঠল।আমিও একটুকরো কেক খাইয়ে দিলাম।
যাওয়ার সময় বড়আব্বু ইমন ভাইয়া এবং আপুকে গম্ভীর গলায় বলে গেলেন,

‘ ঝগড়া করার জন্য দিনের বেলাটা ভালো ছিল না?রাতে মানুষের ঘুম ভাঙিয়ে ঝগড়া ভালো দেখায় না।যে যার যার রুমে চলে যাও এখন।গুডনাইট বাচ্চারা।’

বড়আব্বু চলে যেতে আমরা কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম নিজেদের জায়গায়।এরপর হঠাৎই সবাই মিলে রুম কাঁপিয়ে হেসে উঠলাম।

__________________________

সকালে ঘুৃম থেকে উঠেই টের পারলাম আজ আমার মনটা ভীষণ ভালো।বাইরের আবহাওয়াটাও চমৎকার! আমার মনের সাথে মিল রেখে প্রকৃতিও সামিল হয়েছে।মোবাইলে সময় দেখতে গিয়ে কাল রাতে দুর্জয় ভাইয়ার কথা মনে পড়ল।নিজের অজান্তেই হেসে ফেললাম।পারেও বটে মানুষটা।উইশ করার জন্যই তাহলে এসেছিল কিন্তু এটা কেমন উইশ ছিল তা একমাত্র উনিই ভালো বলতে পারবেন।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here