দিন কেটে যায় আশায় আশায়
দশম পর্ব
-তোর কি ভয় করছে সুমাইয়া ?
আমি জবাব দিলাম না I প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বললাম
-তোর ভয় করছে আপা ?
-যতক্ষণ কবুল বলা না হয় ,আমার কিন্তু ভয় যাবেনা I
– কেন ?
– কি জানি ? কখন তোর দুলাভাই এসে পরে I আবার কি ঝামেলা লাগিয়ে দেয় I ওদেরকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে I
– কিছু হবে না I রাশেদ সব ম্যানেজ করে নেবে I
– বা বাহ ! এত ভরসা ? এখনি এই অবস্থা !
আপা একটু হেসে আমার চিবুক ছুঁয়ে দিলো I আমার কেন যেন হঠাৎ করেই খুব লজ্জা করতে লাগলো I রাশেদ এত সহজ, স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিশেছে আমার সঙ্গে যে কখনো লজ্জা হয়নি I এমনকি যখন বিয়ের কথা বলেছে তখনও না I কিন্তু হঠাৎ করেই একরাশ লজ্জা আমাকে ঘিরে ধরল I এবং সেইসঙ্গে হঠাৎ করে কাঁপিয়ে দিল একরাশ ভয় I যদি সত্যিই বিয়েটা না হয় I আপা আমাকে শাড়ি পড়ানো শেষ করে বলল
-চুলগুলো তো এখনো ভেজা I
আমার চুল শুকাতে অনেক সময় লাগে I একেতো লম্বা চুল তার ওপর আবার ঢেউ খেলানো I এজন্যই আমি রাতে গোসল করি I দিনের বেলা করলে ,চুল শুকায় না I মাথায় কাপড় দিতে সমস্যা হয় I কিন্তু আজ কোন উপায় ছিল না I আমি আপাকে বললাম
– আমি ফ্যান ছেড়ে চুল আঁচড়ে নিচ্ছি I শুকিয়ে যাবে I
তখনই দরজায় টোকা শুনলাম I আপা দরজা খুলে বলল
– আসেন , আসেন আপু I
আমি তাকিয়ে দেখলাম একজন খুব মিষ্টি চেহারার ভদ্রমহিলা I বুঝলাম উনি রাশেদের বোন I উনি এসে আমার চিবুক ধরে বললেন
– মাশাআল্লাহ I বাঁদরটার পছন্দ এত সুন্দর ! আমি রিমি I রাশেদের বড় বোন I
– “আসসালামু আলাইকুম” আপা I
– “ওয়াআলাইকুমুসসালাম” একটু তাড়াতাড়ি করতে হবে আপু I জোহরের আযানের আগেই বিয়েটা পরিয়ে ফেলতে চাই I কখন আবার তোমার দুলাভাই এসে পড়ে I কোন রিস্ক নেয়া যাবে না I তুমি অবশ্য কোন চিন্তা কর না I আর সুরমা তোমাকে বলছি ,একদম চিন্তা করবে না I
আপা বলল
– একবার বিয়েটা হয়ে গেলে I আমার আর কোনো চিন্তা নেই I আমার যা হবার হবে I
রিমি আপা ধমকে উঠে বললেন
একদম বাজে কথা বলবে না I নিজেকে নিয়ে চিন্তা নেই I মানে কি ? তোমার জামাই কোন বেগড়বাই করলে একদম টাইট করে দেবো I আমি গ্রামে থাকি এর অর্থ এই না যে ,আমি গাইয়া ক্ষেত একটা মেয়ে I তোমার দুলাভাইয়ের মত এরকম হাজার জনকে আমার দেখা আছে I এখন তাড়াতাড়ি করো I সুমাইয়া আমরা তো আলাদা করে ওড়না আনিনিI তুমি চুল টা হালকা করে বেঁধে মাথায় আঁচলটা দিয়ে দাও I আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজী সাহেব কে পাঠাচ্ছি I
আমি বললাম
– আপা আমার আমার একজন ঘনিষ্ঠ বান্ধবী আছে I তাকে কি আসতে বলতে পারি ?
– অবশ্যই বলবে I কিন্তু আপু তার জন্য বিয়েটা আটকে রাখা যাবে না I তুমি ওকে ফোনে জানাও I কিন্তু বিয়েটা তার আগেই শেষ করে ফেলতে হবে I বুঝতেই পারছ I
আমি মাথা নিচু করে বললাম
– ঠিক আছে আপু I
আপা আমাকে একটা টেবিল ফ্যান এনে দিল I চুল শুকানোর জন্য I একটু হালকা করে সাজিয়ে দিল I আমার কিংবা আপার সাজগোজের বিশেষ কিছু নেই I আপার বিয়ের সময় পাওয়া কিছু লিপস্টিক ছিল আর আমার একটা পুরনো কাজল ছিল I শুধু ওই দিয়েই সাজলাম I ইস ! জুই থাকলে কত ভালো হতো I আমি জুইকে ফোন দিয়ে কোন রকম ভনিতা ছাড়াই বললাম
– জুই আমার বিয়ে I
ও আঁতকে উঠে বলল
– বিয়ে ? কবে ?কার সঙ্গে ?
– রাশেদের সঙ্গে I একটু পরেই I
– মানে !
আমি ওকে সংক্ষেপে সবটা বললাম I ও শুনে বলল
– তুই আমাকে ছাড়াই বিয়ে করে ফেলবি ?
– তুই এক্ষুনি চলে আয় I
– আমার খুব খারাপ লাগছে
– কেন ? আমার বিয়ে হচ্ছে I তুই খুশি না ?
– আমি যদি ছেলে হতাম তোর অন্য কারো সঙ্গে বিয়ে হতেই দিতাম না I তা সে রাশেদ হোক আর যেই হোক
আমি হাসতে হাসতে বললাম
– তুই ছেলে হলে ,কি আমি অন্য কাউকে বিয়ে করতাম নাকি ?
দুজনে কিছুক্ষন হাসলাম I আমি ওকে তাড়া বিয়ে বললাম
– তাড়াতাড়ি আয় দোস্ত I
জুই আসার আগেই আমার বিয়েটা হয়ে গেল I কাজী সাহেব এসে কবুল পরিয়ে গেলেন I আমার কেন যেন কোন অনুভূতি হচ্ছে না I বিয়ে হয়ে গেছে ,এটাও মনে হচ্ছে না I ভেবেছিলাম বিয়ে পড়ানোর পর হয়ত রাশেদ ঘরে আসবে I কিন্তু ও এল না I বরং মালিহা আপু এবং আরিফ ভাই তাড়াহুড়া করে দেখা করে চলে গেলেন I বলে গেলেন যে ওনারা চলে যাচ্ছেন I আজকে আমরা ওনাদের বাসায় থাকব I কাজেই বাসায় গেলে দেখা হবে I
জুই যখন এলো ততক্ষণে ছেলেরা সবাই নামাজ পড়তে চলে গেছে I আমরা বাড়িতেই নামাজ পড়লাম I আপা আমার আর জুই এর জন্য খাবার নিয়ে এলো I আমাকে খাইয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু আমি দিলাম না I নিজের হাতেই খেলাম I আপাকেও কয়েকবার খাইয়ে দিলাম I খাবার শেষ হলে জুই আমাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো I সাজান শেষে বললো
– এইবার বউ বউ লাগছে I
আমি হেসে ফেললাম I কিছু বলবো তার আগেই দরজায় শব্দ পেলাম I জুই উঠে দরজা খুলে বলল
এই যে দুলাভাই I তারাতারি মাল ছাড়েন , না হলে ঢুকতে দেবো না I
বুঝলাম রাশেদ এসেছে I আমি একটু কৌতুহলী হয়ে শুনছিলাম যে ও কি বলে I
একটা গান শোনালে কি ঢুকতে পারবো ? আমার নিজের লেখা গান I
আমি পিছন থেকে বললাম
গান শোনালে অ্যামাউন্ট ডাবল হয়ে যাবে Iজুই ভুলেও ওই ভয়ঙ্কর গান শুনতে রাজি হইস না I
জুই হাসতে হাসতে বলল
গান শুনব আবার টাকা ও নেব I তা না হলে কিন্তু বউ নিয়ে যেতে পারবেন না I আমার বাড়িতে নিয়ে চলে যাব I
রাশেদ ওর হাতে কিছু একটা গুঁজে দিয়ে বলল
বউ এবং শালিকা দু’জনকেই নিয়ে গেলে কেমন হয় ? একটা সঙ্গে আরেকটা ফ্রী I
জুই হাসতে হাসতে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো I আর ঠিক তখনই কলিংবেলের শব্দ হলো I নিশ্চয়ই দুলাভাই এসেছে I ভয়ে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল I রাশেদ আর ঘরের ভেতর ঢুকলো না I জুই এসে আমার পাশে বসলো I আমার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল
ভয় পাচ্ছিস কেন ? বিয়ে তো হয়ে গেছে I
আমার সত্যি সত্যি খুব ভয় করছে I নিজের জন্য নয় I আপার জন্য I আমি জানি রাশেদ আমাকে এখানে ফেলে কখনো যাবেনা I কিন্তু আপার কি হবে ?
আমি টের পেলাম জুঁইয়ের হাতের মধ্যে আমার হাতটা থর থর করে কাঁপছে I আমি খুব চেষ্টা করছি শুনতে, কি কথাবার্তা হচ্ছে I আমার ঘরটা মেইন গেটের কাছে I আমি উঠে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়ালাম I একটু ফাঁকা করে দেখার চেষ্টা করলাম কি হচ্ছে Iদুলাভাই সঙ্গে আরো কয়েকজন লোক নিয়ে ভেতরে ঢুকলো I চেহারা দেখেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে নিচে থেকেই কিছু খবর পেয়ে উঠেছেন I দরজা কে খুলেছে সেটা আমি দেখতে পারিনি I তবে দুলাভাইয়ের রাগী চেহারা দেখা যাচ্ছে I উনি আশেপাশের সবাইকে অগ্রাহ্য করে উঁচু গলায় বললেন
– সুরমা I সুরমা কই ?
আপাকে ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসতে দেখলাম I হঠাৎ করেই রিমি আপা আপার একটা হাত ধরে সরিয়ে দিলেন I তারপর সামনে এগিয়ে এসে কাউকে হাতের ইশারা করলেন I আমি তাকিয়ে দেখলাম দুজন ষন্ডা গোছের লোক দরজার দুই পাশে দাঁড়ানো I রিমি আপার হাতের ইশারায় তারা দরজা বন্ধ করে দিল I রিমি আপা এগিয়ে এসে বললেন
আসসালামু আলাইকুম I বিয়ে হয়ে গেছে I আপনারা খাওয়া-দাওয়া করতে বসেন I
দুলাভাই চিৎকার করে বলল
আপনার এত বড় সাহস I আমার বাড়িতে এসে এইসব করতেছেন I বের হন আমার বাড়ি থেকে
ঠিক এই ভয়টাই আমি করছিলাম I রিমি আপা দুলাভাইকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে , তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল
আরে রায়হান ভাই না ? আসেন আসেন I আপনার বউয়ের সাথে একটু আগে কথা হল I নতুন বৌ না I চৈতি আপার সঙ্গে তো আপনার তালাক হয়নি এখনো I উনিও আসতেছেন I বান্ধবীর ভাইয়ের বিয়েতে আসবেন না তা কি হয় ? আপনি খেতে বসে যান I
আমি স্পষ্ট দেখলাম ভদ্রলোকের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে I কিন্তু দুলাভাইয়ের তেজ তখন ও কমেনি I উনি বললেন
কামাল ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দে তো এদেরকে I
এবার আমার সত্যি সত্যি ভয় করতে লাগলো I কোনমতে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম I দেখলাম ষন্ডা গোছের লোক দুজন দুলাভাই এবং তার পাশের লোকটাকে প্রায় শূন্য তুলে টেবিলে বসিয়ে দিল I তারপর বলল
আম্মাজান খাইতে কইসে I খাইতে বসেন I বেশি কথা বললে কল্লা নামায় নিব I
রিমি আপা গলায় মধু ঢেলে বললেন
আহা রুম্মন I অমন কথা বলতে নাই I উনারা আমাদের পরম আত্মীয় I ভালো করে খাবার খাওয়াও I বেয়াইন সাহেব ভালো করে খান I নাকি মাহফুজ ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করবেন ? হাজার হোক আপনার বস I
আমি দুলাভাইয়ের চেহারা দেখতে পেলাম না I তবে স্পষ্ট দেখলাম উনি খাওয়া শুরু করেছেন I রিমি আপা আবার বললেন
রুম্মন উনাদের যত্ন কইরা খাওয়াও I আমি এখনই আসতেছি I
রিমি আপা ঘরে ঢুকে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন I তারপর বললেন
একটুও ভয় পেয়ো না I
আমি কোনমতে বললাম I আপু আমার আপার কি হবে ?
কিচ্ছু হবে না I যেমন অসুখ তার জন্য তেমন চিকিৎসা I জ্বর হলে তো আর ডায়রিয়ার ওষুধ দেওয়া যায় না I তাই না ? তোমার দুলাভাইয়ের ওষুধের বন্দোবস্ত হয়ে গেছে I একটু পরেই দেখতে পাবে I
আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম I যতটা ভরসা রাশেদের উপর ছিল I বুঝলাম উনার উপর তার থেকে কিছুমাত্র কম করা সম্ভব নয় I
চলবে ……
গল্পটা আগামী পর্বে শেষ হবে I আজকের পর্বে অনেক কিছুই অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে I শেষ পর্বে সেটা ক্লিয়ার হয়ে যাবে I শেষ পর্ব বুধবারে আসবে ইনশাআল্লাহ I