দিন কেটে যায় আশায় আশায়
পঞ্চম পর্ব
-তুই বিয়ে করে ফেলেছিস ? আবার তোর বাচ্চাও আছে ? আর এই কথা আমাকে জানতে হলে অন্য একজনের কাছ থেকে ?
একথা বলেই বুবু ফ্যাচ ফ্যাচ করে কান্না শুরু করলো I
কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে না পেরে আমি বললাম
– কিসের বিয়ে ? কার বাচ্চা ?
– সেটাও এখন আমাকে বলে দিতে হবে ? আমরা কি এমন অপরাধ করে ফেলেছি যে তুই আমাদের এভাবে …..
এর পরের কথা আর কিছু বুঝতে পারলাম না I কান্নার দমকে বুবুর কথা আটকে গেল I আমি বিরক্ত হয়ে বললাম
– ফোনটা একটু দুলাভাইকে দে তো I
দুলাভাই ফোন হাতে নিয়ে বললেন
– এসব কি শুনছি রাসু ?
– বিষয় কি দুলাভাই ?
– তোমার আপা তার কোন বান্ধবীর খালাতো বোনের ননদের ফেসবুকে তোমার ছবি দেখেছে, হাসপাতলে; বাচ্চা কোলে I
– দুলাভাই ওইটা আমার পরিচিত একজনের বাচ্চা I আমি হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম I
আপার ফ্যাচফ্যাচানি তখনও বন্ধ হয়নি I দুলাভাইকে বলতে শুনলাম
-দেখেছো , আমি বলেছিলাম না?
আমি বললাম
দুলাভাই বুবু কে ফোন টা দেন তো I
বুবু ফোন হাতে নিয়ে নাক টানতে লাগল I আমি বললাম
– তোর আর কোন কাজ নাই ? সারাদিন খালি ফেসবুক দেখিস ?
একটু আগের কান্নাকাটি ভুলে গিয়ে বুবু বলল
– বাচ্চাটা কি যে সুন্দর I শোন , আমরা সামনের সপ্তাহে ঢাকা আসছি I তোর দুলাভাইয়ের মামাতো বোনের বাসায় উঠবো I তুই কিন্তু আমাকে ওই বাচ্চাটা দেখতে নিয়ে যাবি I
আমি আঁতকে উঠে বললাম
– আপা এটা সম্ভব না I আমি ওদের ভালোমতো চিনিও না I
বুবু তেতে উঠে বলল
– চিনিস না তো ছবি তুলতে গেছোস কেন ? আমি এত কথা বুঝি না I
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম i অনেক কষ্টে বুঝিয়ে-সুজিয়ে ঠান্ডা করলাম I এর মধ্যে বেশ কয়েকদিন পার হয়ে গেছে I আমার কলেজের ক্লাস শুরু হয়েছে I ভীষণ ব্যস্ততায় সময় কাটছে I সুমাইয়াদের খোঁজ নেয়ার আর কোন সময় পাইনি I নতুন চাকরি নিয়ে বেশ ব্যস্ত ছিলাম I কোন এক অদ্ভুত কারনে আমার ক্লাসে ছেলেমেয়েরা আমাকে খুব পছন্দ করেছে I আপাতত ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার আর সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস নিচ্ছি I সামনের মাস থেকে অনার্স এর ক্লাস নেয়া শুরু করব I নিজেকে একটু গুছিয়ে নিচ্ছিলাম I কিছু পড়াশোনাও করতে হচ্ছিল I সকাল উঠেই কলেজে চলে যাই I ওখানেই ক্যান্টিনে নাস্তা করে নেই I ক’দিন কলিম ভাইয়ের সঙ্গেও দেখা হয়না I
আজ হঠাৎ করেই শুক্রবার হওয়াতে খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগছে I আমার তেমন কোন বন্ধু-বান্ধব নেই I ঢাকা শহরে বন্ধু-বান্ধব রাখতে গেলে যে দু’টো জিনিস লাগে সেটা হলো টাকা আর সময় I এ দুটোর একটাও আমার ছিলনা I ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার সহপাঠীরা যখন টিএসসিতে বসে আড্ডা দিত তখন আমাকে জীবিকার তাগিদে ঘুরতে হতো I টিউশন করিয়েছি, কোচিং এ ক্লাস নিয়েছি I যাতে করে বাড়ি থেকে টাকা আনতে না হয় I আমার ফ্যাকাল্টিতে বেশিরভাগ ছেলে মেয়ে ঢাকার I ক্লাস শেষে ওরা যখন ক্যান্টিনে বসে দেদারসে টাকা খরচ করতো, তখন ওদের সঙ্গে বসার সাহস আমার হতো না I বরং সেই সময় আমি লাইব্রেরীতে থাকতাম I কখনো নোট তৈরি করতাম কখনো আবার অন্য কারো নোট কপি করে নিতাম; যাতে ফটোকপির টাকাটা বাঁচে I তার মানে এই নয় যে আমার পরিচিত জনের অভাব I আমার আর কোন গুণ না থাকলেও একটা গুণ আছে I আমি আমজনতার সাথে খুব সহজে মিশে যেতে পারি I যখন কোন রিক্সায় উঠি, রিক্সাওয়ালার সঙ্গে গল্প করি I মাঝে মাঝে একসঙ্গে সিগারেট খাই I তারা নিজেদের সুখ-দুঃখের গল্প বলে ভীষণ আনন্দ পায় I আমার ফোনের কল লিস্ট এর বেশিরভাগ জুড়েই আছে রিক্সাওয়ালা, দোকানদার, দারোয়ান, ফল বিক্রেতা, রেস্টুরেন্টের ওয়েটার; এদের নাম্বার i এমনকি দুটো ভিক্ষুকের নাম্বারও আছে I মাঝে মাঝে আমার ভাংতি টাকা দরকার হলে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করি I অনেক বিশ্বস্ত উচ্চপদস্থ বন্ধুর চাইতে এরা অনেক বেশি হেল্পফুল I যেকোনো বিপদে নিজের সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করে I এর প্রমাণ সেদিন আবারও পেয়েছিলাম, যেদিন সুমাইয়াকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম I সুমাইয়া অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর কলিম ভাই ছুটতে ছুটতে চলে এলেন I আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছিল I কলিম ভাই সেটা দূর করে দিয়ে বললেন
– ভাইজান তাড়াতাড়ি উঠান I এক্ষণই রাস্তায় ভিড় জইমা যাইবো I
আমি সুমাইয়াকে তুলে নিলাম I কলিম ভাইকে বললাম
– এখন তো কিছুই পাওয়া যাবে না
কলিম ভাই বলল
– খাড়ান কামাইল্লারে ফোন দেই I
কামাল , কলিম ভাই এর মামাতো ভাই I আগে রিকশা চালাত I তবে খুব পরিশ্রমী আর হিসেবি হওয়াতে. কিছু দিনের মধ্যেই নিজের সিএনজি কিনে ফেললো I এখন জমিদারের জীবন কাটায় I নিজের ইচ্ছামত চালায় I যেদিন বেশি টাকা উঠে, তার পর দুদিন শুয়ে বসে থাকে I আজও বোধহয় তার সেরকমই একটা দিন ছিল I কলিম ভাইয়ের ফোন পেয়ে প্রথম মানা করে দিয়েছিল; কিন্তু আমার কথা শুনে আসতে রাজি হলো I আমি সেরকম বিখ্যাত কেউ নই যে, আমার নাম শুনে আসতে রাজি হয়ে যাবে I কিন্তু কামালের সঙ্গে আমার একটা পুরনো সম্পর্ক আছে I যখন ওর আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ; সেই সময়ে একদিন আমি ওকে সাহায্য করেছিলাম I তেমন বিশেষ কিছু না I বাড়ি থেকে ফিরছিলাম I আসার আগে বুবু, দুলাভাই জোর করে ঢেঁকিছাটা চাল , কলা , শুকনো নারকেল ফল তরিতরকারি বস্তা ভরে দিয়ে দিয়েছিল I আমি অতসব নিয়ে কি করবো বুঝতে পারছিলাম না I বহু কষ্টে বাস থেকে নেমে রিকশা খুজছিলাম I সেই সময় কামাল আমাকে নিয়ে আসে I আসতে আসতে ওর সঙ্গে অনেক গল্প হল I ওর পাঁচজন ছেলে মেয়ে I সংসারের নিত্য দিনের টানা টানি I আমি নেমে পুরোটা বস্তাই ওকে দিয়ে দিয়েছিলাম I সেদিন বোধহয় ওর ইনকাম ভালো হয়নি I আমার হাত ধরে অনেক কাঁদলো I এত সামান্য কারণে কাউকে এত ইমোশনাল হতে দেখিনি আগে I সেই থেকে আমার কোন কথা কখনো ফেলতে পারে না ও I আজও তাই হল; 5 মিনিটের মধ্যেই সিএনজি নিয়ে হাজির হয়ে গেল I
আমরা সুমাইয়াকে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে গেলাম I যা ভেবেছি তাই, অতিরিক্ত গরমে হিট স্ট্রোক হয়েছে I ডাক্তার স্যালাইন লাগিয়ে দিল I আমি বাইরে বসে ছিলাম I জ্ঞান ফেরার পর ওর অবস্থা দেখে খুব খারাপ লাগলো I এত সাহসী, শক্ত একটা মেয়ে কিরকম অসহায় এর মত আচরণ করছে I আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল I আরো মন খারাপ হলো যখন ওর কান্নার কারণ জানলাম I আমি সাধারন একজন শিক্ষক I আমার কোনো উচ্চপদস্থ বন্ধু-বান্ধব নেই I আমার শুধু একটাই গুন আছে; সেটা হলো আমি বিপদের সময় মাথা ঠান্ডা রাখতে পারি I আমি সুমাইয়ার কাছ থেকে ওর দুলাভাইয়ের ফোন নাম্বার অফিসের ঠিকানা নিয়ে নিলাম I ওর বোনের হাসপাতালের ঠিকানা সেইসঙ্গে দুলাভাইয়ের একটা ছবিও নিয়ে নিলাম I
যে হাসপাতালে সুমাইয়ার বোনকে ভর্তি করা হয়েছে সেখানের কোন ডাক্তারের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই I ফোন লিস্ট খুঁজে অনেক কষ্টে একজন ওয়ার্ড বয়ের নাম্বার বের করলাম I তাকে অনুরোধ করে কাউন্টারের আপাকে কোনরকমে ম্যানেজ করলাম I জানালাম যে আমরা এক ঘন্টার দূরত্বে আছি এতক্ষন রোগীকে ফেলে রাখতে চাইছি না I প্রয়োজনে 5000 টাকা বিকাশ করে দেব I যেন অপারেশন এখনই শুরু করা হয় I দরকার হলে আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে রাজি আছি I আপার অবস্থা বিশেষ ভাল ছিলনা I ডাক্তারেরাও রিস্ক নিতে চাইছিলেন না I আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে আমার পরিচয় দিলাম I উনি বোধহয় আমাকে একটু বিশ্বাস করলেন I আমি বললাম আমি টাকাটা বিকাশ করে দিতে পারি I কিন্তু উনি টাকা ছাড়াই অপারেশন শুরু করতে রাজি হয়ে গেলেন I
এবার প্রজেক্ট দুলাভাই I উনি যে ব্যাংকে কাজ করেন ওই ব্যাংকে আমার পরিচিত কেউ নেই I তবে তার থেকে একটু দূরেই একটা এটিএম বুথ আছে I সেখান থেকে একবার টাকা তুলেছিলাম I বুথের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ানের সঙ্গে কিঞ্চিৎ সখ্যতা হয়েছিল I আমি তাকে ফোন করে সাহায্য চাইলাম I সে বিশেষ কিছু করতে পারলো না; তবে জানালো ওই ব্যাংকের পিয়ন তার পরিচিত I ফোন নাম্বারও দিয়ে দিলে তাড়াতাড়ি I আমি পিয়ন কে ফোন করে সাহায্য চাইলাম I যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়ে বেশি পেলাম I তার কাছ থেকে জানতে পারলাম সম্মানিত দুলাভাই তার একজন মহিলা কলিগ নিয়ে দুপুরে লাঞ্চ করতে গেছেন I তার কাছ থেকেই দুলাভাইয়ের বস এবং ব্যাংক ম্যানেজারের নাম ও নিয়ে নিলাম I যদিও আশা করিনি জানতে পারবো তবু ভাগ্যক্রমে কোথায় লাঞ্চ করতে গেছে সেটাও জেনে ফেললাম I ব্যাংকটা বসুন্ধরা সিটির পাশেই I তাই সবাই ওখানেই লাঞ্চ করতে যায় I
কাজ গোছানো শেষ I এবার অ্যাকশনে যেতে হবে Iআমি দ্রুত ভাবতে লাগলাম কি করে দুলাভাইকে ধরা যায় I বসুন্ধরা সিটিতে সাধারণত সবাই টপ ফ্লোরে লাঞ্চ করতে যায় I সেখানে আমার কিছু পরিচিত ওয়েটার আছে I এদের মধ্যে জাহাঙ্গীর নামের একজন আমার সঙ্গেই মেসে ভাড়া থাকতো I আমি প্রত্যেকের কাছে দুলাভাইয়ের একটা ছবি পাঠিয়ে দিয়ে লিখলাম এই ভদ্রলোকের স্ত্রী আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি I তাকে পাওয়া যাচ্ছে না I বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলোনা I জাহাঙ্গীর ফোন দিল I ভদ্রলোককে পাওয়া গেছে I এক আপামনির সঙ্গে বসে ধোসা খাচ্ছে I আমি ইচ্ছা করেই জাহাঙ্গীরকে বললাম
দেখ ভাই ,বউ হাসপাতালে আর উনি কি করতেসে I
জাহাঙ্গীরের বয়স কমI শরীরের রক্ত গরম I খেপে উঠে বলল
-দাঁড়ান শালারে এখনই সাইজ দিতাছি I
আমি আঁতকে উঠে বললাম;
-না না সাইজ দেওয়ার দরকার নাই I তুই খালি দুজনের একটা ছবি তুলে আমাকে পাঠা I
এরপর আমি দুলাভাইকে ফোন দিলাম I যা ভেবেছিলাম তাই I উনি ফোন ধরলেন না I আমি ফোন দিতে থাকলাম I একসময় উনি ফোন ধরলেন এবং বিরক্ত কণ্ঠে বললেন
– কি ব্যাপার? কে আপনি ?
– আমার নাম রাশেদ I আপনার স্ত্রী এখন হাসপাতালে I তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে যান I
– আপনার কথায় আমি যাব নাকি ?
– উনার অবস্থা ভালো না I এখনই অপারেশন করতে হবে I
– কিসের অপারেশন ?
– ডাক্তার বলেছে সিজারিয়ান করতে হবে I
– কোন সিজারিয়ান হবে না I নরমাল ডেলিভারি হবে I
আমার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়ে গেল I আমি কড়া গলায় বললাম
– আপনি এখনই হাসপাতালে যাবেন I
– কেন যাব ? আপনার কথায় নাকি?
হঠাৎ করে মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছিল I কিন্তু দ্রুতই নিজেকে সামলে নিলাম I ঠাণ্ডা গলায় বললাম
– তবে কি আপনার সামনে বসে থাকা আপামনির কথায় ? যার সঙ্গে বসে ধোসা খাচ্ছেন I
ঠাস করে একটা শব্দ হলো I সম্ভবত ভদ্রলোকের হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেছে I কিছুক্ষণের মধ্যেই উনি ফোন তুলে নিয়ে আবার বললেন
– কে আপনি ? আমি আপনার কথা কেন বিশ্বাস করব ?
– আমি সুমাইয়ার পরিচিত I আপনি দয়া করে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে যান I
-সুমাইয়ার সাথে কি সম্পর্ক ? আর আপনার কথায় আমি কেন যাব ?
-ভালোয় ভালোয় না গেলে কিভাবে যাওয়াতে হয় সেটা আমি জানি I
– ভয় দেখাচ্ছেন ?
– এখনো দেখাইনি I
আমি ফোন রেখে দিয়ে জাহাঙ্গীরকে ফোন দিলাম I তারপর বললাম
-আমার একটা কাজ করে দে তো ভাই I
জাহাঙ্গীর 5 মিনিটের মধ্যে ফোন করে জানালো যে কাজ হয়ে গেছে I দুলাভাই রওনা হয়ে গিয়েছেন I ওকে বিশেষ কিছুই করতে হয়নি I শুধু একটা কাগজ নিয়ে দুলাভাইয়ের হাতে দিয়ে বলেছে ভাইজান এটা দিতে বলেছে I কাগজে একটা বাক্যই লেখা ছিল;
রিক্সা করে হাসপাতালে যেতে চান না এম্বুলেন্সে ?
চলবে…………….