#দ্বিতীয়_পুরুষ
পর্ব ৩২
_নীলাভ্র জহির
রূপক বাড়ি ফেরার পর থেকে খেয়াল করে দেখল চিত্রার মাঝে অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। চোখমুখ শক্ত , মুখে কাঠিন্য , কারো সাথে কথা বলছে না। বারান্দায় বসে এক দৃষ্টে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। রূপক বাড়ি ফেরার পর সাধারণত সে রূপকের আশে পাশে থাকার চেষ্টা করে, বিভিন্ন ইংগিতে কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু আজ তার একেবারেই বিপরীত। আজ চিত্রার মাঝে কোন কিছু নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই। রূপক বারান্দায় ভাত খেতে বসলো। খাবার দিচ্ছেন জোসনা বেগম। রূপক নিজে থেকেই ডাকলো চিত্রাকে, ভাত খাইছো?
চিত্রার মাঝে কোন ভাবান্তর নেই। রূপক তার মায়ের কাছে জানতে চাইলো, মা ও ভাত খাইছে?
– না, বৌমা ও ডাকতাছে তুমি শুনতাছ না? ভাত খাইতে আসো।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল চিত্রা। তবে সেই দীর্ঘশ্বাসের চিত্র দেখতে পারলো না রূপক কিংবা তার মা। আবছা অন্ধকার ঠেলে চিত্রা ধীর পায়ে এসে মোড়া টেনে নিয়ে বসলো। জোসনা বেগম ভাতের থালা তার দিকে এগিয়ে দিলেন। থালা থেকে অর্ধেকের বেশি ভাত ভাত গামলায় নামিয়ে রাখল চিত্রা। কয়েক লোকমা ভাত নিয়েছে মাত্র। হাত ধুয়ে মাথা নিচু করে ভাত খেতে লাগলো। সে কারও দিকে তাকালো না। চোখ মুখ গম্ভীর। কয়েকবার খাবার মুখে দিয়ে নিঃশব্দে খেয়ে গেল। খাবারটা শেষ করে আবারও উঠে এসে হাত ধুয়ে ফেলল। তারপর গিয়ে বসলো তার ঘরের বারান্দায়।
জোসনা বেগম ও রূপক একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। চিত্রার আচরণ এমন রোবটের মতো হয়ে গেল কি করে সেটাই ভাবছে রূপক। সেই সময়ে জোসনা বেগম বললেন, তুই মঞ্জু মিয়ারে চিনোস?
কোন মনজু মিয়া?
রাস্তার মাথায় যে নতুন বাড়ি করছে। বিল্ডিং ঘর, নীল রং করছে।
হাঁ মনে আছে। কি হইছে তার?
উনার একটা মাইয়া আছে।
মাইয়া কি অসুস্থ?
অসুস্থ হইবো ক্যান?
তাইলে কি হইছে?
তুই মাইয়াডারে একটু দেখবি।
আমি কেন দেখব?
দেখতে কইছি। আমি ওর মায়ের লগে কথা কইছি। মাইয়াডা নাকি জামাকাপড় বানাইতে দিব। তোর দোকানে যাইবো।
যাইবো। অসুবিধা কি? আমিতো দোকানেই থাকি সারা দিন। কইও গিয়া মনজু মিয়ার মাইয়া সেইডা কইতে। তাইলে কয়টা ট্যাকা কম রাইখা দিমু।
আচ্ছা, ঠিক আছে। মাইয়াডারে একটু ভালো কইরা দেখিস তুই।
রূপক মায়ের কথার কোনো ইঙ্গিত ধরতে পারল না। সে কেবল ভাবছে চিত্রার কথা। চিত্রা এতদিন স্বাভাবিক আচরণ করেছিল। স্বামীর অবহেলায় একটা স্ত্রীর কান্নাকাটি করে আবেগে আপ্লুত হয়ে থাকার কথা। সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আজ সে হঠাৎ করে এমন কঠিন হয়ে গেল কি করে? সে কি চিত্রাকে বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলল?
হাত ধুয়ে রূপক মায়ের কাছে এক খিলি পান চাইতে গিয়ে চাইল না। লুঙ্গিতে হাত মুছতে মুছতে চিত্রার পাশে এসে বসলো। চিত্রা কে বলল, আমারে এক খিলি পান আইনা দাও?
মুহূর্তেই ফড়াৎ করে চিত্রা উঠে গেল। রুপক বসে রইল। দখিনা বাতাস আসছে শন শন করে। গায়ের শার্ট খুলে খালি গায়ে বসল রূপক। গা হিম করা বাতাস। রূপক ভাবল চিত্রা পান নিয়ে আসলে সে খানিকক্ষণ গল্প করবে চিত্রার সঙ্গে। চিত্রার মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করবে। সে নিশ্চয়ই রূপকের সঙ্গে অনেক রাগ করে আছে। অনেকদিন হল তাদের মধ্যে ঝামেলা চলছে। এসবের একটা ইতি টানা দরকার।
কিন্তু চিত্রা সেই সুযোগটুকু তাকে দিল না । সে পানের খিলি রূপকের হাতে দিয়ে সোজা ঘরে গিয়ে ঢুকলো। ঘর অন্ধকার হওয়ায় বাইরে থেকে বোঝা গেল না কি করছে চিত্রা। তবে রূপক খুব অপ্রস্তুত বোধ করলো। সে চিত্রার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলতে চেয়েছিল। চিত্রা তাকে পাত্তা দেয়নি বলে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল তার। পরক্ষনেই তার মনে জেগে ওঠা দরদটুকু নিমেষেই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। মনে মনে বলল, আমার লগে বেইমানি কইরা আবার আমারে দেমাগ দেখাইতেছে। কিসের এত দেমাগ বুঝিনা। যত মন চায় রাগ কইরা থাকুক। আমার তাতে কিছুই যায় আসে না। আমি ওর দেমাগের ধার ধারি না।
রাগের চোটে রুপক বারকয়েক পানের পিক ফেলল মাটিতে। শনশন করা বাতাসেও তার গরম লাগছে। সে রীতিমত রাগের স্বরে বলল, পাংখা টা দিয়া যাও।
মুহুর্তের মাঝে হাতপাখা নিয়ে হাজির হল চিত্রা। সেটা রূপকের সামনে রেখে আবার ঘরে গিয়ে ঢুকলো। রূপক ভেবেছিল হাতপাখা নিয়ে চিত্রা তার পাশে এসে বসবে। কিংবা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাতাস করবে তাকে। চিত্রা তার কিছুই করলো না দেখে রূপকের রাগটা আরো বেড়ে গেল। তার সামনে পাখা রেখে এভাবে ঘরে চলে যাওয়া? ঠিক আছে রুপকও দেখে নিবে এভাবে কতদিন রাগ করে থাকতে পারে চিত্রা। মনে মনে রূপক বলল, আমি কোনো দোষ করি নাই। আমার কোন ঠেকা পড়ে নাই কারো কাছে দিয়া ধরণা দেয়ার।
চিত্রা স্তব্ধ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। তার ঘরের জানালা দিয়ে হাওয়া আসছে। চুলের খোপা খুলে গেছে তার। বাতাসে চুল উড়ছে দিগ্বিদিকভাবে। এই মুহূর্তে অতীত-বর্তমান কিংবা ভবিষ্যৎ কোন কিছু নিয়েই সে আর ভাবতে পারছে না। তার ভাবনা গুলো সব কেমন যেন পাথর হয়ে গেছে। অতীতের ভয়ঙ্কর যাতনাময় স্মৃতি কিংবা ভবিষ্যতের কষ্টের শঙ্কা কোনটাই তার মনকে প্রভাবিত করছে না। বর্তমানে সে কোন দহনে দগ্ধ হচ্ছে সেটাও তাকে ভাবাচ্ছে না। তার কাছে সবকিছু মনে হচ্ছে দুঃস্বপ্নের মত। সবটা যেনই স্থির। তার চোখ দুটো হয়ে গেছে পাথরের মত। রূপক কখন এসে তার পাশে শুয়ে পড়েছে চিত্রা খেয়ালই করল না। দেখতে দেখতে রাত বেড়ে যায়। ঘুম নেই তার চোখে। সে ঘুমের ভান ধরে পড়ে রইল। রূপক কয়েকবার ডাকলেও সাড়া দিলো না। যেন গভীর ঘুমে মগ্ন সে। কিন্তু কেবল তার চোখ দুটোই জানে, নির্ঘুম এক রাত্রি কাটিয়েছে তারা।
এভাবেই কেটে গেলো দুটো দিন। বিচিত্র এক ঘটনা ঘটল দুদিন পর। রূপক মাত্র বাড়ি ফিরেছে। ভাত খাওয়ার পর জোসনা জিজ্ঞেস করলেন, আইজ মাইয়াডা তোর দোকানে গেছিল?
– হ। তোমারে কে কইল?
– আমি ওগো বাড়িত গেছিলাম সন্ধ্যয়। আপার লগে আমার খুব খাতির হইছে। অনেক ভালো মহিলা। আমি গেলে আমারে এটা-ওটা খাইতে দেয়। ঘরে সারাক্ষণ বিস্কুট কেক নাস্তা পানি থাকেই।
– তুমি বুঝি বিস্কুট নাস্তা পানি খাইতে যাও?
– আরে না আমিতো গল্প করতে যাই। মহিলার দিল ভালো। ওরা আগে আছিলো নোয়াখালী। ওনার স্বামী চাকরি করতো। দুই পোলা, দুই মাইয়া। মাইয়া দুইটাই সুন্দরী। গেলেই আপা আমার লগে এত কথা কয়, খুব ভালো লাগে। পরান টা জুড়ায় যায়। উনার মাইয়াগুলা খুবই ভদ্র। এত সুন্দর কইরা আমার লগে কথা কয় ,সালাম দেয়।
– হু আমারও তাই মনে হইলো। মাইয়াগুলা ভদ্র। আজকে দুইটা মাইয়া দোকানে আইছিলো। থ্রি পিস লইছে।
– দাম টাম কমাই আর রাখছস?
– হ, কমাইয়া রাখছি। সিঙ্গারা খাইতে কইছিলাম, খায় নাই।
– মাইয়া কি বোরকা পইরা গেছিল?
– হ,
– তাইলে তো তুই ওর মুখ দেখস নাই? হতাশ শোনালো জোসনা বেগমের গলা ।
– মুখ দেখছি। মুখ খোলা ছিল।
জোসনা বেগম খুশি হয়ে উঠলেন, মাইয়া কেমন দেখছস? ছোট মাইয়াটা তো কেবল ক্লাস ফোরে পড়ে। বড়ডারে কেমন দেখলি?
ভালোই। আচার আচরণ দেইখা শিক্ষিত মনে হইল।
শিক্ষিত হইলে শিক্ষিত মনে হইবো না? ইন্টারে পড়ে।
এটা নিয়ে আর কোন কথা বাড়ালো না রূপক। জোসনা বেগম বললেন, মাইয়াডারে কেমন দেখছস কইলি না?
এক কথা কয়বার জিগাও মা? কইলাম তো দেখছি ভালই। পরের মাইয়া দেইখা আমি কি করমু? তুমি কি কারো জন্য ঘটকালি করতাছো?
মুচকি হাসলেন জোসনা বেগম, হ। মাইয়াডারে আমার বড় ভালো লাগছে। আদব-কায়দা আচার-আচরণ সব দিক দিয়া খুব ভালো।
তো কার জন্য দেখতাছো? শরিফের লাইগা?
আরে ধুর। আমাগো শরিফের বিয়ের বয়স হইছে নাকি।
তাইলে কার জন্য দেখতাছো?
জোসনা বেগম খানিকটা ইতস্তত বোধ করলেন। তারপর বললেন, মাইয়াডারে কি তোর ভালো লাগে?
রুপক খানিকক্ষণ তার মায়ের দিকে স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। জোসনা বেগম কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে সেটা বুঝতে আর দেরী হলো না তার। সে জানতে চাইলো, আমার ভালো লাগা দিয়া কাম কি?
ওদের লগে আত্মীয়তা করতাম। মাইয়ার মা রাজি আছে। বাপ রাজী হইবো কিনা সেইটা জানিনা। ওর মায় কইছে ওনারে রাজি করোন যাইবো।
মা তোমার মাথা ঠিক আছে?
হ, ঠিক আছে। তুই আমার যোগ্য পোলা। তোর জন্য একটা যোগ্য মাইয়া দরকার। তুই যারে বিয়া করছোস সে কোন দিক দিয়া তোর যোগ্য না। মঞ্জু মিয়ার মাইয়াডা দেখতে শুনতে যেমন সুন্দরী, তেমনি আচার ব্যবহার। কয়েকদিন হইল এই গ্রামে আইছে। সবাই তার প্রশংসা করে। কলেজে পড়ে, জ্ঞান-বুদ্ধির অভাব নাই। ওর বাপের টাকা পয়সাও আল্লাহ দিলে অনেক। আপা কইসে, মাইয়ারে ঘরভর্তি কইরা জিনিস দেওয়ার লাইগা জমা-জমি রাখছে। একটা জমি বেইচা শুধু মাইয়ারে জিনিসই দিব। মাইয়ার জামাইরে ব্যবসা করার লাইগা টাকা পয়সা দিব। আমি সারাক্ষণ তোরে লইয়া সুনাম করি। তোরে উনি অনেক পছন্দ করে। খালি যদি তোর বিয়ার আগে ওনারা এখানে আইতো, ওই মাইয়ার লগেই তোরে বিয়া দিতাম।
এখন তো আমার বিয়া হইয়া গেছে। এখন আর এসব আলাপ কইরো না।
বিয়া হইছে তো কি হইছে?
আম্মা তোমার মাথা খারাপ হইছে। বিয়া হইছে মানে বিয়ে হইছে। একটা ছেলে কয়বার বিয়ে করে?
তুইতো যোগ্য বউ পাস নাই। তাই যে তোর যোগ্য হইব তুই তারে বিয়া করবি।
তারমানে তুমি কইতে চাইতেছো আমি আমার বউটারে ছাইড়া দেই? আর ওই মাইয়ারে বিয়া করি?
জোসনা বেগম খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ইতস্তত করে বললেন, আমি চিত্রার লগে কথা কইয়া দেখি। সে যদি কোন ঝামেলা না করে, চুপচাপ এই বাড়িতে পইড়া থাকতে চায়, তাইলে তো কোন অসুবিধা নাই। সে থাকবো এই বাড়িতে, কাম কাজ করব। পোলা দেখাশুনা করব। তুই আর একটা বিয়া করলি অসুবিধা কি? কয়েকদিন পরে দেখবি মাইয়া নিজে থাইকা চইলা যাইতাছে।
রূপক বলল, এটা কেমন কথা কইলা মা? একটা মাইয়ারে আমি এমনে কষ্ট দিমু?
– কষ্ট তো সে আগে দিছে। বেঈমান মাইয়া। সত্য গোপন কইরা বিয়া দিছে। তোর যদি বেশি বিবেকে লাগে তাইলে তুই ওরে ছাইড়া দে। ওর আগে বিয়ে হইছিল। তুই ওর বাপের বাড়ির মানুষের লগে বসবি। কইবি, যে মাইয়ার আগে বিয়ে হইছিল তার লগে সংসার করবি না। তাছাড়া ওই মাইয়া সংসারের কিছুই বুঝে না। তুই ওরে ছাইড়া দে। তাইলে দেখবি তোর সবকিছু ভালো মত হইবো । ব্যবসা-বাণিজ্য করতাসোস। শশুর বাড়ি থাইকা বেশি করে টাকা পয়সা পাইলে দোকান বড় করবি। মার্কেট বানাবি। সুন্দরী বউ লইয়া সুখে সংসার করবি। শ্বশুরবাড়ি গেলে অনেক আদর যত্ন পাইবি। বুঝোস না ক্যান?
রুপক বলল, এসব নিয়ে আর কথাবার্তা কইও না। আর নিজেদের ঘরের কথা বাইরে কাউরে কইবানা। এতে নিজের মান সম্মান নষ্ট হইবো। কপালে যা ছিল তাই হইছে। এখন আর ও অশান্তি বাড়াইতে চাইতেছি না।
অশান্তি বাড়াবি কেমনে? এমনিতে কি কম অশান্তিতে আছোস? ঘরে কোন শান্তি নাই। তোর লাইগা আমার কষ্ট হয়।
হোক। আমারে নিয়া উল্টা পাল্টা চিন্তা কইরো না।
আমি কিন্তু তোর ভালোর জন্য কইছি। তুই ওই মাইয়ারে বাপের বাড়িত পাঠাইয়া দে। টাকা পয়সা দিবি খাওয়ার লাইগা। পোলা হইয়া গেলে পোলারে নিয়া আসবি। তারপর ছাড়াছাড়ি করবি।
এসব কথা কইও না মা। চিত্রা শুনলে কষ্ট পাইব।
তার কষ্ট পাওয়াই উচিৎ। সে তোরে জাইনা শুইনা ঠকাইছে। কামডা ঠিক করে নাই।
তোমারে কে কইছে এই কথা?
জোসনা চুপ করে রইলেন।
রূপক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলো। তার অশান্ত মনটাকে জোসনা বেগম এসব কথা বলে আরো অস্থির করে দিয়েছে। এখন একটা সিগারেট ধরাতে হবে। সিগারেট টানলে মনের অস্থিরতা খানিকটা কমে।
চলবে..