দ্বিতীয়_সূচনা পর্ব-৫৪

0
1287

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৫৪
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন পেয়ে অবাক হয় ফারহান। সাধারণত তার ফোনে তেমন অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসে না। অয়নন্দিতা পাশেই শুয়ে আছে। ফারহান ভাবছে, কে হতে পারে। ততক্ষণে ফোনের শব্দে অয়নন্দিতার ঘুম ভেঙে গেছে। অয়নন্দিতা চোখ বুজেই হাত দিয়ে ফারহানকে নাড়ছে।
‘ফারহান, ফোন বাজতেছে। রিসিভ করো।’
ফারহান কিছুটা সময় অয়নন্দিতার দিকে তাকিয়ে এরপর ফোন রিসিভ করে।
‘হ্যালো।’
‘ফারহান, আমি বন্দনা বলছি।’
বন্দনার নাম শুনে ফারহান নড়েচড়ে ওঠে। আরেকবার অয়নন্দিতার দিকে তাকায়। অয়নন্দিতা ঘুমে। ফারহান শব্দহীন ভাবে অয়নন্দিতার পাশ থেকে উঠে যায়। বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।
‘হঠাৎ তুমি?’
‘কেমন আছো?’
‘কেমন আছি এটা জানার জন্য এত সকালে ফোন করেছ?’
‘ঘুমোচ্ছিলে বুঝি?’
‘তুমি জানো না আমি কতক্ষণ পর্যন্ত ঘুমাই?’
ফোনের ওপাশে নীরবতা।
‘কেন ফোন করেছ?’
‘আসলে জাহরাফ যা করেছে তার জন্য…’
‘ওটা জাহরাফ আর আমার ব্যবসায়িক ব্যাপার। আমার সাথে তার সম্পর্ক একান্তই ব্যবসাকেন্দ্রিক। সম্পর্কটাকে ব্যক্তিগত না ভাবো। আশা করি, বুঝতে পারছ।’
‘আসলে, আমি বুঝতেই পারিনি জাহরাফ এমন কিছু করবে।’
‘তুমি তো সবই বুঝতে পারো। কে তোমায় ভালো রাখবে, কার কাছে তুমি ভালো থাকবে, কে তোমায় বুঝবে, সবই তো তুমি জানো। তাই না?’
কিছু পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে বন্দনার। নিজেই আজ নিজের চোখে অনেকটা নেমে গেছে। নিজেই নিজের কাছে দোষী। দোষী সে ফারহানেরও। বন্দনা কিছু বলতে যাবে এমন সময় জাহরাফ ডেকে বসে যা ফারহানও শুনতে পায়। জাহরাফের মুখে বন্দনার নাম শুনে ফারহান হালকা হেসে লাইনটা কেটে দেয়। একটা সময় ছিল যখন জাহরাফ বন্দনা বলে ডাকলে ফারহানের বুকে ব্যথা হতো। একদিন তো এমন হয়েছে সহ্য করতে না পেরে শাওয়ারের পানি ছেড়ে বাচ্চাদের মতো কান্না করেছে। কষ্টটা এখন আর নেই তবে দাগটা রয়ে গেছে। হয়তো সারাজীবন রয়ে যাবে। সকালটা ভীষণ সুন্দর। ফারহান সাধারণত আরও পরে উঠে। বন্দনার ফোন তাকে আজ জাগিয়ে দিয়েছে। ভাবছে, ভাগ্যিস অয়নন্দিতা ঘুমে। নয়তো বন্দনার ফোন আসায় সে কী না কী মনে করত।

বারান্দার দরজার অপর পাশে অয়নন্দিতা দাঁড়িয়ে ছিল। ফারহান উত্তেজিত হয়ে কিছু কথা বলেছিল যা অয়নন্দিতার কানে লাগে। এরপরই সে জেগে যায়। চুলে খোঁপা করতে করতে অয়নন্দিতা বারান্দার সামনে এসে দাঁড়ায়। শুনতে পায় ফারহানের কথাগুলো। ফারহানের বলা শেষের কথাগুলো অয়নন্দিতার খুব লেগেছে। পুরুষ মানুষ বুঝি এত কষ্টও পায়? সত্যিকারের ভালোবেসে মানুষটা ঠকে গেছে। তাই তো এখন পর্যন্ত ওই ভাবে সে অয়নন্দিতাকে ভালোবাসতে পারেনি। আবার কমও ভালোবাসে না। চোখের কোণে জমে থাকা পানিটা আঁচলে মুছে বারান্দায় যায় অয়নন্দিতা। ফারহান তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। অয়নন্দিতা ধীর পায়ে ফারহানের পেছনে এসে দাঁড়ায়। হাত রাখে ফারহানের কাঁধে। আচমকা কাঁধে কারো স্পর্শ পড়ায় ফারহান ঘুরে তাকায়। অয়নন্দিতাকে দেখতে পেয়ে হালকা ঘাবড়ে যায়। ভাবছে, শুনে ফেলেনি তো? অয়নন্দিতাও আর বুঝতে দেয়নি যে, সে সবটাই শুনে ফেলেছে। বিব্রতকর পরিস্থিতিতে তাকে না ফালানোই ভালো। হালকা হেসে ফারহানের বুকে হাত রেখে প্রশ্ন করে,
‘আর ঘুমোবে না?’
ফারহান নির্বাক চেয়ে আছে অয়নন্দিতার দিকে। ভাবছে, হয়তো শুনেনি। শুনলে একটু হলেও কষ্ট পেত। কিন্ত সে কষ্ট পাক এমন কিছু তো বলা হয়নি। অয়নন্দিতার হাসিমুখটা দেখে ফারহান কনফিউজড হয়ে গেছে। এরই মধ্যে অয়নন্দিতা আবারও বলে,
‘কী দেখছ এইভাবে?’
ফারহান কিছু না ভেবেই জবাব দেয়,
‘তোমাকে দেখছিলাম।’
‘আমায় দেখার কী আছে? রোজ-ই তো দেখ।’
‘খুব স্নিগ্ধ লাগছে তোমায়।’
‘হয়েছে। আর বলতে হবে না। চলো। ফ্রেশ হও। শাওয়ার নাও। আমি নিচে যাব। নাস্তা রেডি করব।’
এতক্ষণে ফারহান নিশ্চিত হতে পেরেছে যে, অয়নন্দিতা তার আর বন্দনার ফোনালাপ শুনতে পায়নি। ফারহান অয়নন্দিতার গাল স্পর্শ করে ভেতরে চলে যায়। ফারহান চলে যাওয়ার পর অয়নন্দিতা একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। বলে, আমি জানি তুমি ভাবছ আমি হয়তো শুনিনি। কিন্তু আমি সবটাই শুনেছি, শুধু তোমায় বুঝতে দিইনি। অনেক তো হলো কষ্টের পালা। এবার না হয় সুখগুলো আঁকড়ে ধরার পালা।

ক্লাস শেষ করে বাইরে বের হতেই হাসানকে দেখতে পায় সাজি।৷ সাজি হাসানের চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারছে আজও তার কপালে শনি আছে। হাসান দাঁত মুখ খিটে তাকিয়ে আছে সাজির দিকে। সাজি এদিক-সেদিক একবার তাকায়। হরপ ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। সাজি সামনে এসে দাঁড়াতেই হাসান সাজির হাতটা শক্ত করে ধরে। এরপর সোজা গেইট থেকে বের হয়ে যায়।
‘তোমার সমস্যা কী সাজি?’
‘আমার সমস্যা? কই আমার তো কোনো সমস্যা নেই।’
‘তাহলে এমন শুরু করছ কেন?’
‘কী শুরু করলাম?’
‘সাজি বাড়াবাড়ির একটা সীমা থাকে। দয়া করে সীমা অতিক্রম কোরো না।’
‘যতদিন পর্যন্ত না মানবেন ততদিন পর্যন্ত সীমা অতিক্রম করে যাব।’
‘তুমি জোর করতেছ। এইযে জোর করতেছ, ভালোবাসা পাবে আমার?’
‘আমায় ভালোবাসতে না পারার কারণ বলেন।’
‘আমি এখনও মিলিকে ভালোবাসি। হ্যাঁ, মিলি নেই। মিলি আর কোনোদিন আসবে না। আমি মিলিকে আর কোনোদিন পাব না। তবুও মিলিকেই ভালোবাসি।’
‘আমার ভাইয়াও কিন্তু বন্দনাকে ভালোবাসত। ভীষণ ভালোবাসত। এখন কিন্তু আপনার বোনকে ভালোবাসে। ভীষণ ভালোবাসে।’
কথাটা শোনার পর হাসানের ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে এক চড় বসাতে সাজির গালে। পাবলিক প্লেসে সিনক্রিয়েট করতে চায় না। তবুও কিছু কথা শোনানোর জন্য প্রস্তুত হয়।
‘বন্দনা আর মিলি এক? হাউ ডেয়ার ইউ সাজি? তুমি আমার মিলির সঙ্গে বন্দনাকে মেলাচ্ছো। বন্দনা তোমার ভাইকে ধোঁকা দিয়েছে। চলে গেছে অন্য একজনের সঙ্গে। আর আমার মিলি, আমার মিলি আমায় ভালোবেসে চলে গেছে। আল্লাহ পাক তাকে নিয়ে গেছে। পরপারে গিয়েও মিলি আমাকেই ভালোবাসে।’
‘আমি মিলির সঙ্গে বন্দনাকে মেলাইনি। আমি ভালোবাসার সঙ্গে ভালোবাসাকে মিলিয়েছি।’
‘তুমি কি পাগল নাকি? তোমার মাথায় কি বুদ্ধি নেই? ভালোবাসার সঙ্গে ভালোবাসাকে তুলনা করা যায় না সাজি। ভালোবাসার সঙ্গা একেকজনের কাছে একেক রকম। বোঝো কিছু তুমি?’
‘বুঝতে চাই না আমি। আমি একবারও বলিনি মিলিকে ভুলে যান। বলিনি শুধু আমাকেই ভালোবাসুন। মিলি নেই। মিলির শূন্যস্থানটা পূরণ হবে না কখনও। সবটাই জানি আমি। আর মানিও। শুধু চাই আপনার একাকিত্বটায় সঙ্গী হতে। চাই আপনার বাকি জীবনটা আমার সঙ্গে কাটুক।’
‘তুমি গতকাল কেন আমার বাসায় গিয়েছ? কেন আমার ঘরে ঢুকেছ? কেন বিছানার চাদর পালটে দিয়েছ? কেন আমার জামাকাপড় পরিষ্কার করে দিয়েছ? তোমায় আমি লাস্ট ওয়ার্নিং দিলাম সাজি। এরপর আর ওয়ার্নিং দেব না। ঠাটিয়ে চড় মারব। তুমি আমার বাসায় যাবে না। খবরদার যাবে না।’
‘আমি যাব। একশো বার যাব। হাজার বার যাব। দেখব, কী করে আমায় আটকান আপনি।’
হাসানের আর ভালো লাগছে না। বিরক্ত লাগছে তার। এই মেয়েকে বোঝালেও লাভ হয় না। এই মেয়ে নিজের মতোই বলে। হাসান একটা রিক্সা ডাকে এরপর সোজা রিক্সায় উঠে চলে যায়। সাজি অয়নন্দিতার নাম্বার ডায়াল করে।
চপিং করতে করতে অয়নন্দিতা ফোন কানে নেয়।
‘হ্যাঁ সাজি, বলো।’
‘তোমার ভাই এসেছিল আমার ক্যাম্পাসে।’
‘কী বলল?’
‘থ্রেট করে গেল।’
থ্রেটের কথা শুনে অয়নন্দিতার হাতের ছুরিটা নড়ে ওঠে।
‘থ্রেট করেছে। মানে?’
পাশ থেকে নায়াও হাতের কাজ ফেলে অয়নন্দিতার দিকে তাকায়।
‘আমি যেন সরে যাই। আমি যেন তার বাসায় না যাই। আমি যেন তার ঘরে না ঢুকি। নইলে ঠাটিয়ে চড়াবে আমায়।’
‘এইসব বলেছে!’
‘অবাক হবার কিছু নেই। তোমার ভাই বলতে পারে। তার সেই ক্ষমতা আছে। এবার তুমি একটা কাজ করো, তোমার ভাইকে ফোন করো। বলো সাজি সাফ বলে দিয়েছে। সে যাবে। একশো বার যাবে। হাজার বার যাবে। পারলে যেন আটকায়। রাখলাম আমি।’
সাজি ফোন রেখে দিলে নায়া চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে? উত্তরে সবটা বলে অয়নন্দিতা। সব শুনে নায়া বলে,
‘সাজির মাথা থেকে হাসান ভাই নামবে না ভাবী। এক কাজ করি, আমরা সবাই মিলে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিই সংসার করতে করতে ঠিক হয়ে যাবে।’
‘একদম না নায়া। এই কথাটা ভুলেও সাজির সামনে বলতে যেয়ো না। নয়তো ও লাফাবে এমন করার জন্য। আর আমি তো চিনি ভাইয়াকে। অতিরিক্ত জোর দিলে সাজি আরও কষ্ট পাবে। আরেকটু সময় দিই আমরা ভাইয়াকে। আই হোপ সব ঠিক হবে।’
‘হুম। দেখা যাক। সাজি কোথায় এখন?’
‘ক্যাম্পাসেই মনে হয়৷’
অয়নন্দিতা ভাবছে, এর বেশি বাড়াবাড়ি হওয়ার আগেই যেন সব মিটে যায়। সাজিও তার আপন, তার ভাইও তার আপন। একজনের জন্য অন্যজন কষ্ট পাক কিংবা একজন অন্যজনকে কষ্ট দিক এটা সে চায় না। পঅরে যেন কেউই সাফার না করে। যেমন সাফার করছে বন্দনা। বন্দনার এখন ফেরার পথ নেই। ফিরতে চাইলেও পারবে না। সব পথ বন্ধ।

অফিসে বসে হাসান কেবল একটা কথাই ভাবছে, বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না তো। এমনিতেই অল্প বয়স তার উপর মেয়ে। কোমল হৃদয়ের অধিকারীনি। কষ্ট পেল কি না কে জানে। পর মুহূর্তে ভাবে, পেলে পাবে। এত পাকনামি করতে আসে কেন। সে জানে না, আমি মিলিকেই ভালোবাসি। মিলিকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারব না আমি৷ ফাযিল মেয়ের সাহস কীভাবে হয় আমার বাসায় যায়। আর একবার যদি দেখি, তাহলে জনমকার শিক্ষা দিয়ে দিব৷

চলবে………………..

[আসসালামু আলাইকুম, আমি এই কয়েকদিন ব্যস্ত ছিলাম। ব্যস্ততা ছিল, বইমেলার বইয়ের ফাইনাল প্রুফ নিয়ে। ইচ্ছে করে আপনাদের অপেক্ষা করাইনি। তবুও দুঃখিত। সবার কথা ভেবে এখনি পোস্ট করে দিলাম নতুন পর্ব৷ সন্ধ্যায় একটা সারপ্রাইজ আছে সবার জন্য]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here