দ্বিতীয়_সূচনা পর্ব-৭

0
1981

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৭
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

প্রশ্নের জবাবে যদি নীরবতা পালন করা নামক কোনো খেলা থাকত তবে অয়নন্দিতা নিজের জন্য অনেক সাফল্য বয়ে আনতে পারত। কোনো মানুষ এতটা চুপচাপ থাকে? ফারহান ভাবে, বন্দনা অনেক কথা বলত। এমনও সময় গেছে বন্দনা সারারাত বকবক করে গেছে আর ফারহান নাক ডেকে ঘুমিয়েছে। এ নিয়ে কত যে ততর্কবিতর্ক হতো তাদের মধ্যে। যা বলার মতো না।
অয়নন্দিতাকে আবারও প্রশ্ন করে ফারহান।
‘আচ্ছা কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে তার প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। এটা জানেন?’
‘কেন জানব না?’
‘আমার তো মনে হয় জানেন না। প্রশ্ন করলে চুপচাপ থাকেন আবার প্রশ্ন করলে উত্তর দিতে হবে সেই ভয়ে পালিয়ে যান। এটা কেমন?’
‘আপনি যা ভাবছেন তা নয় কিন্তু।’
‘আমি তেমন ভাবি না। আবার যা ভাবি তা কিন্তু সত্যি হয়ে যায়। যাই হোক, আমায় ওইভাবে সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে দেখছিলেন কেন?’
ভাবাভাবি পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু সন্দেহভাজন দৃষ্টির কথা বলেই ঝামেলায় ফেলে দেওয়া হলো অয়নন্দিতাকে। এখন আর নীরব থাকা চলবে না। নীরব থাকার জন্য শুরুতেই জ্ঞান দিলেন। অয়নন্দিতা বলে,
‘সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে দেখিনি। চোখ পড়ে গিয়েছিল শুধু।’
‘বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। আপনার তাকানোর স্টাইলটাই অন্যরকম ছিল।’
‘আপনি সিগারেট টানছেন আর ফোনে কী যেন দেখছিলেন। তাই ভাবলাম, এত রাতে সিগারেট কেন টানছেন আর ফোনেই বা কী দেখছে এত মনোযোগ দিয়ে।সেটাই ভাবছিলাম আর কি?’
‘ম্যানেজমেন্টে না পড়ে গোয়েন্দা বিভাগে পড়াশোনা করলে ভালো হতো।’
‘মানে?’
‘কিছু না। তা আপনার হাতের ব্যথার কী অবস্থা? কেমন বোধ করছেন এখন?’
‘মোটামুটি ভালো।’
‘গুড। মেডিসিন খাচ্ছেন তো ঠিকমতো।’
‘জি।’
‘আপনার বান্ধবীর নাম শাম্মি। রাইট?’
‘জি।’
‘মেয়েটা ভালো। আপনাকে খাইয়ে দিল দেখলাম। মেডিসিনও খুলে দিল।’
‘শাম্মি আর আমি মাধ্যমিক থেকেই এক সাথে।’
‘তাহলে তো বেশ গভীর বন্ধুত্ব।’
‘জি।’
‘এবার ঝটপট একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো। এতরাতে না ঘুমিয়ে ব্যালকনিতে কী করছেন?’
‘রুমে যখন শুয়েছিলাম তখন সমুদ্রের গর্জন কানে লাগছিল। কান পেতে শুনছিলাম, ভীষণ ভালো লাগছিল। তাই ভাবলাম শুধু কানে না শুনে দুচোখ দিয়ে দেখেও আসা যাক। তাই ঢেউ দেখতে বের হলাম।’
‘এর আগে কখনও আসেননি এখানে?’
‘নাহ। আপনি এসেছিলেন?’
‘হ্যাঁ। তখন বন্দনা ছিল সাথে। এখন আর আসা হয় না। কারণ, বন্দনা নেই।’
ফারহানের মুখে বন্দনা নামটা শুনে অয়নন্দিতা তার ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফারহানের দিকে তাকায়। প্রশ্ন করে,
‘বন্দনা কে?’
‘বন্দনা হলো আ,,,,,,,,,’
বলতে গিয়েও চুপ হয়ে যায় ফারহান। ভাবে এত কথা জিজ্ঞেস করার উনি কে? আর সে-ই বা কেন প্রশ্নের উত্তর দিতে যাবে। অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ুন — এই বলে ফারহান উল্টো পথে পা বাড়ায়। অয়নন্দিতা বিষ্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আর একা-একাই বলে,
‘মাথায় সমস্যা আছে মনে হয়। পাগল কোথাকার?’
ফারহান কিছুটা সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। অয়নন্দিতার বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে।
‘ইয়া মাবুদ, শুনে ফেলল নাকি। লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমীন। অয়নন্দিতা, এই লোক পেছনে ফিরার আগেই রুমে ঢোক।’
অয়নন্দিতা আর এক সেকেন্ডও সেখানে দাঁড়ায়নি। এক দৌড়ে উড়ে গিয়ে রুমের ভেতরে ঢুকে যায়। দরজা লাগিয়ে মনে-মনে বলে, বড়ো বাঁচা বেঁচে গেছি। উফফ,,,,,,

দুই দিন পর৷
ট্যুর শেষ করে সবাই ফেরার পথে। অয়নন্দিতা বাসেই বসেছে শাম্মির সঙ্গে। এই দুইদিন তার জীবনে বেশ সুন্দর ছিল। না দেখা কিছু জিনিস দেখা হয়েছে। কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। সবার সঙ্গে কথা হয়েছে। সবাই এক সঙ্গে প্রতিটা মুহুর্ত এঞ্জয় করেছে। অয়নন্দিতার জীবন থেকে আনন্দ প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল। প্রথমে বাবা মারা গেল। বাবার শোকে চল্লিশ দিনের মাথায় মা-ও চলে গেল। গত দুইটা বছর ধরে ওই এক মামা আর মামীর কাছেই থাকে অয়নন্দিতা। বড়ো ভাইয়ের মতো স্নেহ করে তার হাসান ভাইয়া। আর সে বড়ো বোনের মতো ভালোবাসে ছোটো ছোটো দুটো মামাতো বোনকে। সব মিলিয়ে মামা-মামীর কাছে খারাপ নেই অয়নন্দিতা। কিন্তু মা বাবার অভাব কি কখনও পূরণ হবে তার। কীভাবে-কীভাবে যেন দুইটা বছর পার হয়ে গেল। দুই বছরে চারটা ঈদও পার হয়ে গেল। যেই অয়নন্দিতার ঘুম ভাঙত মায়ের ভালোবাসার ডাকে সেই অয়নন্দিতার ঘুম ভাঙে এখন আজানের শব্দে। ঘুম থেকে উঠেই নামাজ পড়ে মামীর সঙ্গে রান্নাঘরে ঢোকে সে। যদিও মামী কখনও বলেননি তাকে যে অয়নি এটা কর, কিংবা ওটা কর। অয়নি মনে করে জগতে হয়তো তার মামীটাই একমাত্র ভালো মামী। যিনি মনে করেন তার তিন সন্তান না তার চার সন্তান। ফিরে গিয়ে মামীকে সব বলবে অয়নন্দিতা। এখানে কোথায় কী দেখেছে সব বলবে। মামীও খুশি হবে। নিজে হাত খিচিয়ে সবার জন্য টুকটাক জিনিসপত্র কিনেছে। বাসায় গিয়ে সবাইকে দিতে হবে। সব কিছুই প্ল্যান করে রেখেছে অয়নন্দিতা। দুই স্টুডেন্টের জন্য আচার নিয়েছে। ফিরে গিয়ে যখন টিউশনিতে যাবে তাদের আচার। এইসব কিছু ভাবতে-ভাবতে অয়নন্দিতা কখন যে শাম্মির কাঁধে ঘুমিয়ে যায় তা সে নিজেও,টের পায় না।
ফারহান অন্য গাড়িতে। শরীফের সঙ্গে আসছে। এই দুটো দিন তার কাছে ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক ছিল। এসেছিল ভালো লাগবে ভেবে৷ কিন্তু এসে যন্ত্রণা ভোগ করতে হলো। এই দুটো দিনে সে পদে-পদে বন্দনাকে মিস করেছে। সে যদি জানত এখানে আসলে তাকে বন্দনার স্মৃতি তাড়া করে বেড়াবে তবে সে কখনও এখানে আসত না। বাইরের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে এইসবই ভাবছিল ফারহান। ঢাকা ফিরে কাজে মন দেবে সে। প্রয়োজন হলে দেশের বাইরে যাবে কাজের জন্য। তবুও কাজে লেগে থাকবে। তাহলে অন্তত বন্দনা আর তার স্মৃতি উভয়ে থেকেই রেহাই পাবে সে। নইলে সে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে।

চলবে……………………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here