দ্বিতীয়_সূচনা পর্ব_২৭

0
1676

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_২৭
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

প্রচন্ড মাথা ব্যথায় অস্থির অয়নন্দিতা। জ্বরটাও ছেড়ে ছেড়ে আসছে। গলাও পুরোপুরি বসে গেছে। অয়নন্দিতার এতটা অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না ফারহান। বিকেলের দিকে অয়নন্দিতার মামা মামী এসেছিলেন। এবং সেই সাথে এটাও বলে গেছেন যে ঠান্ডা খাওয়ার মধ্যে শুধু একটা আইসক্রিম খেয়েছিল। আর তারপর থেকেই ঠান্ডা লাগে। আইসক্রিম খাওয়ার বিষয়টা নিয়ে ফারহান রাগান্বিত হলেও কিছু বলেনি অয়নন্দিতাকে।
এপাশে মুখ করে ঘুমোচ্ছে অয়নন্দিতা। ফারহানের চোখে ঘুম নেই। জেগে জেগে তাকিয়ে আছে অয়নন্দিতার মুখের দিকে৷ জ্বরে অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে অয়নন্দিতার। ঠোঁট জোড়া শুষ্ক হয়ে আছে। চোখগুলো লালচে। ফারহান এক পাশ হয়ে গাঢ় নজরে দেখছে অয়নন্দিতাকে। ইদানীং অয়নন্দিতার দিকে তাকিয়েই থাকতে ভালো লাগে ফারহানের। সে চায় তাদের মধ্যে কথা কম হোক। কিন্তু দৃষ্টি আকর্ষণ থেকে যাক।
ঘুম ভেঙে নড়েচড়ে ওঠে অয়নন্দিতা। পাশে হাত রেখে টের পায় তার পাশের জায়গাটা খালি৷ মুহুর্তেই চোখ খুলে তাকায় সে। ফারহান পাশে নেই। ঘরে যতটুকু আলো আছে ততটুকু দিয়েই অয়নন্দিতা দেখতে পায় তার ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। তার মানে ফারহান বাইরে যায়নি। বার কয়েক এদিক-সেদিক তাকায়। কিন্তু দেখতে পায়নি। অয়নন্দিতা শোয়া থেকে উঠে বসে। গলায় তেমন জোরও নেই যে শব্দ করে ডাকবে ফারহানকে। বাধ্য হয় বিছানা থেকে নামতে। ওয়াসরুমের দরজাটাও বাইরে থেকে বন্ধ। অয়নন্দিতা বুঝতে পারে ফারহান বারান্দাতেই আছে। বারান্দার সামনে দাঁড়ায় অয়নন্দিতা। দেখতে পায় ফারহান সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। সিগারেট টানছে এক মনে। অয়নন্দিতা ভাবছে, অনুমান যদি ঠিক হয় এখন গভীর রাত কারণ সে এখনও ঘড়ি দেখেনি। এত রাতে না ঘুমিয়ে ফারহান এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। ব্যাপারটা কেমন যেন লাগছে অয়নন্দিতার কাছে। তার দুর্বল চিত্ত মনে মনে বলছে, ফারহান নিশ্চয়ই কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত৷ নইলে সে এত রাতে না ঘুমিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানত না।

নিজের কাঁধে কারো আলতো স্পর্শ পেয়ে ফারহান পেছন ফিরে তাকায়। বাইরের ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে আলোতে অয়নন্দিতার মুখখানা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ফারহান। ফারহান অয়নন্দিতাকে এখানে এভাবে আশা করেনি। হঠাৎ দেখতে পেয়ে চমকে যায় সে। তার ধারণা অনুযায়ী অয়নন্দিতা এতক্ষণ ঘুমেছিল।
ফারহান হাতে থাকা জ্বলন্ত সিগারেটটা ফেলে দিয়ে অয়নন্দিতার দুই বাহু আঁকড়ে ধরে পাছে সে পড়ে যায়। বসা গলায় অয়নন্দিতা প্রশ্ন করে,
‘না ঘুমিয়ে এখানে সিগারেট টানছেন?’
অয়নন্দিতার বসা গলাটা অদ্ভুত রকম শোনাচ্ছিল। কিন্তু এই শব্দটা ফারহানের বেশ ভালো লাগছিল। মন চাইছিল আরও কথা বলুক অয়নন্দিতা। কিন্তু ডক্টর বলে গেছে বেশি কথা না বলতে। জোর করে শব্দ করে কথা না বলতে। নয়তো ভোকাল কর্ডে সমস্যা হতে পারে। ফারহানের চোখে মুখে স্নিগ্ধ হাসি। অয়নন্দিতা উত্তর না পেয়ে আবারও প্রশ্ন করে,
‘এত রাতে এখানে কী করেন? ঘুমাবেন না?’
এবার ফারহান জবাব দেয়,
‘ঘুম আসছিল না।’
‘কেন?’
‘ঘুমকে জিজ্ঞেস করতে হবে।‘
‘ করেন প্রশ্ন। জিজ্ঞেস করেন, কেন সে এখনও আসছে না।’
ফারহান হাসছে। অয়নন্দিতা তাকিয়ে দেখছে ফারহানের দিকে। একটা সতেজ ভাব ফারহাবের মুখশ্রীতে। ফারহান প্রশ্ন করে,
‘তুমি ঘুম থেকে উঠলে কেন?’
‘হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে গেছে। পাশে তাকিয়ে দেখি আপনি নেই।’
‘তাই খুঁজতে চলে এলে!’
‘হ্যাঁ।’
‘এত খোঁজার কারণ কী?’
অয়নন্দিতা পূর্বের মতোই তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি এনে জবাব দেয়,
‘যদি হারিয়ে ফেলি।’
‘হারানোর হলে সত্যিই হারিয়ে যাব একদিন। তার আগে হারিয়ে যাওয়া নিয়ে ভয় পেও না।’
কথাটা শুনে অয়নন্দিতার তার নিজের বাবা মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। তারাও তো একদিন হুট করেই হারিয়ে গিয়েছিল অয়নন্দিতার হাসিখুশি জীবন থেকে। ফারহানও বলছে হারিয়ে যাওয়ার কথা। বাবা মায়ের হারিয়ে যাওয়াটা মানতে অনেকটা সময় লেগেছে৷ এবার যদি ফারহান হারিয়ে যায় তাহলে হয়তো অয়নন্দিতা আর এই পৃথিবীতে ভালো মতো বেঁচে থাকতে পারবে না। হারিয়ে যাওয়ার কথা শুনলেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে তার। আল্লাহ পাক কি তবে সমস্ত হারিয়ে যাওয়া তার জন্যই রেখে দিয়েছে নাকি? অয়নন্দিতা তেমন কিছু না ভেবে হঠাৎই ফারহানকে জড়িয়ে ধরে। এই প্রথমবার সে ফারহানকে নিজ থেকে জড়িয়ে ধরে।
অয়নন্দিতা যে তাকে এভাবে হুট করে জড়িয়ে ধরবে সে ভাবেনি। এই ঘটনার পর ফারহান কয়েক সেকেন্ডের জন্য ব্ল্যাক আউট হয়ে গেছে। অয়নন্দিতার শরীরের গরম ভাবটা পুরোপুরিভাবে ফারহানকে আঁকড়ে ধরেছে। জড়িয়ে ধরার কয়েক মিনিট পর অয়নন্দিতা টের পায় তার শরীরে ফারহানের হাত পড়েনি। দুঃখ হলেও সেই দুঃখটা চেপে রাখতে সক্ষম হয় অয়নন্দিতা। তার লোভের মাত্রা দিন দিন যে বেড়ে যাচ্ছে তা সে বুঝতে পারছে। ভালোবাসার লোভ অত্যন্ত খারাপ জিনিস। পৃথিবীতে টাকা পয়সার লোভের থেকেও মারাত্মক হলো ভালোবাসার লোভ। এই লোভ খারাপ মানুষকে মুহুর্তের মধ্যেই ভালো মানুষে পরিণত করে আবার ভালো মানুষকে মুহুর্তের মধ্যেই ভয়ংকর করে তোলে।
নিজেকে ফারহানের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অয়নন্দিতা বলে ওঠে,
‘কাল তো অফিস আছে। ঘুমাতে চলুন।’
‘তুমি যাও। আমি কিছুক্ষণ পর আসছি।’
‘নাহ। কিছুক্ষণ পর না। এক্ষুনি চলুন।’
‘জোর খাটাচ্ছ মনে হচ্ছে।’
‘মনে হলে তা-ই। চলুন এখন।’
অয়নন্দিতা ফারহানকে ঘরে নিয়ে যায়।
‘শুয়ে পড়ুন। এরপর লম্বা একটা ঘুম দিন।’
‘তোমার শরীরের এখন কী অবস্থা অয়নন্দিতা?’
‘মাথা ব্যথা করছে।’
‘গলাটা তো একেবারেই বসে গেছে।’
‘সব একত্রে ধরল।’
‘তুমি শুয়ে পড়ো। আমি তোমার মাথাটা ম্যাসাজ করে দেই। দেখবে ভালো লাগবে।’
‘নাহ। লাগবে না। ঘুমিয়ে পড়ুন আপনি।’
অয়নন্দিতার পাশে শুয়ে পড়ে ফারহান। ততক্ষণে অয়নন্দিতার চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে গেছে। ফারহান নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারেনি। অয়নন্দিতা তার ব্যথাটা লুকিয়ে রাখলেও ফারহানের চোখ এড়ায়নি। ফারহান তার ডান হাত দিয়ে অয়নন্দিতার কপালের দুটো দিক ম্যাসাজ করা শুরু করে।
জানালা দিয়ে আসা ঘোলাটে আলোতে ঘুমন্ত অয়নন্দিতার চেহারাটা বড্ড বেশি মায়া মাখানো মনে হচ্ছে ফারহানের কাছে। হাতটা কপাল থেকে কখন যে অয়নন্দিতার গালে চলে আসে বুঝতে পারেনি।
ফারহান শুয়ে আছে অয়নন্দিতার পাশে। চোখে ঘুম নেই। মনটা বড়ো বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। তবে কি সে অয়নন্দিতার ভালোবাসায় পা রাখতে চলেছে?

চলবে………………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here