#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_২৯
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)
নীল হলুদে মিশ্রিত বাটিক শাড়িতে অয়নন্দিতাকে মাশা-আল্লাহ অপূর্ব লাগছে। শাড়ির উপরে মেরুন রঙের শালও জড়িয়েছে সে। অবশ্য শালটা সে পরতে চায়নি কিন্তু ফারহান তাকে শাল ছাড়া বেরও হতে দেয়নি। এই অসুস্থ শরীরে অয়নন্দিতাকে বাইরে বের করার অপরাধে তাকে বকা খেতে হবে। তার উপর যদি টের পায় অয়নন্দিতা শরীরে শাল জড়ায়নি তাহলে তো হয়েছেই। ফারহান জোর করেই শাল পরিয়ে দেয় অয়নন্দিতার।
নদীর পাড়ে বসে আছে দু’জন। অয়নন্দিতা তাকিয়ে আছে নদীর পানির দিকে। পাশে বসে ফারহানের নজর পানির দিকে না গিয়ে অয়নন্দিতার মুখশ্রী দেখতে ব্যস্ত।
ন্যুড রঙের লিপস্টিক মাখানো অয়নন্দিতার ঠোঁট জোড়া যেন প্রজাপতির ডানায় মতো লাগছে। কাজল বিহীন চোখ জোড়ায় যেন রাজ্য জয়ের আনন্দ। এত খুশি কেন অয়নন্দিতার চোখে। জানতে ভীষণ ইচ্ছা করছে ফারহানের। বলতে ইচ্ছে করছে, হ্যাঁ গো মেয়ে, রাজ্যের খুশি বয়ে বেড়াচ্ছে তোমার ওই শীতল চোখে। এর রহস্য কী। কিন্তু আফসোস, সে মুখ খোলার আগেই অয়নন্দিতা ঘাড় ফিরিয়ে ফারহানের দিকে তাকায়। আচমকা তাকাতেই ফারহানও ভড়কে যায়। সে যে এতক্ষণ ধরে একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখছিল অয়নন্দিতাকে সেই বিষয়টা তো ধরা পড়ে গেল।
মলিন হাসি দিয়ে অয়নন্দিতা বলে,
‘আমার ভীষণ ভালো লাগছে জানেন তো। মনে হচ্ছিল আমি দম বন্ধ হয়ে মরেই যাব। কী এক অসুস্থতা ভর করল আর আমি একেবারেই ঘরবন্দী হয়ে গেলাম। একটু বাইরে বের হওয়ার জন্য মনটা ছটফট করছিল আমার।’
ছোটো বাচ্চারা যেমন বায়না করা খেলনাও পেলে আনন্দ পায় হয়তো অয়নন্দিতার আনন্দটাও তেমন। ফারহান এক গাল হেসে চোখ থেকে সানগ্লাসটা সরায়।
‘তোমার ভালো লাগছে সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু আমায় যে আজ বকুনি খেতে হবে। তখন কি আমায় বাঁচাবে?’
‘বকুনি খাবেন কেন?’
‘কেন খাব না, এইযে অসুস্থ মানুষটাকে নিয়ে বের হলাম। মা এতক্ষণে হয়তো টের পেয়ে গেছে। আমায় ফোন করল বলে। কথাটা বাবার কানেও যাবে। এরপর দু’জন মিলে বকবে আমায়। সাথে ওই দুই সাগরেদ একজন সাজি ম্যাডাম অন্যজন ফারাশ স্যার। তারাও তালে তাল দেবে।’
অয়নন্দিতা খিল খিল করে হেসে ওঠে। বলে,
‘বেশ হবে। আমি বলব, আমি আমি বের হতে চাইনি। তিনিই আমায় জোর করে বের করিয়েছেন।’
‘এইভাবে মিথ্যা বলতে পারবে তুমি, তাও আবার আমার নামে। আমায় যখন বকবে কষ্ট হবে না তোমার?’
অয়নন্দিতার হাসিটা মলিন হয়ে যায়। ভাবে৷ ঠিকই তো, তারই তো ইচ্ছা ছিল বাইরে বের হওয়ার। ফারহান শুধু সাহায্য করেছে তাকে। এখন তো ফারহানকেই বকা শুনতে হবে। ফারহান হাসিমুখে অয়নন্দিতাকে দেখছে। অয়নন্দিতা যে কিছু ভাবছে সেটাও ফারহান জানে।
‘যা ভাবছ আর ভেবে কাজ নেই। আমার বউয়ের জন্য এতটুকুন বকা হজম করার মতো শক্তি আমার আছে। কেমন?’
আমার বউ– শব্দটা শুনে অয়নন্দিতার ভেতরটা ছ্যাত করে ওঠে। ফারহান নিজের মুখে বলল আমার বউ। অয়নন্দিতার শরীরটা যেন মুহুর্তেই শীতল বাতাসে জুড়ে গেল। চারদিকে তাকাতে লাগল সে। হিম বাতাস বইছে।
ফারহান সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। পাশেই ফুচকার দোকান। সে জানে অয়নন্দিতার ফুচকা ভীষণ পছন্দ। ফারহান এক প্লেট ফুচকার অর্ডার দিয়ে দেয়। এর আগে ফারহান কখনও রাস্তার পাশে দাঁড়ায়নি আর সেই ফারহান এখন অয়নন্দিতার সাথে বসে ফুচকা খায়। সময়গুলো বড্ড বেশি পরিবর্তনশীল। আগের মানুষটাকে ভালোবেসেও পূর্ণতা পায়নি ফারহান। আর এই মানুষটাকে ভালো না বেসেও পূর্ণতা পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। একদম সাধারণ জীবন যাপনেও যে এত পূর্ণতা তা আগে বুঝতে পারেনি ফারহান। হয়তো এই বোঝানোর ক্ষমতাটা আগের মানুষটার মধ্যে ছিল না। তাই তো সে না পেরেছে ভালোবাসায় পূর্ণতা দিতে না পেরেছে ফারহানকে এই ছোটো ছোটো আনন্দের মূল্য বোঝাতে।
শীতের বিকেলটা অনুভব করতে পেরে মুচকি হাসে অয়নন্দিতা। পড়ন্ত বিকেলে ঠান্ডা ভাব আর রোদের উঁকি ঝুঁকির খেলাটা তার বরাবরেরই পছন্দ। আজ অসুস্থ শরীরর আরও ভালো লাগছে।
নীরবতা পালন করে ফারহানও পাশেই হাঁটছে অয়নন্দিতার। এত সুন্দর পরিবেশে নীরব থাকতে মোটেই ভালো লাগছে না তার। প্রাণ খুলে কথা বলতে পারলে ভালো হতো। কিছুটা পথ গিয়েই অয়নন্দিতা বলতে শুরু করে,
‘আপনি চুপ কেন?’
প্রশ্নটা ফারহানের কানে যেতেই মুখ তুলে তাকায় সে।
‘তুমি তো কিছুই বলছ না। তাই আমিও চুপচাপ।’
‘আমি তো ভাবলাম আপনি আমার উপর ক্ষেপে আছেন।’
‘এমনটা ভাবার কারণ কী?’
‘সব থেকে বড়ো কারণ আপনার অনেকটা সময় খরচ হয়ে গেছে। এই সময়টুকুন অফিসের কাজে লাগাতে পারতেন। আমার জন্য শুধু শুধু এখন হাঁটতে হচ্ছে আপনাকে।’
‘আমার হাঁটতে খারাপ লাগছে না। আর সময় খরচের কথা বললে তো, তাহলে তুমি বোধ হয় একটা কথা ভুলে গেছ।’
কিঞ্চিৎ অবাক হয় অয়নন্দিতা। প্রশ্ন করে,
‘কোন কথা ভুলে গেলাম আমি।’
‘মনে করে দেখ।’
‘উমমম,,, নাহ মনে তো পড়ছে না। কোন কথা ভুলে গেছি আমি।’
ফারহান হালকা হেসে বলতে শুরু করে,
‘চলার পথে কাটা থাকবে। অনেক সময় পায়েও বিঁধবে। ব্যথাও লাগবে, রক্তও ঝরবে। তবুও এগিয়ে যেতে হবে। সত্যিকারের ভালোবাসা ধরা পড়বেই। একদিন আগে হোক আর একদিন পরে হোক। আপনার ভালোবাসা থেকে খানিকটা ভালোবাসা আমার পেছনে ইনভেস্ট করতে পারেন। লাভ না হলেও লস হবে না আশা করি — এই কথাটা কেউ একজন আমায় বলেছিল। আফসোস যে বলেছিল সে-ই আজ ভুলে গেছে।’
অয়নন্দিতার মনে পড়ে যায়। রাঙামাটি গিয়ে একদিন বিকেল বেলা সে নিজেই ফারহানকে বলেছিল এই কথাটা। সেদিন কথার মারপ্যাঁচেই হোক আর একটু ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়েই হোক ফারহানকে নিজের মনের কথাটা বলেছিল অয়নন্দিতা। কিন্তু ফারহান আজকে হঠাৎ সেই কথাটা এখন বলল কেন? এদিকে অয়নন্দিতাকে চুপ থাকতে দেখে ফারহান বলে,
‘এবার মনে পড়েছে?’
‘একদিন বলেছিলাম বোধ হয়।’
‘বোধ হয়!’
ফারহানের রিয়েকশন দেখে অয়নন্দিতা হেসে দেয়।
‘কিন্তু সেই কথাটা এখানে কেন এলো।’
‘যেভাবে তুমি খরচের কথাটা এনেছ সেভাবেই এই কথাটাও এলো।’
‘আমি না অবাক হলাম অন্য বিষয়ে।’
‘কোন বিষয়ে?’
‘এইযে আপনি আমার বলা হুবুহু কথাটা বললেন। আপনার ব্রেইন অনেক শার্প।’
‘তাহলে ভাবো, আমি কত ব্রিলিয়ান্ট।’
‘হয়েছে হয়েছে, এখন বলুন তো কথাটা এখানে কেন এলো।’
‘ধরে নাও আমি আমার ভালোবাসার খানিকটা তোমার পেছনে ইনভেস্ট করতে চাচ্ছি। কতটা প্রফিট হবে জানি না। তবে এতটুকুন আমিও শিওর আছি যে, অধিক লাভ না হলেও লস একেবারেই হবে না।’
ফারহানের কথাটা শুনে অয়নন্দিতার পা জোড়া চলতি পথেই থেমে যায়। ফারহানও কি তবে তার দিকে অগ্রসর হচ্ছে? অয়নন্দিতার মায়াবী চোখে চেয়ে থাকা ফারহানের হৃদয়ে এক উষ্ণ অনুভূতি অনুভব হয়। এই চোখ জোড়া যেন বলে দিচ্ছে গভীর ভালোবাসার কথা। এই চোখ জোড়া যেন জানান দিচ্ছে অজানা পথে হারিয়ে যাওয়ার বার্তা।
চলবে………………………….