দ্বিতীয়_সূচনা পর্ব_৩০

0
1363

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৩০
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

বাড়িতে পা রাখতেই রওশন বেগম, সাজি এবং রমজান শেখ-এর সামনে পড়ে ফারহান আর অয়নন্দিতা। তারা তিনজন ড্রইংরুমেই বসে ছিল। ফারহান আর অয়নন্দিতাকে দেখে তিনজনের মুখেই হালকা হাসি। রওশন বেগম বসা থেকে উঠে অয়নন্দিতার কাছে যান। ছেলের বউকে আঁকড়ে ধরেন। কপালে হাত দিয়ে চেক করেন জ্বর আছে কি না।
শাশুড়ি মায়ের এই ভালোবাসাটুকুই অয়নন্দিতাকে এখন আর মায়ের অভাব বুঝতে দেয় না। শ্বশুর মশাইয়ের স্নেহটুকুই অয়নন্দিতাকে এখন আর বাবার অভাব বুঝতে দেয় না। সাজির বোনের মতো আচরণটুকু অয়নন্দিতাকে এখন আর একাকীত্ব বুঝতে দেয় না।
আর ফারহান, তার কিছুটা ভালোবাসা বাকিটা বন্ধুত্বসুলভ আচরণ তাকে দ্বিধায় ফেলতে বাধ্য করে, ফারহান কি তাকে ভালোবাসে নাকি কখনও ভালোবাসতে পারবে না নাকি তাদের দু’জনকে সারাজীবন বন্ধু হয়েই কাটাতে হবে?
অয়নন্দিতা তার শাশুড়ি মায়ের পাশে গিয়ে বসে। ছেলের বউয়ের মাথায় হাত রেখে রওশন বেগম বলেন,
‘এই অসুস্থ শরীরে বাইরে যাওয়ার কী দরকার ছিল অয়নন্দিতা? এখন যদি শরীরটা আরও খারাপ হয়, তখন কী হবে?’
অয়নন্দিতা কিছু বলতে যাবে তখনই ফারহান বলে,
‘তোমার বউমাকে অত্যন্ত সাবধানেই রেখেছি মা। চিন্তা কোরো না, কিছু হবে না ইনশাআল্লাহ।’
‘আরও কিছুদিন পর বের হলেই ভালো হতো।’
‘অসুস্থ বলে কি একটু ঘুরতে পারবে না বেচারি? তার কথাতেই বোঝা যাচ্ছিল যে, সে বোর হচ্ছে। তাই ভাবলাম আমিও যখন ফ্রী আছি একটু বের হই ওকে নিয়ে।’
রমজান শেখ ছেলের কথায় সমর্থন জানিয়ে বলেন,
‘এইভাবে ঘরবন্দী থাকলে আরও অসুস্থ হয়ে যাবে। এর চেয়ে বরং একটু আধটু ঘুরবে। এটাই ভালো।’
সামনা-সামনি বসাতে দু’জন দু’জনকে সরাসরিই দেখতে পাচ্ছে। অয়নন্দিতার অবাক চোখ ফারহানকে দেখে যাচ্ছে আর ফারহানের চোখ অয়নন্দিতার চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করছে। চোখ জোড়া গভীর ভালোবাসার জানান দিচ্ছে ফারহানকে। তাদের এই চোখাচোখিতে ভাব বিনিময় তৃতীয় ব্যক্তির চোখে পড়ে। সাজি একদিকে মোবাইল ফোনে ব্যস্ত, আবার অন্যদিকে ভাই-ভাবীকে দেখতে ব্যস্ত। চোখের সামনে এদের দু’জনকে দেখলে ঠোঁটের কোণে অটোমেটিকলি হাসি চলে আসে। সাজি এই ভেবেই খুশি যে তার ভাইটা আস্তে আস্তে এই সম্পর্কের প্রতি স্বাভাবিক হচ্ছে।

ফারহান এবং রমজান শেখ স্টাডি রুমে চলে যান। রওশন বেগমকে দু’কাপ চা পাঠাতে বলেন রমজান শেখ। ব্যবসা নিয়ে কিছু আলাপ আলোচনায় বসবেন বাবা-ছেলে। এই বাড়িতে আলাদা করে একটা স্টাডি রুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে যেখানে একান্তে বসে অফিসের কাজগুলো করা যায়। প্রথমে রমজান শেখ এই স্টাডি রুমে কাজ করতেন। আর এখন বাবা এবং ছেলে দু’জনেই বসেন এই রুমে। কিছুদিন পর হয়তো আরও একজন বসবেন। যিনি এখনও ঘুরে বেড়াতেই ভালোবাসেন। রমজান শেখ ফারহানকে বার বার বলছেন ফারাশকে ব্যবসা বুঝিয়ে দিতে কিন্তু ফারহান চায় ফারাশ আরও কিছুটাদিন ঘুরেফিরে কাটাক। এরপর তো সারাজীবন ব্যবসা-ই সামাল দিতে হবে।
খানিক বাদেই দু’কাপ চা নিয়ে স্টাডি রুমে হাজির হয় অয়নন্দিতা। চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে অয়নন্দিতাকে এইভাবে আশা করেনি ফারহান। রমজান শেখ হাসিমুখে বলেন,
‘তুমি নিয়ে আসলে কেন মা, বুয়া কোথায়?’
অয়নন্দিতা হালকা হেসে জবাব দেয়,
‘বুয়া কিচেনে অন্য কাজে ব্যস্ত আছে বাবা। তাই আমিই নিয়ে এলাম।’
‘আচ্ছা।’
বাবার চোখের আড়ালে ফারহান আড়চোখে অয়নন্দিতাকে দেখছে। অয়নন্দিতা চায়ের ট্রে-টা টেবিলের ওপর রেখে দরজা অবধি চলে গিয়েও পেছনে ফিরে তাকায়। মন বলছিল ফারহান হয়তো তার দিকে তাকিয়ে আছে। মনের কথাটাই সত্যি হয়েছে। পেছনে তাকিয়ে ফারহানের চোখে চোখ পড়ে তার। হালকা হেসে ঘাড়টা নিচু করে রুম থেকে বের হয়ে যায় অয়নন্দিতা। ফারহান কিছুক্ষণের জন্য যেন ফ্রিজড হয়ে যায়। অয়নন্দিতার এই রুপটা আগে কখনও দেখেনি সে কিংবা দেখা হয়নি। লুকায়িত সেই রুপটা আজ দেখে নিজের ইমোশনকে কন্ট্রোল করতে হিমসিম খেতে হচ্ছে ফারহানকে। আরও কিছুটা সময় অতিবাহিত করতে ইচ্ছে করছে অয়নন্দিতার সঙ্গে। কিন্তু আপাতত সে রমজান শেখের সঙ্গে আছে। চাইলেই এখান থেকে বের হওয়া যাবে না।
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। অয়নন্দিতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। রাত আটটা অবধি মনটা ভালো থাকলেও আটটার পর থেকেই মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেছে অয়নন্দিতার। ফারহান বলেছিল রায়ে আর বের হবে না, কিন্তু তবুও সে বের হয়েছে। চল্লিশ মিনিট স্টাডি রুমে অতিবাহিত করে ঘরে এসেই শার্ট চেঞ্জ করে বের হয়ে যায় ফারহান। অয়নন্দিতা সাহস করে একবার জিজ্ঞেসও করেছিল ফারহানকে। ফারহান হাসিমুখে জবাব দেয়, একটা জরুরী কাজ পড়েছে। ঘন্টা খানেকের মধ্যে চলে আসব। একত্রে খাবার খাব এসে।
কিন্তু ঘন্টা খানেক হয়ে আরও দুই ঘন্টা অতিবাহিত হয়ে গেছে। ফারহান এখনও আসছে না। কয়েকবার ফোনও করেছিল কিন্তু ফারহান ফোনটা রিসিভ করেনি। আকাশে মেঘ জমেছে। এমনিতেই হালকা শীত পড়ছে। তার উপর যদি বৃষ্টি হয় তাহলে তো আর কোনো কথাই রইল না।
অয়নন্দিতার চোখ জোড়া বাড়ির বড়ো ফটকের দিকে। কখন একটা গাড়ি বাড়ির ভেতরে ঢুকবে সেই অপেক্ষায় আছে সে। এদিকে ক্ষুধাও লেগেছে ভীষণ। রাতের খাবার খাওয়ার সময় খাবার টেবিলে সবাই জোর করেছিল তাকে। বলেছিল খেয়ে নিতে সবার সঙ্গে। কিন্তু অয়নন্দিতা জানে খাবার তার গলা দিয়ে নামবে না। কারণ, ফারহান বলে গিয়েছে এসে একত্রে খাবার খাবে। তাই অয়নন্দিতা পরে খাব বলে সেখান থেকে সরে যায়। অপেক্ষায় আছে ফারহানের। কখন সে আসবে আর কখন তারা দু’জন এক সঙ্গে খাবার খাবে।
দরজায় টোকা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অয়নন্দিতা দৌড়ে ঘরের ভেতর চলে আসে। ভেবেছে ফারহান এসে গেছে। ফারহানকে মনের মধ্যে এতটাই বসিয়ে নিয়েছে যে, বোকা মেয়ে বেমালুম ভুলে গেছে যে বাড়ির ভেতরে কোনো গাড়ি-ই ঢুকেনি। ফারহান তো গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিল। ঘরে এসে অবাক হয় অয়নন্দিতা। ফারহান না দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ফারাশ। এত রাতে ফারাশকে ঘরে দেখে অনেক কিছুই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল অয়নন্দিতার। ফারাশও বুঝতে পেরেছে তার ভাবী হয়তো এখানে অন্য কাউকে আশা করেছিল। অয়নন্দিতাকে কমফোর্ট জোনে রাখার জন্য মুখে হাসি আনে ফারাশ।
‘ভেতরে আসতে পারি?’
ফারাশের প্রশ্ন শুনে আরও অবাক হয় অয়নন্দিতা। অবাক হয় এই ভেবে যে, তাদের বাড়ি তাদের ঘর অথচ ফারাশ অনুমতি নিচ্ছে সে ভেতরে আসবে কি না। অয়নন্দিতা সঙ্গে সঙ্গে ফারাশকে ভেতরে আসতে বলে। ফারাশ সোফায় বসতে বসতে বলে,
‘বারান্দায় ছিলে বুঝি?’
‘জি।’
‘ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলে?’
উত্তরটা হ্যাঁবোধক হলেও অয়নন্দিতার উত্তর দিতে অস্বস্তি হচ্ছিল তাই চুপ করে আছে সে। ফারাশ এইবারও অয়নন্দিতার না বলা কথাটুকু বুঝে নেয়।
‘খাবারও তো খেলে না দেখলাম।’
‘ক্ষুধা লাগেনি।’
‘ক্ষুধা লাগেনি নাকি ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করছ?’
এইবারের উত্তরটাও হ্যাঁবোধক। কিন্তু এইবারও চুপ অয়নন্দিতা। আর এইবারও ফারাশ বুঝে নেয়।
‘ভাইয়া চলে আসবে। টেনশন নিও না। ভাইয়া না আসা পর্যন্ত আমরা কথা বলি। কেমন?’
‘আচ্ছা।’
‘তুমি কিন্তু আমার ছোটো।’
‘হ্যাঁ। জানি আমি।’
‘কিন্তু সম্পর্কে বড়ো। এখন তুমিই বলো তোমায় কী বলে ডাকব। ভাবী নাকি অন্য কিছু?’
‘যেভাবে ডাকলে আপনার সুবিধা হবে।’
‘এই ওয়েট ওয়েট, আমি তোমার বড়ো তবে এতটাও বড়ো নই। আর সম্পর্কে আমি তোমার দেবর, ভাসুর নই। সো আপনি আজ্ঞে কোরো না। আপনি থেকে তুমিতে ট্রান্সফার হও।’
‘কিন্তু,,,’
‘কিন্তু টিন্তু বাদ। ট্রান্সফার লেটার আগামীকাল নিয়ে আসব।’
ফারাশের কথা শুনে অয়নন্দিতা না চাইতেও হেসে দেয়। অয়নন্দিতার হাসি দেখে ফারাশও হাসে। ফারহান আর ফারাশের হাসিটা প্রায় এক রকম। ফারহানের মতো ফারাশও বেশ সুদর্শন। বিয়ের এতদিন পরও তাদের মধ্যে তেমন কথা হতো না। ফারাশ তার বন্ধু বান্ধবী নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এখানে সেখানে ট্যুর দেয়। সেইসব নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাই তেমন কথা এবং দেখা হতো না তাদের। আজ কী মনে করে ফারাশ নিজ থেকেই এই ঘরে এসেছে কে জানে।
অয়নন্দিতাকে ফারাশ আবারও প্রশ্ন করে,
‘বললে না তো তোমায় আমি কী বলে ডাকব?’
‘যা ডেকে তুমি কমফোর্ট ফিল করো।’
‘ভাবী ডাকতে আন-কমফোর্ট লাগে। অয়নন্দিতাও বড়ো নাম। অভ্যস্ত নই আমি। ছোটো একটা নাম দিতে হবে তোমার।’
ফারাশ বেশ মজার মজার কথা বলে। তার কথা শুনে মানুষকে না চাইতেও হাসতে হয়। অয়নন্দিতা হেসে বলে,
‘তবে একটা ছোটো নাম দিও৷’
‘ওকে রাজরানী।’
‘রাজরানী! আমি রাজরানী!’
‘হ্যাঁ। ভেবে নাও এটা আমাদের ছোটো একটা রাজ্য। এই রাজ্যের মহারাজা হচ্ছেন রমজান শেখ আর মহারানী রওশন বেগম। তাদের দু’জন রাজকুমার একজন রাজকুমারী। বড়ো রাজকুমারের বধূ তুমি। তাহলে তুমি তো রাজরানী-ই হলে। তাই না।’
অয়নন্দিতা গালে হাত দিয়ে ফারাশের কথাগুলো শুনে গেল। কীসব রাজ্য, মহারাজ, রাজকুমারের গল্প বলল। ফারাশ চেয়ে আছে অয়নন্দিতার দিকে। মেয়েটাকে বেশ ভালো লাগে তার কাছে। বিশেষ করে তার চোখ জোড়া ফারাশকে বেশ ভাবাচ্ছে। যেন রাজ্যের রহস্য লুকিয়ে আছে ওই দুটো চোখে। ফারাশ ভাবে, এই মেয়েটাই পারবে তার ভাইয়ের যন্ত্রণাগুলোকে ধীরে ধীরে কমিয়ে দিতে। হুট করেই ফারাশ বলে ওঠে,
‘ব্যাস, পেয়ে গেছি নাম। তোমায় আমি রাজরানী বলে ডাকব। সকালে সাজিকেও বলব যাতে ও তোমায় রাজরানী বলে ডাকে।’
‘রাজরানী, কেমন একটা মুঘল আমলের মতো শোনাচ্ছে না?’
‘নো সমস্যা। শোনালে শোনাক। তুমি আমাদের এই ছোটো রাজ্যের রাজরানী।’
‘তোমার রানী কবে আসবে?’
‘হা হা, আগে এই রাজকুমার নিজের পায়ে দাঁড়াক।’
‘এখন কী অন্যের পায়ে দাঁড়িয়ে আছো?’
ফারাশ জবাব দিতে যাবে ওমন সময় ফারহান ঘরে ঢোকে। এই সময় ফারাশকে নিজের ঘরে অয়নন্দিতার সঙ্গে দেখে ফারহানের ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে যায়। ফারাশ এবং অয়নন্দিতা উভয়ের নজর পড়ে ফারহানের দিকে। এতক্ষণ পরে অয়নন্দিতার স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে। তার সামনে যে ফারহান দাঁড়িয়ে আছে। বড়ো ভাইকে দেখে ফারাশ বলে,
‘রাজকুমার হাজির।’
ফারহান ভেতরে প্রবেশ করে বলে,
‘কী ব্যাপার! ফারাশ সাহেব কি রাস্তা ভুলে আমার ঘরে ঢুকে পড়েছে নাকি?’
‘আজ্ঞে না। আপনি এত দেরি করে এলেন। রাজরানী তো আপনার প্রতিক্ষায় ফটকের দিকে চোখ মেলে তাকিয়ে ছিল। তাই, এই অধম রাজরানীর মনটা ভালো করার জন্য বকবক করছিল।’
‘কীসব যে বলিস মাঝে মাঝে।’
‘যা বলি ভালোই বলি৷ রাজরানী তোমার অপেক্ষা করতে করতে রাতের খাবারটাও খায়নি। ফ্রেশ হয়ে দু’জন মিলে রাতের খাবারটা খেয়ে নাও।’
ফারাশের কথা শুনে ফারহান অয়নন্দিতার দিকে তাকায়। মনে পড়ে সে বলে গিয়েছিল, সে আসলে দু’জন একত্রেই খাবে। বারোটার বেশি বেজে গেছে। ভেবেছিল কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করতে পারবে৷ কিন্তু এত দেরি হবে বুঝতে পারেনি।
ফারাশ বিদায় নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। ফারহান অয়নন্দিতার কাছে চলে আসে। দুই হাত দিয়ে অয়নন্দিতার বাহু জোড়া আঁকড়ে ধরে। হালকা হেসে বলে,
‘তুমি ডাইনিংয়ে খাবার দাও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। কেমন?’
অয়নন্দিতা এক গাল হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। ফারহান ওয়াসরুমে চলে গেলে অয়নন্দিতাও নিচে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হয়।

চলবে…………………………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here