#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৪১
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)
গলাটা কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছে। পানিও যেন আটকাচ্ছে। অয়নন্দিতা বহু কষ্টে নিজের ইমোশনকে কন্ট্রোল করছে। ফারহান যখন থেকে বলেছে এই ফার্ম হাউজটা বন্দনার কথা ভেবেই বানানো হয়েছে তখন থেকেই বুকে ব্যথা অনুভব হচ্ছে তার। ব্যথাটা এইজন্য হচ্ছে না যে ফার্ম হাউজটা বন্দনার জন্য বানানো হয়েছে। ব্যথাটা এইজন্য হচ্ছে যে একটা মানুষ একটা মানুষকে কতটা ভালোবাসলে একটা স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিতে পারে। অন্যকে ভালোবাসার এমন অসাধারণ ক্ষমতা এই মানুষটার এত বেশি যে অপর মানুষটা বাধ্য হয় তার প্রেমে পড়তে। তবে তার সাথেই কেন এমন হলো। কোথায় আছে বন্দনা? অয়নন্দিতা ভাবছে, আদৌ আছে তো? অয়নন্দিতা একটা ব্যাপারে বেশ অবাক হয়। ওই বাড়িতে এই পর্যন্ত কেউ একবারের জন্যেও বন্দনাকে নিয়ে কথা বলে না। এমন কি সাজিও না।
দূরত্ব বজায় রেখে ফারহান বসেছে। অয়নন্দিতা চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। দু”ফোঁটা অশ্রু মুছে নিয়ে তাকায় ফারহানের দিকে। ফারহান তখনও সিগারেট ফুঁকছে। ফারহানও নীরবতা পালন করছে। মনে মনে নিজেও গিলটি ফিল করছে ফারহান। ভাবছে অয়নন্দিতা কষ্ট পেলো না তো। হুট করে বন্দনার কথাটা বলা উচিত হয়নি। বুকটা জ্বালা করছে। চিনচিন ব্যথা করছে। আজও বন্দনার জন্য মন কেমন করে। তবে এই অনুভূতি সে কাউকে দেখায় না। বুঝতেও দেয় না। বন্দনা যে তার দুর্বলতা ছিল তা কারো চোখে পড়ার আগেই নিজেকে সামলে নেয়।
অয়নন্দিতার দিকে নজর যায় তার। জীবনের কঠিন মুহুর্তগুলো কীভাবে যে পার করেছে একমাত্র সে-ই বোঝে। একটা নির্দিষ্ট গন্ডির মাঝে নিজেকে বন্দী করে রেখেছিল। কিন্তু এসবের মাঝে হুট করেই তার জীবনে অয়নন্দিতা প্রবেশ৷ প্রথম প্রথম বেশ অসুবিধা হতো ফারহানের। ধীরে ধীরে সব ঠিক হতে থাকল। অয়নন্দিতার সব কিছুই তার ভালো লাগে। অয়নন্দিতার কথাবার্তা, চলাফেরা, মুচকি হাসিটাও এখন তার প্রিয়। ফুচকা খেয়ে ঝাল সহ্য করতে না পেরে চোট পিটপিট করাও ফারহানের ভীষণ পছন্দের। সে মনে করে অয়নন্দিতার শরীর থেকে এক অদ্ভুত সুবাস ছড়ায়৷ অয়নন্দিতার চুলেও মাতাল করা সুবাশ আছে যা রাতের বেলায় ফারহানকে আকর্ষণ করে। তবে এত কিছুর পরেও
কেন বন্দনাকে সে ভুলতে পারে না। এই ভুলতে না পারা-ই ফারহানকে যন্ত্রণা দেয়। যেই যন্ত্রণাটা তাকে নিংড়ে নিংড়ে মারছে প্রতিনিয়ত।
অনেকক্ষণ কেটে যায়। প্রায় চল্লিশ মিনিট। ফারহান নিজেকে স্বাভাবিক করে উঠে দাঁড়ায়। অয়নন্দিতা ততক্ষণে বসা থেকে উঠে রেলিংয়ে গিয়ে দাঁড়ায়। ফারহান ধীর পায়ে অয়নন্দিতাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। নিজের শরীরে ফারহানের স্পর্শ অনুভব করতে পেরে অয়নন্দিতা বার কয়েক ঢোক গিলে নিজেকে আগের তুলনায় আরও স্বাভাবিক করে। ভাগ্যিস চোখের পানিগুলো আরও আগেই মুছে নিয়েছিল। ফারহান অয়নন্দিতার বাম কাঁধে নিজের মাথা রাখে। প্রশ্ন করে,
‘কী হলো, চুপ হয়ে গেলে যে।’
ফারহানের কথার জবাব দিতে ইচ্ছে করছে না। কারণ, এখন কথা বলতে গেলেই ফারহান তার কন্ঠস্বর শুনে বুঝে যাবে যে সে কান্না করছিল। তাই চুপ থাকাকেই শ্রেয় মনে করে অয়নন্দিতা। নীরবতা পেয়ে ফারহান বলে,
‘তুমি কেঁদেছ। আমি বুঝতে পেরেছি৷ তাই ধরা পড়ার ভয়ে কথা বলবে না এমনটা ভেব না অয়নন্দিতা। কথা বলো আমার সঙ্গে। তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালো লাগে। ভীষণ ভালো লাগে।’
অয়নন্দিতা চমকে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। ফারহান তাকে এতটা চমকে দেবে সেটা সে ভাবেনি। লাইটের স্বল্প আলোতে ফারহানের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে অয়নন্দিতা। ফারহান দেখছে অয়নন্দিতার চোখ চিক চিক করছে। স্বচ্ছ চোখ জোড়া একদম স্পষ্ট। অয়নন্দিতার চোখে নিজের ছবি দেখতে পাচ্ছে ফারহান। ভ্রু জোড়া উঁচিয়ে অয়নন্দিতাকে ইশারা করলে অয়নন্দিতা চোখের পলক ফেলে। ফারহান অয়নন্দিতার গাল জোড়ায় নিজের হাত রাখে। ধীর কন্ঠে প্রশ্ন করে,
‘মন খারাপ করে দিলাম তোমার৷ তাই না?’
অয়নন্দিতা ঘাড়টা বাঁকা করে ফারহানের হাতে চুমু দিয়ে বলে,
‘উহু।’
‘তবে চুপ ছিলে যে?’
‘এমনি।’
‘কেঁদেছ কেন?’
প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না বলে মাথাটা নুয়ে রাখে অয়নন্দিতা। ফারহান মাথাটা তুলে নিজের মুখের সামনে ধরে।
‘বলো, কেঁদেছ কেন?’
‘ভেতরটায় একটা ব্যথা অনুভব হচ্ছিল। তাই কান্না পেয়েছে।’
‘আমায় নিয়ে ভাবছিলে। তাই ব্যথা অনুভব হয়েছে। তাই তো?’
‘হ্যাঁ। বুঝলে কী করে?’
অয়নন্দিতার প্রশ্নে ফারহান চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকে তার চোখের দিকে। এরপর বলে ওঠে,
‘আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন
তোমাতে করিব বাস
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনি, দীর্ঘ বরস-মাস’
অয়নন্দিতা ফারহানের মুখে গান শুনে নিজেও পরের লাইন ধরে,
‘যদি আর কারে ভালবাসো
যদি আর ফিরে নাহি আসো
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও
আমি যত দুঃখ পাই গো’
অয়নন্দিতার মুখ থেকে গানটা শোনার পর ফারহান জবাব দেয়,
‘আমি আর কাউকে ভালোবাসি না৷ আমার ভালোবাসার মানুষ একজনই। আর সে হচ্ছে তুমি। মিসেস অয়নন্দিতা শেখ।’
এরপরই ফারহান অয়নন্দিতাকে জড়িয়ে নেয় নিজের বুকে। অয়নন্দিতা ঠান্ডা নিঃশ্বাস ছেড়ে ফারহানকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘আমি কখনও জানতে চাইনি বন্দনা সম্পর্কে। আজ যদি তোমায় বলি, আমায় বন্দনার গল্প শোনাও। শোনাবে আমায়?’
‘তোমায় আমি যতটা বন্ধু ভাবি তার থেকেও তোমায় আমি ভালোবাসি। হয়তো তুমিও আমায় ভালোবাসো। তোমার কষ্ট হবে অয়নন্দিতা।’
‘কতটা কষ্ট হবে?’
‘হয়তো অনেকটা।’
‘এখনও ভালোবাসো বন্দনাকে?’
‘বন্দনাকে ভালোবাসি না এটা শিওর থাকো। কিন্তু বন্দনাকে ভুলতেও পারি না।’
‘ভুলতে না পারার কারণ কী?’
‘কিছু স্মৃতি।’
‘ভালোবাসার নাকি বিষাদের?’
‘কষ্টের।’
অয়নন্দিতার নাকে লেবুর ঘ্রাণ আসছে। লেবুর কড়া ঘ্রাণে অয়নন্দিতার নাক ভারী হয়ে আসছে। মাথা তুলে সে ফারহানকে বলে,
‘বাতাবি লেবুর ঘ্রাণটা কত্ত সুন্দর। আশেপাশে গাছ আছে নাকি?’
‘হ্যাঁ। অনেকগুলো লেবু গাছ আছে। কাল সকালে দেখতে পাবে।’
অয়নন্দিতা আবারও বলে,
‘শোনাবে না আমায় বন্দনার গল্প।’
অয়নন্দিতার আবদারে ফারহান শান্ত দৃষ্টিতে দেখতে থাকে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয় নারীটিকে। যে অনেক সময় কিছু না বলেও অনেক কিছু বলে যায়। যার চোখে তাকালে ঝর্নার জলস্রোত দেখা যায়। যে পানি হয় পবিত্র এবং স্বচ্ছ।
চলবে…………………………….