দ্বিতীয়_সূচনা পর্ব_৪৭

0
1635

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৪৭
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

নিজেকে যতটা সম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করছে ফারহান। কিন্তু শান্ত রাখতে পারছেই না। তার ইচ্ছা করছে পুরো অফিসটা তছনছ করে ফেলতে। রমজান শেখ অর্থাৎ তার বাবা যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটাতে তার মত নেই। সে চায় পুরো অর্ডারটাই ক্যান্সেল করে দিতে। কারণ, সে জানে এখানে ঝামেলা হবে। রমজান শেখ কেবিনে এসে ছেলের মুখোমুখি বসেন।
‘ফারহান, তোমার কোথায় সমস্যা হচ্ছে?’
‘তুমি জানো না সমস্যা কোথায়?’
‘এই সমস্যার জন্য দায়ী কে? আমি নাকি আমরা নাকি তুমি?’
‘বাবা, আমি চাই না এই অর্ডার অনুযায়ী আমরা কাজ করি।’
‘ভুলে যেও না ফারহান, এখানে আমার সম্মান জড়িত।’
‘বাবা, সম্মান আরও যাবে। এদের সঙ্গে কাজ করা মানে এরা সব শেষ করে দিবে।’
‘এদের সঙ্গে রেগুলার ক্লাইন্টদের সাথে ঝামেলায় জড়াতে চাই না আমি।’
বাবাকে কিছুতেই বোঝাতে পারছেন না ফারহান। ভালো হবে না, কিছু ভালো হবে না। মন চাইছে সব ছেড়েছুড়ে চলে যেতে।

সাজিকে নিয়ে বের হয়েছে অয়নন্দিতা। শপিংমলে অন্যদিনের তুলনায় আজ একটু বেশিই ভিড়। সাজি কিছু ড্রেস কিনবে। অয়নন্দিতাও তার প্রয়োজনীয় কিছু নেবে। সেই উদ্দেশ্যেই আসা। এস্কেলেটরে উঠেই অয়নন্দিতার দেখা হয়ে যায় তার বান্ধবীর সঙ্গে। সাজি তাদের স্পেস দিয়ে অন্য দোকানে ঢোকে। এদিক-ওদিক দেখাদেখি করছে সে। কোনো ড্রেস-ই পছন্দ হচ্ছে না তার। অথচ নিয় কালেকশনের অভাব নেই। সেলসম্যান এসে পাশে দাঁড়ায়।
‘কোনটা দেখাব ম্যাম?’
‘কোনোটাই তো পছন্দ হচ্ছে না।’
‘কী বলছেন ম্যাম? এত এত ড্রেস, আর আপনি বলছেন পছন্দ হচ্ছে না।’
‘আসলেই হচ্ছে না। না হলে কী করব, বলুন।’
‘এপাশটা দেখতে পারেন। আশা করি ভালো লাগবে।’
‘আচ্ছা দেখছি আমি।’
সেলসম্যান চলে গেলে সাজি এপাশে ভালো করে নজর দেয়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সেখানে থাকা একটা কালো ড্রেসে নজর পড়ে তার। প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয় তার। এই ড্রেসটাই নেবে সে। ড্রেসটার কাছে গিয়ে সেলসম্যানকে ডাকে সাজি।
‘এক্সকিউজ মি, এই ড্রেসটা।’
অ্যাট দ্য সেইম টাইম আরেকজনও সেইম এই ড্রেসটাই দেখিয়ে সেলসম্যানকে ডাকে। সেলসম্যান কনফিউজড হয়ে যায় দু’জনকে দেখে। সাজিও তার ভ্রু জোড়া কুঁচকে পাশে তাকায়। মনে মনে বিরক্ত হচ্ছে সে। এত খুঁজে একটা ড্রেস পছন্দ হলো তা-ও এখন ড্রেসটার ওপর অন্য একজন্রর নজর। সাজি পাশে তাকিয়ে আরও অবাক হয়ে যায়। তার পাশে হাসান দাঁড়িয়ে আছে। হাসান নিজেও বেশ অবাক হয়ে যায়৷ প্রায় অনেকদিন পর দু’জন দু’জনকে দেখেছে। লাস্টবার দেখা হয়েছিল অয়নন্দিতা যেদিন অসুস্থ হয়েছিল। তা-ও অন্তত দেড় মাস তো হবেই। হাসানের চোখমুখ ভালো না তেমন। মনে হয়, কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছে সে। হাসান সাজিকে দেখে একটু বিব্রতবোধ করে। সাজিই প্রথম সেধে কথা বলা শুরু করে,
‘হাসান ভাইয়া, আপনি এখানে?’
হাসান কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীর কন্ঠে জবাব দেয়,
‘কেমন আছো তুমি?’
‘আমি ভালো আছি। বাসায় সবাই ভালো?’
‘হ্যাঁ, ভালো।’
‘আপনি কি অসুস্থ নাকি?’
‘নাহ।’
‘ভাবীও এসেছে।’
‘অয়নি, কোথায় সে?’
‘ওই তো ওইখানেই আছে। ভাবীর এক ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা হয়েছে। কথা বলছে।’
হাসানকে কিছু না বলতে দেখে সাজি আবারও বলে,
‘ড্রেসটা আপনি পছন্দ করেছেন। কার জন্য, মিলি ভাবীর জন্য?’
‘হ্যাঁ, আসলে, মানে,,,’
সাজি হালকা হাসে।
‘বুঝতে পেরেছি। আপনি নিয়ে যান ড্রেসটা।’
‘নাহ থাক। আমি অন্য দোকানে দেখব।’
‘পছন্দ যখন এটাই হয়েছে তবে অন্য দোকান কেন? এটাই নিয়ে নিন।’
‘এটা তো তোমারও পছন্দ হয়েছে।’
সাজি সেলসম্যানকে জিজ্ঞেস করে এই ড্রেসের আরেকটা পিস আছে কি না। কিন্তু সেলসম্যান জানায় এই ড্রেসটা এক পিস-ই আছে। কথাটা বলার পর পর-ই সাজি আয়নায় হাসানকে দেখে। তার মুখটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেছে। বোঝা-ই যাচ্ছিল ড্রেসটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে তার। আর মিলি ভীষণ সুন্দর। তাকে এই ড্রেসটায় বেশ ভালো মানাবে। সাজি খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। বুকের ভেতরটা কেমন জানি করছে তার। সে সেলসম্যানকে বলে ড্রেসটা প্যাক করে হাসানকে দিয়ে দিতে। এতে হাসান কয়েকবার না করে। কিন্তু সাজি শোনেনি।
বিল পেমেন্ট করে হাসান দোকান থেকে বের হতে নিলেই অয়নন্দিতার মুখোমুখি হয়। ভাইকে অনেকদিন পর দেখে অয়নন্দিতা। হাসানের চোখ-মুখ দেখে অয়নন্দিতা ঘাবড়ে যায়। হাসানকে এর আগে কখনও সে এমন দেখেনি৷
‘কেমন আছো ভাইয়া?’
‘এইতো ভালো। তুই কেমন আছিস?’
‘খোঁজ খবর রাখো আমার?’
‘ব্যস্ত থাকি তো। তবে মায়ের কাছে তোর কথা শুনি।’
‘কী হয়েছে তোমার? এমন লাগছে কেন?’
‘কই, কিছু হয়নি তো।’
‘উহু, কিছু তো হয়েছে। বলো, কী হয়েছে?’
‘কিছুই হয়নি।’
অয়নন্দিতা বুঝে গেছে তার ভাই কিছুই বলবে না। তাকে একবার বাড়ি যেতে হবে। তবেই সে সব জানতে পারবে। কিন্তু মামীর সঙ্গে তো রোজ-ই কথা হয়, কই তিনি তো কিছুই বলেনি। আপাতত এইসব বাদ দিয়ে অয়নন্দিতা জিজ্ঞেস করে,
‘এখানে কী করছিলে?’
হাসান মুখ খুলবে তখনই সাজি পেছন থেকে বলে ওঠে,
‘ড্রেস কিনতে এসেছিলেন। আনফরচুনেটলি ওই ড্রেসটাই ওনার পছন্দ হলো, যেটায় আমার নজর পড়েছে।’
অয়নন্দিতা একটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় সাজির দিকে। এরপরের কাহিনী জানতে চাইলে সাজি বলে,
‘আনফরচুনেটলি এই এক পিস ড্রেস-ই এখানে এভেইলেবল।’
‘ড্রেসটা কে নিল অবশেষে?’
‘অবশেষে ড্রেসটা হাসান সাহেবের ভাগ্যেই ছিল।’
কথাটা শোনার পর হাসান ঘাড় ঘুরিয়ে সাজির দিকে তাকায়। সাজিও মলিন হাসি দেয়। হাসান অয়নন্দিতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। সাজি হাসানের প্রস্থানের দিকে গাঢ় নজরে তাকিয়ে থাকে। বুঝতে পারছে না সে হাসানকে দেখার পর ভেতরটা এমন করছে কী কারণে? আজ হাসানকে তার চোখে ভালো লেগেছে। ভীষণ ভালো লেগেছে। মনে হচ্ছিল যেন, পৃথিবীতে একমাত্র হাসান-ই আছে যে সুদর্শন পুরুষ মানুষ। বিশেষ করে হাসানের হাঁটার ভঙ্গিমাটা।

শপিং শেষ করে এস্কেলেটর দিয়ে নেমে রেস্টুরেন্টে ঢোকে সাজি আর অয়নন্দিতা। সাজি কফি খাবে। সাথে অয়নন্দিতাকে থাকতে হচ্ছে। কফি অর্ডার করে দু’জনেই বসে আছে। অয়নন্দিতা ফারহানকে একবার ফোন করেছিল। ফারহান রিসিভ করেনি। হয়তো ব্যস্ত আছে সে। সাজি হাসানকেই ভাবছে। কালো চেক শার্টে হাসানকে দারুণ লাগছিল তার চোখে। এমন সময়,
‘সাজি, তুমি এখানে!’
কথাটা শোনা মাত্রই সাজি পাশে তাকায়। এদিকে ফোন থেকে নজর সরিয়ে অয়নন্দিতাও সামনে থাকা মানুষটির দিকে তাকায়। তাকে দেখা মাত্রই সাজি শরীর রাগে রি রি করে ওঠে। হাতের মুঠো শক্ত হয়ে যায় তার। ইচ্ছে করছিল এই মুহুর্তে সবার সামনে ঠাটিয়ে এক চড় বসাতে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সাজি৷ অয়নন্দিতাও দাঁড়িয়ে যায়। ঘৃণা মিশ্রিত কন্ঠে সাজি বলে,
‘জায়গাটা কি তোমার একার সম্পত্তি নাকি?’
সাজির কথা শুনে সামনের মানুষটি হেসে জবাব দেয়,
‘জায়গাটা পাবলিক প্রোপার্টি। যে কেউই আসবে।’
‘তাহলে বেকার প্রশ্ন করছ কেন?’
‘অনেক বছর পর দেখলাম তোমায়, তাই ভাবলাম কথা বলি।’
‘চোখের সামনে থেকে সরে যাও। নয়তো আমার হাত উঠে যাবে।’
‘রাগটা আগের মতোই আছে দেখছি। তা ইনি কে?’
অয়নন্দিতা দেখছে সাজি রেগে যাচ্ছে। মেয়েটা তাকে রাগান্বিত করছে। অয়নন্দিতা অবশ্য তাকে চিনতে পারছে না। পাবলিক প্লেসে কোনো অশান্তি হোক অয়নন্দিতা চাচ্ছে না৷ তাই সিচুয়েশন ঠিক করার জন্য বলে,
‘এক্সকিউজ মি, আপনি কে? আর এইভাবে যেচে এসে কথা বলছেন।’
‘সাজি আমায় চেনে।’
‘সাজিকে দেখে মনে হচ্ছে না সে আপনাকে সহ্য করতে পারছে। আপনি প্লিজ আসুন।’
মেয়েটা মুচকি হেসে সাজির দিকে তাকায়। আর সাজি ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
‘ইনি নিশ্চয়ই তোমার ভাই আই মিন ফারহানের ওয়াইফ।’
কথাটা বলার পর অয়নন্দিতা অবাক হয়ে যায়। এতক্ষণে অয়নন্দিতা শিওর যে, এই মেয়ে সবাই চেনে। ভালো থেকো সাজি– বলেই মেয়েটা সামনে এগিয়ে যায়। সাজিও অয়নন্দিতাকে তাড়া দেয় এখান থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য। অয়নন্দিতা সাজির কথানুযায়ী বের হতে হতে প্রশ্ন করে,
‘ইনি কে সাজি?’
অয়নন্দিতার প্রশ্নটা ওই মেয়ের কানে পৌঁছায়। সাজি কিছু বলার আগে মেয়েটা পেছন থেকে ডাকে।
‘এই যে ম্যাডাম।’
ডাক শোনার পর অয়নন্দিতা এবং সাজি একত্রে পেছনে তাকাতেই সে বলে ওঠে,
‘সাজি তোমার ভাবীকে বলো, আমার নাম বন্দনা।’
বন্দনা– নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে অয়নন্দিতার আত্মা কেঁপে ওঠে। আর সাজি রাগে ফেটে পড়ে।

চলবে………………………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here