দ্বিতীয়_সূচনা পর্ব_৫২

0
1319

#দ্বিতীয়_সূচনা
#পর্ব_৫২
লেখা – আফরোজা আক্তার
(কোনোক্রমেই কপি করা যাবে না)

হাসপাতালে মোটামুটি সবাই উপস্থিত হয়েছে। মিলির মায়ের চাপা কান্না, আয়শা বেগমের চাপা আর্তনাদ হাসানের চোখের পানি সব মিলিয়ে হাসপাতালের পরিবেশ ভারী হয়ে গেছে। মিলির বাবা, শ্বশুর দু’জনেই দিশেহারা অবস্থায় আছেন। মিলির বাবার শোক, তার একমাত্র মেয়েটা এইভাবে চলে যাবে এটা তাকে মেনে নিতে হবে। মিলির শ্বশুরের শোক, বউটা এত অল্প বয়সে পৃথিবীর সমস্ত সুখ শান্তিকে বিসর্জন দিয়ে পরপারে পাড়ি জমাবে সেই সাথে তার ছেলের হাসি আনন্দ সব নিয়ে যাবে৷ বেয়াই-বেয়ানকে মানসিক সাপোর্ট দিতে এসেছেন রমজান শেখ এবং রওশন বেগম। ফারহান অয়নন্দিতার ফোন পেয়ে হাসপাতালে পৌঁছলে দেখতে পায় হাসান একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। কথা বলার মতো পরিস্থিতিতে নেই সে। ফারহান কাঁধে হাত রাখার পর মুখ তুলে তাকায় হাসান। কে বলেছে পুরুষ মানুষ কাঁদে না। তারাও কাঁদে। কাঁদতে পারে তারা। যেমন কেঁদেছিল ফারহান। আজ কাঁদছে হাসান। শুধু তফাৎ একটাই। পুরুষ মানুষ নীরবে কাঁদে। ফারহান চোখের ইশারায় হাসানকে সান্ত্বনা দিতে নিলে হাসান বলে ওঠে,
‘সময় এসে গেছে। ওর চলে যাওয়ার সময় এসে গেছে।’
কথাটা সেখানে উপস্থিত সবার বুকে কাটার মতো বিঁধে গেছে। সবার আড়ালে একজন আছে যে, এই কথাগুলো সহ্য করতে পারছে না। যার বুকটা ভেঙে যাচ্ছে হাসানের কষ্টে। সাজির মাথায় ওড়না। ওড়নার একাংশ দিয়ে মুখটস চেপে দাঁড়িয়ে আছে এক কোণায়। ওড়নার আড়ালে হাসানকে দেখছে সে বার বার। চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে। প্রিয় মানুষের চলে যাওয়াটা দেখতে হচ্ছে হাসানকে। এর চেয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্য আর কী হতে পারে? ফারহান একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
‘কালও তো কথা হলো আমাদের। কাল তো বললে, ভালো আছে মিলি। আজ হঠাৎ করেই এত অসুস্থ হয়ে গেল।’
‘সকালবেলা ভালোই রেখে গেলাম। বারোটা বাজেই মায়ের ফোন। এত পরিমাণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল ওর। উফ, ওর যে কী কষ্ট হচ্ছে, বোঝাতে পারব না আমি। আমার যদি ক্ষমতা থাকত, আমি ওর সব কষ্ট নিজের করে নিতাম। ওর সমস্ত যন্ত্রণাগুলো নিজের করে নিতাম। সামনের মাসেই তাকে ইন্ডিয়া নিয়ে যেতাম। সব ব্যবস্থাও করে ফেলেছিলাম। সে আমায় সুযোগ দিলে তো। কেন যে আমায় এত জ্বালাচ্ছে সে?’
অয়নন্দিতার মামীর পাশে বসে কাঁদছে। রওশন বেগম বুঝিয়েছেন তাকে যেন সে না কাঁদে। সবাই একত্রে ভেঙে পড়লে কীভাবে হবে? কাউকে না কাউকে সাহস তো রাখতে হবে যে বাকিদের সামাল দিতে পারবে।
ডাক্তারের সঙ্গে আলাপে বসেছেন রমজান শেখ। এখানে আসার পর তিনি দেখলেন ডাক্তার তো তার পরিচিত। চেম্বারে মোট পাঁচ জন উপস্থিত আছেন এই মুহুর্তে। মিলির বাবা, শ্বশুর, স্বামী। অয়নন্দিতার শ্বশুর, স্বামী। রমজান শেখ জিজ্ঞেস করলেন,
‘কন্ডিশন কেমন বুঝলেন?’
ডাক্তার একবার সবার মুখের দিকে তাকালেন। মিলিকে নিয়ে এখানে আরও আসায় ডাক্তার হাসানকে বেশ ভালো করেই চিনেন। তিনি হাসানকে দেখছেন। একজন স্বামী, যে তার সমস্তটা দিয়ে চেষ্টা করছে স্ত্রীকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু, হয়তো আল্লাহ পাকের এটা মঞ্জুর না। হয়ত মিলির ডাক পড়ে গেছে৷ এবার তাকে যেতেই হবে। ডাক্তার রমজান শেখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘ক্যান্সারটা একদম লাস্ট স্টেজে গিয়ে ধরা পড়ায় তেমন কিছুই করার ছিল না। আমি আরও আগেই বলে দিয়েছিলাম তাদের। রোগীর মৃত্যু নিশ্চিত৷ এবার যতদিন বাঁচে। এরপরেও তো হাসান অনেক চেষ্টা করেছে। আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবতাম একজন স্বামী তার স্ত্রীকে এতটা ভালোবাসে কীভাবে। যাই হোক, আল্লাহকে ডাকুন সবাই মিলে।’
হাসান টেবিলের পাশ দিয়ে ঘুরে ডাক্তারের কাছে যায়।
‘স্যার, আপনি কিছু একটা করুন না প্লিজ। আমায় শুধু দুটো দিন সময় নিন। আমি আজকের মধ্যেই সব ঠিক করে ওকে নিয়ে যাব ইন্ডিয়াতে। সেখানে গিয়ে চিকিৎসা করাব।’
ডাক্তার হাসানের হাত ধরে বললেন,
‘শান্ত হও বাবা। নিজেকে সামলে নাও৷ চেষ্টা করো নিজেকে শান্ত রাখার। ভেঙে পড়লে চলবে না। ওর শ্বাসকষ্ট বেশি হচ্ছে। অক্সিজেন চলছে তবুও তার শ্বাসকষ্ট বন্ধ হচ্ছে না।’
‘আপনি শুধু আমায় দুটো দিন সময় দিন। প্লিজ।’
ডাক্তার বোঝাতে ব্যর্থ। হাসানের বাবা কাঁদছেন। মিলির বাবাও কাঁদছেন। ফারহান নিঃশব্দে নিঃশ্বাস ফেলছে।

রাত বারোটা। একটা মানুষও নড়েনি আইসিইউর সামনে থেকে। অনেকক্ষণ পর অনেক জোরাজুরি করার পর হাসানকে আইসিইউতে যেতে পারমিশন দেওয়া হয়। হাসান বেডের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মিলি বেডে শুয়ে আছে। অক্সিজেন লাগানো অবস্থায় মিলিকে একটা লাশ মনে হচ্ছিল। হাসান যেন এই দৃশ্য সহ্য করতে পারছে না। হাসানের দমটা যেন বের হয়ে যাবে এমন অবস্থা। সেদিন নামাজ পড়তে গিয়েছিল আর সেখানে হুজুর বক্তব্য দিচ্ছিলেন৷ আল্লাহ পাকের সৃষ্টির সেরা জীব হচ্ছে আশরাফুল মাখলুকাত। আল্লাহ পাক তার সৃষ্টি আশরাফুল মাখলুকাতকে বেশি ভালোবাসেন। তাহলে সেই আল্লাহ পাক-ই কেন এত তাড়াতাড়ি তার জানটা কবজ করতে চান। একটা মানুষকে কী করে এত কষ্ট দিতে পারেন। আল্লাহ পাকের কি একটু মায়া হয় না সেই মানুষটার জন্য। হাসান গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় মিলির দিকে। মিলির হাতটা ধরতেই পেছন থেকে নার্স বলে ওঠে,
‘ধরবেন না। অনেক কষ্টে ঘুমিয়েছেন একটু। ঘুমোতে দিন তাকে।’
নার্সের কথা শুনে হাসান চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলে। চোখ জোড়া বন্ধ করতেই গড়গড় করে পানি গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে। নিজের স্ত্রীকে ধরতে বারণ করে নার্স। এর চেয়ে এত কষ্ট এই দুনিয়াতে আছে বুঝি?
শার্টের হাতা দিয়ে চোখের পানি মুছে আইসিইউর বাইরে বের হয়ে যায় হাসান। বের হতেই তার সামনে পড়ে সাজি। চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নেয় হাসান। সাজিও নিজের নজর সরিয়ে নেয় অন্যখানে। অনেকক্ষণ থাকার পর রমজান শেখ এবং রওশন বেগম বাড়ি চলে যান। ভাবীর সঙ্গে থাকার জেদ ধরে সাজি থেকে যায় হাসপাতালে। থাকার উদ্দেশ্য একটাই। হাসানকে চোখের সামনে দেখতে পাওয়া৷ এখানে উপস্থিত প্রত্যেকেই জানে মিলির মৃত্যু নিশ্চিত। সবাই ভেতর ভেতর নিজেদের প্রস্তুত করেছেন। যে কোনো মুহুর্তে খারাপ খবর আসবে।
অয়নন্দিতা অনেক বোঝানোর পরেও হাসানকে খাওয়াতে পারেনি। ফারহানও বুঝিয়েছে। সে-ও খাওয়াতে পারেনি। হাসপাতালের করিডোরের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে হাসান। অপেক্ষা করছে একটা ভালো খবরের। কিন্তু, কে জানে ভালো খবররের বদলে খারাপ খবর না চলে আসে।
সবার চোখকে আড়াল করে সাজি এসে হাসানের পাশে এসে দাঁড়ায়। হাতে খাবার।
‘খাবারটা খেয়ে নিন।’
ধরা গলায় হাসান জবাব দেয়,
‘ইচ্ছে করছে না।’
‘ইচ্ছে না করলেও খেতে হবে।’
‘খাবারটা সরিয়ে নাও সাজি। প্লিজ, বিরক্ত কোরো না। যাও এখান থেকে।’
‘খেয়ে নিন।’
‘আমার বউটা ওইখানে বেডে শুয়ে আছে। আর তুমি আমায় এখানে খাবার খাওয়াতে এসেছ। কী মনে হয়, আমি খুব সুখে আছি? নাকি তুমি মনে প্রাণে চাচ্ছো যাতে মিলি চলে যায়, আর তোমার রাস্তাটা ক্লিয়ার হয়ে যায়।’
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সাজির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়। হাতে থাকা খাবারটাও নড়ে যায়। হাসান এটা কী বলল? চোখের পানিগুলো অঝোরে ঝরতে শুরু করে তার। কয়েক সেকেন্ড পর হাসান সাজির দিকে তাকিয়ে বলে,
‘সরি। উল্টাপাল্টা বলে ফেলেছি আমি। সরি।’
হাসান চলে যায়। সাজি মূর্তির মতো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।

ভোর চারটা।
হাসপাতালের একটা অংশ আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে। মিলি চলে গেছে। হাসানকে কিছু না বলেই মিলি চলে গেছে। হাসানের কাছে মিলির ওড়নাটা ছিল। সেটা জড়িয়েই কাঁদতে শুরু করে হাসান। তার একটাই অভিযোগ। কীসের এত রাগ ছিল তার প্রতি। কিছু না বলেই এইভাবে চলে গেল মিলি। কেন কিছু না বলে চলে গেল। আয়শা বেগম নিজের ছেলের আর্তনাদ সহ্য করতে পারছেন না। আর কেউ না জানুক তিনি অন্তত জানেন যে, হাসানের পুরোটা জুড়েই মিলির অবস্থান ছিল। আর সেই মিলি তাকে ছেড়ে চলে গেছে। এর থেকে কষ্টের, যন্ত্রণার আর কিছু হতে পারে না। কিছু হতে পারে না।

চলবে………………………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here