#ধূসর_ভালোবাসা
পর্ব -১০
জীবনে যা ঘটে গেলো তা কল্পনার অতীত। চোখের পানিতে বুক ভাসালেও, আমার চলে যাওয়া দিন আর ফিরে আসবে না। তবুও নিজেকে সামলানো আজ আমার সাধ্যের বাহিরে। নিজের ফেলে যাওয়া পায়ের চিহ্নের যে ভার, তা বহন করতে হবে সারা জীবন। একটা দিনের স্মৃতি বুঝি বয়ে চলতে হবে আজীবন।
বাবা মায়ের মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠতেই, আমার অন্তর আত্না কেঁপে গেলো। এমনটা কখনও স্বপ্নেও কল্পনা করিনি আমি।ভাইয়া, দাদা, নানা, আত্নীয় স্বজনের সামনে কি মুখ নিয়ে দাঁড়াবো! জীবনের বহু স্বপ্ন আমার শেষ হয়ে গেলো।
দুপুরের আগেই আমরা নিয়াজদের বাসায় পৌঁছালাম। নিয়াজের মা আমাকে খুব স্বাভাবিক ভাবে গ্রহন করলো।কিন্তু সবাই নিয়াজের বাবার জন্য ভয় পাচ্ছে।
দুপুরে নিয়াজের বাবা বাসায় আসলে, তাকে খাওয়ানোর পর নিয়াজের চাচা মামারা সবাই মিলে নিয়াজের বাবার সাথে গল্প করতে লাগলো। এবং গল্পের এক পর্যায়ে আমাকে নিয়াজের চাচা সামনে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন, আর বললেন,
– বড় ভাই এই মেয়েটা আফিফা।
নিয়াজের বাবা বললেন,
– কার কে?
– নিয়াজের বৌ।
– কি বলিস? নিয়াজ বিয়ে করেছে আর আমি জানতে পারলাম না।
আমি গিয়ে নিয়াজের বাবাকে সালাম করলাম, উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– কি নাম তোমার?
– আফিফা।
– বাসা কোথায়?
– বগুড়া, তবে বাবার পোষ্টিং রংপুরে তাই আমরা রংপুরে থাকি।
– তোমার বাবা মা জানে, তুমি বিয়ে করে এখানে এসেছো?
– জি না।
– তোমরা ছেলে মেয়েরা কখনও বাবা মায়ের কষ্ট বুঝবে না। তোমার জন্য আজ উনারা কষ্ট পাচ্ছে। আমার নিজের আশা আকাংখার কথা বাদই দিলাম। তুমি নিয়াজের সম্পর্কে সব জেনে বিয়ে করেছো?
– জি।
– তুমি ভদ্র, নম্র, মিষ্টি একটা মেয়ে। আমার ছেলের মত একটা বাদরকে তোমার পছন্দ হলো? তোমার বাবা একজন অফিসার, তুমিও দেখতে মাশআল্লাহ। অনেক ভালো জায়গায় তুমি যেতে পারতে মা। কেন তুমি আমার ছেলেকে পছন্দ করে নিজের জীবন নষ্ট করলা, আমি বুঝলাম না।
যাই হোক, এরা যখন বিয়ে করে ফেলেছে তখন আর কি বলবো। এদের আবার বিয়ের ব্যবস্থা করো। আমার চোখের সামনে সঠিক ভাবে বিয়ে পড়াও। যাও সবাই ব্যবস্থা করো।
সবাই মিলে আমার আর নিয়াজের বিয়ের ব্যবস্থা শুরু করলো।
নিয়াজরা ছয় ভাইবোন, তিন ভাই তিন বোন। নিয়াজ বড়। বাকি ভাই বোন গুলো ছোট। নিয়াজের ছোট ভাইবোনদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। কিছুক্ষনের মধ্যে নিয়াজের অনেক গুলো আত্নীয় স্বজন চলে আসলো। কেউ খুব খুশি, কেউ কম খুশি।
আমার কোন কিছুই ভালো লাগছে না। বিকেল হতে হতে আরো অনেকেই আসছে আমাকে দেখতে। এতো সবার মাঝে একজন এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
– বাবা মা জানে তুমি কোথায়?
– জি, না।
– তুমি দেখতে তো বেশ ভালো, এতো সবের মধ্যে নিয়াজকেই পছন্দ হলো? পৃথিবীতে আর কাউকে পাওনি?
আমি কোন উত্তর খুঁজে পেলাম না, চুপ চাপ বসে রইলাম।
নতুন জীবনের শুরু এভাবে হবে তা ভাবতেও পারিনি। নিয়াজকে আমার পছন্দ, সময়ের বিবর্তনে তা ভালোবাসায় রুপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু তাই বলে এমন করে জীবনকে কখনও ভাবিনি।
নিয়াজের ছোট চাচি আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন, একটা টুকটুকে লাল শাড়ি আমার হাতে দিয়ে ফ্রেশ হয়ে পরতে বললেন।
সন্ধ্যায় কাজি আসলেন এবং বিয়ে পড়ালেন। রাতে নিয়াজদের সব আত্নীয় মিলে বেশ আনন্দ করে আমাদের বিয়ের আয়োজন করলো।
নিয়াজের বাবা এসে সবাইকে বললেন, আজ থেকে আমার তিন মেয়ে নয় চারটা মেয়ে। আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন। তারপর সবাই আমাকে আর নিয়াজকে পাশা পাশি বসিয়ে মিষ্টি খাওয়ালেন। নিয়াজের বাবা মা সবাইকে পরের দিন দুপুরের দাওয়াত দিলেন। আমার চোখের সামনে যা কিছু ঘটছে সবই কল্পনা মনে হচ্ছে।
পরের দিন দুপুরে নিয়াজদের অনেক আত্নীয় স্বজন আসলো। সাথে নিয়াজের বন্ধুরা। পাড়া প্রতিবেশি। বাহিরের অনেক মেহমান আসলো। বিশাল আয়োজন করা হলো বিয়ের।
নিয়াজের চাচাতো ফুপাতো বোনেরা এসে আমার পাশে বসলো। তাদের মুখে নিয়াজের খুব সুনাম, তবে কারো কারো চোখের ভাষা আমি বুঝতে পারলাম না। আমাকে দেখে খুশি হবার পরিবর্তে খুটিয়ে খুটিয়ে আমাকে দেখতে শুরু করলো।
তবে চমকে উঠলাম রিংকুকে দেখে। সে আমার সামনে বসে, আমাকে দেখছে আর হাসছে। তারপর বললো,
– শেষ মেশ পড়েই গেলা নিয়াজের বিছানো জ্বালে। যাক নিয়াজ বেড ধরে জিতেই গেলো। কিন্তু তোমার বাবার ভূত আর পড়ার ভূত, পালালো কি করে?
আমি কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলাম,
– আপনার কথা আমি বুঝতে পারছি না। আর আপনার সাথে নিয়াজের মিমাংসা কবে হলো? আপনাদের না গন্ডগোল হয়েছিল?
– (হা হা হা) সবই বুঝতে পারবে, সময় হলে।
রিংকু চলে গেলো, কিন্তু আমার মনে কেমন যেন অশান্তি লাগতে শুরু করলো?
তবে নিয়াজের ছোট ছোট ভাইবোন গুলোর সাথে আমার খুব ভাব বনে গেলো। তবে নিয়াজের ইমিডিয়েট ছোট যে বোন, তার নাম শিরিন। সে একটু রেগে রেগে কথা বলে আমার সাথে।
আসতে আসতে আমি নিজেকে এই পরিবারের সাথে খাপ খাইয়ে নেবার চেষ্টা করছি। তবে সমস্যা হলো, আমাদের পরিবার আর নিয়াজদের পরিবারের মধ্যে চালচলনে আচার আচরনে অনেক পার্থক্য। তবুও আমি সব সময় চেষ্টা করি যেন সবার সাথে মিলে মিশে যেতে পারি।
আমার শাশুড়ী ও শশুর আমাকে খুব ভালোবাসে। আমার শাশুড়ী প্রতিদিন আমার গোসুলের কাপড় পর্যন্ত ধুয়ে দেয়। আমার শশুর রোজ তাই বাজার করেন যা আমার পছন্দ। ছোট ননদ দেবর গুলো আমার কাছেই থাকে সারাদিন। তাদের পড়াশোনার হাতেখড়ি আমার কাছেই।
এখন আমার পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ পুরুষ হলো, আমার বাবা ও নিয়াজ। কারন নিয়াজ আমার খুব খেয়াল রাখে, সে আমাকে খুব ভালোবাসে। তার কারনে আমি অনেক কিছুই ভুলে থাকতে পারি। নিজেকে খুব ভাগ্যবতি মনে হয় আজকাল নিয়াজের মতো স্বামি পেয়ে। তবে মাঝে মাঝে কেউ কেউ নিয়াজ সম্পর্কে কি কি যেন বলে। আমি ওসবে কান দেই না কখনো। কারন হয়ত আমার আর নিয়াজের সম্পর্ক দেখে তাদের হিংসে হয়। নিয়াজ কখনো খারাপ হতে পারে না। এটা আমার দৃঢ বিশ্বাস।
খুব অল্প সময়ের মধ্যে নিয়াজের আত্নীয় এবং পাড়া প্রতিবেশির সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। সবাই আমাকে খুব পছন্দ করে এবং ভালোবাসে। তবে আমার ননদ শিরিন, সে কখনই আমার সাথে ভালো ব্যবহার করেনি।
আমার হাতের রান্না আমার শশুরের খুব পছন্দ। তবে এটা শিরিনের পছন্দ নয়, আমি বুঝতে পারি। কিন্তু আজকের ঘটনা আমার খুব খারাপ লেগেছে। আমি রান্না করে গোসুলে গেছি। সব তরকারি রান্নার সময় আমি নিজে একটু করে মুখে দিয়ে দেখেছি লবন ঝাল ঠিক আছে কিনা। অথচ যখন সবাই খেতে বসেছে, দেখা গেলো এতো লবন যে খাওয়া যাচ্ছে না। এটা আজ প্রথম না, এর আগেও হয়েছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি যে এমন কি করে হয়। আজ বাড়ির কাজে সহকারি মেয়েটা আমাকে সব বলেছে, যে প্রায়ই শিরিন এমন করে। শশুর বাবা রাগ করে আমাকে কাল থেকে রান্না করতে মানা করলেন। মনটা খুব খারাপ হলো, কিন্তু সত্যটা কাউকে বলতে পারলাম না। তবে আমার ছোট চাচি শাশুড়ি বেশ ভালো মানুষ। উনি আমার না বলা অনেক কথা বুঝতে পারতেন।
আজ রেজাল্ট হয়েছে এইচ এস সির, আমার রেজাল্ট এখনো পাইনি। নিয়াজদের টেলিফোন ওদের অফিসে। নিয়াজ আমাকে আজ প্রথম ওদের অফিসে নিয়ে গেলো শেফালি আন্টির সাথে কথা বলার জন্য। শেফালি আন্টিদের বাসায় টেলিফোন আছে।
বহুদিন পর আপন জনদের সাথে কথা বলবো, কেমন যেন অস্থির লাগছে। ফোন দিয়ে রিসিভার আমার হাতে দিলো নিয়াজ। ফোনের একেকটা রিংটোন হচ্ছে, আর আমার ভেতর টা প্রতিবার কেপে উঠছে। শেফালি আন্টির আব্বা ফোন ধরলেন। আমি পরিচয় দিলে, উনি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়লেন। আমি শেফালি আন্টিকে চাইলাম। শেফালি আন্টি হ্যালো বলতেই আমি জোরে করে কেদে ফেললাম। আন্টি বললেন,
– কে? আফিফা? কাঁদছো কেন? তুমিতো ভালোই আছো, আর তোমার বাবা মা ভাই বোন না মরে বেঁচে আছে।
– কেন কি হয়েছে আন্টি?
– কি হয় যখন সন্তান রাতের আঁধারে অন্যের হাত ধরে চলে যায় সেটা তুমি বোঝ না? তুমি কেন এমন করলে? কি সমস্যা তা কি আমাকেও বলতে পারতে না? তাই বলে কাউকে কিছু না বলে চলে যেতে হবে?
আমি নিজেকে সামলাতে পারছি না, কেঁদেই যাচ্ছি। তাই নিয়াজ ফোনটা নিয়ে শেফালি আন্টির সাথে কথা বলল,
– শেফালি, আমি নিয়াজ। আফিফার রেজাল্ট হয়েছে। তুমি কি ওর রেজাল্ট জানো?
– আফিফা বোর্ড ষ্ট্যান্ড করেছে, সে বোর্ডে ষষ্ঠ হয়েছে। আফিফাকে ফোনটা দাও নিয়াজ।
আমি কাপা কাপা হাতে ফোনের রিশিভার হাতে নিয়ে শেফালি আন্টির মুখে নিজের রেজাল্ট শুনে খুশিতে আবার কেদে ফেলেছি। সবার খোঁজ খবর নিয়ে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো।আন্টি এটাও বলল,
– আফিফা, ছেলে মেয়ে যত বড়ই দোষ করুক না কেন, তারা বাবা মায়ের সামনে আসলে, বাবা মা সব ভুলে যায়। তুমি নিয়াজকে নিয়ে বাসায় আসো। আর এতো ভালো রেজাল্ট করেছো, এখন উনারা তোমাকে দেখলে সব ভুলে যাবে।
– আন্টি আমি আসবো আন্টি, সারাক্ষন আমার বাড়ি যেতে মন চায় কিন্তু ভয়ে আমি যেতে পারি না।
– তুমি সব ভয় বাদ দিয়ে চলে আসো।
আমি আনন্দে আত্নহারা হয়ে গেলাম, আমার রেজাল্ট শুনে। আমার শশুর বাড়ির সবাই খুব খুশি হলো। শশুর আব্বা এতো খুশি হয়েছেন যে, পুরো পাড়ায় মিষ্টি বিলিয়েছেন। সোনার একটা চেন এনে আমার গলায় পরিয়ে দিলেন।
শিরিন পাস থেকে বলল,
– আমরাও পরীক্ষা দিয়েছি আব্বা, কোন দিন তো আমাদের জন্য এমন কিছু করেন নি। আর আফিফার জন্য আপনার এতো আদিক্ষেতা।
– তোরা কেউ আফিফার মতো রেজাল্ট করতে পেরেছিস?একবার পরীক্ষা দিয়েওতো পাস করতে পারিস না। দুই তিন বার লাগে এক ক্লাস পাস দিতে। যা এখান থেকে, আমার রৌমার উপর হিংসা করবি না।
আমি শশুর আব্বাকে বললাম যে,
– আব্বা আমি বাসায় যেতে চাই।
– শোন মা, চাইলেই কি এখন সব হয়।
– আমি আগে লোক পাঠাই, উনারা কি চায় শুনি। তারপর তুমি বাবার বাসায় যেও।
#সিরাজুম_মনিরা