ধূসর ভালোবাসা পর্ব-৩২শেষ পর্ব

0
2007

#ধূসর_ভালোবাসা
শেষ পর্ব

ঈশান আমাকে নিয়ে ছুটে চলল। ঈশান ড্রাইভ করছে, আমি চুপচাপ পাশে বসে রইলাম। নিরাবতা ভেঙ্গে ঈশান বলে উঠলো,

– এক বারের জন্যে জিজ্ঞেস করলে না, আমরা কোথায় যাচ্ছি!

– আপনি আমাকে কোন ভুল যায়গায় নিয়ে যাবেন না, এটা আমার বিশ্বাস।

– তুমি আমাকে বিশ্বাস করেছ এটা আমার সৌভাগ্য। তোমার বিশ্বাস যেন আজীবন অটুট রাখতে পারি, সেটাই আমার প্রয়াস থাকবে।

আমরা কিছুক্ষন পরে পৌঁছালাম একটা কবরস্থানে। এখানে ঈশানের বাবা শায়িত আছেন। ঈশান কবর জিয়ারত করলো। আমি দূরে দাড়িয়ে রইলাম। তারপর ঈশান ইশারা করে আমাকে ডাকলো। আমি এগিয়ে গেলে সে বললো,

– এটা আমার বাবার কবর, উনি শায়িত আছেন এখানে। যে কোন ভালো কাজে আমি বাবার কাছে আসি। বাবাকে সব কথা বলে তবে কোন কাজ শুরু করি।

আমরা আবার রওনা দিলাম,
– জানো অবন্তি, বাবার কবরের পাশে যে জায়গাটা ফাঁকা দেখছো। মায়ের খুব ইচ্ছে যেন ওখানেই মায়ের কবরটা হয়। আমি যখনই আসি মা ঐ জায়গাটার খোঁজ নেন। জায়গাটা ফাঁকা আছে কিনা, জানার জন্য। আমার বাবা খুব ভালো মানুষ ছিলেন, আমাদের খুব সুখের সংসার ছিল। জানো, আমি বাবাকে ছাড়া ঘুমাতে পারতাম না। বাবা ব্যবসার কাজে বাহিরে গেলে, আমিও প্রায় সাথে যেতাম। বাবা যখন চলে গেলেন, আমি কোন কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। বাবা হুট করেই চলে গেলেন, সেই কষ্ট সামলে উঠতে সময় লেগেছে বহু। বাবা মারা যাবার পর, বাবার ব্যবসার পার্টনাররা নয় ছয় বুঝিয়ে আমাদের একটা হিসেব করে অল্প কিছু টাকা দিয়ে দেনা পাওনা চুকিয়ে দিলেন। মা সেদিন কাউকে কিছু বলেনি। বাবার কবরে এসে সব বলে গেছেন। আর জায়নামাজে ওপর ওয়ালাকে বলেছেন। এর পরের দিন গুলো কেটেছে বেশ কষ্টের। কিন্তু মা আমার মামাদের সাহায্যে সব সামলে নিয়েছেন। এরপর আমি ব্যবসার হাল ধরলাম, কারন মা বললেন, টাকা খারাপ জিনিস। মামাদের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখতে চাইলে, নিজের ব্যবসা নিজেকে বুঝে নিতে হবে। এরপর আর পিছনে তাকানোর সময় পেলাম না। তবে এটুকু বলতে পারি, যা করেছি, যেটুকু করেছি নিজের যোগ্যতায় করেছি।
আমার যে কোন সমস্যা বা সুসময়ে আমি বাবার কাছে আসি। সে কারনে তোমাকে এখানে নিয়ে আসলাম। তুমি কিছু মনে করোনিতো?

– না না, মোটেও না। বরং অনেকদিন পর এমন একটা স্থানে আসলাম। মনটা ভালো হয়ে গেলো।

– অবন্তি আমাকে তোমার পছন্দ কি না, আমি জানি না। তুমি তা বলো নি। তবে তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে, ঠিক যেমনটা চেয়েছিলাম, তেমন। বাবার দেয়ার সাথে নিয়ে, তোমার সাথে জীবন শুরু করতে চাই। কাল থেকে বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু, তাই মা বললেন আজকের পর অনুষ্ঠান শুরু হওয়া পর্যন্ত তোমার আর আমার দেখা করা ঠিক হবে না। বিয়েতে কোন কিছু কেনাকাটা বাদ পড়েনি তো তোমার। কিংবা তোমার কোন ইচ্ছা, থাকলে নির্দ্ধিধায় আমাকে বলতে পারো।

– আপনি যত কিছু করেছেন, সে গুলোই আমার কল্পনার বাহিরে। নতুন করে আর কোন কিছুই লাগবে না আমার।

– তুমি কিন্তু আমাকে বলতে পারো।

– সমস্যা নেই, কোন কিছু লাগলে আমি আপনাকে বলবো। আজ মামনির সাথে শপিং এ যেতে হবে। আপনাকেও তো আসতে হবে মনে হয়।

– কেন?

– শেরোয়ানির মাপ দেবার জন্য।

– যাক তাহলে আজ আরেকবার তোমাকে দেখতে পাবো। ধন্যবাদ তোমাকে, খবরটা দেবার জন্য।

– আচ্ছা, এই যে আপনি। এতোটা পছন্দ করছেন আমাকে, হয়ত আরও বেশি কিছু আমি আপনার কাছে। এটা কি আজীবন থাকবে।

– সময় তা বলে দেবে। তুমি দেখে নিও, আজ যতটা আমি তোমার পাশে আছি ভবিষ্যতে এর থেকেও বেশি তোমাকে ভালোবেসে আগলে রাখবো।

বিকেলে মামনি আমি নানী আবীর সবাই মিলে শপিং গেলাম। ঈশান এসেছে শেরোয়ানীর মাপ দেবার জন্য। হাতে ছোট্ট একটা প্যাকেট। টিপ করে আমার হাতে দিলো, তারপর গগন ভোলানো হাসি।

সন্ধ্যার পর থেকে বাসায় আত্নীয়রা সবাই আসতে শুরু করেছে। মামা মামীরা রওনা দিয়েছে। খালামনিরাও রওনা দিয়েছেন। কাল সকালের মাঝে সবাই চলে আসবে। বাড়ি আসতে আসতে ভরে যাচ্ছে মেহমানে। বুকের মাঝে একরাশ মেঘ জমছে আমার। আমি যেন মেঘের মতো, ভাসছি আর ভাসছি। ভাবতে ভাবতে কোথায় যাবো জানি না।

আজ আমার গায়ে হলুদ। পুরো বাড়ি লাইটিং করা, বিকেলে সাদ তার বন্ধু সৃজিতকে পাঠিয়েছিল। আমি বসে আছি, আমার সামনে সৃজিত,

– অবন্তি তোমাকে অনেক ভালো মেয়ে জানতাম। কেন এসব করছো? সাদ মারা যাবে। সাদের কি দোষ, একবার বলবে? তুমি বলেছিলে, তোমার ইন্জিনিয়ার পছন্দ। সে তাই পড়েছে। তুমি যেভাবে সাদকে চেয়েছিলে, সে নিজেকে সেভাবেই তৈরী করেছে তোমার জন্য। তাহলে কেন এখন তুমি অন্য কোথাও …..? তোমাকে কি আমরা চিনতে ভুল করেছিলাম? কথা বল অবন্তি।

– সৃজিত, আমি অনেক ভেবে দেখেছি। সাদ আমার যোগ্য নয়। আর যার সাথে আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে তার সাথে আমি খুব সুখে থাকবো। সাদকে বলে দিও, আমাকে ভুলে যেতে।

মামনি, সৃজিতকে চা দিও। বলেই আমার ঘরে চলে আসলাম। আমি যে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিলাম না। আমার ভেতরে যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে তা কাউকে বোঝানোর নাই। এ কষ্ট শুধুই আমার। আমি চাই সাদ আমাকে ঘৃনা করুক, খুব ঘৃনা করুক। যাতে সে জীবনে সামনে আগাতে পারে। নইলে ওর দিন গুলো অনেক কষ্টের হয়ে পড়বে। আমাকে সাদ ঘৃনা করুক, তবুও যেন নিজেকে সামলে জীবনে সামনে এগিয়ে যায়।

পুরো বাড়িতে সবাই এতো খুশি। বহুদিন পর আমি মামনিকে এতোটা আনন্দে দেখতে পেলাম। খালা খালু মামা মামি সহ অনেক আত্বীয় দিয়ে আজ পুরো বাড়ি ভরপুর। সবাই নেচে আছে গল্পে, আর আনন্দ উৎসবে।

কেউ জানতে পারবে না আমার একটা মনের মৃত্যূর কথা। আচ্ছা, কেউ বলতে পারে যে এক জীবনে মানুষ কত বার মারা যায়? কতবার ক্ষতবিক্ষত হয়, কতবার হৃদয়ের অনলে পুড়ে হয় ছারখার? তবুও কেউ কেউ বুঝি বা আর সুখের মুখ দেখে? সব কিছু মাড়িয়ে আমি আজ নতুন দিনের পথিক, পেছনে ফেলে অজস্র ক্ষত।

দুপুরের কিছু আগে ঈশানের বাসা থেকে ডালা এসেছে, এসেছে বিয়ের সাজন। পুরো বাড়ির মানুষ মহা ব্যস্ত তা নিয়ে। সবার খুব পছন্দ হয়েছে।

কথা মতো গায়ে হলুদ আর বিয়ের অনুষ্ঠান এক সাথেই হবে। সন্ধ্যার পরে সবাই গেলাম কমিউনিটি সেন্টার। ঈশান, নিজে তার পছন্দ মতো পুরোটা ডেকোরেশন করিয়েছে। প্রথমে দেখে ভেবেছিলাম ভুল কোথাও বুঝি এসে পড়েছি। আমরা প্রবেশ করতেই ঈশানদের পক্ষের সবাই এসে আমাদের বরণ করলো মনে হলো আমরাই যেন ছেলে পক্ষ। আয়োজনের কোন কমতি রাখেনি, ঈশান।

ষ্টেজে উঠে দুজন পাশা পাশি বসলাম। ঈশান আমার কাছে এসে বললো, মহারানী আমার আয়োজন আপনার পছন্দ হয়েছেতো? কোন সমস্যা থাকলে এখুনি বলো, আমি ঠিক করে দেবো।
সব ঠিক আছে কোন সমস্যা নেই। বরং যা সাজিয়েছেন, তা আমি কল্পনাও করিনি। তহমিনা আন্টি কি যে খুশি, তা বলে বোঝানো যাবে না। উনি মহাআনন্দে সবাইকে ডেকে এনে দেখাচ্ছেন, দেখো আমার পরীর মতো বৌ নিয়ে এসেছি। তার আনন্দ দেখে আমি সত্যিই অভিভূত। ঈশানের বাড়ির সবাই এতো বেশি আদর করছে আমায়, যেন নিমিষেই আমার মন ভালো হয়ে গেলো। মনে হলো, এরা আমার কাছে নতুন কেউ নয়, আত্বার পরম আত্নীয়।

কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগছে সব কিছু। যাকে আমি ভালোবাসি, তার পরিবারের কাছে আমি নগন্য, হেয়প্রতিপন্ন। আর যাদের আমি চিনিও না ঠিক ঠাক, তাদের কাছে আমার আদরের কোন অভাব নেই।

বিয়ের দিন, সবকিছু দেখে মনে হচ্ছিল। এখানে কোন রাজা রানীর বিয়ে হচ্ছে।আমাকে গহনা দিয়ে ঈশান এমন ভাবে মুড়ে দিয়েছে, আয়নার সামনে নিজেকে প্রথমে চিনতে পারিনি। বিয়ের বাড়ির প্রতিটা আয়োজন দেখে সবাই অভিভূত।

ঈশানের একটা দিক হচ্ছে, সে যেটাই করবে তা অবশ্যই পরিপাটি হতে হবে। ওর প্রতিটা কাজ খুব গোছানো। ঈশান সবার প্রতি অনেক যত্নশীল।

একটা জীবনের শুরু করতে যাচ্ছি, জানি না কি লেখা আছে আমার কপালে।

ঈশানের বাড়ি অর্থাৎ আমার শশুর বাড়িতে এসে, পুরো বাড়িটা দেখে মন ছুয়ে গেলো। গোছানো, পরিপাটি বাড়িটা।

ঈশানের সাথে চলার পথে, কখন যেন ধিরে ধিরে আমি ওর প্রতিটা কাজের প্রতি মুগ্ধ হয়ে গেছি। আবীরকে নিয়ে যেন আমি চিন্তা না করি, এটা ঈশানের কথা। আবীরের সব দায়িত্ব ঈশান নিজে পালন করবে, এবং করছেও তাই।

বিয়ের পরের জীবনে কখন যে আমি সংসারে একজন রমনী হয়ে গেছি বুঝে উঠতে পারিনি। ঈশানের যত্নে, ভালোবাসায় আমি কবে যেন মিসেস ঈশান হয়ে গেছি মনে প্রানে।

মামনি রিটায়ার্ড করেছ। ঈশান মামনি আর নানীর সবটা খেয়াল রাখে, আমার চেয়েও বেশি। আবীর টা ভার্সিটির পড়ছে। আমার দেবর অর্ক, সে কলেজে পড়ছে। কলেজের বাহিরে অর্কের দিন কাটে আমার সাথে খুনসুটি করে। অর্ক আমাকে যেমনটা আগলে রাখে আমিও ঠিক তেমন করেই ভালোবাসি, ও আমার কাছে সন্তানের মতো প্রিয়।

আমার শাশুড়ি শুরুর দিনই বলেছিলেন, তুমি আমার ছেলের বৌ, বৌমা। তুমি আজীবন আমার লক্ষি বৌমা হয়েই থেকো মা। আমাদের আগলে রেখো। আমি উনার কথা একচুল অমান্য করিনি। পুরো সংসারটা কখন যেন আমার জীবনের বিশাল একটা অংশ হয়ে গেছে বলতে পারিনা।

সাদের খবর পাই, সে চাকরী ছেড়ে দিয়েছে। বিদেশে স্কলারশীপ পেয়েছিল, সেটাও আর করেনি। সব ছেড়ে চলে গেছে রংপুরে। এত পড়া শোনা করে শেষ বেলায় ওর বাবার ব্যবসাটাকে আপন করে নিয়ে নিজের মতো করে বেঁচে আছে। বিয়ে করেনি আজো। আমি জানি, সে হয়ত আপাদমস্তক একজন মৃত মানুষ, কারন মন মরে গেলে শরীরটা শুধু বয়ে বেড়াতে হয়। অনুভূতি গুলোর ও যে মৃত্যূ হয়। আমি জানি সাদের বাবা আজ হয়ত খুব খুশি। কারন বাবা হিসেবে সে হয়ত উচিত কাজটাই করেছেন, শুধু বুঝতে পারেন নি, এ জীবনে খুন না করেও তিনি দুটো জীবনের ভালোবাসার, মনের এবং জাগতিক আত্বার খুনের আসামী। তবুও দোয়া করি ভালো থাকুক প্রতিটা বাবা, এবং সাদের বাবাও। ভালো থাকুক সাদ, দোয়া করি সব সময় সাদের জন্যে।

ঈশানকে বেশিক্ষন না দেখলে, আমার মন কেমন করে। ওর মন খারাপ দেখলে আমার অস্থির লাগে। এর কারন আমার জানা নেই।

আমার নিজের জীবনের প্রয়োজন গুলো আমার থেকে ঈশানের বেশি খেয়াল থাকে। আমার জীবনে না পাওয়ার মতো এখন কিছু আর নেই। ঈশানের ভালোবাসার কাছে আমি ধিরে ধিরে যেন কখন যেন হেরে গেছি তা বুঝতেও পারিনি। তবে আমার আর চাকরী করা হয়ে ওঠেনি। ঈশানের পছন্দ না, মেনে নিয়েছি।

একজীবনে সুখি হতে, কিছু পেতে হলে কিছু হয়ত হারাতে হয়। কিছুটা হয়ত ছাড়ও দিতে হয়। যোগ বিয়োগ করে সুখি হতে এ জীবন আমাকে শিখিয়ে দিয়েছে।

…………সমাপ্তি…………….

বি:দ্র: আপনাদের সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ, আমার গল্পটা ধৈর্য্যর সাথে পড়ার জন্যে। তবে গল্পটা শেষের দিকে আমি নিয়মিত পোষ্ট করতে পারিনি, কারন আমি সব আমার পরিবার ও আপন আত্নীয়রা অনেকেই করোনা আক্রান্ত। তাই নিয়মিত লিখতে পারিনি। আমি দু:খিত। আর আপনাদের কমেন্ট গুলো আমার লেখার অনুপ্রেরনা। আজ এ গল্পের শেষ পর্ব লিখলাম। গল্পটা পড়ে আপনাদের কেমন লাগলো, জানাতে ফুলবেন না। প্লিজ। দোয়ায় রাখবেন, যেন নতুন কোন গল্প নিয়ে খুব শিঘ্রই আবারও আপনাদের কাছে ফিরে আসতে পারি।

#সিরাজুম_মনিরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here