#ধূসর_ভালোবাসা
পর্ব ২০
বর্ণিল জীবনের রঙ আপসে বিবর্ণ হয়ে মিশে যাচ্ছে – নিকষকালো অবেলায়। যেভাবে দিনের আলোর মতো গোধূলিতে মিশে যায় অগনিত জীবন।
যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ – এও এক মায়াময় সত্ত্বার নাম। যেরকম মায়াময় সত্ত্বায় মানুষ বেড়ে ওঠে সেভাবে একদিন ঝরেও যায়। হয়ে যায় সুদূরের শঙ্খধ্বনি! পেছনে পড়ে থাকে তখন শুধু তার বলা আর না বলা অতীত। আর আমার পুরো অতীত জুড়েই শুধু নিয়াজ।
ছেলে মেয়ে মা ভাই বোন সবার অক্লান্ত পরিশ্রমে আমার হাঁটা চলার গতি আগের চেয়ে অনেক ভালো হতে শুরু করেছে। খুব দ্রুততার সাথে আমি সুস্থ হতে শুরু করেছি, তবে সে সময়টাও প্রায় তিন মাস।
চার মাসের মাথায় অফিসে যাওয়া শুরু করলাম। ভাই চলে গেলো, ইরা চলে গেলো। আবীরকে আবার বোর্ডিং এ পাঠিয়ে দিলাম, তবে সে বলে গেছে এর পর আর সে বোর্ডিং এ পড়বে না। আবীর এবার এস এস সি দিবে। আমার ইচ্ছা ছিলো, একেবারে ইন্টার কমপ্লিট করে তবে বাড়িতে আসুক। কারন হাজার হলেও নিয়াজের রক্ত ওর শরীরে। কখন যেন বিপথে যায়, সে ভয় সব সময় আমার।
অফিসে গিয়ে রেগুলার শেফালি আন্টির সাথে কথা হয়, তার মাধ্যমেই আমি নিয়াজের সব খবর পাই। আর নিয়াজের সংসার, সন্তান সব খবর পাই। বাড়িতে কাউকে বলতে পারিনি।
আমি আজো পথ চেয়ে ছিলাম, নিয়াজের জন্য। আমার প্রতিটি স্মৃতিতেই নিয়াজের ছায়া। আমিতো জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুধু একজনকেই ভালোবেসেছি। কিন্তু শুধু মাত্র একটু ভালোবাসা দিতে তোমার অনেক কষ্ট। আর আমার স্মৃতির পাতায় শুধুই তোমার অবহেলার চিহ্ন।
তবুও আমার মন আনমনে তোমার কাছে ছুটে যায়। এখনো আমার সকাল বেলার স্নিগ্ধ বাতাস, তোমার কথা মনে করিয়ে দেয়। রংধনু দেখলে, তোমার বিবর্ন জীবনে হারাতে মন চায়।
আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছো তুমি, আপন করতে শিখিয়েছো তুমি, শেষ জীবনে পর করার সুত্র টাও তুমিই শেখালে। একজীবনে আর কতো? আমি যে আর পারছি না।
তুমি কখনও কল্পনাও করতে পারবে না যে, একটা স্থান তিলে তিলে গড়ে নিজের আপন করার পর, তা হারানোর কি কষ্ট।
তোমাকে ছেড়ে আসার ইচ্ছে আমার কখনও কল্পনাতেও ছিল না, শুধু ভেবেছিলাম হয়ত এটার কারনে তুমি পাল্টে যাবে। একজন সত্যিকারের স্বামী, মমতাময়ী বাবা হয়ে ফেরত আসবে।
ভালোবাসা হলো সুখের একটি ঠিকানা, যা খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু ভালবাসার মতো যোগ্য মানুষ, পাওয়া খুব অসম্ভব। তুমি তা সুনিপুণ ভাবে শিখিয়ে দিলে।
তুমি স্বামি হয়েছো কবে অন্যের, বাবাও হয়েছো অন্য কারো, তবে আমার সন্তানদের এতিম করে তারপর। এই সন্তান গুলো রাত নিশীতে তোমার জন্য কাঁদে। ওরা আমাকে বলে না, তবে ওদের নির্ঘুম চোখ আমাকে অবলীলায় পুরোটা বলে যায়। তারাও যে বাবার মমতায়, আহ্লাদে, আশকারাতে নিজেদের দেখতে চায়। ওদেরও তোমাকে খুব দরকার ছিল। তুমি ওদের হলে না। প্রকৃতি সব কিছুর জবাব দেয়, কোনদিন না কোনদিন তোমারও ওদেরকে খুব প্রয়োজন হবে। হয়ত সেদিন তাদেরও আর সময় থাকবে না।
আমি চাই, আমার সকল না বলা কথার উত্তর দিক ঐ প্রকৃতি। তার পানে চেয়ে রইলাম। শেষ জীবনে হলেও আমি তোমার অশ্রুসজল চোখ গুলো দেখতে চাই, যেখানে থাকবে শুধুই আমার পুরো স্বত্ত্বা অর্থাৎ আমার সন্তানদের হারাবার যন্ত্রনা।
তবে এখন মনে হচ্ছে সব কথা অবন্তি ও মায়ের জানার দরকার। আর তাই আজ অফিস থেকে বাড়ি ফিরে সবকিছু অবন্তি ও মাকে বলবো। আমার কষ্ট গুলো বুকে চেপে পথ চলা খুব কষ্টকর হয়ে পড়েছে। তাদেরকে কষ্টের ভাগ দিয়ে একটু মুক্তি চাই। তবে এও জানি আমার কষ্টের দায়ভার শুধুই আমার। আর কেউ পারবে না এর ভাগিদার হতে।
—
মামনির অফিস থেকে ফেরার সময় হয়ে গেছে, ডায়রিটা সঠিক স্থানে রেখে দিলাম।
সাদ ফোন দিয়ে জানালো, আগামী কাল সে ঢাকায় আসছে, আমার সাথে জরুরী কথা আছে।
চিন্তায় আর বহু প্রশ্নে আমার মাথা ছিড়ে যাচ্ছে। কি এমন হলো ছুটির দিন গুলো বাবা মায়ের সাথে না থেকে ঢাকায় আসতে চাচ্ছে। কেন এতো বিমর্ষ শোনালো সাদের কন্ঠ। তার কন্ঠে রাজ্যের বিরাগ। তুমুল আন্দোলিত মনে হলো ওর মন।
সাদের অনেক গুলো চিঠি আমার কাছে আছে। আমি ঢাকায় চলে আসার পর ও পাঠাতো। যার খুব কম চিঠির উত্তর আমি দিয়েছি। কারন আমি সে সময় চাইতাম যেন সাদ আমার জীবন থেকে চলে যাক। কিন্তু সাদের প্রতিটা চিঠি আমাকে বার বার সাদের দিকেই টেনে নিয়ে যেতো।
এতোটা বছর আমি সাদকে চিঠিতে চিনেছি, ফোনের মাঝে চিনেছি এবং বাস্তবেও চিনেছি। তবে একটা জিনিস আমি সব সময় লক্ষ্য করেছি। সাদ এবং আমি যখন কোথাও থাকি একসাথে, আমরা প্রানবন্ত উৎফুল্ল থাকি। সেই মুহুর্ত গুলোতে কষ্ট কিংবা বিষাদ আমাকে গ্রাস করতে পারে না, আর সাদ ও থাকে প্রফুল্ল যেমন টা আমি সাদের বাসাতেও দেখিনি। সাদ নিজে বলে, যে সে আমার সাথে থাকলে পৃথিবীর সব ভুলে যায়। তখন সাদের পৃথিবী শুধুই আমি। তাহলে আজ কি হলো সাদের? এমন করে কেন কথা বলছে।
কত মানুষ প্রতি নিয়ত চলে যাচ্ছে- চলে যায়, কিন্তু আমার জীবন থেকে সাদ চলে গেলে তা মেনে নেয়া আমার জন্য খুব কঠিন।
মামনি অফিস থেকে ফিরে কিছু না খেয়ে মামনির ঘরের বেলকনিতে ইজি চেয়ারটায় বসে আছেন। মামনির খুব মন খারাপ হলে সে ওখানে বসে থাকেন। আর এই দৃশ্যটা আমি সহ্য করতে পারিনা। মামনির চোখের পানি জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি। এই অশ্রু আজীবন নিরবে ঝরে গেছে। কিন্তু এখন আমি মোটেও তা সহ্য করতে পারি না। এর আগে মামনিকে আমি একা রেখেছিলাম, জীবনে আর এ ভুল করবো না। মামনির পায়ের কাছে বসে মামনির কোলে মাথা রাখলাম। আমাকে কাছে পেয়ে মামনি ছোট শিশুর মতো কাঁদতে শুরু করলো। আমাকে শক্ত করে বুকের সাথে জড়িয়ে কতক্ষন কাঁদলো বলতে পারবো না, কারন আমিও মামনির বুকের মাঝে আমার সব কষ্ট গুলো চোখের পানির সাথে ভাসিয়ে দেবার জন্য চেষ্টা করছিলাম। মা মেয়ে একে অপরের বুকে অসহ্য যন্ত্রনা নিয়ে, নিজেদের মাঝে নিজেরাই কষ্ট পুড়াই। হয়ত নিজেরাই পুড়ি। তবুও বেঁচে থাকতে হয়, তবুও হাসতে হয়। এরপরেও বাঁচাতে হয়।
মামনির বুকের যন্ত্রনা হয়ত কল্পনা করার মতো ক্ষমতাও আমার নেই, তবে সাদের ফোনের পর থেকে কিছুটা হলেও বুঝতে পারছি।
মামনিকে নিয়ে বিকেলে ছাদে গেলাম, দুপুরে একপশলা বৃষ্টি হয়েছে। আর বিকেলে ছাদে উঠে দেখি রংধনু উঠেছে। আমাদের মন ভালো হয়ে গেলো এই রংধনু দেখে। আকাশের রুপ আজ অনন্য লাগছে, রংধনুর কারনে। পৃথিবীর কাউকে বলতে পারবো না যে এই রংধনুর মতো আমার মনের ভেতর হাজারো রঙ্গের কষ্ট। যা বয়ে চলছি, হয়ত এভাবেই পার করতে হবে আজীবন।
পরদিন আমি ঘুমিয়ে আছি, সাদের ফোন।
– হ্যালো।
– অবন্তি তুমি ঘুমাচ্ছ?
– আসলে ভোরের দিকে ঘুম আসছে, তাই উঠতে দেরি হয়ে গেছে। সাদ, তুমি কোথায়?
– তোমার বাসার সামনে। খুব তাড়াতাড়ি বাহিরে আসো।
লাফ দিয়ে উঠে দেখি বেলা ১১টা বাজে। কেও ডাকেনি আমাকে। খুব তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নাস্তা না করেই বেরিয়ে পড়লাম। পেছন থেকে নানী বকেই গেলো যে কেন আমি নাস্তা না করেই বের হয়ে যাচ্ছি। নানী আমার জরুরী ক্লাস আছে। আমি ক্যাম্পাসে খেয়ে নিবো। তুমি চিন্তা কোরো না।
সাদ আর আমি রিক্সায় বসে, সাদের মুখে কোন কথা নেই। নিরব হয়ে কখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকছে, কখনও দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। আমি সাদকে বলতে পারছি না, যে তার এই নিরবতা আমাকে চুর্ন বিচুর্ণ করছে। আমি প্রতি মূহুর্ত নিঃশ্বেষ হয়ে যাচ্ছি, সাদের এই বিমুর্স্ব মূর্তি, আমাকে তপ্ত আগুনের ন্যায় পুড়িয়ে অঙ্গার করছে।
জানিনা, তোমার নিরাবতা ভাঙ্গলে না জানি কোন ঝড় তুফানের সামনে আমি পড়বো। যদি তোমাকেই হারাতে হয়, তবে আমার অন্তর আত্নার মৃত্যূ হবার আগে আমার যেন মরন হয়।
ধানমন্ডি লেকে আমরা দুজন বসলাম। সাদ নিরাবতা ভাঙ্গলো। আমার হাতটা দুহাতে তুলে মলিন মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
– যদি সব ছেড়ে আমি তোমার কাছে আসি, তুমি আমার শূন্য হাত ধরে আগামীর পথে হাঁটবে আমার সাথে?
– তুমি কি বলছো বুঝতে পারছি না। আমাকে একটু খুলে বলবে, তুমি যা বলতে চাচ্ছো। তোমার মুখ শুকনো লাগছে, সকালে নাস্তা করেছো?
– অবন্তি তোমাকে কি করে বলবো? আমি নিজেও কিছু বুঝতে পারছি না।
– প্লিজ বলো না সব কথা।
– গতকাল দুপুরে খাবার টেবিলে, আব্বা বললেন যে! আগে বলো তুমি রাগ করবে না! আমাকে ভুল বুঝবে না!
– উফ! বলো প্লিজ। আমি রাগ করবো না, ভুল ও বুঝবে না।
– আব্বা খাওয়ার টেবিলে তোমার কথা জিজ্ঞেস করলো, তুমি কেমন আছো, কি পড়ছো, এসব কথা। তারপর বললো, দেখ সাদ, ছোট থেকেই তুমি আফরিন আর অবন্তি এক সাথে বড় হয়েছো। মানে আফরিনের সাথে পড়ার কারনে অবন্তির সাথে তুমি বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলে। আর মেয়েটাকে আমারও বেশ পছন্দ। তাই কখনও তোমাদের ওর সাথে চলা ফেরা করতে আমি বাঁধা দেইনি। কিন্তু এখন সমস্যা অন্য। অবন্তির বাবা কেমন মানুষ তুমি জানো। তার থেকেও বড় ব্যাপার ওর বাবা মায়ের ডিভোর্স। এবং অবন্তির বাবার আবার বিয়ে, সেখানে বাঁচ্চা ও হয়েছে শুনেছি। বাবা সাদ, তোমার কি মনে হয় এতো কিছুর পরেও তোমাদের দুই ভাই বোনের অবন্তির সাথে চলা ফেরা করা উচিত? মাথা নিচু করে বললাম, বাবা আমি অবন্তিকে ভালোবাসি। বাবা আরো রেগে গেলেন। বললেন মানসম্মান থাকবে না। বাবা এতো কিছুর পেছনে অবন্তির কোন হাত নেই। সে অনেক ভালো মেয়ে। তুমি ওর বাবাকে দেখে অবন্তির বিচার করতে পারো না।
বাবা বললেন,
-পৃথিবী তোমার কাছে আমার চিনতে হবে না। আমি দুনিয়া চিনি। এসব ভাঙ্গা পরিবারের ছেলেমেয়েরা খুব সুবিধার হয় না। এদের সাথে জীবনে সামনে আগানো সম্ভব না। তুমি আমাকে এসব বোঝাতে এসো না।
-বাবা প্লিজ।
– তোমার সাথে এ বিষয়ে আমি কোন কথা শুনতে চাই না। তুমি আর অবন্তির সাথে কথা বলবে না। এটাই আমার শেষ কথা।
বাবার সাথে আর আমার কথা হয়নি। রাতের ট্রেনে রওনা দিয়েছি। সকালে এসে পৌছেছি। আমি তোমাকে ছাড়া এক মুহুর্ত থাকতে পারবো না। তোমাকে ছাড়া জীবনের একটা দিন আমি ভাবতে পারবো না। তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি অবন্তি, নিজের থেকেও বেশি। আর তাই আমি চাই তোমাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। কারন বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে। কাল দুপুরেই বলেছে। বাবার বন্ধুর মেয়ের সাথে। অবন্তি আমি কিছুই ভাবতে পারছি না। বাবা নিজেই তোমাকে অনেক পছন্দ করেন। তোমাদের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। আফসোস করতেন তোমার জন্য, যে তুমি কত কষ্ট পাচ্ছো তোমার বাবার কারনে। তাহলে আজ কেন এমন করছে?
#সিরাজুম_মনিরা