ধূসর ভালোবাসা পর্ব-২১

0
859

#ধূসর_ভালোবাসা
২১তম পর্ব

আমি অনেকক্ষন চুপ চাপ বসে রইলাম। দুর আকাশে আজ অনেক মেঘ। বুঝতে পারছিনা, আমার মনে বেশি মেঘ নাকি আকাশে। রৌদ্রছায়ার জীবনে আমি কি হারাই আর কি পেয়ে যাই, আমি নিজেও কল্পনা করতে পারি না।

যাদের জীবনে বাবা নামক সবচেয়ে কাছের মানুষটাই পর হয়ে যায়। তাঁরাই শুধু জানে এর কষ্ট কতটা। আর পৃথিবী তাদের কোন চোখে দেখে। বাবা যাদের থেকেও নাই, তাদের জন্য পুরো পৃথিবী শুন্য সমতুল্য। তাদের সমবেদনা অনেকেই দেয়, কিন্তু ভরসার হাত কেউ এগিয়ে দেয় না। যখনই বাবা মায়ের সম্পর্কের ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়, সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায় সে সন্তান। শুধু তাই নয়, সমাজে সে অবহেলার বস্তুও হয়ে যায়। অসহায় এ মানুষ গুলোর স্বভাব চরিত্র তখন সবার বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। হোক সে ভালো কিংবা খারাপ। হোকনা কেন ধার্মিক কিংবা পর্দানশীল। তাদের পরিচয় একটাই ব্রোকেন ফ্যামেলী অর্থাৎ ভাঙ্গা পরিবারের সন্তান।

তারা সমাজের যেখানেই যেভাবেই থাকুক, শুনতে হয়ই যে ব্রোকেন ফ্যামেলীর ডেসপারেট ছেলে মেয়ে। পৃথিবী যতই উন্নত হোক, কিছু দৃষ্টি ভঙ্গী কখনই পাল্টায় না।

তবে সাদের বাবার ব্যাপারটা আলাদা, উনার মনোভাব জানার পর কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। কারন ছোট থেকে তাকে একজন খুব ভালো মানুষ হিসেবে চিনি। সে যেমন ভালো মানুষ, তেমন ভালো বাবা। কিন্তু সে যখন এমন টা চিন্তা করেছেন, তাহলে অবশ্যই তার দূরদৃষ্টি দিয়েই চিন্তা করেছে। হয়ত ………

আমি নিজেকে খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম। কথা বলার সময় গলা জড়িয়ে আসছিল। কিন্তু অনেক করে নিজেকে বুঝালাম যে, হয়ত পৃথিবীর বহু সুখ আমার কপালে নেই। তারপর সাদকে বললাম,

– সাদ, উনি তোমার বাবা। এবং উনি খুব ভালো মানুষ, বাবা হিসেবেও অনেক ভালো। উনি যখন বলেছে যে আমি তোমার উপযুক্ত নই। তাহলে উনি ভেবেই বলেছেন। আর বড়রা ভুল বলেন না।

– তোমাকে ছাড়া নিজের জীবন আমি কল্পনাও করতে পারি না। সেই কবে থেকে তুমি জড়িয়ে আছো আমার স্বত্তায়। আমি আমার পাশে শুধু তোমাকেই চাই। আর কোন কিছুই আমি কল্পনা করতে পারবো না। সে কারনে আমি আজ চলে এসেছি। কয়েক মাসের মধ্যেই আমার পড়াশোনা শেষ হয়ে যাবে। তারপর ঢাকায় চলে আসবো, কোন একটা চাকরি হয়ে যাবে, ইন-শাহ আল্লাহ। এরপর তোমাকে নিয়ে ছোট্ট একটা সংসার, ব্যাস।

– বুঝলাম, কিন্তু বড়দের দোয়া, তা জীবনের সব বাকেই প্রয়োজন।

– সেটা আমিও বুঝি। কিন্তু উনারা যদি আমার পছন্দের কথা মাথায় না রাখে। তাহলে কেমন করে কি বলো?

– বাবা মাকে অসন্তষ্ট করে কেউ সুখি হতে পারে না। জীবনে ভালো থাকতে হলে, বাবা মায়ের দোয়া সবার আগে প্রয়োজন। জীবনে যা কিছুই আজ তুমি, তার সব টুকু তাদের অবদান। আর আজ আমার জন্য তাদের কথা ভুলে গেলে চলবে বলো? উনারা আমাদের বাবা মা, তাদের উপর দিয়ে আমরা কথা বলতে পারিনা। এটা উচিত না।

– আমিতো অস্বীকার করছি না তাদের প্রতিদান।

– তাহলে?

– তাহলে, আমি বাবা মায়ের সাথে তোমাকে চাই।

– আমিও তাই চাই, এমন একটা ঘর জাতে বাবা মা ভাই বোন সবাই মিলে থাকতে পারি। আমি তোমার বাবা মা ছাড়া তোমাকে আপন করতে পরবো না। আমি বড়দের দোয়া চাই, ভালোবাসা চাই। চাই সুখের সংসার। জীবনে অশান্তি অনেক দেখেছি। বাকি জীবন সুখে থাকতে চাই।

– কি করবো এখন বলো?

– কিছু করার নেই, তুমি পড়া শেষ করো। ভালো করে জীবনটাকে গড়ো, তাড়াহুড়োর কিছু নেই। তারপর উপর ওয়ালার ইচ্ছা থাকলে এবং তোমার বাবা মা ও আমার মামনির ইচ্ছায় আমরা বিয়ে করবো।

– যদি আমার আব্বা মা রাজি না হয়?

– তাহলে…………আমি আর কোন কথা খুঁজে পেলাম না।

– তুমি যা বলেই আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করো না কেন অবন্তি, জীবনের শেষ বেলার স্নিগ্ধ প্রতিটা বিকেলের সঙ্গী হবে তুমি। তোমাকে ছাড়া আমার জীবনের একটাও সকাল আমি দেখতে চাইনা।

– ও তাই না? তুমিতো সেদিন বললে, তোমার ডিপার্টমেন্ট এ একটা সুন্দর মেয়ে এসেছে। ডিপার্টমেন্টের সবাই পাগল প্রায়।

– হুম সত্যিতো, কিন্তু আমার কথাতো বলিনি। আমিতো সেই কবে থেকে তোমার প্রেমে ডুবে আছি।

– সে দেখা যাবে, সময় আসুক।

– এখনো সময় হয়নি? বাবা আজ আমার এংগেজমেন্ট করাতে নিয়ে যেতো সন্ধ্যায়, তার বন্ধুর বাসায়। আমি তোমার জন্য রাতের বেলা পালিয়ে চলে এসেছি। পরবর্তি মাসের খরচ পাবো কিনা কে জানে। ভাবছি চিটাগং যেয়ে কয়েকটা প্রাইভেট নিতে হবে। তবুও তুমি আরও পরীক্ষা নিতে চাও আমার?

– আমি ভাবছি, আমার কারনে তোমার বাবা কত কষ্ট পেলো। নিজেকে খুব ছোট আর স্বার্থ পর লাগছে।

– তুমি আমার প্রেমে প্রথমে পড়োনি। আমি তোমার প্রেমে পড়েছি। বহু বছর তোমার পিছে পিছে ঘুরে তবে তোমার মন পেয়েছি। তাহলে এখানে তোমার দোষ কোথায়। দোষ তো আমার। আর আমার বাবাও তোমাকে পছন্দ করতো। এখন তোমার বাবা যদি তোমাদের সাথে অন্যায় করে, সে জন্যে কি তুমি দায়ী? তুমি কিসের শাস্তি ভোগ করবে? তোমাকে আমি ছোট থেকে পুরোটা চিনি। তোমার মতো লক্ষী, আত্নিনির্ভরশীল, সৎ মানুষ খুব কম আছে। তোমার ডিপার্টমেন্ট, যেখানে তুমি এতোটা বছর ধরে পড়ছো, সেখানেও তোমাকে সবাই খুব ভালো, দয়ালু মানুষ হিসেবে জানে। এবং তুমি পরোপকারী হিসেবে সবার ভালবাসার পাত্রী। এর পরেও যদি তোমাকে তোমার বাবার কর্ম দিয়ে সমাজ বিচার করে, তাহলে আমি ধিক্কার জানাই এমন সমাজকে। কোন দরকার আছে এমন ভঙ্গুর সমাজের। যে দিনের পর দিন অন্যায় করে সে মাথা উঁচু করে চলে। আর যারা অন্যায় সহ্য করে, নিরবে পথ চলে, তাদের সব দোষ দেয়।

– সাদ স্যার, আমার প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়েছে। নাস্তা করিনি।

– আমি কাল দুপুরের পরে থেকে কিছু খাইনি। তোমার জন্য আমার সব ক্ষুদা মরে গেছে। আর তুমি পড়ে আছো ক্ষুধা নিয়ে।

– কি বলো? তুমি কাল রাতেও খাওনি। ওঠো, এক্ষুনি চলো, খাবো।

আমি যতটাই সাদের সামনে শক্ত হয়ে আছি, ভেতরে ততটাই ভঙ্গুর হয়ে গেছি। আমার জীবনটা অনেক কষ্টের, এটা মেনে নিয়েছি বহু আগে। তবুও কিছু কিছু ঝড় সামলে নিতে আমি বার বার ভেঙ্গে যাই। যতই চেষ্টা করি নিজেকে সামলে নেবার ততই আমি ভঙ্গুর হয়ে পড়ি। নিজেকে অসহায় মনে হয়। চার পাশটা একদম অন্ধকার। যে আমি সারাদিন মানুষকে হাজারও সাহায্য করি। কিন্তু সেই আমি রাতের আঁধারে একা, নিস্বঙ্গ, অসহায়। অথচ আমার নিজের কোন দোষ নেই। আমি নিজে ইচ্ছায় তো পৃথিবীতে আসিনি। বিধাতা আমাকে পাঠিয়েছেন, আমার এই নির্মম ভাগ্যে হয়ত তার কোন লিলাখেলা। আমি তা মেনে নিয়েছি। প্রতি নিয়ত লড়াই করে যাচ্ছি আমার ভাগ্যের সাথে। কিন্তু তবুও বেলা শেষে আমি ডিভোর্সি বাবা মায়ের সন্তান। আমি ভালো না, আমার সাথে মেশা যাবে না, চলা ফেরা করা যাবে না। আমি ……………

সাদকে আমার মনের কোন খবর জানতে দেইনি। আমি যে কি পরিমান কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি সে তা জানে না। তবে………….
আমরা নাস্তা সেরে, আবার অনেকক্ষন গল্প করলাম। রিক্সা নিয়ে ঢাকা শহরেরই রাস্তায় ঘুরে বেড়ালাম।

সন্ধ্যার কিছু আগে বাড়ি ফিরলাম। সাদ চলে গেলো চট্টগ্রামে, চুয়েটে। বাসায় আজ মামনির অফিসের কলিগ তমালিকা আন্টি এসেছেন। উনি মামনির ঘরেই আছেন। মামনির আজ মনটা বেশ ভালো। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে কার না ভালো লাগে। ইচ্ছে হচ্ছে মামনিকে জড়িয়ে ধরে বলি, মাগো তোমার সন্তানকে মানুষ বিচার করে, তোমার অতীত জীবনের আবর্তে, যেখানে তুমি ছিলে খেলনা আর আমি তোমার ছায়া।

মাগো পৃথিবীতে আমি একটা আলাদা প্রজাতী, তা হলো- ডিভোর্সি বাবা মায়ের সন্তান। তুমি যতই ভালো হও গো মা, তবুও মানুষ এটাই বলে,- এমনি এমনি কি স্বামীর ভাত জোটে নি, অবশ্যই কোন দোষ ছিল। চরিত্র হয়ত ভালো না। হায়রে মানুষ, হায়রে দুনিয়া।

এ দুনিয়ায় দুর থেকে সমবেদনা জানানোর অনেক মানুষ, তবে কাছে এসে, শক্ত হাত কাঁধে রেখে বলবে যে আমি আছি পাশে, চিন্তা করোনা। সে রকম মানুষের বড় অভাব।

আজ সাদ আমার জন্য সব ছেড়ে চলে এসেছে, কিন্তু এমনটা কি সে থাকবে আজীবন। নাকি তারও কখনও মনে হবে, ব্রোকেন ফ্যামেলীর মেয়ে! আমার মাথা পুরো শূন্য হয়ে আসছে। চিন্তা করার ক্ষমতা যেন লোপ পাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছি অজানায়। কে আপন আর কে পর আজ চিন্তে বড় কষ্ট হচ্ছে, আসলে চিন্তেই পারছি না।

#সিরাজুম_মনিরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here