ধূসর ভালোবাসা পর্ব-২২

0
850

#ধূসর_ভালোবাসা
পর্ব-২২

সন্ধ্যার দিকে মামনির ঘরে গেলাম। তমালিকা আন্টি এসেছেন। তমালিকা আন্টি আমাকে অনেক আদর করেন। উনার সন্তান নেই। নেই বলতে, উনি যখন প্রেগনেন্ট ছিলেন কখন উনার উচ্চবিত্ত মাতাল স্বামী উনাকে জোরে ধাক্কা দেয়। উনি পড়ে যান, তারপর বাচ্চাটা পেটেই মারা যায়। মেয়ে বাচ্চা ছিল, আর কদিন পরেই তার পৃথিবীতে আসার কথা ছিল। উনার হাসবেন্ড খুশি হন, কারন মেয়ে বাচ্চা ভুমিষ্ট না হয়ে মরে গেছে বেশতো। কিন্তু তমালিকা আন্টি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন কিছুদিন এবং হারিয়ে ফেলেন বাচ্চা জন্ম দেবার ক্ষমতা। উনার হাসবেন্ড আবার বিয়ে করে, আন্টি নিজে থেকেই চলে আসেন কারন উনার হাসবেন্ড, প্রভাবশালী উচ্চবিত্ত একজন চরিত্রহীন লোক। তার সাথে বহু কষ্টে আন্টি আট বছর সংসার করেছে। কিন্তু এর পর আর সম্ভব হয়নি। পরে যে বিয়েটা করে, সেই মেয়ে উনার হাজব্যান্ডের মতোই স্বভাবের।

মায়ের কাছে গিয়ে, আন্টির কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। আন্টি বললেন,

– আয় মা, আয়, আমার বুকে আয়। তোকে দেখলেই, আমার মেয়েটার কথা মনে পড়ে। সে বেঁচে থাকলে তোর সমান হতো। তোর মতো করেই আমার বুকের মাঝে, পুরোটা জড়িয়ে থাকতো।

– তমাল আন্টি, তুমি আংকেলের খোঁজ রাখো?

– দিব্যি রাখি, কারন কি জানিস? ওর শাস্তি হবেই, আর আমি তা নিজ চোখে দেখতে চাই। আর খোঁজ রাখাও লাগে না। আমার মায়ের বাড়ি আর ওদের বাড়ি একই পাড়ায়। খোঁজ খবর একা একাই আসে।

– তোমার সাথে আঙ্কেলের বিয়ে কিভাবে হয়ে ছিল?

– সে লম্বা কাহিনীরে মা, অন্য দিন বলবো।

– আজ বলোনা, প্লিজ।

– হা হা হা। পাগল, এসব শুনে তোর ভালো লাগবে না।

– খুব লাগবে। তুমি বলো।

– আমি যখন ক্লাস সিক্সে তখন বাবা বাড়িটা কিনে, আর সে সুত্রেই আমরা ওদের পাড়াতে আসি। আমার ছোট ভাইটা তখন খুব ছোট। বাবা চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় থাকতেন। আমার পড়ালেখার জন্য বাবা বাড়িটা কিনেন। যাতে বাবার সাথে সাথে আমাদের সব জায়গায় না যেতে হয়। এতে আমাদের পড়ার ক্ষতি হয়। বাবা না থাকায়, আমার মামা আমাদের সাথে থাকতেন। এবং মামা ঢাকা কলেজে পড়তেন। মামার সাথে পাড়ার ছেলেদের বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর তাদের মধ্যেই একজন আমার হাসবেন্ড শওকত। সে আমাকে সেই ছোট থেকেই পছন্দ করতো। পাড়ায় ওদের খুব প্রভাব, কারন তাদের মতো উচ্চবিত্ত পাড়াতে আর কেউ ছিল না। আমি নাইনে পড়ি তখন বুঝতে পারি যে সে আমাকে ভালোবাসে। খুব ভালোবাসে। আমিও তাকে ভালোবেসে ফেলি। একটা পর্যায়ে সবাই জেনে যায়, আমাদের সম্পর্কের কথা। ওদের বাড়ি থেকে না করে দেয়। কারন তাদের আর আমাদের আর্থিক বৈষম্য । বাবাও বলেন, যে এতো বড় বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দেবো না। বিয়ের পর মেয়েকে পর করে দেবে। কিন্তু সে নাছোড় বান্দা। এক পর্যায়ে শওকত জিদ ধরে, যে আমি যদি তার সাথে পালিয়ে বিয়ে না করি তাহলে সে আত্মহত্যা করবে। এবং করেও তাই। একসাথে অনেক গুলো ঘুমের ঔষধ খেয়ে ফেলে। তারপর সুস্থ হলে, উপায় নাই দেখে আমি তার সাথে পালিয়ে যেতে রাজি হই। আসলে আমি নিজেও শওকত কে খুব ভালোবাসি। আমাদের বিয়ে মোটামুটি স্বাভাবিক ভাবেই সবাই মেনে নেয়। বিয়ের পর আমাদের মতো সুখি মনে হয় কেউই আর ছিলো। আমি পড়াশোনার জন্য দেরিতে বাচ্চা নিতে চাই। শওকত তাতেই রাজি ছিল। সে তার বাবার ব্যবসা দেখতো। ব্যবসার কাজে প্রায় দেশের বাহিরে যেতে হতো। প্রথমে আমি সাথে যেতাম ওর সাথে বিভিন্ন দেশে। পরে আমাকে আর নিতো না, বলতো আমি সাথে থাকলে, ক্লাইন্ট এটেন্ড করতে অসুবিধা হয়। আমাকে আর সাথে নিতো না। এরপর জানতে পারি আসলে সে বিদেশে যাবার সময় নতুন নতুন মেয়েদের সাথে নিয়ে যেতো এবং সব রকম নেশাও সে করতো। এগুলো শুরু হয় বাহিরে যখন থেকে একা যাওয়া শুরু করলো। আসতে আসতে আমি হয়ে গেলাম অপছন্দের ব্যক্তি। যখন বাচ্চা কনসিভ করলাম, তখন খুশি ছিল। কিন্তু পরে কেমন যেন পাল্টে গেলো। টাকার জন্য মেয়েরা তার আগে পিছে ঘুরতে লাগলো। আর সে দিনে দিনে হারিয়ে যেতে লাগলো অন্য জগতে। তার এসব কাজে বাঁধা দিতে গেলেই, আমার উপর অকথ্য ভাষা। চুপচাপ সহ্য করছিলাম, কিন্তু আমার ডেলিভারির আগে সে খুব অন্য রকম হয়ে গেলো। একদিন বুঝানোর জন্য কেবল কথা বলেছি, আমাকে কিছু বুঝে উঠার সুযোগ না দিয়েই এমন জোরে ধাক্কা দিলো। আমি মাটিতে পড়ে যাই, পেটটা সোফার হ্যান্ডল এ পড়ে, তারপর মাটিতে। আমি আর কিছুই বলতে পারিনা। যখন জ্ঞান ফেরে তখন সব শেষ। আমি মা হতে পারবো না তাই সে বিয়ে করে। এর পর আমি হয়ে যাই সংসারের উচ্ছিষ্ট। আমি নিজেই তার জীবন থেকে সরে আসি।
তবে সে ভালো নেই মা। একটা ছেলে, নেশায় ধুর। কারো কথা শোনে না। টাকা না দিলে বাবা মাকে অপমান করে। মেয়েটা…. আর না বলি, ভালো লাগছে না।

আমি আন্টির কোলে শুয়েছিলাম। বুকের মধ্যে মোচড় দিল। মনে হলো, আমার ভালবাসার মোহ কাটলে সাদও কি এমন করবে। সেও কি….?

তমালিকা আন্টির দিকে তাকিয়ে আমি বললাম,

– আন্টি সব পুরুষই কি এমন?

– কখনোই না মা, তাহলে কি পৃথিবী চলত? এই পৃথিবীতে যেমন ভালো মেয়ে মানুষ আছে, ঠিক তেমনি ভালো ছেলেমানুষ ও আছে। অনেক মেয়ে দেখো, কত সুখে আছে। তাদের অনেকেই এমন যে সংসারি নয়, তবুও তাদের স্বামী সব সহ্য করছে। ভালোবেসে মনে রানি বানিয়ে রাখছে। ভালো খারাপ তা মানুষকে দেখে বোঝাটা খুব কঠিন, আবার ক্ষেত্র বিশেষে খুব সহজ। কোন মানুষ কখন যে কি করবে বোঝা কঠিন। অনেক ভালো ছেলে, মেয়েদের কারনেও খারাপ হয় মা। অনেক মেয়ে থাকে টাকা ওয়ালা মানুষ দেখলেই পিছু লেগে যায়, ব্যস, এমন ভাবেও ছেলেরা খারাপ হয়ে যায়।

তমালিকা আন্টির কথায় মাথা কেমন গুলিয়ে গেলো। তবে এটা জানতাম না যে, মেয়েরাও খারাপ হয়। মেয়েরাই মেয়েদের ক্ষতির কারন।

আবীর পরীক্ষা দিয়ে বাসায় এসেছে, ওর ইচ্ছা যে আর বোর্ডিং এ যাবে না। বহুদিন পর দুই ভাই-বোন অনেক গল্প, ঘুরে বেড়ালাম। বাবার জন্য আবীরের মনটা মাঝে মাঝেই খারাপ হয়ে যায়। বাবার শূন্যতা আবীরকে জেকে ধরে। কারন সে যখন কোন বাবাকে দেখে সন্তানদের আদর করছে, সেও তার আসে পাশে শূন্যতা অনুভব করে। যেদিন ও শুনলো যে বাবা আবার বিয়ে করেছে সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিল, ছোট বাচ্চার মতো ডুকরে কেঁদেছিল। মাকে জড়িয়ে ধরে বার বার বলছিল, মামনি আমি আছি তোমার পাশে। তুমি মোটেও চিন্তা করবে না। তুই আর অবন্তী ভালো ভাবে মানুষ হবি সোনা, আমার আর কিছু লাগবে না। কোন দিন যেন তোদের জন্য আমাকে ছোট হতে না হয়, সে দিকে খেয়াল রাখবি। আর ভালো মানুষ হবি, মামনি বললেছিল।

কিন্তু সেদিনের পর থেকে আবীর অনেক পাল্টে গেছে। কথা কম বলে, সব সময় পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। যেহেতু এস এস সিতে খুব ভালো রেজাল্ট হয়েছে, তাই ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়ে গেলো। তবে ওর জগৎ আসলে বই। মামনি সব সময় ভয় পেতো, যদি আবীর বাবার মত হয়। কিন্তু আবীর আসলেই খুব ভালো মানুষ, ভালো ভাই এবং ভালো সন্তান। সে একেবারে মামনির মনের মতো করে মানুষ হচ্ছে।

আমার ও সময় এখন জীবন গড়বার। সাদ ঢাকায় একটা বেসরকারি জব করছে। স্যালারি বেশ ভালো, তবে এর থেকে আরও ভালো জব এর জন্য চেষ্টা করছে। আমিও বেশ কয়েক যায়গায় এপ্লাই করেছি। তবে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হলো না। মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিতে খুব ভালো একটা জব হয়ে গেলো। মাস্টার্স এর জন্য আমি এক্সিকিউটিভ ব্যাচে ভর্তি হলাম।

মামনির অফিস থেকে ট্যুরে নিয়ে যাবে, সুন্দর বনে। আমি আর আবীর জোর করে মামনি আর নানীকে ট্যুরে পাঠালাম।

তবে মনের মধ্যে কেমন যেন অশান্তি লাগছে। বার বার বুক চেপে আসছে। মনে হচ্ছে কারন ছাড়াই খুব কাঁদি। আবীরেরও ভালো লাগছে না। মামনির সাথে আগামী ৪/৫ দিন কথা হবে না, কারন সুন্দর বনে যোগাযোগ খুব কঠিন, সেখানে নেটওয়ার্ক থাকে না।

আমরা দুই ভাইবোন একটা হাসির মুভি দেখছি আর লুডু খেলছি সন্ধ্যার পর, আর আমরা দুই ভাইবোন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছি। মন খুলে বহুদিন পর হাসলাম। আজ আমাদের কারনে অকারণেই হাসি পাচ্ছে।

বার বার ফোন বাজছে, কিনতু আমাদের কানে তা পৌছালেও ফোন ধরতে আমরা কেউই উঠি নি। কারনে অকারণে আমরা দুই ভাইবোন হেসেই যাচ্ছি। অনেক ক্ষন ফোন বাজার পর সানেকা খালা এসে ফোন ধরলেন। খালা বললেন, কে জেনো ফোন দিয়েছেন, নাম বলছে না মামনিকে চাচ্ছেন।

আমি গিয়ে ফোন ধরলাম, ওপাস থেকে বলল,

– আফিফা, আমি রফিক বলছি। তোমার রফিক চাচা।

– মামনি বাড়িতে নাই।

এটা বলে ফোন রেখে দিলাম, কারন এই লোকটা সম্পর্কে মামনির ডায়রিতে পড়েছি।তাই কথা বলতে ইচ্ছা করলো না।

কিছুক্ষন বাদে আবার ফোন বাজছে, সানেকা খালাকে বললাম ফোন ধরতে, সানেকা খালা ফোন ধরলে, লোকটা আমার সাথে কথা বলতে চাইল। আমি খালাকে বললাম, তুমি কথা বলো। কি বলে শোন। সানেকা খালা কথা বলতে বলতে আমার দিকে তাকিয়ে কাঁদছেন আর বললেন,

– অবন্তী মা, তোমার বাবা নাকি মারা গেছেন।

আমি আর আবীর চমকে উঠলাম, ফোন ধরে বললাম,

– কি বলছেন আপনি?

– ঠিক বলছি মা, তোমার বাবা সন্ধ্যার কিছু পরেই মারা গেছেন।

এই লোকের কথা আমি কি করে বিশ্বাস করি, তখন মনে পড়লো মামনির সেফালী আন্টির কথা। উনার সাথে আমারও অনেক ভালে সম্পর্ক। তাই উনাকেই ফোন করলাম।

সেফালী আপুর সাথে কথা হলো, উনি বাবার খবর জানেন না, তবে খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছেন। এমন টাই বললেন।

আমি আর আবীর অপেক্ষা করছি উনার ফোনের, কিন্তু অনেক সময় পার হলেও উনার ফোন আসলো না। আমরা মনেমনে দোয়া করতে লাগলাম, বাবা যেন ভালো থাকে। বাবার যেন কোন ক্ষতি না হয়।

বেশ অনেক সময় পর সেফালী আপু ফোন করে জানালেন, খবর সত্য, বাবা আর নেই।

#সিরাজুম_মনিরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here