ধূসর ভালোবাসা পর্ব-৩

0
1234

#ধূসর_ভালোবাসা
পর্ব-৩

আমি খুব ভয় পেয়ে কাঁপতে শুরু করেছি। এবং খুব জোরে হেটে রাস্তা পার হয়েছি। স্কুলে পৌছে কান্না পাচ্ছিল, তবে স্কুলে পৌঁছে একটু স্বস্তি পেলাম পরক্ষনেই মন খারাপ হলো এই ভেবে যে ঐ রাস্তা দিয়ে কি করে আবার বাসায় যাবো।

স্কুল শেষে আমরা রওনা দিলাম বাসার দিকে। বাসা থেকে স্কুল খুব বেশি দূরে নয়, আবার একে বারে কাছেও নয়। তাই সবার সাথে আমি হেঁটেই স্কুলে যাই।

মোড়ের সামনে আসতেই পা দুটো জমে গেলো, রিংকু আর ওদের বন্ধু গুলো বসে আছে। রিংকু ওর বন্ধুদের ডাকলো, রাজু, নিয়াজ, পারভেজ এদিকে আয়। আমাদের দেখে ওমনি আমাদের দিকে এগিয়ে আসলো। এবং আমাকে বললো,

রিংকু- তোমার মা বাবার খুব সাহস যে, আমার গায়ে হাত দেয়। আর আমার বাপের কাছে নালিশ দেয়। এবার কত ধানে কত চাল বুঝাবো। নিয়াজ এই মেয়েটার কি করবি বল?

নিয়াজ- থাম রিংকু ,মাথা গরম করিস না, আমি দেখছি।

আমার দিকে নিয়াজ নামের ছেলেটা এগিয়ে এসে বলে গেলো,

– এখান থেকে যাও, আমি দেখছি সবাইকে।

আমরা তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসলাম। পারভীন আমার হাত ধরে বলল,
– ঐ যে নিয়াজ, ঐ ছেলেটাই ওদের গ্রুপের লিডার। তোর কাছে এসে কি বলল? আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। তোকে না জানি কি বলে, কিন্তু তোকে তেমন কিছুই বলল না। বুঝলাম না ব্যাপারটা। তবে সাবধানে থাকিস।

পরের দিন, তিন রাস্তার মোড়ের ঐ দোকানে রিংকুরা সবাই আছে কিন্তু আমাদের দেখেও কিছু বলল না। অবাক হলাম আর টান পায়ে স্কুলে চলে আসলাম।

কিন্তু মাথায় আসলো না যে আজ রিংকুরা কিছু বলল না কেন? তাহলে ঐ নিয়াজ ছেলেটাই বুঝি সবাইকে বুঝিয়েছে যেন আমাকে না বিরক্ত করে।

সেদিনও স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে কেউ কিছু বলল না। বাসায় কাউকেই রিংকুদের কথা বলা যাবে না, নইলে আমাকে আর পড়তে দিবে না। আর কয়েকদিন থেকে তো আর ওরা আমাকে বিরক্ত করছে না। তাই বেশ সস্তি লাগছে।

ভাইয়া এস এস সি পাশ করেছে স্টার মার্কস নিয়ে। ভাইয়ার ইচ্ছে যে সে ঢাকা কলেজে এইচ এস সি পড়বে। বাবা অনেকের সাথে কথা বললেন এ বিষয়ে। সবাই এক মত হলেন। ভাইয়ার ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দেয়া হলো। ভাইয়া পড়াশোনার জন্য ঢাকায় পাঠানো হলো।

ভাইয়া যাবার পর থেকে সব কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বাবা প্রায় দিনই ভাইয়াকে চিঠি লেখেন, যেন ভাল করে পড়ালেখা করে আর আজে বাজে কারো সাথে না মেশে।

ভাইয়া যাবার পর থেকে আমার আরো বেশি ভয় লাগছে। আমি স্কুলে যাবার সময় কোন দিকে তাকাই না। মাথা নিচু করে যাওয়া আশা করি।

স্কুলে যাবার সময় রাস্তায় একদিন ঐ নিয়াজ ছেলেটার সাথে দেখা, সে বলল,

– কি ব্যাপার আফিফা ভালো আছো?
– জি ভাইয়া।
– তোমাকে রিংকু আর বিরক্ত করে?
– জি না।
– আমি মানা করেছি, তোমাকে আর বিরক্ত করবে না।
– আপনাকে অনেক ধন্যবাদ নিয়াজ ভাই।

নিয়াজ ভাই চলে গেলো। পারভীন আর খুকি হা করে তাকিয়ে থাকলো। বললো,

– বাবাহ, নিয়াজ ভাই তোর সাথে কি সুন্দর করে কথা বললো। আমিতো তাকে খুব বদরাগী মানুষ হিসেবে চিনি। দলনেতা মানে মাস্তানের মত ভাব নিয়ে কথা বলে। আর তোর সাথে কি সুন্দর নরম হয়ে কথা বললো। ব্যাপার বুঝলাম না।

স্কুল শেষে বাসায় এসে দেখি নানা ভাই এসেছেন। আমার আনন্দ ধরে না। নানা ভাই বাসায় আসলে, সারাটা দিন আমি আর ইরা নানা ভাই এর সাথে সারা দিন বক বক করে পার করি। নানা ভাই কোলকাতায় পড়া শোনা করতেন। উনি বিক্রম রাজার সব কাহিনী জানেন। উনি ইসলাম ধর্মের সব জানেন, সব নবী রাসুলদের জীবনি নানা জানেন। আরব্য সকল কাহিনী উনি হুবহু বলতে পারেন। বার বার উনার কাছে একই কাহিনী শুনেছি, উনি প্রতি বারই হুবহু বলেন।নানা ভাই রাম সিতার কাহিনীও বলতে পারেন নিখুঁত করে। ভারতের বহু রাজার জীবন কাহিনী উনি বিন্দাস বলতে পারেন। নানা ভাইয়ের স্বরণ শক্তি অসাধারন।

বাসার সামনে আমার ছোট্ট একটা বাগান আছে, তাতে আমার পছন্দের বহু ফুলের গাছ লাগিয়েছি। আরেক পাশে বাবা সবজি বাগান করেছেন।

আমার পৃথিবী এটুকুই। এতেই আমি মহা খুশি। বিকেলে বান্ধবীরা আসলে বাসার সামনের সবাই মিলে একটু খেলি, নইলে গল্প করে সময় পার করি। দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে আমার বইয়ের সাথে। পড়া শুনা আমার খুব খুব পছন্দের। বইয়ের বাহিরে আমার জগত খুব ছোট। আমার জগত আমার বই। মা চান যেন আমি সংসারে মায়ের সাথে একটু সাহায্য করি, কিন্তু আমার মন পড়ে থাকে রাত দিন বইয়ের পাতায়।

সেদিক দিয়ে ইরা আমাকে খুব সাহায্য করে, ইরার পড়াশোনা মোটেও পছন্দ না। তাই সে আমার পরিবর্তে মাকে কাজে সাহায্য করে। বাবা আমার প্রায় সব আবদার পূরন করার চেষ্টা করেন, কারন আমি পড়তে ভালোবাসি তাই।

নানা ভাই বাসায় আসলে মা আমাকে স্কুলে যেতে দিতে চান না, এটা আমার মোটেও পছন্দ না। পড়া আর স্কুল, এগুলোর মাঝে কেউ আসলে আমার কিছু ভালো লাগে না। আমি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখি পড়া শোনা করে প্রতিষ্ঠিত হবার।

নানা ভাইয়ের কারনে মা আমাকে তিনদিন স্কুলে যেতে দেননি। নানা ভাইয়ের বদ-অভ্যাস হলো, একটু পর পর পান বানিয়ে দিতে হয় আর সারা দিন ঘুরে ফিরে চা করে দিতে হয়। আর এ কারনেই মা স্কুলে যেতে দিতে চান না।

চারদিনের দিন নানাভাইকে পটালাম যেন মাকে বুঝিয়ে আমাকে স্কুলে যেতে দেয়।
ব্যাস কাজ হয়ে গেলো। মা কখনো নানা ভাইয়ের কোন কথা ফেলতে পারেন না। মা নানা ভাইকে খুব ভালো বাসেন, তেমনি নানা ভাই তার সব সন্তানের মধ্যে মাকেই বেশি ভালো বাসেন।

আমি বেশ কয়েকদিন পর স্কুলে যাচ্ছি। খুকি আর পারভীনকে আজ কেমন যেন লাগছে। মনে হচ্ছে কিছু বলবে, আবার বলছে না। স্কুলের রাস্তা একটাই। ঐ মোড় দিয়েই আমাদের স্কুলে যেতে হয়। মোড়ে আজো রিংকুরা সবাই দাড়িয়ে আছে। আমার এই জায়গাটাতে আসলে মনে হয় ছুটে পালাই। আমার এসব একদম ভালো লাগে না। আমার শুধু ভালো লাগে পড়াশোনা করতে ।

মোড়ের কাছে আসতেই নিয়াজ আমাদের সামনে এসে বললো,
– আফিফা, ভালো আছো?

পারভীনকে বললো,
– কি ব্যাপার পারভীন, আফিফাকে বলেছো? আমি যেটা বলতে বলেছি।

পারভীন মাথা নাড়ালো, যে বলেনি।

নিয়াজ আবার বললো,
– আফিফা তুমি স্কুলে যেয়ে পারভীনের সাথে কথা বলে সব শুনে নিবে, কেমন। আমি ছুটির সময় এখানেই থাকবো।

স্কুলে দেরি হয়ে গেছে, এসেম্বলি শুরু হয়ে গেছে। পারভীনের সাথে টিফিন পিরিয়ডের আগে কথা হলো না। টিফিনের ফাঁকে পারভীন আমাকে স্কুলের মাঠের এক কর্নারে নিয়ে গিয়ে বললো।

– আফিফা তুই কয়েকদিন স্কুলে আসিস নি, এর মাঝে নিয়াজ ভাই আমাকে বেশ কিছু কথা বলেছে। সেটা হলো, নিয়াজ ভাইয়ের তোকে খুব পছন্দ হয়ে গেছে। সে তোকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে। এ কথা আমাকে তোকে জানাতে বলেছে। আমি তোদের বাসায় গেছিলাম, কিন্তু বলতে পারিনি। নিয়াজ ভাই এটাও বলেছে যে, তুই যদি নিয়াজ ভাইকে ভালোবাসিস তাহলে রিংকুরা কেউ তোর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। নিয়াজ ভাইকে ওরা খুব ভয় পায়।

আমি কি বলবো ভাষা খুঁজে পেলাম না। এর মাঝে টিফিন পিরিয়ড শেষ হয়ে গেলো। স্কুলে পারভীনের সাথে আমার আর কোন কথা হয়নি। স্কুল শেষে সবার সাথে বের হয়েছি। রাস্তার মোড়ে নিয়াজ দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে, আমার কাছে চলে আসলো।সামনে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলো,

– আফিফা, পারভীনের সাথে কথা হয়েছে?

পারভীন পাশে থেকে জবাব দিল -বলেছি ভাইয়া।

আমি বললাম,

– নিয়াজ ভাই, আমি পড়া পাগল মানুষ।পড়ার বাহিরে আমার কোন জগত নেই। আমি এসব প্রেম ভালোবাসা মোটেও পছন্দ করিনা। আর আপনাকে আমি খুব ভালো ভেবেছিলাম আপনিও ওদের মতো?

নিয়াজ বললো,
– তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে, আমার পিছে বহু মেয়ে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু আমার তোমাকেই পছন্দ। এর পর আর কোন কথা আমি শুনতে চাই না। আর মনে রেখ, আমি তোমার পাশে থেকে সরে গেলে রিংকুরা কিন্তু প্রতিশোধ নেবেই।

#সিরাজুম_মনিরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here