#ধূসর_ভালোবাসা
পর্ব -৩১
মা আর নানী রাতে বাড়ি ফিরে আমার রুমে এসে বসেছেন, উনার একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছেন। বুঝতে পারছি, উনারা একে অন্যকে কিছু বলার জন্য ঠেলাঠেলি করছেন। অবশেষে আমি নিজেই নিরাবতা ভাঙ্গালাম।
-কিছু বলবে মা? কোন সমস্যা?
মা বললেন, আজ সব কথাই বলে এসেছি মা। সব বিষয়ে আলোচনা পাকা করে এসেছি।
– কি কি কথা পাকা করলে মা?
– এই ধর যেমন, গায়ে হলুদ এর অনুষ্ঠান এক সাথেই হবে। বিয়ে আর রিসিপশন ও এক সাথে হবে। তারপর, আমাদের গ্রামের বাসায়, গ্রামের লোকজনদের জন্য একটা খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করবো। তহমিনা আপাও উনাদের গ্রামের লোকদের খাওয়াবেন। আসলে গ্রামের আত্নীয়রা অনেকেই শহরে আসতে চায় না। বিব্রতবোধ করে। তার চেয়ে গ্রামে অনুষ্ঠান করলে, বিয়েতে গ্রামের আনন্দটাও উপাভোগ্য হবে। সব আত্নীয়-রাও সাচ্ছন্দ্য বোধ করবে।
তারপর..
– তারপর?
– ঈশান বলবে তোকে, তারপর।
সবাই রুম থেকে চলে গেলে, আমার পুরো রুমটা নিরব হয়ে গেলো। একাকিত্ব আমাকে অনেক পেছনে নিয়ে গেলো, আজ আমার জীবনের নাটাই আমার হাতে নেই। আছে নিয়তির হাতে। আজ আমি চাইলেও যা ইচ্ছে তাই করতে পারবো না, কারন আমার যা করার সবকিছু নিয়তিতে লেখা আছে। জীবনে যা পেয়েছি, তার থেকে খোয়া গেছে ঢের। তাই হিসেবের খাতা একে বারেই শূন্য।
ছোটবেলায় যখন পুতুল খেলতাম, শাড়ি পরতাম। কোলে একটা পুতুল নিতাম। এর পর নিজেকে যা ইচ্ছে সাজাতাম। কল্পনায় কখনও কখনও কোন রাজপুত্রেরও ছবি আকঁতাম। একি খেলা বেশিক্ষন ভালো না লাগলে, খেলা পাল্টে ফেলতাম।
কিন্তু জীবন কেন নিজেই তার লেখা পাল্টালো তা বুঝলাম না। সাদ আমার সব বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করছে। সাদের সাথে আমিই ওদের পরিচিত করেদিয়েছি। আমার বাস্তবতা এক দুইজন বান্ধবী ছাড়া কেউ জানে না। আর তাই সবাই ভাবছে, বড়লোক ছেলে পেয়ে আমি সাদকে ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে করছি। কারো কথায় আমার আর জায় আসে না। আমি কেন যেন পাল্টে যাচ্ছি, বোনে যাচ্ছি অন্য আমি।
মামনি বিয়েতে দেরি করতে চায় না, তহমিনা আন্টিও না। তাই আসছে শুক্রবারই বিয়ের দিন ঠিক করা হয়েছে। কাল সকাল এগারোটায় তহমিনা আন্টি আসবেন, আমাকে নিতে। উনার ইচ্ছা, বিয়ের সবকিছু আমার পছন্দেই হবে।
আন্টি আমাকে খুব ভালবাসেন। এতটা অল্প সময়ে আমার জীবনের পুরোটা জানা সত্ত্বেও আমাকে প্রচন্ড ভালো বাসেন। অথচ সাদের পরিবার আমাকে চেনে সেই ছোটবেলা থেকে। তবুও তাদের ভরসা আসলো না আমার উপর। আমাকে বিচার করলো আমার অতীত দিয়ে। মামনি কতটা অত্যাচার সহ্য করেছে বাবার, তা সাদের পরিবার জানে, তবুও মাকে ডিভোর্সি বলে তিরস্কার করতে এক মুহুর্ত বাঁধালো না। কিন্তু তহমিনা আন্টিদের পুরো পরিবার মামনিকে তার প্রাপ্য পুরো সন্মান দিয়েই চলা ফেরা করছে। জীবন হয়তো এভাবেই আমার ভবিষ্যত নির্ধারণ করেছে। আর আমাকে হয়ত তা মেনে নিয়ে বাস্তবতার সাথে চলতে হবে।
সকালে মা বলে গেলেন, তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে যেন ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে থাকি। ঈশান আর আন্টি নিতে আসবে আমাকে, কেনা কাটার জন্য।
মা তোমাকে ছাড়া আমি যাবো না। এসব কেনাকাটা আমি খুব একটা বুঝি না। আর একা যাবো না মা। তুমি যাবে আমার সাথে।
আমার অফিসে যেতে হবে মা, আবীর যাবে তোর সাথে। চিন্তা করিস না, আসতে আসতে সব কিছুই অভ্যেস হয়ে যাবে মা। আমাকে ছাড়া চলতেও শিখে যাবি।
– মা তুমি কাঁদছো? কেন? তুমিতো জলদি করে বিয়ে দিচ্ছ। আবার তুমি কাঁদছো?
– বিয়ে তো দিতেই হয় রে মা, তবে আমার ইচ্ছা ছিল কিছুদিন পর তোর বিয়ে দেবো। কিন্তু সব কিছু কেমন করে যেন হয়ে গেলো মা। উপরওয়ালা যা করে ভালোর জন্যেই করে। একেই তোর ভালো আছে। আর যত পরেই তোর বিয়ে দেই না কেন, চোখে পানি আসবেই। মেয়ে বিদায় দেয়া বড়ই শক্ত কাজ। সে সব তুই বুঝবি না। বয়স হলে তবে বুঝবি। যা মা, এখন তৈরি হো।
হাল্কা গোলাপী রঙ্গের একটা থ্রিপিস পরেছি, এটা সাদের খুব পছন্দের রঙ্গ। জীবনের প্রতি বাকেঁ সবার অগোচরে সাদ হয়তো এভাবেই আমার স্মৃতিতে থাকবে, যা সাদ নিজেও কোনদিন জানতে পারবে না। সাদ জানবে আমি একটা বেইমান, লোভী। এতেই আমি খুশি। আমাকে খারাপ ভেবেও যেন সাদ ভালো থাকে, খুব খুউব ভালো থাকে। আমার দোয়ায় সাদ থাকবে আজীবন।
ফোনটা বেজে উঠলো, ফোন ধরতেই ওপার থেকে বলে উঠলো,
– আসসালামু আলাইকুম ম্যাডাম। আমি আর মা নিচে, আপনার জন্য অপেক্ষমাণ।
– জি, আমি এখুনি আসছি।
আবীর আর আমি নিচে নেমে গেলাম। অর্ক হাতে এক গুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আমার হাতে দিয়ে বলল, দাদা (ঈশান) সকালে তোমার জন্যে কিনেছে। নিজে দিতে লজ্জা পাচ্ছে, তাই আমাকে বলেছে তোমাকে যেন দেই। তহমিনা আন্টি অর্ককে ধমক দিয়ে বললো, বোকা ছেলে তোকে দিতে বললো আর তুই রাজি হয়ে গেলি। যার ফুল তার হাতে দে। অর্ক ফুল গুলো ঈশানের হাতে দিলে, আন্টি ঈশান কে বলল, সুন্দর করে ফুল গুলো অবন্তির হাতে দাও। ঈশান লজ্জায় লাল, আমার হাতে ফুল দিলে সবাই কি খুশি। তা দেখে আমিও যে লজ্জা পাইনি তা নয়। কেমন যেন লজ্জায় চোখ উপরে তুলতে পারলাম না। এ কেমন যেন অন্য রকম অনুভূতি। সাদের অনুভূতি গুলো সাথে নিয়ে নতুন পথ চলা। সব কিছুই কেমন যেন গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। সব কিছুর মাঝে সাদের কথাই শুধু মাথায় আসে। এটাকে অন্যায়? উত্তরটা আমার জানা নেই।
শাড়ি গহনা সবকিছুই কেনাকাটা করছে সবাই মিলে। আমি আসলেই এগুলোতে আগ্রহ খুব কম। তবে মজার ব্যাপার হলো, তহমিনা আন্টি আর ঈশান খুব আগ্রহ সহকারে শপিং করছে। অর্ক আবীর শুধু খেয়ে বেড়াতেই ব্যাস্ত। আমি শুধু দেখছি, আমার কোন কাজ নেই। ওরা মা ছেলেই সবকিছু নিয়ে ব্যস্ত। আমি শুধু হুম, কিংবা হ্যা। এসবেই সীমাবদ্ধ। ওরা মা ছেলে খুঁটিয়ে খুটিয়ে সব কেনাকাটা করছে। ঈশান আর আন্টির ইচ্ছা, বিয়ের শাড়ি হবে আমার পছন্দে। আমি শাড়ির দোকানে বসে, পুরো মাথা ঘুরছে। এতো শাড়ি, সবই তো সুন্দর। আমি কিভাবে পছন্দ করবো?
ঈশান একটা টুকটকে লাল শাড়ি আমার গায়ে ধরে, আন্টিকে বললো, মা দেখো লাল শাড়িতে তোমার বৌমাকে খুব মানাবে। এটা বলেই ঈশান লজ্জা পেয়েছে।
বিয়ের লাল টুকটুকে শাড়ি, সাথে গহনা। আরো সব কি কি যেন কেনাকাটা করেছে ওরা মা ছেলে। তাদের কেনার কোন শেষ নেই। ঈশানের কোন ক্লান্তি নেই, সেও ধুমসে শপিং করেই যাচ্ছে। এটার সাথে ওটা ম্যাচিং। এটা সেটা আরও যে কতকি। দুপুরে বাহিরে খেয়ে, তহমিনা আন্টি অর্ক আর আবীর সব কিছু নিয়ে বাড়ি রওনা দিলো। ঈশান আমাকে নিয়ে গেলো, বিয়ের অনুষ্ঠানের ডেকোরেশন দেখার জন্য।
বিকেলের দিকে ঈশান আমাকে নিয়ে গেলো একটা ফার্ষ্টফুডে। দুজনে বসে কফি খাচ্ছি। ঈশান কফি খেতে খেতে বললো,
– অবন্তি আমার জীবনের প্রতিটা সম্পর্ককে আমি খুব শ্রদ্ধা করি, যত্ন করি। তুমি সদ্যই এসেছো আমার জীবনে, জীবনের প্রতিটা বাঁকে আমার চেষ্টা থাকবে তোমাকে ভালো রাখা। যদি ভুলবশত কোন ত্রুটি করে ফেলি তবে আমাকে তা ধরিয়ে দেবে। আমি সুধরে নিবো।
তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো, আমার কলেজ লাইফে একজন ছিল যাকে আমি খুব পছন্দ করতাম,খুব। সে সময় বাবা হুট করে মারা যায়, বাবার ব্যবসার কিছুই আমি বুঝতাম না। বাবার পার্টনাররা, অল্প কিছু হিসেব দিয়ে সব অর্থ আত্মসাত করলো। সে দিন গুলো খুব কঠিন ছিলো। মা তার জমানো সবদিয়ে আবার ব্যবসা দাঁড় করালেন। সে দিন গুলোতে আমি মায়ের মাঝে অন্যরকম আত্মবিশ্বাস দেখতে পেয়েছি। মা আর আমি কষ্ট করেছি ঢের, তবে বিধাতা খালি হাতে ফেরান নি। কলেজের সেই পছন্দ আমার জীবনের নির্মল কড়া ঘাতে হারিয়ে গেছে বহু আগে। কিন্তু মায়ের মুখে প্রথম যেদিন তোমার কথা শুনলাম, মনে হলো বিধাতা আমাকে ঠকায় নি, হয়ত সুদ সমেত আরও বেশি কিছু দিয়েছে। তোমাকে প্রথম দেখায় আমার খুব ভালো লেগে যায়। কিন্তু বলতে পারিনি। সে কারনেই সেদিন লোকের পাড়ে সবাইকে ডেকে ছিলাম, আসলে আমার তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। আজকের শপিং গুলো তোমার পছন্দ হয়েছে?
– আপনি যত নিখুঁত করে দেখে খুটিয়ে খুটিয়ে ম্যাচিং করলেন, তাতে কারো অপছন্দ করা সম্ভব না।
– আর তোমার?
– আমারও খুব পছন্দ হয়েছে।
– আমাকে তোমার পছন্দ হয়েছেতো?
– এ পর্যন্ত আপনাকে যতটুকু দেখলাম, তাতে যে কোন মেয়ের আপনাকে পছন্দ করবে, এমন কেয়ারিং মানুষকে স্বামী হিসেবে সবাই চায়। আর আমার বিয়েটা হচ্ছে মায়ের পছন্দে। আমার মামনির পছন্দের উপর ভরসা আছে। তবে আপনার যেমন অতিত আছে, আমার জীবন ও অতিতের উর্ধ্বে নয়। আমার মনে হয় তার কথা আপনার জানা দরকার।
– আজ থাক আরেক দিন শুনবো। যেদিন তোমাকে হারানোর ভয় থাকবে না। হয়ত খুব অল্প সময় তোমাকে দেখেছি, কিন্তু তোমার অধিকার আমার মনের রাজ্যে পুরোটাই হয়ে গেছে। এখান থেকে ফিরে তাকানো আমার জন্যে কষ্টের। একটা সময় ভেবেছিলাম বিয়ে করবো না। মা বহু বলেছে, তোমাকেই প্রথম আমি দেখতে গেছি। এর আগে আমি কখনও মেয়ে দেখতে যাইনি। কিন্তু তোমাকে দেখার পর থেকে আগের সব কথা বাদ, শুধু মনে হয়েছে, এইতো এই মেয়েটার জন্যেই আমার জন্ম। সে পাশে থাকলে আমার আর কিচ্ছু প্রয়োজন নেই। তবে তোমার কাছে একটাই অনুরোধ, আমার মা আর ভাই। এই দুইটা আমার জীবনের সম্পদ, তোমার শুধু এদের আপন করে নিয়ে চলতে হবে।
আমি কিন্তু তোমার জন্যে প্রতিটা জিনিস খুব খুটিয়ে দেখে কিনেছি, তুমিতো কিছুই বললে না। তোমার পছন্দ হলো কিনা?
– আমি আপনার কেনা কাটা দেখে অবাক হয়ে গেছি। কারন এতো নিখুঁত ভাবে সব কিছু আপনি কিনলেন, এটা আমি কখনই পারবো না।
– দরকার নেই। আমি তোমার জন্য সারা জীবন এভাবেই সব কিছু কিনে আনবো।
– শুনেছি, প্রতিটা ছেলে এভাবেই বলে, বিয়ের আগে। আবার বিয়ের পাল্টে যায়।
– সময় কথা বলতে অবন্তি।
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলে মা আর নানী অধিক আগ্রহে বসে আছে। আমার মুখে সারা দিনের গল্প শুনবে তাই। আমি তাদের মন ঠান্ডা করে সারা দিনের সব গল্প করে তবে আমি ছুটি পেলাম। রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছি, কিছুক্ষন বাদেই শুনছি পাখির কিচির মিচির। কি অদ্ভুত এক ঘুমেই সকাল হলো কিভাবে। বেলকনিতে এসে দেখি কেবল ভোর হচ্ছে। কাল এতো বেশি ক্লান্ত ছিলাম যে, শুয়ে সাথে সাথে ঘুমিয়ে গেছি। রাত কিভাবে পার হয়েগেছে টের পাইনি।
ঈশানের কথা মনে পড়লো, সে কি সত্যিই এমন ভালো মানুষ। নাকি নিছক সময় পার করছে। মানুষকে বিশ্বাস করতে ভয় পাই যে। বিশ্বাস সেতো অন্য বিষয়।
বিয়ের মাত্র কদিন বাকি, এখন আর সাত পাঁচ কি ভাবছি। যা হবে দেখা যাবে। নিয়তির হাতে আমার জীবন শপে দিয়েছি।
বেলকোনি থেকে দেখতে পাচ্ছি, ঈশান দাঁড়িয়ে। সাথে সাথে ফোনটা বেজে উঠলো, ফোন রিসিভ করতেই ঈশান বললো,
-আমার হবু বৌ, নিচে আসবে? সকালের শুভ্রতায় তোমাকে নিয়ে দূরে হারাতে খুব মন চাইছে। একটু আসো, প্লিজ।
– এখন কেন, কদিন পরে তো এমনি বের হওয়া যাবে।
– তখনতো আর কারো অনুমতি লাগবে না, লোক লজ্জার ভয় থাকবে না। এখন তো এটাতেই বেশি মজা লাগছে। প্লিজ আসো।
মাকে বলে নিচে নামলাম। ঈশান সাদা পাঞ্জাবী পরেছে। হাতে অনেক গুলো সাদা গোলাপ। বেরিয়ে পড়লাম ঈশানের সাথে অজানা গন্তব্যে।
#সিরাজুম_মনিরা