ধূসর ভালোবাসা পর্ব-৪

0
1228

#ধূসর_ভালোবাসা
পর্ব ৪

বাসায় এসে আমার মাথা প্রচন্ড ব্যাথা করছে। আমি কোন দিকে তাকাতে পারছি না। বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে কখন যেন গেছি। বিকেলে ঘুম ভেঙ্গেছে পারভীনের ডাকে। তাকিয়ে দেখি পারভীন মাথার কাছে বসে আছে।

আমি উঠে বসে পারভীনকে জিজ্ঞেস করলাম, তুই এখানে কেন, এসময়?

পারভীন বললো,
– আফিফা তোর শরীর খারাপ দেখে, তোকে দেখতে এসেছি। তুই আমাকে ভুল বুঝিল না। দেখ আমাকে নিয়াজ ভাই খুব করে বলছে। আর নিয়াজ ভাইকে সবাই খুব ভয় পায় জানিস তো। সে বিশাল বড় লোকের ছেলে। তার অনেক টাকা, সবাই তো নিয়াজ ভাইয়ের চামচা। অনেক বড় বড় মানুষ ও নিয়াজ ভাইকে দেখে ভয় পায়। আফিফা তুই একটু ভেবে দেখ, তারপর আমাকে জানাস।

– শোন পারভীন, পড়াশোনার বাহিরে আমি অন্য কিছু নিয়েই ভাববো না, সে যেই আসুক।

পারভীন চলে গেলো। একটু পরে মা চিৎকার করছেন। দৌড়ে যেয়ে দেখি যে কার যেন গরু আমাদের বাগানে ঢুকে সব গাছ নষ্ট করে দিয়েছে। আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। আমার সখের বাগান, এতো সুন্দর ফুলের গাছ গুলো সব নষ্ট হয়ে গেছে।

বাবা অফিস থেকে এসে খুব মন খারাপ করলেন। কিছুই করার নাই। কিন্তু গরুটা কার, সে খোঁজ কেউ দিতে পারলো না, অবশেষে রাতে বাবা গরুটা ছেড়ে দিলেন।

রাতে কিছুতেই পড়ায় আমার মন বসছে না। বাবাকে কিংবা আম্মাকে কথা গুলো বলা খুব জরুরী, নিয়াজ সম্পর্কে ।কিন্তু যদি আমি এই কথা গুলো বলি আব্বা আম্মাকে, উনারা নির্ঘাত আবার আমার পড়া বন্ধ করে দেবে। আব্বা আম্মা কোন কথাই শুনবে না, আমার পড়া বন্ধ করে দিবে আর নইলে গ্রামে পাঠিয়ে দিবে।

ভয়ে কাউকে কিছুই বলতে পারছি না। ভাইয়া থাকলে হয়ত তাকে কিছু বলতে পারতাম। দিন স্কুলে যাইনি। বাসায় বসে অনেক কথা ভাবছি। কিন্তু ভেবে কোন কুল পাচ্ছি না। আমি বই নিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছি দেখে, ইরা অবাক হয়ে গেলো। আমি শুধু পড়তেই পছন্দ করি, সে মানুষ জানালা দিয়ে এতোক্ষন বাহিরে কি দেখছি? ইরার এটাই প্রশ্ন।

আসলে আমার পড়তে ভালে লাগছে না, আনার কিছুই ভালে লাগছে না। আমি কাউকে কিছু বলতেও পারছি না আবার সহ্য করতেও পারছিনা।

বিকেলে পাশের বাড়ির কাশেম চাচা ও চাচি আমাদের বাসায় এসে বললেন যে মঞ্চ নাটক দেখতে যাবে। আমি যাবো কিনা জিজ্ঞেস করলেন, আমি আম্মার দিকে তাকালাম। আম্মা যেতে বললেন।

সন্ধ্যার পর চাচা চাচি সাথে আমি আর ইরা নাটক দেখতে আসছি। চাচা বিশেষ অতিথি তাই আমরা একেবারে সামনে বসে নাটক দেখছি। এখানে এসে মনটা একটু ভালো লাগছে।

খানিক বাদেই মনে হচ্ছে আমাকে কেউ দেখছে। মেয়েদের কেমন যেন একটা অনুভূতি আছে, যদি দূর থেকেও কেউ দেখে মনের অজান্তেই সেটা বোঝা যায়।
আমি আমার মনের ভুল মনে করে সেটাকে পাত্তা দিলাম না। কিন্তু নাহ, কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে, কেউ আমাকে দেখে দেখে যাচ্ছে। এবার খুব ভালো করে এদিকে ওদিক তাকালাম, নাটক থেকে মনোযোগ চলে গেলো, মনের মধ্যে কেমন যেন ভয় করছে।চাচু পাশেই বসে আছে। চাচিকে ডেকে বললাম, যে আমি বাসায় যাব। কিন্তু চাচি আমাকে জোর করে আবার বসালেন। আমি এবার নাটক না দেখে, যে দিকে মনে হচ্ছে কেউ দেখছে সেদিকেই তাকিয়ে থাকলাম।

যা দেখলাম, তা দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। রিংকু, রাজু, পারভেজ সহ আরো বেশ কিছু ছেলে আমাকে দেখে কি যেন বলছে।

আমি চাচাকে বললাম যে, আমার শরীর খুব খারাপ লাগছে। চাচা আমাকে বাসায় রেখে গেলেন। রাতে চাচা চাচি বাসায় এসে গল্প করলেন যে আমি আশার পর পরই নাকি কারেন্ট চলে গেছে। আর ওখানে বেশ গন্ডগোল হয়েছে।

পরের দিন স্কুলের জন্য বের হলাম, আল্লাহর কাছে অনেক দোয়া করলাম যেন রাস্তায় ঐ বদমাস গুলো না থাকে।

কিন্তু সব চাওয়া যে পূরন হয় না, নিয়াজ রাস্তাতে দাড়ানো। সে সামনে এসে বলল,
– নাটক না দেখতে গেলে কি খুব ক্ষতি হতো?

আমি মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, কিছু বুঝতে পারছিনা কি বলছে।

আবার বলল,
– কাল সময় মতো ওখানে আমি না গেলে কাউকে মুখ দেখানোর যোগ্যতা থাকতো না এতোক্ষণে। রিংকু কাল তোমাকে তুলে নিতে গেছিলো। আমি বুঝতে পেরে বাধা দেই, আমার সঙ্গে অনেক গন্ডগোল হয়েছে।তোমাদের বাসায় রিংকুই গরু ঢুকিয়েছিল, সে দিন যদি তুমি আগে বের হোতা, তাহলে তোমাকে তুলে নিয়ে যেতো। যেহেতু তোমার আম্মা বের হয়েছে তাই ওরা চলে গেছে।

আমি ভয়ে জমে গেছিলাম এগুলো শুনে, ভয়ে কেঁদে ফেলেছি, নিয়াজ আমার পাশে দাড়িয়ে আমাকে শান্ত হতে বললো, এও বলল যে

– যতক্ষণ আমি তোমার পাশে আছি, ওরা তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কারন আমার সামনে দাড়ানোর মত সাহস ওদের নেই।

আমি বললাম,
– নিয়াজ ভাই, আমি রিংকুদের কাছে আমার বাবা মার হয়ে মাফ চাইবো। যেনো ওরা আমাকে ক্ষমা করে। আমি পড়ালেখা করতে চাই। এগুলো আমি সহ্য করতে পারছি না।
আপনিও আমাকে ক্ষমা করেন, আমি এই প্রেম ভালোবাসা মোটেও পছন্দ করি না।

নিয়াজ কেমন যেন রেগে গেলো, বলল,
– এই মেয়ে এতো কিসের অহংকার তোমার, আমি কোন দিকদিয়ে তোমার অযোগ্য যে তুমি আমাকে এভাবে ফিরাচ্ছ। আমি যদি পাশে না থাকতাম, এতো দিনে রিংকু তোমার কি হাল করতো জানো। খুব ভালো করে শোন, আমি নিয়াজ, তোমাকে ভালোবাসি। আমি যা চাই, তাই করি। তোমাকে আমি ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি। নিয়াজকে অনেক মেয়ে পছন্দ করে কিন্তু আমি নিয়াজ তোমাকে ভালোবাসি। এর বাহিরে আর কোন কথা নাই।

আমি কাঁদতে কাঁদতে স্কুলে চলে গেলাম। পারভীন স্কুলে আমার পাশে বসে আমাকে অনেক কথা বলেই বুঝালো, কিন্তু আমি কি করে বোঝাবো যে, আমি কি বিশাল বিপদে পড়ে গেছি। আমিতো কাউকে কিছু বলতেও পারছিনা, আবার সহ্য করতেও পারছি না।

পারভীন অনেক ভেবে একটা বুদ্ধি বের করলো, বললো,

– আফিফা, তোর বাবা চাকরি করে, আর তোর এস এস সি পরীক্ষার পর এখান থেকে তোদের চলে যাবার কথা শুনেছি তোর মুখে।

– হুম, আমার এস এস সি পরীক্ষার পর আব্বা এখান থেকে চলে যাবেন, অনেক আগেই আব্বার বদলি হয়ে যতো, শুধু আমার পরীক্ষার জন্য কোন ভাবে আটকে রেখেছে।

– এইতো বুদ্ধি পেয়েছি, শোন যতদিন তোরা এখানে আছিস, ততদিন নিয়াজ ভাইয়ের সাথে প্রেমের অভিনয় কর, তার পর তোরা চলে গেলে নিয়াজ ভাই তোকে খুঁজেও পাবে না, আর ততদিন রিংকুও চুপচাপ থাকবে।

– ছিঃ পারভীন এগুলো কি বলিস, ঐ বদমাশ গুলার মুখ দেখতেও আমার বিরক্ত, আর আমি করবো প্রেমের অভিনয়। ছিঃ ছিঃ ছিঃ।

– তাহলে কি করবি বল?

– জানিনা কি যে করবো? কিভাবে এই বিপদ থেকে উদ্ধার হবো। আমি এগুলো পছন্দ করি না, আমার সাথেই এগুলো কেন হচ্ছে। তবে প্রেম ভালোবাসা এগুলো আমার দ্বারা হবে না।

পরক্ষণেই আবার ভয় করতে শুরু করলো রিংকুর কথা মনে পড়ে।

পারভীন আবার বলল,

– রিংকুদের ফ্যামেলি ভালো না, খুব খারাপ। ওর বোন, মা ভাই সবাই খারাপ, বুঝলি আফিফা। রিংকুদের মত ছেলেরা সব পারে। শুধু রিংকুর বাপটা একটু ভালে, মুদিখানার দোকানে বসে। তবে বুড়া মানুষ রিংকুর বাবা। ওরা ওদের বাবার কোন কথাই শুনেনা। তাই রিংকুর কেন ভরসা নাই। এসব বাজে ছেলে সব করতে পারবে।
তার চেয়ে আমার কথা শোন, তোর পড়ার ক্ষতিও হবেনা, নিয়াজও খুশি আর রিংকুও জব্দ থাকলো। এখন তুই ভেবে দেখ কি করবি।

খুকি এতো দিনে সব জেনে গেছে, সেও একই কথা বলল।

#সিরাজুম_মনিরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here