#ধূসর_ভালোবাসা
পর্ব-৮
মুগ্ধ সকাল। আকাশের বুকে মেঘেরা খেলছে। কখনো বা নীল মেঘের উপর পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে। প্রকৃতি সেজেছে তার আপন মহিমায়। চারিদিকের পরিবেশে এক অদ্ভুত ভালোলাগা। খুব সকালে ছাদে এসে এমন আকাশ দেখা হয়নি বহু দিন। মুগ্ধ হচ্ছি আকাশ দেখে, আরো মুগ্ধ হচ্ছি সকালের মিষ্টি ঘ্রানে। শীতের সকালের এই ঘ্রান আমার খুব প্রিয়।
আজ আমার মনটা খুব ভালো। তবে আজ কলেজে যাবো না। সারা দিন পড়বো ।সামনে প্রি টেষ্ট পরীক্ষা। সে কারনে সারাদিন আজ খুব পড়বো।
ভাইয়া বাসায় এসেছেন। এখন আমার পড়া কিছু দিন ভাইয়াই দেখবেন। তাই যতদিন ভাইয়া আছে আমি কলেজে যাবোনা।
এভাবে কয়েকদিন যেতেই, একদিন রফিক চাচা বাসায় এসে বললেন,
– আফিফা, তোমাকে শেফালি ডাকছে।
আমি কিছুক্ষন পর শেফালি আন্টিদের বাসায় গেলাম। যেয়ে দেখি ,নিয়াজ বসে আছে। শেফালি আন্টি, তার মাকে বলেছেন যে, এটা তার বন্ধু। সবাই মিলে পেছনের পুকুর ঘাটে গিয়ে বসলাম। আমার যেমন ভয় করছে, তেমন ভালো লাগছে অনেক দিন পর নিয়াজকে দেখে।
নিয়াজ বলল,
– গতকাল আমি রংপুরে এসেছি। শুনলাম তুমি কলেজে যাচ্ছ না। তাই রফিক তোমাকে ডেকে নিয়ে আসছে, রাগ করোনি তো?
আমি কোন উত্তর না দিয়ে বসে রইলাম। আসলে পুকুরের এ পাসে আমি কখনোই আসিনি। জায়গাটা খুব সুন্দর। পুকুর ঘাটের পাশে কামিনি, গন্ধরাজ আর জবা ফুলের গাছ। জবা ফুলের গন্ধে কেমন যেন ঘোর লাগা পরিবেশ। তার উপর নিয়াজ আমার সামনে। কেমন যেন লজ্জা লাগছে। সামনে শেফালি আন্টি আর রফিক বসে। আমার মুখ দিয়ে আসলে কোন কথাই বের হচ্ছে না।
মনে হচ্ছে সময় বুঝি এখানে থেমে যাবে। অনন্ত কাল আমি এই মুহুর্ত টাকে বাঁচতে চাই। নিয়াজ কি কি সব বলেই যাচ্ছে। কোন কথা আমার কানে পৌছাচ্ছে, কোনটা কোথাও যাচ্ছে হারিয়ে। আর আমি আছি আমার জগতে।
কিছু যেন বলল নিয়াজ, আমাকে ডাকতেই আমি ঘুরে তাকালাম।
নিয়াজ বলল,
– আমার কথা কি বুঝতে পারছো?
– হুম।
– উত্তর দিচ্ছ না কেন?
আমি হাসলাম, আর বললাম,
– আপনি বলেন আমি শুনছি।
– আফিফা, সামনে কিছু দিন ব্যাবসা নিয়ে ব্যাস্ত থাকবো, তাই আসতে পারবো না। যদি পারো চিঠি লিখো।আর সাবধানে থেকো।
– সাবধানে থাকা লাগবে না, কারন আপনি ছাড়া আমাকে বিরক্ত করার মতো আর কেউ নেই।
– আমি বিরক্ত করি?
– তা-তো করেনই।
– তাই, তাহলে চলে যাই?
-চলেই যখন এসেছেন, যেয়ে আর কি করবেন? আপনি বসেন। আমি যাই। ভাইয়া খুঁজবে। না পেলে রাগ করবে।
– সে কারনে আমাকে রেখে চলে যাবা?
– এই যে এসেছি, এটাই বিশাল ব্যাপার।আমি যাই।
দিলাম দৌড়। কারন ভাইয়া একটু পর পর আমার খোঁজ করে। ভাইয়ার নাকী আমাদের দু বোনকে চোখের সামনে থেকে আড়াল করতে মন চায় না। ঢাকায় ভাইয়ার খুব মন পোড়ে আমাদের জন্য। ভাইয়ার ইচ্ছা, আমাকেও ডাক্তারিতে ভর্তি করবে। আর সবাইকে নিয়ে ঢাকায় থাকবে।
বাসায় এসে দেখি, ভাইয়া সারা বাড়ি মাথায় করেছে। আমাকে খুঁজে না পেয়ে।
রাতে খাবার টেবিলে বাবা ভাইয়াকে বললেন,
– তাহনীম, তুমিতো বেশি দিন থাকবেনা। আবার ঢাকায় চলে যাবা। তোমার সাথে কথা বলবো সময় করতে পারছিনা। অফিসে খুব চাপ যাচ্ছে।
ভাইয়া বলল,
– বাবা আপনি এখন বলেন।
-বেশ অনেক দিন থেকেই আফিফার বিয়ের প্রস্তাব আসছে। আমি গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু কিছুদিন থেকে বেশ ভালো ঘর থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে, বাবা। তুমি বড় ছেলে। তাই তোমার সাথে আলোচনা করছি।
– বাবা, আমার ইচ্ছে যে আফিফা ডাক্তারি পড়ুক। তারপর বিয়ে।
– আমিতো তাই ভেবেছিলাম, কিন্তু আমাদের অফিসের সেকেন্ড অফিসার ‘আলতাফ’ একদিন বাসায় এসেছিল। আফিফাকে দেখে গেছে। তারপর থেকে একে ওকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে। গতকাল আমার এক কলিগকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে যে, আমাদের বাসায় আলতাফ, ওর বাবা মাকে নিয়ে আসতে চায়। আমি না করতে পারিনি ।আগামীকাল ওরা আসবে।
– আসতে যখন চেয়েছে ,তাহলে আসুক বাবা। তার পর দেখা যাক ওরা কি বলছে।তুমি চিন্তা করো না, আসুক ওরা কাল।
আমি চুপচাপ খেয়ে উঠে গেলাম, ভাইয়া আমার ঘরে এসে আমার সামনে বসলো। আমি রাগ করে ভাইয়ার সাথে কোন কথাই বলিনি।
ভাইয়া বললো,
– রাগ করছিস কেন? আসুক নারে বাবা। আসলেই কি বিয়ে হয়। একটা মানুষ নিজে বাসায় আসতে চাইলে, না করবি কি ভাবে, বল।
– তাই বলে, তোমরা আমার এখুনি বিয়ে দিয়ে দিবা?
– নারে পাগল, চিন্তা করিস না। আমি আছিতো, আমার উপর ভরসা রাখ।
পরদিন বিকেলে বাবার অফিসের কলিগ আলতাফ, তার বাবা মাকে নিয়ে আসলো আমাদের বাসায়।
বাবা তাহনীম ভাইয়াকে খাওয়ার দায়িত্ব দিলো, ভাইয়া এখানে তেমন কিছু চেনে না তাই বাবা রফিক চাচাকে ভাইয়ার সাথে দিলেন।
ওরা দুজনে সব কিছু কিনে নিয়ে আসলেন। বাসায় মেহমান, রফিক চাচা মাকে জিজ্ঞেস করলেন যে কে এই মেহমান? মায়ের মুখে, আমাকে দেখতে আসার কথা শুনে রফিক চাচা চুপ করে রইলেন।
মেহমান চলে গেলে, বাবা আর ভাইয়ার কি কথা হয়েছে তা আমি আর শুনিনি। তবে ভাইয়া আমাকে বলেছেন যে,
– তুই মাথা ঠান্ডা করে পরীক্ষা দিবি। তোর পড়ার মাঝে আমি কাউকে আসতে দেবো না।
ভাইয়া আজ সকালে চলে গেছে, পুরো বাড়ি কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে। ইরা আর আমার জীবনে ভাইয়া খুব ভালো বন্ধু।
দিনের শুরুতেই বৃষ্টি, বৃষ্টির দিন আমার খুব পছন্দের। তবে বৃষ্টির কারনে আজ কলেজে যাওয়া আর হলো না।
মেঘলা দিন, মেঘলা আকাশ, উদাস করা দুপুর। মনে পড়ে গেলো, অনেক আগের কিছু কথা। তখন স্কুলে পড়ি, বৃষ্টির মধ্যে স্কুল থেকে ফিরছি। আমি আর পারভীন, কোথা থেকে যেন নিয়াজ সামনে চলে এলো। সেদিন আসলেই খুব ভয় পেয়েছিলাম।
দিনে দিনে সে ভয় এখন ভালোবাসায় রুপ নিয়েছে। এখন নিয়াজের অনেক পাগলামুই ভালো লাগে। এখন কলেজের রাস্তায় আমার চোখ খুজে ফিরে নিয়াজকেই।
আমার মনেও যে কখনও ভালবাসার সুর বেঁজে উঠবে, তা আমি ভাবতেও পারিনি। আমিও কারো জন্যে দ্বিবা স্বপ্ন দেখবো, এটা আমার কল্পনার বাহিরে। এখন পৃথিবীকে কেমন যেন অন্য রকম রঙ্গীন লাগে। মা বকলেও ভালো লাগে। ইরার সাথে খুনশুটি খুব কম হয় এখন, কারন ইরার আবদার গুলোও আমার ভালো লাগে। প্রেমে পড়লে মন বুঝি এভাবেই নেচে বেড়ায়। দিন শেষে সূর্যটাকেও নতুন করে ভালো লাগে লাগে।
সামনে এইচ এস সি পরীক্ষা, এখন এগুলো ভাবার সময় নয়। তবুও বার বার আজ নিয়াজের কথা মনে পড়ছে।
শেফালি আন্টি, উনার ছোট বোনকে দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছেন। হঠাৎ এমন দুপুর বেলায় কেন ডাকলো? এটা বুঝতে পারছি না। গোসল সেরে শেফালি আন্টিদের বাসায় যেতেই কেমন যেন সন্দেহ হলো। নিয়াজ আসেনি তো?
যা ভাবা, তাই কাজ। নিয়াজ আর রফিক চাচা, শেফালি আন্টিদের ড্রইং রুমে বসে আছে। হঠাৎ নিয়াজকে দেখে, ভর দুপুরে ভূত দেখার চমকে গেছি আমি। কেপে যাচ্ছে বুকের ভেতর এবং পুরো শরীর। গলা শুকিয়ে কাঠ। নিয়াজকে দেখেছি বহুবার, এমন অনুভূতি কখনই হয়নি। আগে নিয়াজকে দেখলে আমার চোখ রাগে লাল হয়ে যেতো, সেই আমি লজ্জায় চোখ নামিয়ে রেখেছি। কিছুতেই চোখ তুলতে পারছি না।
শেফালি খালা আমাকে দেখে বললেন,
– কিরে আফিফা, তোকে কখন ডেকে পাঠিয়েছি। আর তোর এখন আসার সময় হলো? নিয়াজ ভাই আজই চলে যাবে ।কখন থেকে তোর জন্য বসে আছে।
এবার নিয়াজ তার নিরাবতা ভেঙ্গে বললো,
– আফিফা কেমন আছো?
– জী, ভালো আছি।
– ভালোইতো থাকবা, কয়দিন পর বিয়ে করে অন্যের ঘরে চলে যাবা। ভালোতো তুমি থাকবাই।
– কি বলছেন আপনি?
– ঠিকই তো বলছি। পাড়ায় এতো গুলো বিয়ের প্রস্তাব তোমার বাবার কাছে, তোমার জন্য। আবার তোমার বাবার অফিস থেকে সেকেন্ড অফিসারের বিয়ের প্রস্তাব। শহরের নাম করা কলেজের লেকচারার এর বিয়ের প্রস্তাব। এতো ভালো ভালো প্রস্তাবের মাঝে আমার কথা তোমার মনে না থাকারই কথা।
– আমার এতো বিয়ের প্রস্তাব কখন আসলো? আর আমি জানতে পারলাম না, সেখানে আপনি কি করে জানেন এতো কথা?
– রফিক বলেছে। ভাগ্যিস রফিকের তোমার বাবার সাথে ভালো সম্পর্ক। আর তোমার বাবা সব কথা রফিককে বলেন। নইলে তোমার বিয়ের পরে তোমার বিয়ের অলিমা খাওয়ার দাওয়াত পেতাম। তুমিতো কিছু বলবে না।
– আমি যে কথা জানি না সেটা আপনাকে বলবো কি করে?
– কেন, তোমাকে দেখতে আসেনি ছেলে পক্ষ?
– হুম এসেছিল, তাতে তো আমার বিয়ে হয়ে যায়নি। আর ভাইয়া ছিল তখন। সে কখনই আমার পরীক্ষার আগে বিয়ে হতে দেবেন না। আর আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? আমাকে যখন আপনার বিশ্বাসই হয় না, তাহলে ভবিষ্যতে আগাবেন কি করে। তার থেকে আমাদের এ পর্যন্তই শেষ।
এটা বলেই শেফালি খালাদের ড্রইং রুম থেকে উঠে বাহিরে বের হবো, ওমনি নিয়াজ আমার হাত ধরে নিলো। এতে আমার খুব রাগ হয়েছিল। আমি রাগে ফেটে যাচ্ছি।জোরে করে বললাম,
– খবরদার আমার হাত ধরবেন না। এগুলো আমি মোটেও পছন্দ করি না। হাত ছাড়েন।
নিয়াজ লজ্জা পেয়েছে, চোখ লাল। তবে তা লজ্জায় নাকি রাগে আমি বুঝতে পারছি না। সে শান্ত হয়ে বললো,
– প্লিজ যাবে না! আমি কিছু কথা বলেই চলে যাবো।
প্লিজ একটু বসো!
আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। অবশেষে বসলাম। ঘর থেকে সবাই বের হয়ে গেলো। শুধু শেফালি আন্টি বসে রইলেন।নিয়াজ আন্টিকে অনুরোধ করলেন যেন ,একটু বাহিরে যায়। এতে আমার আরো বেশি রাগ হলো। আমি বললাম,
– আপনার যা বলার আছে, আপনি শেফালি আন্টির সামনেই বলবেন। নইলে আমি চলে যাবো।
– ঠিক আছে, আফিফা। তুমি শান্ত হয়ে বসো প্লিজ, আমি কয়েকটা কথা বলেই চলে যাবো।
আমি বসলাম, আমার পাশে শেফালি আন্টি। আর সামনে নিয়াজ বসে বলতে শুরু করলো,
– আফিফা, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, খুব। তোমাকে না পেলে আমি জীবন রাখবো না। তুমি অন্যের হয়ে গেছো, এটা শোনার সাথে সাথে আমি জীবন শেষ করে ফেলবো। প্রতি ওয়াক্তের নামাজে, মোনাজাতে আমি আমার খোদার কাছে তোমাকে ভিক্ষে চাই। আমি দিনাজপুরে থাকি, আর আমার মন পড়ে থাকে এখানে, রংপুরে। তুমি বিশ্বাস করবা কিনা, জানি না। আমার প্রায় প্রতিটা নির্ঘুম রাত কাটে, তোমার কথা ভেবে। তুমি ছাড়া আমার জীবনে কোন মেয়ে আসেনি। অনেক মেয়ে আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয় কিন্তু আমি ভালোবাসি তোমাকেই। তোমার দেখতে আসার কথা শুনে আমি পাগলের মতো ছুটে এসেছি। এসে শুনছি তোমার অনেক গুলো বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। আমি চাই যে, তুমি এখুনি আমার সাথে চলো।
– কি বলতে চাচ্ছেন? আমি আপনার সাথে পালিয়ে যাবো? আপনি ভাবলেন কি করে? আপনাকে আমার পছন্দ। এটা খুব সত্য, তার চেয়ে বড় সত্য যে আমি আমার পরিবারকে খুব ভালোবাসি। আমি এমন কোন কাজ করবো না যে, আমার বাবা মায়ের মুখ ছোট হয়। আমাকে বিয়ে করতে হলে, আপনাকে আমার বাবা মায়ের সম্মতি নিয়ে, সন্মানের সাথে, মাথা উঁচু করে নিয়ে যেতে হবে। নইলে আমাকে মাফ করবেন।
– প্লিজ আফিফা, আবার রাগ কোরো না। তাহলে এখনি তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দেই?
– না? আমি বলছি যে আমার পরীক্ষার আগে, আমার বাবাও কোথাও আমার বিয়ে দিতে পারবে না। কারন আমি ডাক্তারি পড়বো। ডাক্তারি চান্স পেলে তবে আমি বিয়ের কথা ভাববো।
– যদি তোমার বাবা তোমার বিয়ে দিয়ে দেয়?
– আমার বাবা আমার পছন্দের বাহিরে কিছু করবেন না।
এমন সময় শেফালির আন্টির বাবা রুমে আসলেন। শেফালি আন্টি বললেন যে নিয়াজ কার কলেজের বন্ধু।
শেফালি আন্টির বাবা ভেতরে চলে গেলেন ।
শেফালি আন্টিদের পরিবার মর্ডান খেয়ালের। শেফালি আন্টির বাবা মেয়েদের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। আর তাই বন্ধু বাসায় আসলেও তিনি কিছু মনে করেন না। তবে শেফালি আন্টিরা কোন ভাই বোনই উশৃঙ্খল নয়। সবাই পড়াশোনায় খুব ভালো, তবে স্বাধীনচেতা।
#সিরাজুম_মনিরা