#ধূসর_ভালোবাসা
পর্ব ৯
ঘুম ভাঙলো, একটু বেলা করেই। মায়ের ডায়রি পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে গেছিলাম। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে হসপিটালের জন্য বের হলাম। নানি আমার সাথে যেতে চাইলে তাকেও সাথে নিলাম। আর সানেকা খালাকে রান্না করতে বললাম, ইরা খালামনি আর খালু, সকালে কি খেয়েছেন জানি না। দুপুরের আগেই বড় মামা চলে আসবেন। মামার জন্যেও তার পছন্দের খাবার রান্না করতে বললাম। বের হবো, ওমনি আবির তৈরি হয়ে চলে এসেছে। সেও যাবে।
ইরা খালা কেবিনে বসে আছেন, খালু আই সি ইউ এর সামনে বসে আছেন। খালুর সামনে দাঁড়াতেই উনি বললেন,
— অবন্তি মামনি, আফিফার অবস্থা সকালের দিকে আবার খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার বলছে যে এম আর আই করবে, সাথে সিটিস্ক্যান ও করবে।
— খালুমনি, আপনি বাসায় যান, আমি এখন থাকি। আপনি রেস্ট নিয়ে তারপর আবার আসেন।
— না মামনি, তুমি একা পারবে না।
— পারবো, আমি একা না। আবির আমার সাথেই আছে। আপনারা ফ্রেশ হয়ে, একটু রেষ্ট নিয়ে তারপর আসেন, খালু প্লিজ।
নানি, খালামনি ও খালুকে বাসায় ফ্রেশ হয়ে আসতে বললেন। বড় মামা কিছুক্ষনের মধ্যেই বাংলাদেশে পৌছে যাবেন। মামা বলেছেন, গাড়ি পাঠালেই হবে। মামা সরাসরি হাসপাতাল এ চলে আসবেন।
আই সি ইউ এর সামনে বসে থাকাটা খুব কষ্টের, প্রতি মূহুর্তে নিজেকে মৃত্যূর সামনা সামনি দেখতে হয়। জীবন কতটা ঠুনকো, তা এখানে বসে উপলব্ধি করা যায়। আমি জীবনের বহু নির্মমতা দেখেছি, আর বাকি যা ছিল তা এই আই সি ইউ এর সামনে পূরন হয়ে গেলো।
মামনিকে একবার দূর থেকে দেখে আসলাম। আমার মামনি জীবনে অনেক কষ্টের সম্মুখীন হয়েছে, যার অনেক কিছুর সাক্ষী আমি। আমার মায়ের কষ্ট গুলো তিক্ত নীল। আমার বাবা নামের জায়গাটা অস্পষ্ট, ধূসর।
বড় মামা চলে এসেছেন। আই সি ইউ এর সামনে ছোট শিশুর মতো করে কাঁদছেন। মামাকে আমি খুব ভালোবাসি, সে খুব নরম মনের আবেগী মানুষ। মামা দূর থেকে মামনিকে দেখে, খুব ভেঙ্গে পড়েছেন।
নিজেকে দেখতে আমার নিজেরই অবাক লাগছে। কয়েকটা দিনের ব্যবধানে, নিজেকে অনেক বড় মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি পরিনত হয়ে গেছি। মামা কে অনেক বুঝিয়ে শান্ত করে নানির সাথে বাসায় পাঠালাম। যেন ফ্রেশ হয়ে হাসপাতালে আসে। আবীরকে যেতে বললাম। কিন্তু সে কোথাও যাবে না। গতকাল থেকে আবীর আমার সাথে ছায়ার মতো লেগে রয়েছে। আমাকে ছাড়া কোথাও যেতে চাচ্ছে না। সব সময় কি যেন ভাবছে। আবীরকে এখনো বলিনি যে, বাবা আবার বিয়ে করছেন। আর এ কারনেই মামনি অসুস্থ। আবীর খুব কষ্ট পাবে, এটা শুনলে।
আই সি ইউ এর সামনে আমরা দুই ভাইবোন, মামনির জীবন মৃত্যূর সন্ধিক্ষণে মূহুর্ত গুলো অসহায়ের মতো দেখছি। জানি না আসছে সময়ে আরো কি দেখতে হবে। বিধাতার কাছে আজ শুধুই চাওয়া, আমাদের মামনি যেনো আমাদের জীবনে ফিরে আসেন।
আবির বসে থাকতে থাকতে, আমার ঘাড়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। একাকিত্ব আমাকে তেড়ে আসছে। আমি আবার মায়ের ডায়রি পড়তে শুরু করলাম।
পরবর্তী ডায়রিতে লেখা আছে –
পরীক্ষার সময় গুলো চোখের নিমিষে পার হয়ে গেলো। এইচ এস সি পরীক্ষা আমার খুব খুব ভালো হয়েছে। পরীক্ষার পর কয়েকদিন দাদা বাসায় থেকে বেড়িয়ে আসলাম। মাঝে একদিন নিয়াজ এসেছিল রংপুরে কিন্তু আমার সাথে দেখা হয়নি। কারন আমি তখন দাদা বাসায় বগুড়ায় ছিলাম।
রংপুরে আসার কয়েকদিনের মাথায় একজন মূরুব্বিকে দিয়ে নিয়াজ বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। আমার পরীক্ষার পর থেকে বাবা কেন যেন আমার বিয়ের কথা প্রায় বলছেন। বাবার ইচ্ছা যে, আমি ডাক্তারি পড়বো। কিন্তু বিয়ের পর। কারন আশে পাশে আমার বয়সের মেয়েদের বেশির ভাগের বিয়ে হয়ে গেছে। তাই বাবার এতো চিন্তা।
রফিক চাচার সাথে বাবা সব কথা বলেন, আর তাই নিয়াজ সব কিছু জানতে পারে। বাবার ইচ্ছে যে, বাবা তার অফিসের সেকেন্ড অফিসারের সাথে আমার বিয়ে দেবেন। আর এ কারনেই নিয়াজ ঘন ঘন লোক পাঠাতে শুরু করেছে। পাড়ার কয়েকজন মুরুব্বির সাথেও নিয়াজের বেশ পরিচয়। তারাও বাবাকে নিয়াজের সাথে আমার বিয়ের কথা বলেছে।
দিনাজপুরের যে পাড়ায় আমরা থাকতাম, বাবা সেখানের রহিম চাচার কাছে নিয়াজের খোঁজ নিয়েছেন। আর তারপর মাকে বলেছেন যে, নিয়াজ ভালো ছেলে নয়। নিয়াজ নাকি নেশা করে, বহু মেয়েদের সাথে তার ওঠা বসা, খুব বাজে একটা ছেলে।
আমি রফিক চাচার সাথে এ বিষয়ে কথা বললে, সে বলে যে,
— আফিফা, তোমার বাবা তার অফিসের ঐ অফিসার ছেলেটাকে পছন্দ করে, তাই মিথ্যে বলছেন। যেন কেউ নিয়াজকে পছন্দ না করে।
— চাচা, আমার বাবা কখনও মিথ্যে বলে না।
— আমিও তোমার বাবাকে পছন্দ করি। কিন্তু তোমার বাবা নিজের পছন্দের প্রাধান্য দেবার জন্য মিথ্যে বলছে। তুমি রাগ করো না আমার কথায় আফিফা। তবে তোমার আব্বা এবার মিথ্যে বলছেন।
আমি রফিক চাচার সাথে আর কথা বলিনি। বাসায় এসে খুব মন খারাপ হলো, কোন দিন বাবাকে মিথ্যে বলতে দেখিনি, আর বাবা আজ মিথ্যে বলছে।
এরপরের দিন গুলো খুব দ্রুত পার হলো। একদিন দুপুরে বাবা বললেন যে, তার অফিসের অফিসার ঐ আলতাফ, আজ বিকেলে আমাদের বাসায় আসবেন কথা বলতে।
কিন্তু রফিক চাচা বললেন,
— তোমার বাবা কিন্তু আজও মিথ্যে বলছে কারন আলতাফ রা আসতেছে তোমাকে আংটি পরাতে।
সন্ধ্যার দিকে আলতাফ আর তার বাবা মা আসলেন। বাবা আমাকে বললেন যেন আমি শাড়ি পরি। মাকে বললেন,
— তাহনীমের মা, ছেলে পক্ষ আজ আংটি পরাতে চাচ্ছে।
আমার মাথা ঘুরে গেলো, বাবা তাহলে মিথ্যে কথা বলে! আর তাহলে নিয়াজ সম্পর্কেও মিথ্যে বলছে।
আমি মাকে বললাম,
— মা, আলতাফকে আমার পছন্দ নয়। তাকে আমি বিয়ে করবো না। তার আংটিও পরবো না।
মা আমার গালে জোরে থাপ্পড় দিলেন।আর বাবাকে সব বললেন। বাবাও আমাকে খুব বকলেন, খুব। আমার কোন কথাই শুনলেন না কেও।
আমি বসে বসে কাঁদছি, রফিক চাচা আমার ঘরের বেলকনির পাশে এসে আমাকে ডাকছেন। বেলকনিতে যেতেই রফিক চাচা বললেন,
— আফিফা, নিয়াজ এসেছে তোমার সাথে দেখা করার জন্য। খুব জরুরি দরকার। তুমি দ্রুত বাহিরে বের হয়ে আসো।
আমি কি করবো কোন কিছু বুঝে উঠতে পারছি না, মা আবার রুমে এসে অনেক বকাবকি করে গেলেন। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি যে, বাবা একবার আমার পছন্দের কথা ভাববে না?
অনেকক্ষন চুপচাপ বসে রইলাম, কিন্তু মা একটু পর পর তাড়া দিচ্ছেন, তৈরি হবার জন্য। সাথে একগাদা বকাবকি গালমন্দ। মনে হচ্ছে আজ এ বাড়িতে আমি পর হয়ে গেছি। আমার বিয়ে দিতে পারলে বাবা মা জানে বেঁচে যায়।
আর কিছু মাথায় আসলো না, বাবা মায়ের উপর খুব রাগ হতে শুরু করলো। কেন উনারা আমাকে বোঝার কোন চেষ্টা করছে না?
সাত পাঁচ আর কিছু ভাবতে পারছিনা বাড়ির পেছনের গেট দিয়ে বের হতেই দেখি রফিক চাচা দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে বললেন,
— আফিফা ,তুমি হেটে সামনে আসো। আমি তোমার পেছনে আছি।
আমার বাবা মায়ের উপর রাগে কান গরম হয়ে আছে, নিজের মাথা খাটানোর ক্ষমতা নাই। তাই রফিক চাচা যা বললেন তাই করলাম।
কিছুদূর সামনে এগিয়ে গেলে, নিয়াজ দাঁড়ানো। সাথে একটা বাইক। আমাকে বাইকে উঠতে বলল। প্রথমে মন সায় দিচ্ছিল না। নিয়াজ কি কি যেন বলল। আর কিছু না ভেবে নিয়াজের বাইকে উঠে বসলাম।
রফিক চাচাদের বাসায় বসে আছি, কি করবো মাথায় আর কিছু আসছে না। তারপর মনে হলো ভুল করছি। ওমনি বললাম ,
— বাসায় যাবো।
রফিক চাচা বললেন ,
–তা আর সম্ভব না। সবাই জেনে গেছে যে, তুমি বাসা থেকে পালিয়ে গেছে।
–আমি বাসায় যাবো। যে যা খুশি ভাবুক।
নিয়াজ আমার সামনে এসে বলল,
— আফিফা, তুমি যেও না প্লিজ। কিছুক্ষনের মধ্যেই কাজী এসে যাবে। আমরা আজই বিয়ে করবো।
— কিছুতেই না, আমার বাবার উপর রাগ হয়েছে। ওরা জোর করছিল, তাই। আমি বাহিরে এসেছি, কারন আমাকে না পেলে আলতাফ আর ওর বাবা মা চলে যাবে। এর মানে এই নয় যে আমি বিয়ে করবো।
আমি বাসাতে যাবো।
— শোন, সবাই জেনে গেছে, তুমি পালিয়ে গেছো। এখন বের হলে বদনাম হবে।
রফিক চাচা বলল,
— তোমার বাবা রেগে গেছেন, তোমাকে পেলে কেটে ফেলবেন। তার সামনে যাওয়া তোমার উচিত হবে না। এখন পরিস্থিতি খুব খারাপ। তুমি আর বাড়িতে যেতে পারবে না। নইলে খুব খারাপ কিছু করে ফেলবেন তোমার বাবা।
আমার পুরো পৃথিবী ভেঙ্গে আসল, আমি কি করলাম। এমন কিছু হবে তা আমি ভাবতেও পারিনি। কতটা সময় ঘোরের মাঝে ছিলাম, মনে নেই। আমি বিচলিত হয়ে গেলাম যখন শুনলাম কাজি এসেছে।
আমি পাগলের মতো অস্থির হয়ে উঠলাম, আমি কখনই এমনটা করতে পারিনা। আমি স্বপ্নেও এমন কিছু ভাবতে পারিনি। বাহিরে খুব চিৎকার চেচামেচি শোনা যাচ্ছে। রফিক বলল,
— তাড়াতাড়ি করো, নইলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তুমি এতক্ষন আমাদের এখানে আছো, এটা শুনলে বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমরা এখানে থেকে চলে যাও।
আমি নিহত পাথর বনে গেলাম। সমস্ত শরীর যদি মোমের মত গলে যেতো, আমি এখানেই নিঃশ্বেষ হয়ে যেতাম। এমন যদি হতো, আমি চোখ খুলে দেখতাম যে আমি বাড়িতেই আছি। সব কিছু আগের মত ঠিক আছে।
আমার কানের পাশে দিয়ে গরম বাতাস বের হচ্ছে, কানে বহু ঝিঝি পোকা ডেকে উঠছে। আর কিছু মনে নেই।
চোখ খুলে কোন কিছুই চিনতে পারলাম না।উঠে বসে দেখি, নিয়াজ আমার সামনে বসা।
আমি নিয়াজকে জিজ্ঞেস করলাম,
— আমি কোথায় আছি, কিছু বুঝতে পারছি না।
— আমরা রংপুরেই আছি, তুমি জ্ঞান হারিয়েছিলে তাই আমার বন্ধু তার গাড়ি নিয়ে আসার পর তোমাকে নিয়ে আমরা চলে আসি। এটা আমার বন্ধুর বাসা। আমরা এখানেই বিয়ে করবো।
আমি এটা কি করে ফেললাম। এতো কিছু হয়ে গেলো শুধু আমার একটা সিদ্ধান্তে। আমি ভেবেছিলাম যে বাহিরে যেয়ে কোথাও বসে থাকবো। মেহমান চলে গেলে বাড়ি ফিরে যাবো। বাবা মা যে কি করছে!
অনেক পরে, রাত ঠিক কতটার দিকে আমি বিয়েতে রাজি হয়েছি বলতে পারবো না।
অবশেষে কাজি এসে আমার সামনে বসলো, নিয়াজ ও তার অনেক গুলো বন্ধু আমার আশে পাশে। আমি কাবিল নামায় সিগনেচার করলাম। ঠিক তার পরপরই আবারও কানের কাছে ঝিঝি পোকার ডাক শুনতে পারলাম।
মনে হচ্ছে কোথাও তলিয়ে যাচ্ছি, কত কি ধরার চেষ্টা করছি। তবুও তলিয়ে যাচ্ছি।
চোখ খুলে দেখি আমার সামনে অনেক মানুষ। নিয়াজ আমাকে পানি খাওয়ালো। এর কিছুক্ষন বাদেই নিয়াজ আমাকে গাড়িতে বসতে বলল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
— আমরা কোথায় যাচ্ছি?
— দিনাজপুরে, আমাদের বাসায়।
#সিরাজুম_মনিরা
১৯-০৬-২০২০