#ধূসর_রঙে_আকাশ
#পর্ব_১৪
লিখা: Sidratul Muntaz
সূর্য রশ্মির আনম্র আলো জানালা ভেদ করে বিছানায় ঝিলিক দিচ্ছে। তোহা চোখ মুখ কুচকে মুখ ঢাকল। তাকিয়ে বুঝল সকাল হয়ে গেছে। ঘড়িতে সাড়ে দশটা বাজে। তোহা মাথায় হাত রেখে দুম করে উঠে বসল। ইদানীং এতো দেরিতে ঘুম থেকে উঠে সে? অথচ ঘুমায়ও খুব দ্রুত। রাত দশটা বাজলেই তো আমীর ওকে ঘুমাতে নিয়ে আসে। এগারোটার মধ্যে তোহা ঘুমিয়েও যায়। সেই হিসাব করলে ভোর ছয়টা-সাতটায় ওর ঘুম ভাঙা উচিৎ। কিন্তু তোহার ঘুম ভাঙে বেলা এগারোটায়। দিনে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বারো ঘণ্টাই কি তাহলে সে ঘুমিয়ে কাটায়? না, এই অভ্যাস বদলাতে হবে। তোহা দিন দিন খুব অলস হয়ে যাচ্ছে। তার পাশে আমীরও ঘুমের রাজ্যে ব্যস্ত। অন্যান্য দিন তোহা ঘুম থেকে উঠে আমীরকে জাগ্রতই দেখে। হয় গোসল করে নাহলে ব্রেকফাস্ট বানায় নাহলে তোহার পাশে বসে মোবাইল টেপে। কিন্তু আজকে আমীরও ঘুমাচ্ছে? তোহা গালে একহাত রেখে আমীরের দিকে চেয়ে রইল।
চশমা ছাড়া আমীরকে খুব কিউট লাগে। সুন্দর চোখগুলো ভালো করে দেখা যায়। চোখের পাপড়ি খুব বেশি ঘন না। কিন্তু অনেক কালো। সাদামুখে কালো পাপড়িগুলো ফুটে থাকে। চোখের আকৃতিও খুব একটা বড় না। কিন্তু আমীরের মুখ অনুযায়ী ঠিক আছে৷ এর চেয়ে বড় চোখ হলে আমীরকে মানাতো না। ওই চোখ দুটোয় একটা ঘোর আছে৷ তাকালেই ডুবে থাকতে ইচ্ছে করে। আর যখন আমীর নিজে তাকায়, ওর তাকানো দেখতে আরও সুন্দর লাগে। তোহার হার্টবিট বেড়ে যায়। এখন সেই দৃশ্য কল্পনা করেও হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে।যদি আমীরের মুখটা ঢেকে শুধু চোখগুলো দেখা যেতো, মনে হতো ওগুলো কোনো সুন্দরী মেয়ের চোখ৷ চুলগুলোর জন্য ওকে আরও আকর্ষণীয় লাগে। মনে হয় ব্ল্যাক ফরেস্ট। কালো কালো ঘাস গুচ্ছাকারে মাথায় দাড়িয়ে আছে। আর ঘুমালে সেগুলো চোখের মধ্যে লেপ্টে থাকে। ওর ঠোঁট দুটোও মেয়েদের মতো। পাতলা, হালকা গোলাপী। কিন্তু পুরো মুখসহ দেখলে মনে হয় ছেলেদের ঠোঁট। আর মুখ ঢেকে দেখলে মনে হয় মেয়েদের। উল্টা ত্রিভূজাকৃতির মুখে পিচ্চি একটা নাক। কিন্তু বোচা বলা যায় না, অনেকটাই খাড়া। তবে এর বেশি খাড়া হলে ভালো লাগতো না। সব মিলিয়ে পারফেক্ট কম্বিনেশন। এর মধ্যে কিছু একটা মিসিং হলেই আমীরকে দেখতে খুব বাজে লাগতো। কিন্তু সব পারফেক্ট বলেই ওকে দেখতে এতো সুন্দর লাগে। আচ্ছা আমীর যদি মেয়ে হয় ওকে দেখতে কেমন লাগবে? খুব বেশি ভালো লাগবে না। ছেলে হওয়াতেই ভালো লাগছে৷ তবে চশমা পড়লে ওকে মনে হয় খুব রাগী মানুষ। আর চশমা ছাড়া মনে হয় ইনোসেন্টের দোকান। অন্যান্য দিন আমীর চশমাটা হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘুমায়। আজকে অবশ্য সেটা করেনি। চশমাটা বালিশের পাশে। তোহা চশমাটা তুলে নিয়ে নিজের চোখে পড়ল। ভেবেছিল আমীরের মতো সেও একটু চাশমিশ সেজে ভাব নিবে। কিন্তু চশমা চোখে লাগানোর সাথে সাথে ওর দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসল। মনে হলো, পুরো পৃথিবী একসাইডে উল্টে পড়ছে৷ মাথায় তীব্র ব্যথা শুরু হয়। তোহা সঙ্গে সঙ্গে চশমা নামিয়ে রাখল। তার চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে। এতো পাওয়ারী চশমা আগে কখনো দেখেনি তোহা। বাবার চশমাটাও তো অনেক পাওয়ারী। সেটা পড়লেও তোহার মাথাব্যথা করতো কিন্তু এতো সাংঘাতিক লাগতো না। মাত্র দুই সেকেন্ডের জন্য এই চশমা পড়ে তোহার মনে হচ্ছে তার দুইচোখে কেউ সজোরে ঘুষি মেরেছে অনেকক্ষণ। মাথা ভনভন করছে। আমীর এটা সারাদিন কিভাবে পড়ে থাকে? কি আছে এই চশমায়? তোহা একবার উল্টে- পাল্টে চশমাটা দেখল। তারপর জায়গামতো রেখে দিল। আমীরের সামনের লম্বা চুলগুলো কপালের সাথে লেপ্টে আছে। তোহা ফু দেয়। চুলগুলো উড়ছে না। আরও জোরে ফু দিল। এবার চুল উড়লো কিন্তু আমীরের ঘুম ভেঙে গেল। ভ্রু কুচকে উঠে তোহার দুই হাত শক্ত করে ধরল আমীর। মনে হচ্ছে ভীষণ বিরক্ত হয়েছে। তোহা ভয়ে সদ্য খাচায় বন্দী হওয়া পাখির মতো ছটফট শুরু করে। আমীর বলল,
” কি করছিলে? সমস্যা কি?”
তোহা আতঙ্কিত গলায় বলল,” সরি, দেখছিলাম..”
” কি দেখছিলে?”
” ওই, আপনার চুল।”
” আমার চুলে কি হয়েছে?”
” কিছু না।”
” বিরক্ত করার চেষ্টা করছিলে?”
” না, বিশ্বাস করুন। বিরক্ত করতে চাইনি।”
” এবার আমিও একটু বিরক্ত করি?”
তোহা বিস্মিত হলো খানিক। চোখ বড় করে বলল,” মানে? আপনি আমায় বিরক্ত করবেন?”
আমীর তোহার ছোট চুলের ঝুঁটি খুলে দিল। তারপর দুহাতে মাথা ঘেটে এলোমেলো করে দিল চুল। তোহা হা করে চেয়ে রইল। আমীর হাসছে। তোহা খুব অবাক হয় আমীরের হাসি দেখে। আমীর সত্যিই হাসছে? আগে তো কখনো এভাবে হাসতে দেখেনি আমীরকে! এই হাসি প্রাণবন্ত, বিশুদ্ধ, আনন্দমুখর। তোহার চারপাশটা যেন আনন্দে ঝলমল করছে। সকালে উঠেই এতো সুন্দর দৃশ্য দেখেছে। আজ সারা দিনটাই মনে হয় অনেক ভালো যাবে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকে তোহা। আমীর তোহার মুখের কাছে ঝুঁকে ফু দেয়। তোহা ভাবমূর্তির মতো বসে থাকে। কয়েক মুহুর্তের জন্য হারিয়ে যায় স্বপ্নজগতে। তার সম্বিত ফিরল যখন আমীর বলল,
” তোহা!”
তোহা ভ্যাবাচেকা খেয়ে উত্তর দিল,” হুম?”
” চোখ বন্ধ করে কি ভাবছো?”
তোহা ইতস্তত হয়ে বলল,” কই? কিছু না তো।”
আমীর জানে তোহা কি ভাবছিল। তাই আর জিজ্ঞেস করল না। তোহা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” আজকে মনে হয় আপনার মনটা খুব ভালো। তাইনা? ”
” হুম। একটু পর তোমারও মন ভালো হয়ে যাবে।”
তোহা কাছে এসে আমীরের হাতের উপর হাত রেখে বলল,” তাই? কিভাবে?”
আমীর আড়চোখে হাতের দিকে তাকালো। তোহা মুখ মলিন করে হাতটা সরিয়ে নিল। তারপর এলোমেলো চুল কানে গুঁজে জিজ্ঞেস করল,” কিভাবে?”
আমীর সামান্য হেসে তোহার ডানহাত নিয়ে হাতের উল্টোপিঠে একটা আলতো চুমু দিয়ে বলল,
” সারপ্রাইজ আছে।”
তোহা কেঁপে উঠল। এই কাজটা আমীর মোট তিনবার করেছে। প্রথম করেছিল তোহাকে যখন আমীর হসপিটাল থেকে নিতে এসেছিল তখন। মাঝখানে করেছিল যখন তারা এই বাসায় প্রথমদিন আসে। মা-বাবার কাছ থেকে কষ্ট পেয়ে তোহা যখন বিছানায় বসে কাঁদছিল তখন আমীর এভাবেই ওর হাত নিয়ে চুমু দিয়েছিল। এইযে এখন আরেকবার দিল। প্রত্যেকবারই তোহার নিজেকে খুব স্পেশাল মনে হয়। গর্বে বুক ফুলে উঠে। অজানা অহংকার জন্মায় মনে। আমীরের এই কাজটা তোহার কাছে সুপ্ত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ মনে হয়। মাঝে মাঝে এসব করে আমীর তাকে খুব চমকে দেয়। তোহা চিন্তা করল, আজকে সেও আমীরকে চমকে দিবে। আমীর চোখে চশমা লাগিয়ে বাথরুমে চলে গেছে। তোহা ঠিক করল যখন আমীর বের হবে সে হুট করে গিয়ে জড়িয়ে ধরবে। এতোই জোরে ধরবে যেন আমীর সামলাতে না পেরে দুই কদম পিছিয়ে যায়। তোহা এর আগে কখনো আমীরকে জড়িয়ে ধরেনি। কিন্তু তোহা যখন কাঁদে, আমীর নিজে থেকেই তোহাকে জড়িয়ে ধরে। সেটা খুব আলতোভাবে। কখনো তোহার কোমরে বা পিঠে হাত রাখেনা। শুধু মাথায় হাত রেখে জড়িয়ে ধরে। তোহা ঠিক করেছে আজকে নিজ উদ্যোগে আমীরের হাত দুটো নিয়ে তার কোমরে রাখবে। তারপর আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরবে আমীরকে। তখন কি করবে আমীর? তোহা যখন অন্যমনস্ক হয়ে এসব চিন্তা করছিল তার একটু পরেই কলিংবেল বাজে। তোহা বিরক্ত হয়। এই সময় কে এলো? আমীর বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল,
” দরজা খুলো। সারপ্রাইজটা এখনি পাবে।”
” কি সারপ্রাইজ?”
” দরজা খুলেই সরাসরি দেখো!”
তোহা চুপচাপ দরজা খুলতে গেল। লাভলী আর জাবিদ সাহেবকে একসাথে দাঁড়ানো দেখে তোহার নিঃশ্বাস আটকে আসার উপক্রম। সে ঠিক দেখছে তো? এইটা কোনো স্বপ্ন নয়তো? মা-বাবার হাসিমাখা মুখ দেখে তোহার প্রাণ খুশিতে কেঁদে উঠতে চায়৷ এটা কোনো স্বপ্ন নয়তো? সে ঠিক দেখছে তো?তোহার চোখ অশ্রুতে ছলছল করছে। সে মুখে হাত দিয়ে দাড়িয়ে থাকে। হাত-পা কাঁপছে। লাভলী বললেন,
” ভিতরে আসতে বলবি না? তাহলে চলে যাই।”
জাবিদ সাহেবও তাল মিলিয়ে বললেন,” হ্যা চলো তাই করি। চলেই যাই। দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে খেকে করবো?”
লাভলী মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,” গেলাম?”
তোহা কান্নার জন্য কথাও বলতে পারছিল না। দুজনই উল্টোদিকে ঘুরলেন চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। তোহা সিক্ত কণ্ঠে পিছু ডাকল,” বাবা, আম্মু।”
লাভলী আর জাবিদ সাহেব থামলেন। তোহা গোঙানার মতো শব্দ করে কেঁদে মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরল। লাভলী আর জাবিদ সাহেব হেসে চারহাতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন। তিনজনই হু হু করে কাঁদতে থাকেন। আমীর আড়ালে দাড়িয়ে সবটা দেখে। তারপর মনে মনে হাসে। আজ-বাদে কাল তোহাকে ফেলে সে চলে যাবে৷ তখন তোহার একটা আশ্রয় দরকার। মা-বাবার সাথে সম্পর্ক ঠিক না হলে আমীর কার কাছে রেখে যেতো তোহাকে? তাই তোহার সাথে ওর মা-বাবার সম্পর্কটা স্বাভাবিক করে দেওয়া খুব জরুরী ছিল।
মা-বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে তোহা শুধু একটা কথাই চিন্তা করছে।আমীর বাবাকে এতোবড় মিথ্যে কথা কিভাবে বলল? ছোট বাচ্চা নিয়ে এতোবড় একটা মিথ্যে সাজানো কি ঠিক? এজন্য যদি আল্লাহ তাদের শাস্তি দেয়? যদি কখনো তাদের ঘরে সন্তান না আসে? কথাটা ভাবতেই তোহার বুক ধুকপুক করতে লাগল। মা-বাবা যখন তোহার মিস ক্যারেজের কথা জিজ্ঞেস করে কাঁদছিলেন তোহারও তখন অজান্তেই কান্না আসছিল। সে কথাটা অস্বীকার করতে পারেনি। তাহলে আমীর মিথ্যুক হয়ে যেতো। মা-বাবার সামনে আমীরকে মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন করার ইচ্ছা তোহার ছিল না। কিন্তু এখন আমীরকে এ বিষয়ে বুঝিয়ে বলা দরকার। তার মনে হচ্ছে, মা-বাবা যাই মনে করুক। তাদের কাছে সত্যিটা স্বীকার করে নেওয়াই ভালো। তোহার যে আসলেই কোনো মিস ক্যারেজ হয়নি এমনকি তার পেটে কোনো বাচ্চাও ছিল না এই সত্যিটা মা-বাবাকে জানাতে হবে। তারপর ক্ষমা চাইতে হবে। এতে যদি মা-বাবা ক্ষমা করে তো করবে। না করলেও তোহা সত্যি লুকিয়ে রাখবে না। ঠিকই বলবে। তোহা এসব চিন্তা করতে করতে রান্নাঘরে ঢুকল। আমীরকে কিভাবে বুঝাবে মাথায় আসছে না। রান্নাঘরের জানালা আবার বারান্দার সাথে কানেক্টেড। চুলার কাছে দাড়ালে বারান্দাটা বেশ ভালোভাবে দেখা যায়৷ তোহা সেখান থেকে দেখল আমীর কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। কথার বিষয়বস্তু তোহা শুনল না। শুধু শুনলো আমীরের মাতাল করা কণ্ঠস্বর আর মাঝে মাঝে হেসে উঠার ছন্দ। একহাতে সামনের চুলগুলো পেছনে ঠেলে দেওয়ার দৃশ্য, জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে মৃদু হাসির গুঞ্জন। চোখের পলক ঝাকানি আবার মাঝে মাঝে চোখ বুজে ফেলা। ওই চোখ, ওই নাক, ওই ঠোঁট, চুল সবকিছুতে যেন জাদু আছে। এতো সুন্দর কেন? তোহা মোহে পড়ে যায়। হা করে দেখতেই থাকে। দেখতে দেখতে কখন যে গরম পাতে হাত দিয়ে ফেলল সেই খেয়ালও হয়নি। হঠাৎ চেচিয়ে উঠে তোহা৷ হাত পুড়ে গেছে। আমীর দৌড়ে রান্না ঘরে এলো। তোহার ডানহাতের তিনটি আঙুল পুড়েছে। সবচেয়ে বেশি পুড়েছে শাহাদাৎ আঙুল।আমীর দাঁত খিচড়ে জিজ্ঞেস করল,
” এটা কিভাবে হলো?”
তোহা মাথা নিচু করে থাকে। কি জবাব দিবে? আপনাকে লুকিয়ে দেখতে গিয়ে হাত পুড়ে গেছে? আমীর তোহাকে রুমে নিয়ে আসে৷ হাতে অ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিতে দিতে বলল,
” আগামী তিনদিন তোমার রান্নাঘরে ঢোকা বন্ধ। ফুডপান্ডা থেকে খাবার অর্ডার করা হবে। ”
তোহার একথা শুনে খুব হাসি পায়। পাগলের মতো হাসতে শুরু করে। আমীর মহাবিরক্ত গলায় বলল,
” হাসির কি হলো?”
তোহা হাসতে হাসতে জবাব দিল,” আমার রান্না বন্ধ, আপনারও কোনো কাজ নেই। তাহলে সারাদিন আমরা কি করবো? চলুন শুয়ে শুয়ে মুভি দেখি।”
” মুভি দেখে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয়না। তার চেয়ে তুমি বই পড়ো।”
” কি বই পড়বো? আমাদের বাসায় তো কোনো বই নেই।”
আমীর নেমে আসা চশমাটা একহাতে উঠিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল,
” আমি এনে দিবো বই।”
হাসিটা তোহার হৃদয়ে গেঁথে গেল। আমীর মেঝেতে হাটু ভাজ করে বসেছিল। আর তোহা খাটে। তার পুড়ে যাওয়া ডানহাত আমীরের হাতের মুঠোয়। তোহা হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। বামহাত দিয়ে আমীরের গাল স্পর্শ করে হালকাভাবে কপালে চুমু দিল। আমীর অবাক হয়ে তাকায়। হেসে বলল,
” হঠাৎ এইটা কেন?”
তোহার সম্বিত ফিরে আসে। লজ্জায় মুখ লাল হয়ে যায়। কি করতে কি করে ফেলল সে? দৌড়ে পালাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমীর যে হাত ধরে রেখেছে। পালাবে কি করে? প্রয়োজনের সময় হুট করে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার যদি কোনো শক্তি থাকতো তাহলে খুব ভালো হতো। অস্বস্তিতে তোহার মুখ কাচুমাচু হয়ে গেছে। আমীর আর কিছুই বলল না। হাসতে হাসতে উঠে চলে গেল। তোহা রাগে পা দিয়ে ল্যাম্প টেবিলে লাথি মারল। নিজের চুল নিজে টানল। সবকিছুতেই এতো দিশেহারা কেন সে? আমীর কি নির্লজ্জ ভাবছে তাকে? সন্ধ্যায় আমীর ফিরে আসে কতগুলো নন-ফিকশন বই নিয়ে। বই পড়তে তোহার এমনিতেও খুব একটা ভালো লাগে না। গল্পের বই হলে তাও মানা যেতো। কিন্তু তাই বলে নন-ফিকশন বই? এখন আমীর যেহেতু এনেছে ওকে খুশি করার জন্য হলেও পড়তে হবে। তোহা বই নিয়ে বসে। রাত এগারোটা পর্যন্ত বোরিং বইটা পড়তে পড়তে তোহার ঘুম চলে আসে। ওদের বাসায় কোনো টিভিও নেই। আর তোহার কাছে কোনো মোবাইল নেই। তাই সময় কাটানোর অন্যকোনো অপশনও নেই। আমীর নিজের মতো সারাখন থাকে। তোহাকে সময় দেয় খুব কম। কিন্তু যত্নে ত্রুটি রাখে না কখনোই। এইযে তোহা আলুর চিপস খেতে পছন্দ করে। আমীর বাহিরে গেলেই তোহার জন্য গার্লিক ফ্লেভারের সান চিপস নিয়ে আসে। এনে অবশ্য তোহার হাতে দেয়না, ডাইনিং টেবিলে রেখে দেয়। তোহা ফলের জুস পছন্দ করে। আমীর সেটাও এনে ফ্রীজে রেখে দেয়। তোহা ফ্রীজ খুললেই দেখতে পায়। অজান্তেই মুখে হাসি ফুটে উঠে৷ খুশিতে মন ভরে যায়। তবুও মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে, আমীরের মনোযোগ পেতে। কিন্তু আমীর প্রয়োজন ছাড়া তার দিকে ঠিক করে তাকায় পর্যন্ত না। তোহার ইচ্ছে করে আমীরের কলার টেনে ধরে বলতে,
” জানেন, শুধু আমার জন্য কত ছেলে গার্লস কলেজের সামনে লাইন লাগিয়ে রাখতো? আমার রূপের প্রশংসা করতে গিয়ে কত যৌবন কবি হয়েছে? আর আপনি আমার স্বামী হয়েও আমার প্রশংসা করা দূরে থাক, ভালো করে আমাকে দেখেনও না। কেন? কেন এতো ইগো আপনার? আমি কি বানের জলে ভেসে এসেছি? আমার সামনে এতো ভাব কিসের? ঘুষি মেরে যখন ওই সুন্দর নাক চ্যাপ্টা বানিয়ে দিবো তখন বুঝবেন আমি কি জিনিস। নাক চ্যাপ্টা হয়ে গেলে চশমাটা কোথায় আটকাবেন সেটাও দেখবো। ভাবওয়ালা চাশমিশ!”
তোহা মনে মনেই হেসে উঠে। এসব কি ভাবছে সে? হঠাৎ লাইট বন্ধ হয়ে গেল৷ তোহা বুঝল আমীর এসেছে। সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে রইল তোহা। আমীর জিজ্ঞেস করল,
” ঔষধ খেয়েছিলে?”
তোহা জিভ কাটল। সে ঔষধ খায়নি। কিন্তু একথা এখন আমীরকে বলতে গেলে বকা খাবে। তাই মিথ্যে বলল,” হুম৷ খেয়েছি।”
” গুড। এবার ঘুমাও।”
তোহা দ্রুত চোখ বন্ধ করে নিল। বুকের মধ্যে ভূমিকম্প হচ্ছে। বিকালের সেই অদ্ভুত কান্ডের কথা মনে পড়তেই লজ্জায় সারা শরীর কাঁপছে। তোহা ওই কাজটা কেন করেছিল? ছি! আমীর কি এখনো এটা মনে রেখেছে? অবশ্য এতো জলদি ভুলে যাওয়ার কথা না। অবশ্যই মনে রেখেছে। ইশশ, তোহার পেছনে তাকাতেও লজ্জা লাগছে। বেশ কিছুক্ষণ পর তোহা অনুভব করল আমীর তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। তোহার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে সঙ্গে সঙ্গে। আমীর ধীরে ধীরে তোহার পিঠে নাক-মুখ ঘষতে ঘষতে ওর গায়ের উপর চড়ে বসল৷ তোহা বিস্ময়ের সর্বোচ্চ সীমায়। তবুও চোখ বন্ধ করে রাখে। কিন্তু তার চোখের পাতা পিটপিট করছে৷ আমীর আলতো করে চুমু দেয় তোহার কপালে, নাকে। তোহা হালকা চোখে তাকায়। আমীর নেশাভরা দৃষ্টিতে তোহার ঠোঁট স্পর্শ করার জন্য অগ্রসর হচ্ছে। আমীরের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার জন্য তোহা নিজেও অগ্রসর হয়। হঠাৎ আমীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,
” তোহা, হোয়াট ইজ দিস? ল্যাম্পলাইটে কত ময়লা জানো?”
তোহা হকচকিয়ে উঠে। দেখল তার সামনে ল্যাম্পলাইট। আরেকটু হলেই সে ল্যাম্পলাইটটাকেই চুমু দিয়ে ফেলছিল। অবাক চোখে পেছন ফিরে দেখল আমীর অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওদের মাঝখানে একহাত দূরত্ব। তোহা চোখমুখ খিচে উচ্চারণ করে,” ওহ শিট।” আবার অন্যমনস্ক হয়ে কি সাংঘাতিক ভুলটাই না করতে যাচ্ছিল সে। দারুণ লজ্জা পেল তোহা। আজকে মনে হয় তার মাথাটাই খারাপ হয়ে যাবে। আমীর বলল,
” আজেবাজে চিন্তা বাদ দিয়ে ঘুমাও তোহা।”
একথা বলে আমীর উল্টোদিকে ঘুরে শুয়ে পড়ল। তোহার গলা কাঁপছে। আমীর আজেবাজে চিন্তা বলতে কি বুঝালো? সে কি বুঝে গেছে তোহা কি চিন্তা করছিল?
মাঝরাতে হঠাৎ করেই ঘুমটা ভেঙে যায় তোহার। পাশ ফিরে দেখল আমীর নেই। বুকটা ধ্বক করে উঠল। বারান্দায় গিয়ে খুঁজল সেখানেও নেই। বাথরুমের লাইট বন্ধ। কিন্তু ডাইনিং টেবিলে সরু আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। মনে হয় দ্বিতীয় বেডরুমের লাইট জ্বালানো। আর কেউ দরজা ভিড়িয়ে রেখেছে বলে সেই আলোটা ডাইনিং টেবিলে এমন দেখাচ্ছে৷ আচ্ছা আমীর এতোরাতে ওই রুমে কি করছে? বিষয়টা দেখতে হয়৷ তোহা এই ভেবে যখনি রুমের চৌকাঠে পা রাখতে যাবে হঠাৎ একটা অদৃশ্য শক্তি তোহার সারা শরীর আকড়ে ধরে। তোহার মনে হয় যেন সমস্ত রক্তনালিতে জুড়ে বিষপোকারা বিচরণ করছে৷ এক নিমেষে তোহা ছিটকে পড়ে বিছানায়। হাত-পা থরথর করে কাঁপে। কপালে ঘাম জমে যায়। প্রথম কয়েক সেকেন্ড তোহা চোখেমুখে অন্ধকার দেখে। কিছু বুঝতে পারে না। দ্বিতীয়বার উঠে যখন দরজার সামনে যেতে নেয়, আবার একই কাহিনি ঘটল। বৈদ্যুতিক শকের মতো তোহা ছিটকে পড়ল বিছানায়। কোনোভাবেই সে এই রুম থেকে বের হতে পারছে না কেন? বিছানা খামচে গুমরে গুমরে কান্না শুরু করল তোহা। এসব কি হচ্ছে তার সাথে?
চলবে